ধারাবাহিক গল্প ।। প্রেম ও সংকল্প ।। দীপক পাল
প্রেম ও সংকল্প
দীপক পাল
( শেষ পর্ব )
ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ঠিক সাড়ে ছয়টায় সুমন্ত বড়ো রাস্তায় বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ালো। পরনে তার অফ হোয়াইট কালারের ফুলপ্যান্ট আর সমুর দেওয়া ডিপ নীল রঙের গেঞ্জি যার কলারে হাফ হাতার সীমানায় কোমরের নীচে ও একমাত্র বুক পকেটের ওপরের দিকে কালচে হলুদ রঙের মানানসই বর্ডার। বুকের মধ্যিখানে কিছুটা জায়গায় জালি জালি করা আছে। সুমন্তর গেঞ্জীটা ভারী পছন্দ হয়েছে। হাতে ঝোলান সমুর জন্য কেনা কাপড়টা। কিন্তু সে জানেনা সমুর কাপড়টা পছন্দ হবে কিনা। পছন্দ নাহলেও সেটা ও প্রকাশ করবে না কখনো। সুমন্ত সেটা জানে। মার তো খুব পছন্দ হয়েছে কাপড়টা। এও বলেছে দেখবি এটা ওর ঠিক পছন্দ হবে।
চান্দ্রেয়ী হাসিমুখে রাস্তা টপকে সুমন্তর পাশে এসে দাঁড়ালো। অনাড়ম্বর বেশবাস হালকা প্রসাধন
চুলের সামনের দিকে দুপাশে ক্লিপ লাগানো পেছনে চুল হর্সটেল করা। এসে জিজ্ঞেস করলো,
- ' কোনদিকে যাবে?'
- ' সেটা নির্ভর করবে কত সময় তুমি দিতে পার?'
- ' মোটামুটি ধরো বাড়ী ফিরব রাত ১০টার মধ্যে।'
- ' পার্ক সার্কাসে ঠাকুর দেখার সাথে মেলায় ঘুরতে পারবে?'
- ' হ্যাঁ পারবো। মাকে বলেছি ফিরতে ফিরতে ১০টা বাজতে পারে।'
- ' তবে চলো, আজকের দিনটা ভালো করে ঘুরেনি তারপর দেখা যাবে।'
সেদিনটা তারা চুটিয়ে আনন্দ করেছিল। যেই পার্কে সুদীপ্তরা আড্ডা মারতো সেই পার্কে এক আর্টিস্ট সোলা দিয়ে ভারতে প্রথম দুর্গা ঠাকুর তৈরি করার পর তা দেখে চমৎকৃত হয়ে পূজা কমিটি সেই ঠাকুরই প্যান্ডেলে এনে পূজা করে সেবছর। আমরা প্রথমেই সেই ঠাকুর দেখলাম। এখন এই ঠাকুর ভারতীয় জাদুঘরে দেখা যায়। এখন তো সোলার ঠাকুর খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু ওই ঠাকুর প্রথম বানায় ওই পাড়ারই ছেলে। এরপর ওরা গেলো পার্ক র্সার্কাস ময়দানে। কুমারটুলির প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী শ্রী রমেশ পাল দুটো ঠাকুর বানাতেন এক পার্ক সার্কাস ময়দান দুই দমকল। পরবর্তীকালে দমকলের ঠাকুর চলে যায় মোহাম্মদ আলী পার্কে। আর পার্ক সার্কাসে ঠাকুর হতো একটা। এখন হয় দুটো। মনোমালিন্যের কারণে এটা দুটোতে ভাগ হয়ে যায়। তার সাথে বসে মেলা। তারা সেই দুটো ঠাকুর দেখার সাথে মনের খুশীতে মেলায় ঘুরল খানিকক্ষণ। চান্দ্রেয়ী কিছু কিছু মেলার জিনিস কিনলো। ম্যাজিক শো দেখলো তারপর তারা বাসে করে এসে আনন্দ পালিত রোড স্টপেজে নামল। শহীদ স্মৃতি সংঘের ঠাকুরটা সময় নিয়ে দেখল। অবশেষে পেছনের রাস্তা দিয়ে সমুর বাড়ীর দিকে চললো। সুমন্ত চান্দ্রেয়ীর জন্য কেনা কাপড়ের প্যাকেটটা তার হাতে তুলে দিল।
এরপর নিজেরা আলোচনা করে ঠিক করল যে পড়াশোনা ভালো করে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পরস্পরের মধ্যে বেশী দেখা সাক্ষাৎ হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সুমন্ত জানালো দশমীর দিন সন্ধ্যায় সমুদের বাড়ীতে এসে কাকু কাকিমাকে বিজয়ার প্রণাম জানিয়ে যাবে এবং ওদের বাড়ীর সবাইকে ওদের ঘরের কোজাগরী লক্ষ্মী পূজোর নিমন্ত্রণ জানিয়ে আসবে। অনেক কষ্টে তারা পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে বাড়ী ফিরে গেল। এসব ঘটনাগুলো এখন তার মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের ঘটনা।
দশমীর সন্ধ্যায় মা বাবাকে নিয়ে চান্দ্রেয়ী ঠিক সুমন্তদের বাড়ী এল। সুমন্ত এত খুশী বোধহয় কোন দিন হয়নি। মা বাবার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিল। সমুর মা একটা মালা পরিয়ে দিল লক্ষ্মী ঠাকুরের গলায় আর একশো টাকার নোট রাখলো ঘটের পাশে। ওটা রেখে উঠে দাঁড়াতেই মা কাকিমা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। মা বললেন আসুন এই চেয়ারে বসুন। ' আপনার কথা ছেলের কাছে অনেক শুনেছি।' কাকিমা কম যান না বলেন, ' সুমন্ত আপনার সোনার ছেলে।' অন্য দিকে দুজনের বাবা গল্পে জমে গেছে। মা আর কাকিমা কাগজের বাক্সে সব রকমের প্রসাদ গুছিয়ে দিচ্ছেন আর সুমন্ত সমুকে নিয়ে আসেপাশের বাড়ী গুলোতে প্রাসাদ বিতরণ করলো। কৌতুহলি অনেকেই তাকে সমুর সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করেছিল। ও যাহোক একটা কিছু উত্তর দিয়েছিল।
পেছন থেকে কাঁধে হাত পড়ায় তার চিন্তার সুরটা কেটে গেলো। ' তুমি এখানে একা একা বসে কি করছো সুমন্ত? মন খারাপ লাগছে?'
