বিভাগ: বই রিভিউ ।। গোবিন্দ মোদক
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
"কাব্য মালঞ্চ" কাব্যগ্রন্থটি ১৭৮ টি ছন্দ-কবিতা ও পদ্যের একটি উৎকৃষ্ট সংকলন যেগুলির রচনাকাল বর্তমান শতাব্দী। গ্রন্থকার শ্রী পরেশ চন্দ্র রায় ১৯৪৯-এর জাতক এবং পেশায় একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তিনি সারা জীবন ধরে যে তন্নিষ্ঠ সাহিত্যচর্চা করেছেন তা থেকে নির্বাচিত ১৭৮ টি কবিতা নিয়ে গড়ে উঠেছে কাব্য মালঞ্চের অবয়ব। সেই অর্থে কাব্য মালঞ্চ কাব্যগ্রন্থটিকে স্বনির্বাচিত কবিতাও বলা যায়। অতীত থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমাদের আর্থ-সামাজিক পটভূমিকার বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কবি যে পৃথিবীকে দেখেছেন এবং ঘটনার যে সমস্ত বাস্তবতা তাঁর মনকে প্রভাবিত করেছে, অনুরণিত করেছে এবং ভাবিয়েছে তারই লিখিত রূপ এই পদ্য এবং ছন্দ-কবিতা সম্ভার। কবি একদিকে যেমন দেখেছেন পৃথিবীর নান্দনিক দিক, সমাজের আপাত সুন্দর রূপ, মানুষের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ; চাঁদ-ফুল-তারা এবং যা কিছু ভালো — তেমনই সমাজের কদর্য রূপ, পৃথিবীর নিষ্ঠুর দিক, মানবিকতার অপব্যবহার, মানুষের লোভ-লালসা-হিংসা-দ্বেষ, সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিকতার অধঃপতন ইত্যাদিও কবির সতর্ক নজর এড়িয়ে যায়নি। আর পৃথিবীর এই ভালো-মন্দ, সুখ-অসুখ ইত্যাদি কবির মনকে যে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে তা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কবির কাব্য সম্ভার।
সাধারণ মানুষের তুলনায় কবিদের অনুভববেদ্যতা অনেক বেশি হয় এবং কবিরা অনেক বেশি সমাজ সচেতন হন। সমাজের অন্ধকার দিকের প্রতি তীব্র তর্জনী-সংকেত করে জনচেতনাকে জাগ্রত করা তাঁদের আর এক মহান কাজ। বর্ষিয়ান কবি পরেশ চন্দ্র রায় তাঁর সে দায়িত্ব সুচারুভাবেই সম্পাদন করেছেন। কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির নামই "কুসংস্কার" যা কবির সমাজ সচেতনতার দ্যোতক। কাব্যগ্রন্থের ৭৭ নম্বর কবিতাটির নামও "কুসংস্কার" যেখানে তিনি ভিন্নভাবে কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করবার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এরই সঙ্গে তিনি জঙ্গি হানা, যুদ্ধের নির্মমতা, রাজনৈতিক অরাজকতা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শোষণ, পীড়ন, অত্যাচার, অবিচার, মাৎস্যন্যায়, নির্বাচন ব্যবস্থার অসারতা এবং ভোটের অপব্যবহার, কর্মহীনতা, শ্রমিকদের হতাশাব্যঞ্জক অবস্থান, শিশু-শ্রমিকদের দুর্দশা, বৃদ্ধাবাসের বাড়বাড়ান্ত, সমাজে নারীর ক্রমিক অবমূল্যায়ন, পারিবারিক গঞ্জনা, নারীকে একাদিক্রমে ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখা, নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, বাংলা ভাষার ক্রমিক অবমূল্যায়ন, তন্ত্র-মন্ত্র তাবিজ-কবজ জলপড়া তেলপড়া, বাংলা টিভি সিরিয়ালের অবাস্তবতা ইত্যাদি বিষয়ে অসংখ্য কবিতা পাঠককে উপহার দিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন গণসচেতনতা জাগ্রত করতে।
