রম্যরচনা ।। নেশা ।। শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
নেশা
শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
না, না, একবারও ভাববেন না, কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় দফার লকডাইন ঘোষণার দিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লিকার শপে ভ্যাকসিন নেওয়ার লাইনকে হার মানিয়ে জনতার যে ঢল নেমেছিল, তা দেখেই এটা লিখছি। আবার এও নয় যে, ২০২০ সালে দেশব্যাপী লকডাউনে (২৫শে মার্চ থেকে ৩১শে মে) চার দিন অন্তর এক একটা করে সতেরোটা লেখা নামিয়েছিলাম তার কথা ভেবে লেখালেখির পাগলামোতে আবার নেমেছি। সত্যি বলতে কি, সে পাগলামোর ছিটেফোঁটাও নেই আমার মধ্যে এখন। সেদিনই ফেসবুকে দেখলাম, কেউ লিখেছেন, প্রথম প্রেমের রোম্যান্স দ্বিতীয় প্রেমে থাকে না। ঠিক তেমনই প্রথম লকডাউনের কী-হয়-কী-হয় রোমাঞ্চ আর ফিরে আসবে না।
তবে ২০২০ সালে লকডাউন উঠে যাওয়ার পর যেই আনলক ওয়ান শুরু হল, তখন মদের দোকানের চমকে দেওয়ার মতো হুড়োহুড়ি আজও আমি ভুলতে পারিনি। তখন কেউ কেউ রসিকতা করে বলেছিলেন, মদ বিক্রী করে সরকার চাল কেনে, আর সেই চাল বিক্রী করে লোকে মদ কিনে সরকারের রাজস্ব বাড়ায়। কথাটা রসিকতা করে বলা হলেও, একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো কথা নয়। বরং তখনই আমি প্রথম জানলাম যে, এ দেশের বহু রাজ্যের প্রধান আয় মদ বিক্রয়-শুল্ক। মানে, লোকে মদ না কিনলে ওই সব রাজ্যের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
তবে মানুষ যে শুধু মদ্য পান করেই নেশা করে, তা নয় কিন্তু। নেশা করার হাজারো পদ্ধতি আছে। যেমন আমার নেশা টিভি দেখা। মারাত্মক নেশা যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলেছে। এর আগে বেশ কিছু লেখায় আমার এই নাছোড় নেশা নিয়ে লিখেছি। সেই লেখাগুলো পড়ে আমার বেশ কিছু বন্ধুবান্ধবী শুধু মজাই করেনি, চোখা চোখা কটাক্ষও করেছে। কিন্তু তাও সে নেশা থেকে মুক্তি পাইনি, বরং আরও চেপে বসছে দিন কে দিন। বিশেষ করে, হাঁটাচলায় কিছু অসুবিধেয় বাড়ি থেকে বেরোনো খুব কমে গিয়েছে ইদানিং। তাছাড়া চোখের সমস্যায় সন্ধেতে বাইরে যাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছি। বাজারপত্র যা করার সব বেলা থাকতেই করে ফেলি। তাই সন্ধেগুলো এখন আমি টিভি বন্দি।
তবে নেশা বলতে সবার মনে প্রথমেই আসে ঢুক ঢুক পান, তা দেশিই হোক কী বিদেশি! বিয়ের পাত্র খোঁজ করতে গেলে ঘটককে প্রথমেই জিগ্যেস করা হয়, পাত্র কোনও নেশাটেশা করে না তো! এখানে কিন্তু জিজ্ঞাস্য মদের নেশা আছে কি না। সিগারেট খাওয়াটাও নেশা, তবে 'নেশাটেশা আছে কি না' সে জিজ্ঞাসায় সিগারেট খাওয়ার নেশাটা পড়ে না। তাহলে ঠগ বাছতে গাঁ উজার হয়ে যেত। আবার রেসের মাঠে যাওয়ার নেশাও পড়ে না, কারণ সে সব উঁচু মহলের ব্যাপার স্যাপার। ঘোড়া রোগ, সে তো ধনীদেরই হয় শুধু! আধুনিক কালে অবশ্য ড্রাগের নেশাও সমাজে বেশ বড়োসড়ো থাবা বসিয়েছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মে। কিন্তু সে নিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজ ততটা সজাগ নয়, বলা ভালো খানিকটা উদাসীনই। তলে তলে হয়, অভিভাবকরা জানতেও পারেন না।
