ছোটগল্প ।। ভিক্ষুকের শৈলী ।। এস এম মঈনুল হক
0
জানুয়ারী ০১, ২০২৫
চিত্রঋণ - ইন্টারনেট
ভিক্ষুকের শৈলী
এস এম মঈনুল হক
বাসের মধ্যে প্রত্যেক সিটেই প্যাসেঞ্জার বসে আছে। কিছু প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়েও আছে। বিভিন্ন রকমের অঙ্গভঙ্গি করতে করতে একটা ভিক্ষুক বাসের উপরে উঠল। দেখে মনে হচ্ছে একেবারেই বিকলাঙ্গ। মুখটাকে একটু বেঁকিয়ে প্রত্যেক প্যাসেঞ্জারের কাছেই সে ভিক্ষা চাইছে। বক্তব্য হচ্ছে ও ঠিকমত কথা বলতে পারেনা, কমপক্ষে ৫ টাকার বেশি ভিক্ষা নেবে। ওর অবস্থা দেখে প্রায় প্যাসেঞ্জারেরাই ৫ টাকা ১০ টাকা করে ভিক্ষা দিতে লাগল। আমি পরীক্ষা করার জন্য ওকে ২ টাকা দিলাম। পয়সাট ছুড়ে দিয়ে বল, টাকাটা আপনিই কাছে রাখেন। হয়তো আপনার দরকার হতে পারে। আরো চার পাঁচ জন ২ টাকা করে ভিক্ষা দিলে তাদেরকেও ঐ একই কথায় বলল। একজন খুব রেগে মেগে বললেন, প্রত্যেককেই তো আমরা ২ টাকা করে ভিক্ষা দিই। সবাই ২ টাকা করে ভিক্ষা নেই, তোমাকে কেন দশ পাঁচ টাকা দিতে হবে। কিছু একটা ঘটে যেতে পারে এই ভেবে বাস কন্ডাক্টর বললেন, ছেড়ে দিন তো, ওদের সঙ্গে গন্ডগোল করে কি লাভ। কন্ডাকটর বললেন, এই, তাড়াতাড়ি নেমে যা, বাস ছাড়বে। ছেলেটা নেমে পড়ল। বাস তখনো ছাড়েনি। ছেলেটা নেমে একটা চায়ের ঢপের পাশে দাঁড়ালো। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। ছেলেটা একেবারেই স্বাভাবিক। বিকলাঙ্গের কিছুই দেখতে পেলাম না ওর মধ্যে। বাস ছেড়ে দেওয়ার কারণে আর কিছুই বুঝতে পারলাম না। ও নিয়ে আর মাথা ঘামায়ওনি। কিন্তু দিন দশ বারো পরে দারুণভাবে অবাক হলাম। সেদিনের মতোই বাসের সিটে বসে আছি। বাসে বেশ ভিড় ও আছে। দেখলাম, আগের দিনের ছেলেটা অন্য একটা ছেলেকে নিয়ে বাসে উঠে ভিক্ষা চাইছে। আজকে সে কিন্তু বিকলঙ্গ নয়। সে পুরোপুরি এক অন্ধকে নিয়ে ভিক্ষা চাইছে। ভিক্ষার শৈলীটা আগের মতই। আজও আমি দু টাকা দিয়েই পরীক্ষা করলাম। কিন্তু আগের মতো ছুড়ে দিয়ে ওই একই কথাই বলল। বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জারই অন্ধকে ৫ টাকা ১০ টাকা ভিক্ষা দিল। আগের মতই বাস কন্ডাক্টর এসে বললেন, তোরা নেমে যা, বাস ছেড়ে দেবে। বাস ছেড়ে দিল। কিছুটা ভাবার বিষয় হলেও আর মাথা ঘামালাম না। দিন পাঁচ ছয়েক পরে শহরে গেলাম। বেশ ভ্যাপসা গরম সেদিন। দোকান থেকে একটা ঠান্ডা নিয়ে খেতে যাব এমন সময় যা দেখলাম তা আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আগের ঐ খোড়া অন্ধ এবং তাদের সঙ্গে আর একজন ও বসে দোকানে ঠান্ডা খাচ্ছে আর বলছে- আজকে কি অভিনয় করা যায় বলতো। এটা তো শহর। ধরা পড়লেই তুরুক ধুম, কোথায় যে কিল পড়বে তা বলতে পারব না। ওদের দেখেই অনেকক্ষণ আগে আমি আনমনা হয়ে গেছি এবং ওদের যে সব কিছু শুনছি ওরা সেটা কিছুই বুঝতে পারছে না। ওদের নাম তিনটে জানতে পারলাম। মনিরুল, ডেভিড, প্রদীপ। মনে হল, তিন ধর্মের তিনমূর্তি। ওদের যুক্তিগুলো শুনেই বাসে উঠে পড়লাম। বাসে উঠতেই প্রথম সিটটা আমি নিলাম। আমি যখন আনমনা হয়ে ওদের যুক্তিগুলো শুনছিলাম তখন ওরা কিন্তু আমাকে লক্ষ্য করেছিল। একজন পুরোপুরি অন্ধ, একজন এক পা খোড়া, একজন এক হাত ভাঙার অভিনয় করতে করতে বাসে উঠতেই আমি বললাম- মনিরুল, ডেভিড, প্রদীপ, তোমরা ভালো আছো তো। আমার দিকে তাকাতেই ওরা স্বাভাবিক হয়ে এমন ভাবে দৌড় মারল যে কিছুক্ষণের মধ্যে আর ওদের টিকিও দেখতে পাওয়া গেল না। অনেক লোক তাদের লক্ষ্য করল। বাস কন্ডাক্টর আমাকে বললেন, আপনি ওদের নাম জানলেন কি করে। আমি একটু রেগেই বললাম, তুমি যেভাবে জেনেছো, আমিও সেই ভাবেই জেনেছি।
কন্ডাক্টার বলল- কি করি বলুন স্যার, ওরা স্থানীয়। তাছাড়া ওদের খুব বড় একটা ব্যাচ আছে এবং ইউনিয়ন ও। ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে বা বলতে গেলে আমাদের খুবই ক্ষতি করে ফেলবে তারা। তাই সব কিছু যেনেও মুখ বুজে সহ্য করতে হয়। এছাড়া আমাদের কোন উপায় ও নেই।
আচ্ছা সন্তুদা, এর পরে আর কোনদিন ওদেরকে দেখনি।
- দেখিনি তা নয়, তবে আর ভ্রুক্ষেপ দেয় নি। বুঝলি মিলন, রাস্তায় চলতে ফিরতে এরকম কত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু, সবকিছু মনে রাখা আমি উচিত মনে করি না। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ আছে। বিভিন্নভাবে তারা রোজগার করছে। তবে মনিরুল, ডেভিড ও প্রদীপের মত স্টাইলিশ ভিক্ষুক আমি খুব কমই দেখেছি। এটাই হচ্ছে স্টাইল অফ বেগার অর্থাৎ ভিক্ষুকের শৈলী। চল আজকের মত উঠি, না হলে আবার তোর বৌদির বকা খেতে হবে।
গ্রাম: ফুলসহরী, ডাক: রমনা দেখদিঘী, জেলা: মুর্শিদাবাদ।