বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

অণুগল্প ।। আত্মসম্মান ।। শ্যামল হুদাতী


 চিত্রঋণ - ইন্টারনেট

 

আত্মসম্মান

শ্যামল হুদাতী 



কাজ সেরে ফিরছি। গড়িয়াহাটা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। এক বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পড়ে গেলেন রাস্তায় চোখের সামনে। আমার মত অনেকে ওনার কাছে গিয়ে উঠিয়ে বসালেন। লোকটির বয়স আমার মনে হয় ৬০ থেকে ৬৫ এর মধ্যে, ৫ ফুট ১ থেকে ২ ইঞ্চি হবে।মাথায় পাকা চুল। পড়নে প্যান্ট শার্ট, পিঠে একটা কালো ব্যাগ, পায়ে একজোড়া ছেঁড়া চটি।

কয়েকটা মানবিক মুখ চোখে পড়ল। এক মধ্য বয়স্কা ভদ্রমহিলা ছুটে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে এক মুঠো চিনি নিয়ে এসে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে খাইয়ে দিলেন। সাথে সাথে এক ভদ্রলোক ব্যাগ থেকেই জলের বোতল বার করে ভদ্রলোককে খাওয়ালেন, মুখে চোখে জলের ছিঁটে দিলেন। এক যুবক পাশের দোকান থেকে বিস্কুটের প্যাকেট এনে ভদ্রলোককে খাওয়াতে লাগলেন। এক মধ্য বয়স্কা ভদ্রমহিলা সামনের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা নিয়ে আসলেন। কয়েকজন চা খাওয়াতে বারণ করলেন। বললেন গ্যাসের প্রবলেম হতে পারে। অসুস্থ বয়স্ক ভদ্রলোক রাস্তায় বসে খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে কৃতজ্ঞতাচিত্তে মানবিক মুখগুলো লক্ষ্য করার চেষ্টা করছিলেন।
এক ভদ্র মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন - "কোথায় থাকেন? বাড়ি কতদূর? বাড়ির লোকের ফোন নাম্বার আছে"?

"আমার মেয়ের নাম্বার আছে, থাকে অনেক দূরে",  অসুস্থ ভদ্রলোক খুব আস্তে আস্তে বললেন ‌।

"ঠিক আছে দিন না কথা বলি", ভদ্রমহিলা বললেন। 

ভিড়ের মাঝে এক ট্রাফিক পুলিশ হাজির। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, "কীসের এত ভিড়? কি হয়েছে দেখি দেখি জায়গা দিন।"

অনেকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে পুলিশকে এগিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানালেন।

অসুস্থ বৃদ্ধের ব্যাপারে পুলিশ সবটা শুনলেন।

"এখানে এভাবে বসে থাকা যাবে না। জ্যাম হয়ে যাবে। ওনাকে ওই পারে নিয়ে যেতে হবে", পুলিশ সাহেব বললেন। 

বলার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েকজন যুবক অসুস্থ বৃদ্ধ লোককে ভালো করে উঠিয়ে ওপারে নিয়ে গিয়ে এক চেয়ারে বসালেন। এত লোক মিলে বয়স্ক ভদ্রলোককে সেবা করছেন -  তিনি দেখে হয়ত খানিকটা অবাক এবং অস্বস্তিতে পড়েছেন বলে আমার মনে হয়। 

"আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ঠিক চলে যেতে পারবো, " অসুস্থ বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন।

"না না আপনি যেতে পারবেন না", অনেকে সমস্বরে বললেন। 

"দেখি, আপনার কন্টাক্ট নাম্বার। আমরা গাড়ি করে পাঠিয়ে দিচ্ছি বাড়িতে।" পুলিশ সাহেব বললেন। 

"আমার মেয়ে থাকে অনেক দূরে। আমাকে ছেড়ে দিন আমি ঠিক চলে যেতে পারবো।" অসুস্থ বয়স্ক ভদ্রলোক মিনতির সুরে বললেন।

"আপনার মেয়ের নাম্বারটা দিন তাড়াতাড়ি" , পুলিশ সাহেব বললেন।

পিঠের কালো ব্যাগটা খুলে এক ছোট্ট নোটবইয়ের মধ্যে মেয়ের নাম্বারটা দেখিয়ে দিলেন অসুস্থ বয়স্ক ভদ্রলোক।

ফোন করে পুলিশ জানতে পারলেন, মেয়ে থাকে দত্ত পুকুরে, ছেলে থাকে সাউথ সিটির B  টাওয়ার ফ্ল্যাটে, মা নেই, বাবা থাকেন ঝিলমিল বস্তিতে একা।

উপস্থিত সবাই অবাক। এত সুন্দর বেশভূষা পড়া বয়স্ক ভদ্রলোক থাকেন এক বস্তিতে । কেউ যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। 

বয়স্ক ভদ্রলোক পিঠের কালো ব্যাগ থেকে নোট বই বার করতে গিয়ে কয়েকটা ধুপ কাঠির প্যাকেটও বেরিয়ে এসেছিল।

বয়স্ক ভদ্রলোক এখন মনে হয় অনেকটা সুস্থ। যাওয়ার আগে সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে শুধু একটা কথা বললেন, "আত্মসম্মানের জন্য লড়াই করছি।"

তারপর তিনি ভিড়ে মিশে গেলন‌।

শুধু একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে -

        হেথায় দাঁড়ায়ে দু-বাহু বাড়ায়ে
                   নমি নর- দেবতারে,
         উদার ছন্দে পরমানন্দে 
                     বন্দনা করি তাঁরে। 

----------------------------------------------------------------

শ্যামল হুদাতী 
৩৫৭/১/১৩/১, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড 
কলকাতা - ৭০০০৬৮


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.