ধারাবাহিক রচনা ।। গঙ্গার প্রাচীন খাদ: একটি সমীক্ষা ।। বারিদ বরন গুপ্ত
0
ডিসেম্বর ০১, ২০২৪
গঙ্গার প্রাচীন খাদ: একটি সমীক্ষা
বারিদ বরন গুপ্ত
নদীর স্বাভাবিক ধর্ম সমতলে এসে বারে বারে দিক পরিবর্তন করা, দাঁইহাট থেকে ত্রিবেণী ভাগীরথী বারে বারে দিক পরিবর্তন করেছে, ষোড়শ শতকে নবদ্বীপ ছিল ভাগীরথী পূর্ব পাড়ে, আজ চলে গেছে পশ্চিম দিকে! গোটা পূর্বস্থলী প্রাচীন গঙ্গার খাদের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, বিদ্যানগর, চুপি কাস্তশালী একডালা, চাঁদের বিল এখনো প্রাচীন গঙ্গার স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে! সেখানে গড়ে উঠেছে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ! আসলে পূর্বস্থলীর বেশিরভাগ অঞ্চলগুলি অতীতে একসময় জলমগ্ন ছিল, অতীতে দামোদর এই অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবল বেগে বইতো, অজস্র দামোদার পাড় হয়তো সেই স্মৃতিই বহন করছে! আজকের অগ্রদ্বীপ পট্টদ্বীপ বা পাটুলি জনমগ্ন অবস্থা থেকেই উঠে এসেছে! যার জন্য পরবর্তীকালে ভাগীরথীর বারে বারে দিক পরিবর্তনে এই অঞ্চলে অবস্থানগত অনেক পরিবর্তন ঘটেছে বা ঘটছে ,পাটুলি রাজাদের নারায়ণপুর রাজপ্রাসাদ আজ ভাগীরথীর গর্ভে!
প্রাচীন বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাসে দামোদর অজয় ভাগীরথী খড়গেশ্বরী এক বিশাল ভূমিকা পালন করেছে, চম্পক নগরী, কর্জনা উজানী, ইন্দ্রানী প্রভৃতি ছিল প্রাচীন বাংলার বণিকদের অন্যতম কেন্দ্র, সেইসব বিখ্যাত বণিক, চাঁদ সদাগর ধনপতি সওদাগর রা তাদের বাণিজ্য তরী সপ্তডিঙা মধুকর ভাসিয়ে ছিল এর বুকে, ভাসতে ভাসতে চলে গেছিল সপ্তগ্রাম হয়ে সরস্বতীর স্রোত বইয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর হয়ে দেশ বিদেশে, যা আজ প্রাচীন মঙ্গল কাব্যে স্মৃতি হয়ে আছে!
উল্লেখ্য অতীতে পাটুলি নারায়নপুরের পাশ থেকে একটা শাখা ছাদনীর পাশ দিয়ে এসে পশ্চিমমুখী হয়ে নিমদহ এবং জামালপুরের পাশ দিয়ে বদসার উত্তর প্রান্ত দিয়ে হালদার ঘাট গোবিন্দপুর এর পূর্ব প্রান্ত দিয়ে তার পর ধিতপুর কুকশিমলা সরডাঙ্গার প্রান্ত ছুঁয়ে পোলগ্রাম মাদরা সোনারুদ্র শ্যাম বাটির পাশ দিয়ে লোহাচুর এবং বর্গাচির মধ্য দিয়ে দক্ষিণ বাহিনী হয়ে সুলান্টু ভাত শালা বিদ্যানগর চুপি কাষ্ঠশালী জাহান নগর, দক্ষিণবাটি, রাহাত পুর হয়ে নবদ্বীপের পশ্চিম প্রান্ত হয়ে সমুদ্রগড়ের কাছেই জলঙ্গি কে সঙ্গে নিয়ে বইতো, তার স্মৃতিচিহ্ন এখনো বহন করছে মরিগঙ্গা বা ছারিগঙ্গা। এই মরিগঙ্গা ছারিগঙ্গার অনতিদূরে ছিল সমুদ্রগড় রাজাদের আদি বসতবাড়ি , সামনেই ছিল নাচমহল ও কাছাড়ি, আজকে তার কোন চিহ্ন নাই, শুধু নামগুলোই স্মৃতির ইতিহাস হয়ে বইছে।