কোথায় আমি টিভি দেখার নেশা দিয়ে শুরু করেছিলাম, কথায় কথায় আরও বেশ কয়েকটা নেশার কথা চলে এলো। আরও এগোলে আরও কিছু মারাত্মক নেশার কথাও চলে আসবে। যেমন, চিনেরা নাকি এক ধরণের নেশা করে তা ভাবলেও গা শিউরে উঠবে সবার।
শুনেছি, তারা নাকি সাপকে নেশা করিয়ে তার ছোবল খেয়ে নেশা করে। কী সাংঘাতিক তাই না! কিন্তু কথাটা সত্যি। কোনও হাঁড়িতে সাপ রেখে তাকে আফিং জাতীয় কিছু দিনের পর দিন খাইয়ে তাকে নেশা করায়, তারপর যখন নিজে নেশা করার ইচ্ছে হয়, তখন সেই হাঁড়ির মধ্যে জিভ ঢুকিয়ে দেয় আর সেই নেশাগ্রস্ত সাপের ছোবল খেয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য নিশ্চিন্ত। ভাবা যায়!
তাস খেলার নেশাও কিন্তু কিছু কম যায় না। ছাত্র জীবনে এর নেশায় পড়েছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে, এ নেশা ধরেছিল আই.এ.সি পরীক্ষার পর। মাস আড়াই বাদে রেজাল্ট বেরোবে, তাই আমরা কয়েকটি বন্ধু সকাল থেকে প্রায় রাত পর্যন্ত তাস পেটাতাম। সবে তখন অকশন ব্রীজ শিখেছি, তা নিয়েই সকাল থেকে সিমলা স্ট্রিটে এক বন্ধুর বাসায় আসর বসতো। সেই বাড়িটা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের জন্মস্থানের ঠিক পাশেই। তাই সেই বাড়ি পরে বিখ্যাত বিবেকানন্দ মিশনের মধ্যে পড়ে যায় এবং ভাঙা পড়ে। সে যাই হোক, সকালে ঘুম থেকে উঠেই কোনরকমে মুখে কিছু খুঁজে ছুটতাম বন্ধুর বাড়ি। আমাকে ছুটে বেরোতে দেখেই মা বলতেন, ছেলে চড়তে বেরলো।
দুপুর একটা নাগাদ বাড়িতে আসতাম, কোনও রকমে দু'চার মগ জল গায়ে মাথায় ঢেলে চান সারতাম। তারপর আবার সেই নাকে মুখে গুঁজে ভাত খেতাম। মা বারবার বলতেন, একটু ধীরে সুস্থে খা বাবা, বিষম খাবি যে! কে কার কথা শোনে। মাথায় তখন ঘুর ঘুর করছে, বন্ধুরা বোধহয় এতক্ষণে ফিরে এসেছে খাওয়া দাওয়া সেরে। ভালো করে আঁচাবারও সময় পেতাম না। মাতৃদেবী গজগজ করতেন। মুখ ভালো করে না মুছেই বাড়ি থেকে ভোকাট্টা। আবার সেই ম্যারাথন তাস পেটানো। পার্টনার ভুলভাল কল করলে বা ভুলভাল তাস খেললে গালাগালের ঝড় বইয়ে দিতাম। আবার নিজে ভুল করলে পার্টনারের গালিগালাজের মুখে পড়তাম। দেখতে দেখতে রাত ন'টা বেজে যেত, কখনও কখনও রাত দশটাও হয়ে যেত। লাস্ট রাউন্ডটা জিতে ফিরলে মুড ভালো থাকত, আবার হেরে ফিরলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকত। মা ঠিক বুঝতেন।
