গল্প ।। আব্দুল করিম একজন সৈনিক ।। রানা জামান
চিত্রঋণ - ইন্টারনেট
আব্দুল করিম একজন সৈনিক
রানা জামান
আব্দুল করিম গাঁয়ে এসে বুক চিতিয়ে হাঁটছেন। সবেমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছেন। বলা যায় চাকুরির পুরোটা সময় বিভিন্ন সেনানিবাসে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। অবসরে যাবার আগে পেয়ে গেলেন একটা যুদ্ধ। উনিশ শ' পয়ষট্টি খৃস্টাব্দের পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার যুদ্ধ। রাওয়ালপিন্ডি সেনানিবাস থেকে পাঠানো হলো পাঞ্জাবে যুদ্ধক্ষেত্রে। সীমান্তের এপাড়ে থেকে কাঁধে বন্দুক ঠেকিয়ে প্রচুর গুলি ছুঁড়েছেন শত্রুর প্রতি। কোনো শত্রু আহত বা নিহত হয়েছে কিনা বলতে পারবেন না। নিয়মিত চানমারি করার সময় অধিকাংশ গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। তবু তাঁর বিশ্বাস ছিলো: অগুণতি সৈনিকের মাঝে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকলে কারো না কারো গায়ে এক দুইটা গুলি লাগবেই! এতে কোনো শত্রুসৈন্য মারা না গেলেও আহত হবেই! এই ধারণাকে পুঁজি করেই সিনা টান করে গ্রামে ফিরে এলেন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আব্দুল করিম।
আব্দুল করিম দূরের কোন এক গ্রাম থেকে স্থানান্তরিত হয়ে কারঙ্কা গ্রামে এসেছেন। কোন্ গ্রাম থেকে এসেছেন ঠিকভাবে কোনোদিন কাউকে বলেন নি, কেনো এসেছেন এবং ঐ গ্রামে ওঁর কোনো আত্মীয়-স্বজন আছ কিনা, তাও বলেন নি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ওঁর স্ত্রী সুলালি বানু এবং দুই মেয়ে আম্বিয়া ও সরুপা এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলছে না। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো: আব্দুল করিম কিংবা সুলালি বানুর তরফ থেকেও কোনো আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসে না, এরাও কোথাও বেড়াতে যায় না। কারঙ্কা গ্রামে পরিচিতি বাড়তে থাকলেও কোনো বাড়িতে ওদের যাওয়া-আসা শুরু হয়নি তখনো।
আব্দুল করিম স্বল্প মেয়াদী কোর্সে ছিলেন। সে কারণে শরীর এখনো শক্ত-সমর্থ আছে। মাসিক বেতন দিয়ে এই পনেরো বছরে সংসারের খরচ চালিয়ে কারঙ্কা গ্রামে দশ কাঠা চাষের জমি রাখতে পেরেছেন। অবসরে এসে কোনো কাজ করছেন না আব্দুল করিম। জমিগুলো গিরভিই আছে; পেনশন ও যে ফসল পান তা দিয়ে সংসার চলে যাচ্ছে। কিন্তু সন্তানগুলো বড় হলে কি এই আয়ে সংসার চলবে, এই চিন্তা সুলালী বেগম করলেও আব্দুল করিম তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বিন্দাস ঘুরে বেড়ান গায়ে হাওয়া লাগিয়ে- নাটক দেখতে যান, গান দেখতে যান, ষাঁড়ের লড়াই দেখতে যান, সবার সাথে বিভিন্ন বিলে মাছও ধরতে যান। গান ও নাটকের আসরে যেতে যেতে একদিন ওর মনে একটা গানের দল গঠনের ইচ্ছে জেগে উঠলো। সে সময়ে গান বলতে কেবলমাত্র গান-বাজনা ছিলো না, অধিকাংশ আসরে ঘেঁটুপুত্রের নাচের সাথে ছোট ছোট কাহিনীর মঞ্চায়ন ছিলো; যে দল বা গ্রাম অর্থের সংস্থান করতে পারতো, তারা নাচ ও প্রধান মহিলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য মহকুমা শহর কিশোরগঞ্জের বারবনিতা পট্টি থেকে মোটামুটি সুন্দরী কোনো বারবনিতাকে ভাড়ায় নিয়ে আসতো।