- ' না সমু না। মনে মনে একটা হিসাব মেলাচ্ছিলাম।'
- ' কি সেই হিসাব যা নিয়ে তুমি চিন্তিত খুব।'
- ' যে হিসাবটা আমি অবসর নেবার পর উপলব্ধি করতে পারছি। জান সমু গতকাল পর্য্যন্ত আমার যে
ব্যস্ততা গেছে আমার দেহে মনে চিন্তায় ভাবনায় ও আরও অনেক কিছুতেই। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে
আমার দীর্ঘ জীবনের অবসর কাল শুরু হলো বুঝি। তোমার ব্যস্ততা অবশ্য এখনও শেষ হয়নি। তুমি
ইস্কুলের হেডমিস্ট্রেস। তাই তোমার অনেক দায়িত্ব। ইস্কুল ছুটি হলেও তোমার বেরোতে দেরী হয়। সেটা খুবই স্বাভাবিক। সে অভিজ্ঞতা আমার আছে। তবু তুমি আমার আগেই ফিরতে এবং ফেরো। তবু জান আজ সারাটা দিন আমার কাটছিল না। বিকেলে ছাদে উঠে ঘুরতে ঘুরতে পুরনো কথা সব মনে পড়ছিলো। তুমি বাড়ী কখন ফিরেছ একদম তা টের পাইনি।'''
- ' এখন চলো নিচে যাবে তো? কিছু তো খাও নি।'
- ' কেন, সন্ধ্যা চা বানিয়ে দিয়েছিল তো, চা বিস্কুট খেয়ে তো ছাদে উঠেছি।'
- ' সেতো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। চলো কিছু খেয়ে নিয়ে আবার চা খাবে। আমিতো কিছু খাই নি।'
- ' সমু একটু বসো না আমার পাশে। তোমার কি মনে পড়ে সেই কবে তুমি কলেজে যাওয়ার সময়
তোমার হাত থেকে পড়ে যাওয়া ছাতাটা দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।
আর সেই থেকে আমাদের পরিচয়ের সূত্রপাত।'
- ' মনে নেই আবার। তারপর কলেজে যেতে তোমার সাথে রোজ দেখা হতো রাস্তায়। তুমি রোজ
আমায় উঠিয়ে দিতে বাসে।'
-' সেই ষষ্ঠীর দিনে ঠাকুর দেখতে গিয়ে মেলায় ঘোরা।'
- ' লক্ষ্মী পূজোর দিন তোমার বাড়ীতে গিয়ে প্রসাদ বিতরণ। আর সেদিনই দুটো ফ্যামিলির মিলনের সূত্রপাত। তুমি ইন্টার কস্টিং পাশ করে সরকারি অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসাবে ঢুকলে। কস্টিং
ফাইনাল পাশ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাইন্যান্স ম্যানেজার পর্যন্ত হলে। এসব কি ভোলার?'
- ' তুমিও কি কম ছিলে সমু। ইকোনমিকস এর মত শুষ্ক ও কঠিন সাবজেক্ট নিয়ে পড়ে কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া একি কম কথা তারপর বি.এড দিয়ে পাশ করে ধীরে ধীরে স্কুলের
হেড মিস্ট্রেস হওয়া কিছু কম কথা নয়। আসলে কথাকি জান এতদিন পরেও সব কথা আমার মনে
আছে। অথচ গতকাল আমি ফেয়ারওয়েলে কি যে বলেছি আমার কিছুতেই সব মনে আসছে না।'
-' আমাদের দুই ছেলেও আমাদের জেদটা উত্তরাধিকারী সূত্রে পেয়েছে বলো? ছেলেরা যে কোন
সময়ে ফোন করতে পারে। এবার থেকে রাতের খাবারও আমরা আরও তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব।'
- ' চলো তাহলে।' ছাদের দরজায় তালা লাগিয়ে ওরা নিচে নেমে এলো। এযেন অতীতের চিন্তায়
তালা দিয়ে বর্তমানে ফিরে আসা।
____________________________