তবে নেশাটা এমন চরমে উঠেছিল যে, ঘুমের ঘোরে স্পেড, ডায়মন্ড, হার্ট, ক্লাব চিহ্নগুলো নেচে বেড়াতো। একবার তো ঘুমের ঘোরে বাবাকে ঘুষিই মেরে দিয়েছিলাম। আসলে, সেদিন শেষ দানে পার্টনার এমন একটা ভুল করে বসেছিল যে, জেতা খেলাটা হেরে বসেছিলাম আর সেই রাগে আমি বিচ্ছিরিভাবে রেগে পার্টনারকে মারতে গিয়েছিলাম, তবে অন্য বন্ধুরা আমায় আটকে ছিল। শেষে সেই রাগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল ঘুমের মধ্যে, বাবা হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য সেই মুহূর্তে আমি ঘুমের ঘোরে ছিলাম, তাই কী করছি বুঝতে পারিনি। পরের দিন সব শুনে লজ্জায় মাথা কাটা গিয়েছিল আমার। অবশ্য এমন ঘটনা পরে আর ঘটেনি।
এইভাবেই তাসের নেশায় আড়াই মাস কেটে গিয়েছিল। রেজাল্ট বেরোতেই শুরু হয়েছিল ভর্তি হওয়ার বিভিন্ন ঝুটঝামেলা। ভর্তির হুজ্জুতিতে তাসের নেশা মাথায় উঠেছিল আমাদের সবার। পরে সে নেশা আর তেমনভাবে মাথায় চড়েনি, ছুটিছাটার দিনে চার বন্ধু একত্রিত হলে খেলতাম, তবে ম্যারাথন নয়।
আরেকটা নেশার কথা বোধহয় আগেই বলা উচিত ছিল যা পেয়ে বসেছিল স্কুল ফাইনাল দেওয়ার অনেক আগেই। ডিসেম্বরে টেস্ট পরীক্ষা ছিল আর তার ঠিক আগে যদ্দূর মনে পড়ে নভেম্বরে ছিল ভাইফোঁটা। আমার বড়দি তখন থাকতেন হাবরা বাণীপুরে। সেবার তাঁর কাছে ফোঁটা নিতে যাওয়া হয়নি। ছোটদি কাছেই থাকতেন, তাই সকালে তাঁর কাছে ফোঁটা নিয়ে গিয়েছিলাম পাইকপাড়া আমার এক মাসতুতো দিদির কাছে ফোঁটা নিতে। লাঞ্চটা তাঁর বাড়িতেই হয়েছিল। উনি উপহার হিসেবে আমায় দুটো টাকা দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে ওই দু'টাকা অনেক টাকা। টাকাটা পেয়ে আনন্দ যেন ধরছিল না। দুপুরে খাওয়া সেরে বাসে বাড়ি ফিরছিলাম। কেন জানি না, মাঝ পথে উত্তর কলকাতার সিনেমা পাড়া হাতিবাগানে নেমে পড়েছিলাম। এর আগে আমার এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে জীবনে প্রথম হিন্দি সিনেমা দেখেছি। সি.আই.ডি, দেবানন্দ, শাকিলা ও ওয়াহিদা রেহমান, পরে জেনেছিলাম এটাই নাকি ওয়াহিদার প্রথম সিনেমা। ওই ছবিটা দেখেই সিনেমা দেখার নেশায় পড়েছিলাম। কী সব গান ছিল ছবিটায়। আজও মাঝে মাঝে গুনগুন করি। 'আঁখো সে আঁখো মেঁ পেয়ার হো গ্যয়া'। তার ওপর ছিল দেব সাবের আদা। নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। মনে পড়ে পরে আরও দু'বার দেখেছিলাম ছবিটা।
এখন বলি সেই ভাইফোঁটার দিনটার কথা। হাতিবাগানে নেমে ছুটলাম শ্রী সিনেমা হলের দিকে যেখানে তার কিছুদিন আগে শুরু হয়েছিল - নয়া দৌড়। স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে তাহলে যদ্দূর মনে পড়ছে, ছবিটা ছিল বি আর চোপড়ার, সুরকার ছিলেন ও পি নাইয়ার আর অভিনয়ে দিলীপকুমার ও বৈজয়ন্তীমালা। ছবিটা আবার রঙীন ছিল। প্রায় আড়াই ঘন্টার ছবিটা দেখতে দেখতে চোখের পলক পড়ল না। ব্যস তার আগের বছর সি.