তো ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য এক শুক্রবার সকালে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য গ্রামের ছেলে-বুড়ো সকলকে ডাকলেন। কারঙ্কা গ্রামে ছয়টি পাড়ায় পঞ্চান্ন পরিবারের মধ্যে মাত্র একটি পরিবারে শিক্ষার আলো পৌঁছায় সামছুল হক ভূঞা এণ্ট্রান্স পাস করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। তিনি নিজ গাঁয়ে মাতব্বরি করে যাচ্ছেন। চেষ্টা করেন ন্যায় বিচার করতে। লেখাপড়া না জানলেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে চাকুরি করায় আব্দুল করিমকে সম্মান করেন। কিন্তু আব্দুল করিমের গানের দল করার উদ্যোগটা ওঁর পছন্দ হচ্ছে না। সামছুল হক ভূঞা একটি চেয়ারে এবং উপস্থিত লোকজন কয়েকটা বেঞ্চে ও বেঞ্চের সামনে খড় বিছিয়ে বসেছে। আব্দুল করিম বসেছেন একটি বেঞ্চের মাথায়।
সামছুল হক ভূঞা ডান হাত উপরে তুলার সাথে সাথে থেমে গেলো গুঞ্জন। সামছুল হক ভূঞা আব্দুল করিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, গান-বাজনা করা ভালা। আমাদের গ্রামের চারিদিকে বেশ কয়েকটা গ্রামে গানের দল আছে। প্রত্যেক মাসে কোনো না কোনো গ্রামে গান হইতাছে। আপনার গানের দল করার কী দরকার?
এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার: পশ্চিম পাকিস্তানে চাকুরি করায় আব্দুল করিম উর্দু বুঝতে পারেন ও কিছু কিছু বলতেও পারেন এবং শুদ্ধ বাংলাও বলতে পারেন। লম্বা ও বাঁকানো গোঁফে একবার তা দিয়ে আব্দুল করিম বললেন, আমার অনেক দিনের শখ একটা গানের দল করা। গাঁয়ের যুবকদের সাথে আলাপ করে বুঝতে পারছি ওদেরও গানের দলে পার্ট করার খায়েস আছে। খর্চাপাতি সব আমার। আফনে আপত্তি কইরেন না মাস্টার ভাই।
সামছুল হক ভূঞা গ্রামের যুবকদের প্রতি একে একে তাকালে সোলেমান বললো, হ মাস্টর চাচা। আমরা গানের দলে পাট করতাম চাই।
সামছুল হক ভূঞা আর আপত্তি করলেন না। প্রথমবারের মতো কারঙ্কা গঠিত হলো একটি গানের দল। নাম দেয়া হলো ফুলেশ্বরী গানের দল। আব্দুল করিমের ইচ্ছানুসারে গাজী কালু চম্পাবতীর কাহিনী মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্তঃ নেয়া হয়েছে। গাজীর অভিনয় করবেন আব্দুল করিম। চম্পাবতীকে ভাড়া করে আনা হবে কিশোরগঞ্জ থেকে।
স্ত্রীর আপত্তি ও খোঁচা দেয়া কথাকে উপেক্ষা করে আব্দুল করিম চালিয়ে যাচ্ছেন মহড়া। গ্রামের যুবকরা খুব আগ্রহ নিয়ে নিজ নিজ অভিনয়ের মহড়া দিচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো: সামছুল হক ভূঞা মাস্টার প্রত্যেকদিন রাতে প্রম্পট মাস্টারের কাজ করে যাচ্ছেন। কারণ, বই পড়ে চরিত্রগুলোর সংলাপ বলে দেবার মতো তখনো শিক্ষিত ঐ গ্রামে আর কেউ ছিলো না। তখন হেমন্তের দ্বিতীয় মাস চলছে। সারাদিন মাঠে ও খলায় ধান কাটা ও তোলার কাজ করে ক্লান্ত হলেও মহড়ায় এসে কাউকে ক্লান্ত মনে হয় না।
