গল্প ।। প্রেমের শিক্ষা ।। মিঠুন মুখার্জী
0
জানুয়ারী ০১, ২০২৫
চিত্রঋণ - ইন্টারনেট
প্রেমের শিক্ষা
মিঠুন মুখার্জী
তিয়াসার যখন সাত বছর বয়স, তখন একটি শিশু উদ্যানে বাবানের সঙ্গে খেলার সূত্রে পরিচয় হয়েছিল তার। সেই পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব এবং দেখতে দেখতে বয়ঃসন্ধি পার হয়ে একই কলেজে বাংলা অনার্স নিয়ে ভর্তি হয় তারা। বন্ধুত্বের সম্পর্ক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এমন অবস্থা হয় দুজনের যে, একদিনও কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারেনা। একদিন দেখা না হলে মনে হয় তারা যেন কত যুগ দেখা করেনি। এমন প্রেমের সম্পর্ক সচরাচর চোখে পড়ে না। তারা দুজনে গোপনে সংকল্প করেছিল, "বাঁচলে তারা একসাথে বাঁচবে, মরলে একসাথে মরবে। জীবনে সংসার যদি করতে হয় তো দুজনে একসাথে করবে। তারা দুজন শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত একে অপরের।" ছোটবেলার বন্ধু তিয়াসার জন্য একটি নদী কিনবে ভেবেছে বাবান। সে বলেছে--- " সম্রাট শাহজাহান যখন বেগম মমতাজের জন্য সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল বানাতে পারেন, তবে আমি সামান্য একটা নদী কিনতে পারব না।"
ভালোবাসার সব সম্পর্ক পরিণতি পায় না। তিয়াসা ও বাবানের সম্পর্কও একটা সময় গিয়ে আর এগোয়নি। কথায় সম্পর্ক টেকে না। সব সম্পর্কের মূলে থাকে নাম - যশ - অর্থ। এই তিনটি না থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিও অপ্রিয় হয়ে যায়, তো প্রেমিক কোন ছাড়। তিয়াসা এম.এ পাস করার পর স্কুল-শিক্ষিকার চাকরি পায়। সেখানে বাবান ছিল বেকার। বেকার মেয়েকে চাকরি করা পুরুষ বিয়ে করতে রাজি হলেও চাকরি করা মেয়েরা বেকার পুরুষকে বিয়ে করে জীবনটা নরক বানায় না। তিয়াসাও তাই করেছিল। বাবা-মায়ের কথা মেনে আর দশটা মেয়ের মত অরিন্দম নামের এক কলেজ প্রফেসরকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল সে। বাবান তাদের সম্পর্কের পরিণতির কথা বললে তিয়াসা বলেছিল--- " আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তোমাকে অনেক সময় দিয়েছি। চাকরি তুমি পাবে না। তোমাকে বিয়ে করলে তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব শেষমেষ আমাকেই নিতে হবে। তাই আমি অরিন্দমকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওর সঙ্গে আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে। তোমার সঙ্গে আছে একরাশ দুঃখ। তিয়াসার কথা শুনে বাবানের দু-চোখে জল দেখা যায়। গাঢ় প্রেম মনে খুব ব্যথা দেয়। বাবান মনে মনে ভাবে, কত প্রতিশ্রুতি কত ভালোবাসার কথা নিমেষে সব বেকার হয়ে গেল। মানুষের এমন পরিবর্তন দেখলে খুবই কষ্ট পায় সে। একে একে বিগত দিনগুলির কথা মনে পড়ে তার।
তিয়াসার বিয়ের দিন সকালে বাবান তিয়াসাকে ফোন করে। দুই - তিনবার ফোন করার পর তিয়াসা ফোনটা ধরে। বাবানকে সে বলে --- " আজ আমার বিয়ে, তুমি সব জেনেও ফোন করলে কেন? তোমার কি লজ্জা নেই? জীবনে তো কিছুই করতে পার নি , কেবল লম্বা চওড়া বাতলিং ছাড়া। আজ আবার কি বলতে ফোন করেছ?" এই প্রশ্নের উত্তরে বাবান তাকে বলেছিল --- " এই তোমার ভালোবাসা? তুমিও তো আমাকে কত স্বপ্ন দেখিয়েছিলে, কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। চাকরি পাওয়ার পর তোমার এতটা পরিবর্তন হবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এখন আমি বুঝতে পারছি প্রকৃত ভালোবাসার সম্পর্ক আমাদের মধ্যে কখনো ছিল না। আমিই ভুল ছিলাম। তোমাকে বিশ্বাস করে খুব ঠকেছি। তবে একটা কথা তুমিও শুনে রাখ, ভগবান যা করেন ভালোর জন্য করেন। আমার বড় শিক্ষা হল।" এরপর বাবানই ফোন কেটে দেয়।