আই.ডি দেখে যে নেশা ধরেছিল, তাতে ঘৃতাহুতি হল। স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। পড়াশোনায় প্রচণ্ড ফাঁকিবাজ ছিলাম আমি। তাই ভয় তাড়া করছিল। পাশ করব তো! তাই তেড়েফুঁড়ে পড়াশোনা করতে লাগলাম, আবার সিনেমা দেখার যে নেশাটায় আগুন লেগেছিল, সেটা সমানে খোঁচাতে লাগল। সময় পেলেই সিনেমা হলে ঢুকে পড়তাম। তখনকার দিনে বেশিরভাগ সিনেমা হলে ফ্রন্টস্টল টিকিটের দাম ছিল দশ আনা, কোনও কোনও সিনেমা হলে সাড়ে ছ'আনা। অবশ্য সে সব হলে ফ্রন্টস্টলের পাবলিক ছিল পুরোপুরি সিটি মারা পাবলিক। কয়েকবার সেই পাবলিকের পাশে বসে সিনেমা দেখেছি ছবিটা দেখতে হবে বলেই। কিন্তু সব সময় অস্বস্তিতে কুঁকড়ে থেকেছি। তাই বেশিরভাগ সময় দশ আনার ফ্রন্টস্টলেই ছবি দেখতাম।
এখন প্রশ্ন হল, সিনেমা দেখার পয়সা পেতাম কোথায়! যদ্দূর মনে করতে পারছি, যবে থেকে সিনেমা দেখার নেশা চেপে বসেছিল তখন থেকে স্কুল, পরে কলেজ যেতে বাবা টিফিন খাওয়ার পয়সা দিতেন। কিন্তু টিফিন না খেয়ে জমিয়ে রাখতাম। নেশা এমনই জিনিস! এভাবেই যখনই সুযোগ পেতাম ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখতাম, কখনও কখনও রোববারে মর্নিং শো যাতে বাড়ির কেউ বুঝতে না পারে। স্কুলে ক্লাস ফাঁকি দেয়ার কোনও সুযোগই ছিল না। কলেজে ছিল, তবে করিনি কখনও। তাই ছুটিছাটার দিনগুলোই ছিল আমার সিনেমা দেখার দিন, সঙ্গে ছিল শনিবার। ক্লাস নাইন থেকে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস ছাড়া আই.এস.সি পরীক্ষার আগে পর্যন্ত এভাবেই অজস্র সিনেমা দেখেছি, হিন্দিই বেশি। সে কী নেশা! তবে আমার এ নেশায় ছেদ পড়েছিল আই.এস.সি পরীক্ষার পর টানা আড়াই মাস তাসের নেশায়, সে গপ্পো তো আগেই বলেছি। আর সে নেশাটা আমার জার্মানি যাওয়ার আগে পর্যন্ত ছিল। তবে সিনেমা দেখার নেশাটা তেমনভাবে আর চাগিয়ে ওঠেনি। কোনও ভালো সিনেমা এলে বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম, এই যা। তাই সিনেমা দেখার নেশাটা আর তেমন জ্বালাতন করেনি।
এবার আসি আরও দুটো নেশার কথায়, ধূম্রপান আর মদ্যপান। সিগারেট খাওয়ার নেশা প্রথম দিনেই মুখ ধুবড়ে পড়েছিল আমার। সে এক মজার কিছুটা করুণ কাহিনি। আমরা তিন বন্ধু ঠিক করলাম সিগারেট খাবো। কোথায় খাবো! তখন স্কুলে পড়ি আমরা। পাড়ার কাছাকাছি কোথায় খেলে ধরা পড়ে যাবো। এই ভয়ে আমরা ঠিক করলাম, এমন জায়গায় যাবো যেখানে কাকপক্ষীটি টের পাবে না। তাই একদিন বিকেলে আমরা তিনজন ছুটলাম উল্টোডাঙ্গার খাল পাড়ে যে জায়গাটা খুব নির্জন আর আমাদের পাড়া থেকে অনেকটা দূরে। যদ্দূর মনে পড়ে আমাদের মধ্যে যে বন্ধুটি আগেই এই নেশায় মজেছে, সে-ই নিয়ে এসেছিল তখনকার দিনে সব থেকে সস্তা ব্র্যান্ডের সিগারেট 'জিপ'। এক প্যাকেট নিয়ে এসেছিল। আমরা তিনজনেই একটা করে