শরতের শুরু হতেই বৃষ্টি না থাকায় এলাকার খাল-বিল-নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে। অঘ্রাণের শেষের দিকে কয়েকটা বিলের পানি অনেক কমে গেছে। এলাকার কয়েকটা গ্রামে আলোচনা হচ্ছে অঘ্রাণের শেষ শুক্রবারে সূর্য উঠার সাথে সাথে মৌগাও-এর বিলে পলো বাওয়া হবে। বানাইল বাজার, তাড়াইল বাজার সহ আশেপাশের বাজরগুলোয় ঢোল বাজিয়ে চোঙায় ঘোষণা দেয়া হলো। ছোটবেলায় পলোসহ অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহার করে আব্দুল করিমের মাছ ধরার অভ্যাস থাকলেও পনেরো বছর চাকরিতে থাকায় কোনো যন্ত্র ব্যবহার করেই মাছ ধরার সুযোগ পান নি। বেশ উত্তেজনা অনুভব করছেন মৌগাও-এর বিলে পলো দিয়ে মাছ ধরার ঘোষণা শুনে। এক মঙ্গলবার ভোরে বাড়ির কাউকে না বলে বের হয়ে পড়লেন তাড়াইল বাজারের উদ্দেশ্যে। সাড়ে তিন মাইল হাঁটা পথ। দুটো নদী ও চারটি খাল পার হতে হবে। নদী দুটোয় কোনো পুল নেই; খালগুলোয় বাঁশের সাঁকো থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। সন্ধ্যার আগে একটা পলো কাঁধে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে সবাই অবাক হলেও মুখে দেখা দিলো মুচকি হাসি।
পরের শুক্রবার ফজরের আজানের আগেই আব্দুল করিম ঘুম থেকে জাগলেন। তিনি আজান প্রদানের জন্য ব্যবহৃত চোঙাটা মসজিদ থেকে নিয়ে পাঁচটি পাড়ায় গিয়ে লোকদের ডেকে তুললেন। সবাই পলো কাঁধে নিয়ে মসজিদের সামনে এসে জড়ো হলে আব্দুল করিমের নেতৃত্বে রওয়ানা দিলো মৌগাও গ্রামের বিলের উদ্দেশ্য। আধা ঘণ্টার বেশি লেগে গেলো বিলের পাড়ে আসতে। রাস্তায় কোনো লোক দেখতে না পেলেও পলো হাতে অনেক লোক বিলের পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখে আব্দুল করিম বেশ অবাক হলেন। ওঁর ধারণা ছিলো ওরাই আগে এসেছে বিলের পাড়ে।
বিলে পলো দিয়ে মাছ ধরার সংস্কৃতিটা এই, প্রথমবার কোনো একজন বা কোন গাঁয়ের আগত লোকজন নামে না। বিভিন্ন গ্রাম থেকে সবাই পলো নিয়ে সারি ধরে পানিতে নেমে দাঁড়ায়। এবং পরে আল্লাহর নাম নিয়ে পলো বাইতে শুরু করে।এতে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে মৌগাও গ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো একজন। ঐ একজন হাঁক দিতেই শুরু হলো পলো বাওয়া। এগারোটা পর্যন্ত পলো বাওয়া হলো। পরের বারগুলো প্রথমবারের মতো সম্মিলিতভাবে না হলেও মোটামুটিভাবে অনেকেই দলবদ্ধভাবে, কেউ কেউ এককভাবে পলো বেয়েছেন। দুপুর পর্যন্ত পলো বাওয়া হলো। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ও এককভাবে। বিলের পানি এখন কাদা কাদা হয়ে গিয়েছে। কোথাও মাছে নড়াচড়া নেই। যে সকল মাছ নিজেদের লুকিয়ে রাখতে পেরেছে, ওরা পালাতে পালাতে পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে বিলের থকথকে কাদার মতো নিস্তেজ হয়ে কোথাও পড়ে আছে।