সন্ধ্যা ছটায় ছিল তিয়াসার বিয়ের লগ্ন। পাঁচটার মধ্যে বর অরিন্দম এসেছিলেন। বাড়ির পরিবেশ এতটাই সুন্দর ও মঙ্গলময় ছিল যে, দেখে বোঝার উপায় ছিল না একটু পরেই এখানে অমঙ্গলের কিছু ঘটতে চলেছে। বিয়ের সমস্ত নিয়ম প্রায় শেষ, শুধু সিঁদুর দানটাই বাকি ছিল। হঠাৎ একদল পুলিশ তিয়াসা ও অরিন্দমের বিবাহের স্থানে এসে উপস্থিত হন। তিয়াসাকে গ্রেপ্তার করেন তারা। বিবাহের স্থানের সকলে খুব অবাক হয়ে যান। তিয়াসার বাবা-মা ও অরিন্দম পুলিশ অফিসারের কাছে জানতে চান তারা তিয়াশাকে কেন গ্রেফতার করেছেন। তাদের প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ অফিসার শৈলেন সামন্ত জানান---" তিয়াশা দেবীর গুণে নুন দেওয়ার জায়গা নেই। উনি দশ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে স্কুল শিক্ষিকার চাকরিটা পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে প্রমাণও আমরা পেয়ে গেছি। তিনি একা নন, এরকম পঁচিশজনকে সারা জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জালিয়াতি করে শিক্ষিকা হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কি শিক্ষা দেবেন? আমরা ঘৃণা করি আপনাদের মত মানুষদের।" এরপর তাকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়।
এদিকে অরিন্দমের বাবা-মা তিয়াসাকে বৌমা হিসাবে মেনে নেন না। তারা বলেন--- " এমন প্রবঞ্চকের সঙ্গে আমরা কোন সম্পর্ক রাখবো না। তাছাড়া সিঁদুর দানই যখন হয়নি, তখন কিসের বিয়ে!!" বাবা-মার সিদ্ধান্তে একটাও কথা বলেন না অরিন্দম। তারা তৎক্ষণাৎ বাড়ি ফিরে যান। একমুহূর্তে বিয়ে বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়। তিয়াসার মা কেঁদে কেঁদে বাবাকে বলেন--- "তখন বলেছিলাম এসব করোনা। আমার কথা তোমরা শুনলে না। এবার বোঝো ঠেলা। মেয়ে সন্তান চাকরি না পেলেও ভালো ছেলের সঙ্গে ঠিকই বিয়ে হয়ে যেত। তোমাদের লোভের জন্য তোমরা মরলে। চাকরি না করলে সমাজে তোমাদের স্ট্যাটাস থাকে না।" তিয়াসার বাবা মেয়ের বিয়ে এভাবে ভেস্তে যাওয়ায় খুবই কষ্ট পান। মেয়েকে জামিনে বের করার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সে জামিন পায় না। তিনদিন পর একজন অচেনা অজানা উকিল এসে তিয়াসার জামিনের ব্যবস্থা করেন। তিয়াসা ও তার বাবা অবাক হয়ে যান। তাকে জিজ্ঞাসা করেন--- " আমাকে জামিনের জন্য আপনাকে কে পাঠিয়েছেন?" আগন্তুক উকিল প্রথমে আপত্তি করলেও পরে তাদের অনুরোধে বলেন--- " যাকে তুমি বেকার বলে শত অপমান করেছিলে, তোমার যোগ্য বলে তুমি মনে করো নি, যে নিজের থেকেও প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে বেশি ভালোবেসেছিল --- সেই অধমই আজ তোমাকে জামিন করিয়েছে। আমি সেই অধমের কাকা।" তিয়াসা বুঝতে পারে বাবানই আজ তাকে জেলবাস থেকে মুক্ত করেছে। জামিনের ব্যবস্থাটি তারই। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে চাকরি থেকে মানুষের ভালোবাসা অনেক মূল্যবান। এভাবে তার জীবন থেকে তার চলে যাওয়া উচিত হয়নি। সে বাবানের কাকাকে বলে--- " বাবান এখন কোথায় কাকা বাবু? আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমি অর্থের অহংকারে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে একটু ওর কাছে নিয়ে যাবেন? আমি ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইবো। ও আমাকে ক্ষমা করে দিলেই হবে। আমাকে বিয়ে করতে হবে না। আমি ওকে অনেক অপমান করেছি। আমি খুবই অনুতপ্ত।"
বাবানের কাকা এরপর তিয়াসাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। বাবান তাদের বাড়িতেই ছিল। মনের মধ্যে ছিল তিয়াসার প্রতি একরাশ অভিমান। তিয়াসা ঘরে ঢুকেই তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে কান্না করে ও ক্ষমা চায়। তার মাথা বিগড়ে যাওয়ার কারণগুলিও জানায় সে। অনেক অভিমান ও কথার মধ্যে দিয়ে বাবানের কাকার মধ্যস্থতায় তাদের সম্পর্ক পুনরায় জুড়ে যায়। তবে বাবান তিয়াসাকে বলেছিল--- " আমি পুতুল নই, যে যখন চাইলে কাছে টেনে নিলে, কখনো অপ্রয়োজনীয় বলে দূরে ঠেলে দিলে। আমি একজন রক্তমাংসে গড়া মানুষ। আমার মন বলে একটা বস্তু আছে। যা পুতুলের নেই। এরপর পুনরায় আমাদের সম্পর্ক ভাঙলে আর জোড়া লাগবেনা। আমি বড়ই অভিমানী।"
==========================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252