সিগারেট মুখে নিলাম। যে বন্ধুটি প্যাকেটটা এনেছিল, সেই দেশলাই জ্বালিয়ে আমাদের সিগারেট ধরিয়ে দিল, শেষে নিজেরটা ধরালো। আমি এক টান দিয়েই কাশতে শুরু করলাম, তথৈবচ আমার অপর বন্ধুটির। কিন্তু আমাদের সেই বন্ধুটি যে প্যাকেটটি এনেছিল, সিগারেট ধরিয়ে দিয়েছিল, সে দিব্যি ফুক ফুক করে টান মারতে লাগল আর আমাদের 'ব্যাট্যারা একেবারেই আনাড়ী' বলে গালাগাল দিতে লাগল। আমি কয়েক টান দেওয়ার পর এমন কাশতে লাগলাম যে আর সাহস হল না আর টান মারতে। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম সেটা খালের জলে। আমার অন্য বন্ধুটি যে আমার মতোই কাশছিল সেও আমার দেখাদেখি সিগারেটটা ফেলে দিল। শুধু আমাদের হিরো বন্ধুটি বেশ আরাম করে বেশ কয়েকটা টান দিয়ে শেষ করল। ব্যস, সেদিনের সেই অ্যাডভেঞ্চার সেখানেই ইতি। আমাদের হিরো বন্ধুটি ছাড়া আমরা আর দুই বন্ধু আর কখনও সিগারেট ছুঁয়ে দেখিনি তারপর, অথচ আমাদের হিরো বন্ধুটি চিরদিনের মতো চেইন স্মোকার হয়ে গেল। বছর কয়েক আগে সেই বন্ধুটি আমাদের ছেড়ে চলে গ্যাছে সেই দেশে যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। সে প্রায় দুঃখ করে বলত, মনে আছে আমাদের সেই উল্টোডাঙ্গা খালের কাছে সিগারেট খাওয়ার অ্যাডভেঞ্চারের কথা! তোরা ব্যাটা দু'জন আর ওদিকই মাড়ালি না আর আমি চেইন স্মোকার হয়ে গেলুম। সিগারেট খেয়ে তার হার্টের ব্যামো হয়েছিল। শেষে বাইপাস করতে হয়েছিল।
এ তো গেল ধূম্রপানের ইতিকথা, এবার বলি মদ্যপানের কিছু কথা। জার্মানি যখন গেলাম তখন আমি চা-ও খেতাম না, মদ্যপান তো দূরের কথা। সত্যি বলতে কি, প্রায় পাঁচ বছর সেখানে থেকেও ওই জিনিসটিতে আমি রপ্ত হতে পারিনি। কালেভদ্রে খেয়েছি, ভালো লাগার মতো কিছু মনে হয়নি। তবে সুরাপান নিয়ে একটা দুটো ঘটনা ঘটেছিল তা চিরকাল আমার স্মৃতিতে এখনও জ্বল জ্বল করে। তারপর অর্ধ শতাব্দী চলে গেলেও এখনও সে ঘটনা দুটি ভেবে ভালো লাগার আমেজ ছড়িয়ে পড়ে মন প্রাণে। তার একটা শোনাই।
কোম্পানি থেকে আমাকে যখন আইবিএম, মিউনিখে (জার্মান ভাষায় ম্যুইনচেন, কেউ বলে ম্যুইনশেন) পাঠানো হল এক সপ্তাহের একটা ট্রেনিংয়ে, তখন আমার বস ডঃ হুইটনার বলে দিয়েছিলেন যে, মিউনিখের বিয়ার জগৎ বিখ্যাত, ভালো করে খেয়ে এসে বলো কেমন লাগল। যদিও ওই চিরতা মার্কা জল খেতে আমার এতটুকুও আগ্রহ ছিল না। তাও চলে আসার আগের দিন ভাবলাম, ফিরলেই তো বস জানতে চাইবেন, কেমন লাগল! মিথ্যে করে কিছু বলার থেকে একটু খেয়ে দেখে কিছু বলা ভালো হবে। ব্যস, সেদিন সন্ধেতে গাস্টহোপের (যেখানে উঠেছিলাম) ডাইনিং রুমে এসে বসলাম। যে সুন্দরীটি ড্রিংক পরিবেশন করছিলেন, তাঁকে বললাম, আমাকে কোয়ার্টার লিটার বিয়ার দিন। ভুরু তুললেন তরুণীটি, ভালো করে জানতে চাইলেন কতটা বিয়ার চাইছি আমি! আমি পরিষ্কার ভাষায় বললাম, আইন ফিয়ার্টেল লিটার (ওয়ান কোয়ার্টার লিটার)। ঘাড় নেড়ে সুন্দরীটি চলে গেলেন। একটু পর খালি হাতে ফিরে এসে জানতে চাইলেন, 'আমি যদি আপনাকে এক লিটার মাগে কোয়ার্টার লিটার বিয়ার দিই, আপনি কি কিছু মনে করবেন?'