পলো, জাল,বিভিন্ন ফাঁদ বা যন্ত্র বা হাতিয়ে মাছ ধরার ভাগ্য সবার সমান থাকে না। আজকে কেউ কেউ ১০/১২টা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরতে পেরেছে; কয়েকজন কিছুই পায় নি। যে কিছুই পায় নি, তাকে ঐ গ্রামের যারা বেশি মাছ ধরতে পেরেছে, তারা একটা করে চারটি বিভিন্ন ধরনের মাছ প্রদান করলো। গাঁও-গ্রামের এটাই রেওয়াজ।
আব্দুল করিম খুব খুশি। পনেরো বছর পরে প্রথম পলো বেয়ে পাঁচটি মাছ ধরতে পেরেছেন। দুটো মাঝারি আকারের শোল, একটি বেশ বড় বোয়াল, একটি টাকি ও একটি মাগুড়। মাগুড়টা ধরার সময় হাঁতে কাঁটা বিঁধেছে। মাগুড়ের কাঁটায় বিষ না থাকায় আব্দুল করিম গাঁ না করে পলো বেয়ে গেছেন। পানি থেকে উঠে দেখতে পেলেন বাম হাতের মধ্যমা আঙ্গুল বেশ ফুলে উঠেছে এবং টনটনও করছে। গ্রামের লোকজন ওঁর আঙ্গুল দেখে মতামত দিলো এই রকম: বাড়িতে গিয়ে গরম পানির ছ্যাক দিয়ে হলুদ বেটে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে কাপড়ের টুকরো দিয়ে বেঁধে রাখলে দুই দিনেই সেরে যাবে।
কানকোর নিচ দিয়ে দড়ি ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করে পাঁচটি মাছকে দড়িতে ঝুলিয়ে কাঁধের দুই দিকে সামনের দিকে দিলেন ঝুলিয়ে। পলো কাঁধে। গ্রামের অন্যরাও তাই করলো। চলে এলো সবাই নিজ নিজ বাড়িতে। এতো মাছ দেখে আব্দুল করিমের পরিবার খুব খুশি হলো। সবাই হাত লাগিয়ে আব্দুল করিমের কাঁধ থেকে মাছ ও পলো নামিয়ে নিলো। ওঁর ফোলা আঙ্গুল দেখে সবাই আর্তনাদ করে উঠলো সমব্যথী হয়ে এবং এক মেয়ে চলে গেলো গরম পানি করতে এবং আরেক মেয়ে গেলো এক টুকরো হলুদ বাটতে।
আব্দুল হাকিম স্ত্রীকে নির্দেশনা দিলেন এই রকম: শোল দুটোকে লম্বালম্বি চিরে শুঁটকি দিতে হবে এবং মাথা দুটো ভেঙ্গেচুরে একটা আস্ত লাউ দিয়ে রান্না করতে হবে; টাকি মাছের ভর্তা; আজ মাগুড় মাছের তরকারি হবে নতুন আলু দিয়ে; বোয়াল মাছ জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে।
গাজী কালু চম্পাবতী গান মঞ্চায়নের মহড়া চলছে জোরেশোরে। এ সময় বিভিন্ন এলাকায় ষাঁড়ের লড়াই শুরু হয়। কারঙ্কা গ্রামের দুটো ষাঁড় একটি লড়াই-এ অংশ গ্রহণ করে থাকে। ষাঁড়ের মালিক দু'জন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করায়। যার ষাঁড় হেরে যায়, সে আরেকটা ষাঁড় কিনে আনে পরবর্তী বছর ঐ বিজয়ী ষাঁড়ের সাথে লড়াই করানোর জন্য। কারঙ্কা গ্রামে এমনটা চলে আসছে কয়েক বছর যাবৎ। লড়াই-এর আয়োজন করা হয় পুরুড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। ঘোষণা হয়েছে এবছরের লড়াইটা হবে আগামী শনিবার সকাল দশটা হতে। আব্দুল করিম ভাবছেন একটা ষাঁড় কিনবেন কিনা, এমন একটা ষাঁড় যেটার সাথে লড়াই করে এলাকার কোনো ষাঁড় পারবে না।
বাড়িতে এসে আব্দুল করিম কথাটা বললে মেয়ে দুটো খুশি হলেও সুলালী বানু মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, সার কিনার কথা মুখেও আনবাইন না আফনে!
আব্দুল করিম বললেন, ক্যান? কিনলে কী করবা তুমি?
