রম্যরচনা ।। লাঠি ।। শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
0
জানুয়ারী ০১, ২০২৫
চিত্রঋণ - ইন্টারনেট
লাঠি
শুভ্রেন্দু রায় চৌধুরী
জীবনের আশিটা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত কাটিয়ে গত ১৩ই জুন যখন সকালবেলাটা আমার প্রিয় কিছু কবি-লেখক-বন্ধুর সঙ্গে অবিস্মরণীয় কয়েকটা মুহূর্ত সাক্ষী রেখে কাটাচ্ছিলাম, তখন একবারও মনে হয়নি, জীবনের কঠিনতম সময়টা ওৎ পেতে বসে আছে, হাতছানি দিচ্ছে দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে। ঠিক তার পরদিনই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। প্রবল সর্দি-কাশি, কিন্তু কোনও জ্বর নেই, সবকিছু টেস্ট হল, কোভিড টেস্ট হল না। ডাক্তার, ওষুধ, মেডিক্যাল স্টেট করেই একটা মাস কেটে গেল। অনেকেই অনুমান করলেন, কোভিড হয়েছিল আমার। যাইহোক, সব উপসর্গ কমে এলো একটু একটু করে।
কিন্তু ১৭ই জুলাই আবার জ্বরে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে কোভিড টেস্ট হল। রেজাল্ট 'নেগেটিভ'। উৎপাত শুরু হল অন্যভাব। শরীরের নিম্নাঙ্গ সাড়া দেওয়া বন্ধ করল। কোথাও বসে পড়লে সেখান থেকে নিজে ওঠার কোনও ক্ষমতাই ছিল না আমার।
আমাদের সুন্দরবন জনকল্যাণের সঙ্গে জড়িত এক বিশিষ্ট চিকিৎসক আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন, জানালেন, সম্ভবত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি আমি। ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা শুরু করলেন তিনি এবং দিন তিন চারেকের মধ্যে জ্বর কমতে শুরু করল, সঙ্গে অন্যান্য উপসর্গগুলোও। তবে শরীর পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। ইতিমধ্যে আমার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল যে আমার কোভিড টেস্ট নেগেটিভ এসেছে।
হয়তো কেউ কেউ আমাকে দেখতে আসার পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু কোভিড হয়েছে কি না সে সম্পর্কে মনে বিভ্রান্তি থাকায় আসতে পারছিলেন না, যা অত্যন্ত সঙ্গত, স্বাভাবিক এবং কোভিড বিধিনিষেধের অন্যতম একটি শর্ত। এবার তাঁদের কেউ কেউ যখন জানলেন আমার কোভিড হয়নি, ম্যালেরিয়া হয়েছে, তখন তাঁরা দেখা করতে এলেন। খুব ভালো লাগল আমার। অনেকদিন পর বাইরের কারওর সঙ্গে কথা বলে শুধু ভালোই লাগল না, মনে বলও পেলাম। তাঁদেরই মধ্যে একজন হঠাৎ বলে বসলেন, আপনার 'হাই' (কুনজর) লেগেছে।
কথাটা শুনেই আঁতকে উঠলাম। একবিংশ শতাব্দীতে এখনও কেউ এমন ভাবতে পারেন! গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় আমার মাতৃদেবীকে এমন কথা বলতে শুনেছি, অমুক মানুষটার নজর ভালো না, যার দিকে তার কুনজর পড়ে, তার কিছু না কিছু না অঘটন ঘটে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেদিনই সন্ধেবেলায় একটা সিরিয়ালে দেখলাম, এক মা তাঁর ছেলেকে বলছেন, বেটা তোর কারও হাই লেগেছে।
বিজ্ঞানমনস্ক এক প্রবীণ তথ্যপ্রযুক্তিবিদের এ ধরণের কুসংস্কারে কখনও পাত্তা দেওয়ার কথা নয়, কখনও পাত্তা দিওনি। কিন্তু আমার চেহারায় যে বিশাল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে গত এক দেড় মাসে, সেগুলোর দিকে তাকিয়ে যে কেউ ভাবতেই পারেন, এই ধরণের কুসংস্কারের জন্ম কেন হয়। সেই মুহূর্তে আমাকে দেখে কেউ ভাবতেই পারবেন না মাস কয়েক আগে আমায় কেমন দেখতে ছিল, এক দেড় বছর আগের কথা তো দূর অস্ত! যে কেউ দেখে ভাবতেই পারেন, কারও নজর লেগেছে, নয়তো এমনটা কী করে হয়!