আমি অবাক হয়ে বললাম, এতে মনে করার তো কিছু নেই, আপনি স্বচ্ছন্দ্যে দিতে পারেন। একটু পর এক লিটার মাগে কোয়ার্টার লিটার বিয়ার দিয়ে গেলেন তিনি। আমি কোনও রকমে গলধঃকরণ করলাম অস্বাভাবিক তেতো বস্তুটি। একটুও ভালো লাগল না। এরপর ফিরে এসে সহকর্মীদের সবাইকে বললাম সেই সন্ধের অভিজ্ঞতা। শুনে সবাই হো হো করে হেসে বলে উঠল, হ্যার সাউদুরী (মিঃ চৌধুরী) আপনি করেছেন কী! মিউনিখে সব লোক লিটার লিটার বিয়ার খায়, তাই ওখানে এক লিটারের মাগ ছাড়া কোয়ার্টার লিটার মাগ পাওয়া যায় না, আর আপনি কিনা কোয়ার্টার লিটার বিয়ার অর্ডার করেছেন! তরুণীটি তো বিব্রত হবেই, এক লিটার মাগে কোয়ার্টার লিটার বিয়ার দিতে। ওটা যে অসভ্যতা! বুঝলাম, সেদিন সুন্দরীটি আমাকে বিয়ার দিতে এত মুখ কাঁচুমাচু করে ছিলেন কেন।
এরপর বসের মুখোমুখি হলাম। ওনাকে আর কোয়ার্টার লিটারের গপ্পোটা শোনালাম না, শুধু বললাম এক মাগ বিয়ার খেয়েছি, ভালো লাগেনি। উনি বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে বললেন, শুধু এক মাগই খেলে, আরেক মাগ খেলে না! আমি বললাম, না, আরেক মাগ খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি। এবার উনি চোখ কুঁচকে বললেন, এই তো ভুল করলে, আরেক মাগ খেলে তোমার ওই খারাপ লাগাটা ভালো লাগা হয়ে যেত। ওনার এই মন্তব্যটির সারমর্ম তখন বুঝিনি। অনেক বছর পর দিল্লিতে থাকার সময় বুঝেছিলাম, বিয়ারের তেতো ভাবটা দ্বিতীয় গ্লাস না খেলে কাটে না, আমেজ আসে কয়েক গ্লাস খাওয়ার পর।
হ্যাঁ, দেশে ফিরে দিল্লিতে আট বছর কাটিয়ে একটু একটু করে বুঝেছিলাম সুরাপানের মাহাত্ম্য। তবে খেয়ে কখনও বেহুঁশ হয়ে পড়িনি। আর নেশাগ্রস্ত হওয়ার মতোও কিছু ঘটেনি। দিল্লিতে আমার প্রচুর উঁচু মহলের সাউথ ইন্ডিয়ান, সর্দার বন্ধুবান্ধব ছিল আর দিল্লিতে শীতকালে উইক এন্ড মানেই দারু পার্টি ওই বন্ধুদের বাড়িতে, মাঝে সাঝে আমাদের বাড়িতে। সে সব পার্টি চলত রাত একটা দুটো পর্যন্ত। আমাদের বন্ধুরা কেউ থাকত ভারতী নগরে, কেউ ডিফেন্স কলোনীতে, কেউ সাউথ এক্সে আর আমরা থাকতাম প্যাটেল নগরে যা ওই সব জায়গা থেকে প্রায় কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। আর প্রতিটা পার্টি থেকে আমি গিন্নিকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতাম ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে ওই রাত একটা দুটোর সময়। গাড়ি কেনার পর পাঁচ পাঁচটা বছর প্রতিটি শীতকালে এমনটাই আমরা করেছি। মাত্রাছাড়া পান করলে কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে পারতাম না নিশ্চয়!