সুলালী বানু কাঁদ কাঁদ স্বরে বললেন, চাকরি কইরা কয়টা ট্যাকা পাইছিলেন, হেই ট্যাকা দিয়া গানের দল বানছেন। আবার অহন ষাড় কিনতে চাইতাছেন। কুনু কামকাইজ করুইন না। এই ট্যাকা ফুরাইলে সংসার কিভাবে চলবো, হেই ভাবনা আছে আফনের?
আব্দুল করিম কিছু বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে হেকিম ভূঞার বাড়িতে এলেন। বাড়ির সামনে দোচালার নিচে ষাঁড়টা বাঁধা আছে। ঘাড়ের দুই দিকে দুটো মোটা পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা। ষাঁড়ের গায়ের রংটা কুচকুচে কালো। প্রতিদিন খাঁটি সরিষার তেল মাখায় ষাঁড়ের গা-টা চিকচিক করছে। পিঠের ককুদটা বামদিকে সামান্য বেঁকে আছে। হেকিম ভূঞা ষাঁড়ের নাম রেখেছেন রুস্তম। ক' বছর আগে রাউতি গ্রামে সোহরাব-রুস্তম গানের পালা হয়েছিলো। রুস্তমকে অনেক শক্তিশালী মনে হওয়ায় হেকিম ভূঞা এই নাম রেখেছেন ষাঁড়ের। বাস্তবিকই রুস্তম অনেক শক্তিশালী। গত পাঁচ বছর ধরে লড়াই-এ রুস্তম জিতে আসছে।চারিতে খৈল,শুকনো মাসকলাই ও ভাতের মাড় দেয়া আছে।ইচ্ছে হলে রুস্তম মুখ ডুবিয়ে মাঝেমধ্যে খাচ্ছে। আব্দুল করিম কাছাকাছি যেতেই রুস্তম চারি থেকে মুখ তুলে ঘাড় বাঁকিয়ে আব্দুল করিমকে দেখে ফোঁস করে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো একবার। দড়ি ছিঁড়ে গুঁতো মারার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারপরও ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেলেন আব্দুল করিম।
তখন পেছন থেকে হেকিম ভূঞা বললেন, ষাড় দেখতে আইছো সৈনিক?
পেছন ফিরে হেকিম ভূঞার মুখোমুখি হয়ে আব্দুল করিম বললেন, জ্বী হেকিম ভাই। আপনের ষাঁড়টা খুব সুন্দর এবং শক্তিশালীও।
তোমার কি এই রকম একটা ষাড় কিনার ইচ্ছা করতাছে সৈনিক?
ইচ্ছা করে হেকিম ভাই। কিন্তু এতো টাকা নাই আমার কাছে।
এক পাড়ায় দুইটা ষাড় থাকার দরকার নাই। তুমি আমার রুস্তমরে দেখাশোনা কর। আগামী শনিবারে লড়াই-এ তুমি ষাড়ের সাথে যাও।
আজ শনিবার। ষাঁড়ের লড়াই-এর ময়দানে যাবার জন্য সৈনিকের এক জোড়া খাকি পোশাক ও এক জোড়া বুট বের করলেন আব্দুল করিম। তিনি চার জোড়া খাকি পোশাক ও দুই জোড়া বুট নিয়ে এনেছেন। খাকি পোশাক ও বুট পরায় গ্রামের শিশু-কিশোররা ওঁর পিছু নিলো। আব্দুল করিম রুস্তমের সাথে থাকায় বুঝতে পারলেন না শিশু-কিশোররা ওঁর পিছু নিয়েছে, না রুস্তমের পিছু নিয়েছে।