আসলে, আমাদের বয়স যতই বাড়ে, আমাদের নানান শারীরিক সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে প্রাকৃতিক নিয়মে। তখন সেই সব সমস্যাকে কাবু রাখতে, সঙ্গে নিজেকে তরতাজা রাখতেও কিছু মেন্টাল সাপোর্টের প্রয়োজন পড়ে। গত পনেরো বিশ বছর তেমনই কিছু মেন্টাল সাপোর্ট আমি চুটিয়ে উপভোগ করেছি যা কখনও আমাকে ভাববার এতটুকু ফুরসৎ দেয়নি যে বয়স বৃদ্ধি জনিত শারীরিক সমস্যাগুলো কথা কইতে শুরু করেছে। বরং ওই মেন্টাল সাপোর্টগুলোর কাঁধে চেপে সব সময় ভেবেছি আমি আগের মতোই আছি। আর আমার এই ভাবনার সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটেছে আমার চেহারায় ও আচরণে। মেঘে মেঘে যে বেলা অনেক হয়েছে, এই সত্যটা চাপা পড়ে থেকেছে আমার মনে।
কিন্তু সবেরই তো শেষ আছে! বছর দুয়েক আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম, কিছু কিছু মেন্টাল সাপোর্ট ক্ষীণ হয়ে আসছে। হয়তো যারা দিচ্ছিল তাদেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে এই সাপোর্ট দেওয়ার। বাল্যবন্ধুদের যে মেন্টাল সাপোর্ট আমাকে অবিরত তরতাজা রাখছিল তার ক্ষয় তো বছর তিন চারেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বছর চার আগে এক বন্ধু, বছর তিন আগে আরেক বন্ধু, শেষে আরেক বন্ধু গত বছর সেই দেশে পাড়ি জমাল যে দেশ থেকে কেউ আর ফেরে না।
আসলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মেন্টাল সাপোর্টগুলো যাদের থাকে তারা অনুভবই করে না জরা তাদের দিকে চোখ রাঙাচ্ছে। কিন্তু সব কিছু মনের মতো চলে না, একে একে এই সাপোর্টগুলো সরে যেতে থাকে আর জরা ছোবল মারে।
তখন সামান্য অসুস্থ হলেই শরীর বেসামাল হয়ে পড়ে। অনিবার্য বার্ধক্যের চিহ্নগুলো আড়াল করা মুখোশগুলো ধীরে ধীরে খসে পড়ে। এক নতুন উপলব্ধির দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়। তখন শুরু হয় আরেক দ্বন্দ্ব। কিছু কিছু মানসিক প্রতিবন্ধকতা ভেঙে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব মনে হয়, অথচ শারীরিক পরিবর্তনগুলো বসে থাকে না, প্রতিটি মুহূর্তে জানান দিতে থাকে।
ইদানীং কালে, মানে এই ভোগান্তির আগে আমায় রাস্তা ঘাটে চলার সময় মাঝে মধ্যেই টাল খেতে দেখে অনেকেই বলতেন, এবার বাইরে বেরোলে একটা লাঠি সঙ্গে রেখো। কথাটা সত্যি জেনেও মন মানতে রাজি হত না, মনে হত লাঠি নিলেই তো সত্যিকারের বৃদ্ধ হয়ে যাবো। এক প্রবল মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে শুরু হল। এবারের ভোগান্তি হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়ল, প্রয়োজন সবার ঊর্ধ্বে। তাই মন মানতে বাধ্য হল, পরিবর্তিত শারীরিক অবস্থায় লাঠি ছাড়া চলাফেরা করা সহজ হবে না। .
প্রয়োজনের ঠ্যালায় মানসিক প্রতিবন্ধকতা চুর চুর হয়ে ভেঙে পড়ল ক'দিনেই।
সেদিন সুন্দরবনের চিকিৎসকটি, যিনি শুধু চিকিৎসক এবং সমাজসেবীই নন, একাধারে আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ, বললেন, মানুষ সব থেকে বেশি ভয় পায় মৃত্যুকে। অথচ সে বিভিন্ন স্তরের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এসেও সেই ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে না। শৈশবের শেষে সে যখন কিশোর হয়, তার শৈশবের মৃত্যু ঘটে। আবার কিশোর থেকে সে যখন যুবক হয় তখন তার কৈশোরত্বের মৃত্যু হয়। তারপর যখন সে যৌবন ছেড়ে প্রৌঢ়ত্বে পা রাখে, তার যৌবনের মৃত্যু হয়। পর পর এতোগুলো মৃত্যু দেখেও তার মৃত্যুভয় কাটে না। আসলে, প্রৌঢ়ত্বের পর বৃদ্ধত্ব যখন কড়া নাড়তে শুরু করে মৃত্যুভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ঠিক সেই সময় মনকে শক্ত করে বাস্তব চিন্তা করা যায়, তাহলে মৃত্যুকে আর ভয়ঙ্কর মনে হয় না বরং মনে হয়, তুঁহু মম শ্যাম সমান।
গত দেড় মাসের ভোগান্তি আমাকে ড: ঠাকুরের আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনার খুব কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছে। নয়তো এতো সহজে বার্ধক্যজনিত মানসিক প্রতিবন্ধকতাগুলো আমি এতো তাড়াআড়ি অতিক্রম করতে পারতাম না। লাঠি যে আমার বাকি জীবনের সব থেকে বড় ভরসাযোগ্য সাথী হতে চলেছে এটাও মানতে পারতাম না।
***
Subhrendu Ray Chaudhuri
C1/202 Mangalam Park
14 Ho Chi Minh Sarani
Behala
Kolkata - 700 034