এসব ছাড়াও সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনা এবং বিষয়বস্তুর ওপর তিনি আলোকপাত করেছেন এবং সে বিষয়ে তিনি কলম ধরেছেন একদম নিজের মতো করে। যেমন আজকাল নিমন্ত্রণ পত্রে "লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়" – এই আপ্তবাক্যটির প্রতি স্লেষাঘাত করেছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। ভাইফোঁটায় বা জামাইষষ্ঠীতে অনলাইন উপহার পাঠানোর ভালো ও মন্দ দু'দিকের প্রতি তিনি তুল্যমূল্য বিচার করে কবিতা লিখেছেন। একদিকে পুজোর আড়ম্বর, অন্যদিকে প্রদীপের আলো না পাওয়া অনাহারে অর্ধাহারে থাকা মানুষজন — বিপরীতমুখী এই দু'টি ঘটনার প্রেক্ষিতেও কবির কলম সোচ্চার হতে ভোলেনি। এছাড়াও অত্যধিক মোবাইল আসক্তি, আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে ভুলে গিয়ে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি অহেতুক ঝোঁক, অপসংস্কৃতি, তন্ত্র-মন্ত্রের রাজনীতি, মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা ইত্যাদি বিষয়েও তিনি তাঁর কলমকে হাতিয়ার করে সোচ্চার হয়েছেন।
করোনা মহামারী এবং কোয়ারেন্টাইনের স্মৃতি আমাদের কাছে এখনও ফিকে হয়ে যায়নি — এই দু'টি বিষয়কে উপজীব্য করে কবি পরেশ চন্দ্র রায় বেশ কিছু কবিতা সাবধানবাণীর মতো করে উচ্চারণ করেছেন। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে আমাদেরকে পুনরায় মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন করোনাকালে মন্দির, মসজিদ, গির্জা সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে গেছে, অথচ প্রকৃত দেবালয়ের মতো এক-একটি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্র আর্ত মানবসেবায় অহোরাত্র নিয়োজিত থেকেছে। এছাড়া সাম্প্রতিককালের বেশ কিছু বিষয় ও ভাবনা তাঁর কবিতায় রূপ পরিগ্রহ করেছে — যেমন স্বাধীনতার সাতাত্তর বছর, বিক্রমের চাঁদে পাড়ি ও অবতরণ, ঘূর্ণিঝড় ফেনী ও আম্ফান, চেক্ প্রজাতন্ত্রে দুর্গাপুজো, জুনের দহন, কবি শঙ্খ ঘোষ স্মরণ, বিভিন্ন সংস্কৃতি মেলা এবং মিলন মেলা ইত্যাদি।
এছাড়াও বিচিত্র সব বিষয়ে, দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া নানা ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেছেন অজস্র কবিতা যা এই কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এর পাশাপাশি মহাপুরুষদেরকে শ্রদ্ধার্ঘ্য, মহাপুরুষদের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলিজ্ঞাপন, বিভিন্ন ধর্মীয় পূজার্চনা এবং ঈশ্বরতত্ত্ব, দেশপ্রেম ও নাগরিক দায়িত্ব, বইমেলা ও পুস্তক পাঠের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি জ্ঞানগম্ভীর সব কবিতা পাঠককে ভালোবেসে উপহার দিতে চেয়েছেন। পাশাপাশি নবান্ন উৎসব, ঈদ, শারদ উৎসব, জন্মাষ্টমী, শ্যামাপুজো, রথযাত্রা, জগদ্ধাত্রী পুজো, রাস উৎসব, ভাইফোঁটা, বড়দিন, নববর্ষবরণ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন, শিক্ষক দিবস উদযাপন, শিশু দিবস পালন প্রভৃতি বিষয়ে উৎকৃষ্ট সব পদ্য-কবিতা তিনি উপহার দিয়েছেন।
বাংলা ভাষার জন্য তাঁর প্রাণ প্রকৃত অর্থেই কাঁদে, তাই তাঁর লেখা বাংলা ভাষা বিষয়ক বেশ কিছু কবিতাও এই কাব্যগ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে, যেমন- একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা সন্ত্রাস, বাংলা ভাষার চলা, বাংলা ভাষার রূপ, বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাঙালি, বাংলা ভাষার কবি, ব্যথিত বাংলা বর্ণমালা, বাংলা ভাষার শপথ ইত্যাদি। প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাতেও তিনি যে অত্যন্ত সফল তার নিদর্শন আমরা পাই তাঁর শরৎ তর্পণ, শীত প্রসঙ্গ, নতুন বছর, বসন্তের স্পর্শ প্রভৃতি কবিতায়। নারীকে বিষয় করে লেখা তাঁর বেশ কিছু উজ্জ্বল কবিতাও কবিতা মালঞ্চ কাব্যগ্রন্থটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন নারী শক্তি, নারী কল্যাণ, স্ত্রীর উন্নতিতে বাধা, সমাজে বিবাহিত নারীর স্থান, নারীর পদবীর অধিকার, লজ্জাবতী, সমাজ ব্যবস্থায় নারী, মাতৃ সাধনা ইত্যাদি। এভাবে কবিতা থেকে কবিতান্তরে যেতে যেতে সনিষ্ঠ পাঠক টের পান কবি পরেশ চন্দ্র রায় কতো যত্নে কবিতার মাধ্যমে পালন করেছেন তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্তব্য। এই দিক থেকে দেখতে গেলে দেখা যায় বর্তমানকালের প্রেক্ষিতে যে সমস্ত কবিতার বই সচরাচর প্রকাশিত হয় সেগুলি মূলতঃ চাঁদ-ফুল-তারা, প্রেম-ভালোবাসা, তুমি-আমি, আমি-তুমি ইত্যাদির চর্বিত চর্বণ। কিন্তু কবি পরেশ চন্দ্র রায় লিখিত কবিতা মালঞ্চ তার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম যেখানে কবি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বহুলাংশে চেষ্টা করেছেন সমাজের অন্ধকার দিকগুলির প্রতি তীব্র তর্জনী-সংকেত করে গণসচেতনতাকে জাগ্রত করতে — আর এইখানেই কাব্য মালঞ্চের প্রকৃত সার্থকতা।
তবুও এতো কিছু লিখেও কবির কাব্য-ক্ষুধার সম্যক তৃপ্তি হয় না। তিনি জীবনের শেষ বেলায় এসে বিদায় নেওয়ার পালা গান গেয়ে চলেন এবং তাঁর কবিতায় বলেন —
"যা পেয়েছি প্রথম দিনে
সেই যেন পাই শেষে –
দু'হাত দিয়ে বিশ্বেরে ছুঁই
ঠিক শিশুর মতো হেসে।" (শেষ বেলায়)
বলতে পারেন —
"পড়ন্ত বেলায় একটু সান্নিধ্যের আশা
কোনও কীর্তি যশ নয় –
সাফল্যের দৌড়ে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে
একটু ভাবলেই তো হয়!" (একটু ভাবনা)
প্রার্থনা করেন —
"সমাজের অসুর বধ কর মা,
শান্তি ফেরাও দেশে,
এই কামনা মা তোমার কাছে
এই কবিতার শেষে।" (শ্যামা পুজো)
আশাবাদী হন —
নারীর কল্যাণে জাগরণ ঘটিয়ে
মর্যাদা ফিরুক দ্বারে দ্বারে –
জীবন প্রান্তে এসে দশভূজা মা-ও
থাকতে পাক্ নিজের ঘরে॥ (নারী কল্যাণ)
ঝকঝকে প্রচ্ছদ, মজবুত বাঁধাই এবং উৎকৃষ্ট কাগজে প্রায় নির্ভুল ছাপা বইটি হাতে নিলেই মনে অন্য রকম একটা প্রত্যাশা জাগে। আর কাব্যগ্রন্থটির স্বাদ নিতে নিতে পাঠক যে অনিবার্যভাবেই পৌঁছে যান অন্য এক অনুভবের দেশে এ কথা নির্দ্বিধায় বলাই যায়।
===========================
কাব্যগ্রন্থ: কবিতা মালঞ্চ
কবি: পরেশ চন্দ্র রায়
প্রকাশক: মফঃস্বল বাংলা সাহিত্য একাডেমী
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: পল্লব রায়
প্রকাশকাল: জুন'২০২৪
মূল্য - ২০০ টাকা
কবি পরিচিতি:-
গোবিন্দ মোদক।
(কবি, ছড়াকার, গল্পকার)
জন্ম: ৫-ই জানুয়ারি, ১৯৬৭
শিক্ষাগত যোগ্যতা: M.Com
পেশা: প্রথম জীবনে অধ্যাপনা, পরবর্তীতে India Post-এ কর্মরত। নেশা: লেখালিখি
প্রকাশিত গ্রন্থ: হারিয়ে গেছে ডাক-বাক্স, ধিতাং ধিতাং বোলে, অদ্ভুত যতো ভূতের গল্প, পদ্য ভরা আমার ছড়া, ছন্দ ভরা আমার ছড়া, আলুক ফালুক পদ্ম-শালুক, 'আয়নার সামনে একা', 'প্রথম অন্ধকার এবং ঈভ', 'অনিকেত শ্রদ্ধাঞ্জলি, নিমগ্ন রাত্রির ধ্বনিময় সংলাপ, প্রণমি তোমায়, স্বনির্বাচিত পলাশগুচ্ছ, অপার্থিব জ্যোৎস্নায় অচেনা ছায়াপথ, ছোটদের ছড়ার তুবড়ি ইত্যাদি।
সম্পাদিত গ্রন্থ: চয়নিকা (প্রথম খণ্ড), চয়নিকা (দ্বিতীয় খন্ড), কিশোর কবিতা সংগ্রহ, চয়নিকা (তৃতীয় খন্ড), চয়নিকা (চতুর্থ খন্ড)।
সম্মাননা: পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। তবুও পাঠকের ভালোলাগা এবং ভালোবাসা-ই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।
======================================
পাঠ-প্রতিক্রিয়া: গোবিন্দ মোদক
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ডাকসূচক - 741103