আজও ছাতনির কাছে সারিবদ্ধ পুকুরগুলো দেখা যায় যা প্রাচীন গঙ্গার স্মৃতি হয়ে আছে, আজও জেগে আছে, নিমদের নিমাক্ষা খাল এবং জামালপুরের বুড়োরাজ মন্দির এবং গরুর হাটের দক্ষিন প্রান্তে বিস্তীর্ণ খাল যা গঙ্গার স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে! আর বতসার পশ্চিম প্রান্ত এবং হালদার ঘাটের বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি অঞ্চল এখনো বালুকাময়, আজকে ইটভাটার গর্ভে! আজ হালদার ঘাট এই অঞ্চলের মৎস্যজীবী শ্রেণীর স্মৃতি বহন করছে। অতীতে হালদার ঘাট দিয়ে নৌকা পারাপার হত , ছিল গোবিন্দপুর এর ঘাট ,সরডাঙ্গার ঘাট, দাস্তিপাড়ের ঘাট,আজকে শুধু নাম গুলোই তার স্মৃতি হয়ে আছে! আজকে সমীক্ষায় জানলাম যে সুমুরিয়ায় এক সময় জাহাজ ডুবি হয়েছিল! যদিও গোবিন্দপুর এবং ধীতপুরে গঙ্গার এখনো স্মৃতিচিহ্ন স্পষ্ট! আর পোলগ্রাম এবং সোনারুদ্রে গঙ্গা তার স্মৃতিকে এখনো মুছে ফেলেনি, চারিদিক এখনো জলা জংলা! বন্যার সময় স্পষ্ট চেনা যায় প্রাচীন গঙ্গাকে! আমার মনে হয় পোলগ্রাম থেকে বরগাছি পর্যন্ত গঙ্গার প্রবাহ বহুদিন পর্যন্ত জীবিত ছিল, উল্লেখ করা যায় যে এই অঞ্চলগুলোতেই সবচেয়ে বেশি নীলকুঠি গড়ে উঠেছিল! এখনো তার স্মৃতি চিহ্ন পড়ে আছে পোলগ্রাম সোনারুদ্র সরডাঙ্গা এবং শ্যামমবাটিতে ! নীলকর সাহেবরা নীল চাষের জন্য বিহার ঝাড়খন্ড থেকে বেশ কিছু আদিবাসী নিয়ে এসেছিল, আজও তাদের বসতি এই অঞ্চলগুলোতে দেখা যায়! যখন পূর্বস্থলীতে ম্যালেরিয়া অর্থাৎ বর্ধমান জ্বর প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পায় তখন নীলকর সাহেবরা এই অঞ্চল ত্যাগ করে!
জামালপুর নিমদহ গোবিন্দপুর কুকশিমলা হরিপুর দোগাছি পোলগ্রাম প্রভূতি অঞ্চলগুলি এক সময় জঙ্গলে ঢাকা ছিল, দিনে দুপুরে বাঘ বার হতো, শুনলাম ছয়ের দশক পর্যন্ত এখানে বাঘ দেখা গেছে! আমি সাতের দশক পর্যন্ত দোগাছির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জঙ্গল দেখেছি! পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তরা অনেক জঙ্গল সাফ করে বসতি স্থাপন করেছে। তখন শুধু কিছু মৎস্যজীবী, গোপ সম্প্রদায় এবং বর্গক্ষেত্রীয়রা এই অঞ্চলগুলোতে বসবাস গড়ে তুলেছিল! আজও জামালপুর সংলগ্ন নিমদহ, পলাশবেড়ে ছাদনি প্রভৃতি অঞ্চল বাগদি দুলে জেলে প্রভৃতি নিম্নশ্রেনী মানুষের আধিক্য! এক সময় তো জামালপুরে বুড়োরাজ (ধর্মরাজ )এদের হাতেই পূজিত হয়েছিল, পরে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে এসে বুড়োরাজে পরিণত হয়েছেন। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্গী আক্রমণে এসব অঞ্চলগুলোর তছনছ হয়ে যায়! বেশিরভাগ মানুষ ভয়ে গঙ্গার ওপারে চলে যায়, অঞ্চলগুলো পুনরায় জঙ্গলময় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকাল আবার ধীরে ধীরে বসতি গড়ে উঠতে থাকে, তবে এই প্রাচীন গঙ্গার খাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দেশভাগের পর উদ্বাস্তুরা এসে বসতি স্থাপন করে, যার জন্য এই অঞ্চলগুলো আজও ছিন্নমূল পূর্ববঙ্গের লোকজনের আধিক্য।
-------------------------
**** চলবে ****
লেখক পরিচিতি:: বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, কবি প্রাবন্ধিক গবেষক বর্তমানে সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।