তবে দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরার পর এমন পার্টি করার আর সুযোগ আসেনি। ব্যবসা করবো বলে কলকাতা ফিরেছিলাম, তাই তার চাপে আমার জীবনপ্রবাহ সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে দিল্লির ছন্দে চলা উপভোগ্য জীবনটা আর ফিরে পাইনি, পার্টি টার্টি করার মনটাও হারিয়ে গিয়েছিল কঠোর বাস্তবের কঠিন মাটিতে চলতে চলতে। দিল্লির জীবনটা পরে স্বপ্ন বলে মনে হত। নেশার সংজ্ঞাটা ব্যাপকভাবে পাল্টে গিয়েছিল আমার মানসিকতায়। কাজের নেশার থেকে আর অন্যকোনও নেশা বড়ো হতে পারে ভাবতেও পারতাম না।
এখনও হয়তো ভাবতে পারতাম না যদি না সেদিন বাংলা সাহিত্যের এক প্রথিতযশা লেখকের লেখায় জানতে পারলাম, সব থেকে বড়ো নেশা হল প্রেমের নেশা, যা সে বাল্যকালেই হোক, যৌবনেই হোক, কী বার্ধক্যে। উদাহরণস্বরূপ তিনি লিখেছেন, সাধেই কি গ্রামবাংলার মানুষজন গান বেঁধেছে, 'পিরীতি কাঁঠালের আঁঠা, সে আঁঠা ধরলে পরে ছাড়ে না, গোলে মালে গোলে মালে পিরীতি করো না'। আবার কবিগুরু লিখেছেন, 'পুষ্পবনে পুষ্প নাহি, আছে অন্তরে। পরাণে বসন্ত এল কার মন্তরে।। ... হৃদয়ে সুখের বাসা, মরমে অমর আশা, চিরবন্দী, ভালোবাসা প্রাণপিঞ্জরে।।'
এ নেশা প্রাণের নেশা। এ নেশায় যে একবার মজেছে তার কাছে অন্য যেকোনও নেশাই একেবারে জোলো মনে হবে।
শেষে বলবো, মানুষ নেশা করে বলেই কিন্তু সারা পৃথিবীতে বড় বড় মাদকদ্রব্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলো, বড় বড় সিগারেট তৈরির কারখানাগুলো যেমন রম রম করে চলছে, তেমনই হলিউড, বলিউড, টলিউড হই হই করে ব্যবসা করছে। আর এই সব শিল্পে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্ম সংস্থান হচ্ছে। শুধু কী তাই! এই সব শিল্পে যা মাল মসলা লাগে তার সরবরাহেও তো লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রয়োজন! আর এ সবের বিপণনে কী পরিমান লোকবল লাগে! ভেবে দেখুন তো একবার, মানুষ যদি এ সব নেশা ছেড়ে একেবারে সাত্বিক হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী জুড়ে কী কান্ডটাই না ঘটবে!
******
Subhrendu Ray Chaudhuri
C1/202 Mangalam Park
14 Ho Chi Minh Sarani
Behala
Kolkata - 700 034
----------
19th November, 2024