সকাল আটটা থেকে পুরুড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ষাঁড়ের লড়াই শুরু হয়েছে। নির্ধারিত সীমানার বাইরে গোলাকারভাবে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। এখন ছোট ছোট ষাঁড়গুলোর লড়াই চলছে। মাঠের বিভিন্ন স্থানে চার/পাঁচটা করে চলছে লড়াই। সকাল দশট থেকে শুরু হবে বড় ষাঁড়গুলোর লড়াই। তখন একটি করে লড়াই চলবে। যে সকল ষাঁড়ের পূর্বে থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী ষাঁড় স্থির করা হয়নি, সেগুলোর জন্য লড়াই ব্যবস্থাপনা কমিটি আলোচনার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী ষাঁড় ঠিক করে দিচ্ছে। ঘোষণা দেয়া হয়েছে কারঙ্কা গ্রামের হেকিম ভূঞা ও মফিজ উদ্দিনের ষাঁড়ের লড়াই শুরু হবে সকাল এগারোটায়। এরকম পূর্ব নির্ধারিত প্রতিদ্বন্দ্বী ষাঁড়ের চারটি লড়াই অনুষ্ঠিত হবে আজ। দশটার পর হতে বড় ষাঁড়গুলোর লড়াই শুরু হয়েছে। এগুলোর লড়াই দীর্ঘ স্থায়ী হচ্ছে।
এগারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে আব্দুল করিম মুখে চোঙা লাগিয়ে সারা মাঠ ঘুরে ঘোষণা দিলেন এরকম: মাঘ মাসের এক তারিখ শনিবার দিবাগত রাতে কারঙ্কা গ্রামে নুরুল ইসলামের বাড়ির বাইরেগে(বাংলাঘরের সামনে) গাজীকালুচম্পাবতীর গানের পালা অনুষ্ঠিত হবে; চম্পাবতীর অভিনয়ের জন্য কিশোরগঞ্জ থেকে মক্ষীরানি সবিতাকে হায়ার(ভাড়া) করে আনা হবে। এই গানের পালা নিয়ে গুঞ্জণ শুরু হয়ে গেলো দর্শকদের মধ্যে।
এগারোটা বাজতেই ঘোষণা করা হলো কারঙ্কা গ্রামের দুই ষাঁড়ের লড়াই-এর। দুটো ষাঁড় মাঠের দুই দিক থেকে প্রবেশ করলো ভেতরে। দুই জন করে চার জন দুই দিক থেকে দুটো ষাঁড়কে ধরে আছে। ষাঁড়ের হাঁটার গতির সাথে ওরা হেঁটে না পারায় দেহের সর্বশক্তি খাঁটিয়ে টেনে ধরে মৃদু দৌড়ে এগুচ্ছে মাঠের মাঝখানে। দুটো ষাঁড়কে মুখোমুখি দাঁড় করানো হলো। গলার দড়ি কেটে দিয়ে একজন করে রয়ে গেলো ষাঁড় দুটোর সাথে।
শুরু হয়ে গেলো দুই ষাঁড়ের লড়াই। দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে লড়াই দেখছে। অনেকে চিৎকার দিয়ে পছন্দের ষাঁড়কে উৎসাহ দিচ্ছে। আক্রমন প্রতিআক্রমন চলছে সমানে সমান। শিঙের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ষাঁড় দুটো।
আব্দুল করিম রুস্তমের পেছনে নিরাপদ দূরত্বে থেকে চিৎকার করে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন রুস্তমকে। এক ঘণ্টা মরণপণ লড়াই-এর পরে রুস্তমের প্রতিদ্বন্দ্বী ষাঁড় হঠাৎ রণে ভঙ দিয়ে মাঠ জুড়ে দৌড়াতে শুরু করলো। ঐ ষাঁড়ের চারজন রক্ষক ওকে ধরার জন্য ওর পেছনে ছুটছে।
এদিকে আব্দুল করিম সহ চারজন রুস্তমের গলায় দড়ি পরিয়ে মাঠে ঘুরাতে আরম্ভ করলো। ঐ ষাঁড়কে তখনো ওরা ধরতে পারে নি। দৌড়াতে দৌড়াতে ওটা চলে এলো রুস্তমের কাছাকাছি। রুস্তমের চার রক্ষক ভয় পেয়ে ছেড়ে দিলো রুস্তমের দড়ি; কিন্তু দ্রুত সরতে গিয়ে আব্দুল করিম পড়ে গেলেন ঐ ষাঁড়ের সামনে। সাথে সাথে ষাঁড়টা আব্দুল করিমকে শিঙে গেঁথে তুলে নিলো মাথার উপরে।
ঢাকা, বাংলাদেশ।