গল্প ।। নবান্ন ।। আরজু মুন জারিন
আরজু মুন জারিন
সৌম্য পেষায় কৃষক। সারাবছর চাষবাষ করে এই হেমন্তের সময় অপেক্ষা করে থাকে অন্য কৃষকদের মত। অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামবাংলায় হেমন্তকালে আমন ধান পাকার পর এর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি একটি প্রথা হিসেবে চলে আসছে। সৌম্যরা এই দিনটিকে শুভ দিন হিসাবে পালন করে। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে তৈরি করা চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত তাদের একটি মাঙ্গলিক উৎসব।
বাড়ির সদর দরজার চৌকাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছে ও। যতদুর চোখ যায় দেখলো পেকে ওঠা ধানক্ষেত এর জায়গায় জায়গায় এখনও সবুজ। বেশীর ভাগ ক্ষেতে দানা শক্ত দেখাচ্ছে। সপ্তাহ খানিকের মধ্যে মাটিতে হেলে পড়বে। ওর বলদ ষাঁড়টা ক্ষুধায় ছটফট করছে। কোন খড় নেই। ক্ষেতের আল, নালার ধারে গজিয়েছে তাজা সবুজ ঘাস। ভাগ্য ভালো, প্রকৃতি পশুদের ব্যাপারে অনেক সচেতন। চারদিকে ছড়িয়ে আছে খাদ্য। এখন দিনকাল খারাপ। তাই যত দুর্ভোগ সব মানুষের। "সামনে কোন লগ্ন নেই।" মন্দিরের পন্ডিত ঠাকুর বললেন কাল "লগ্ন একটা সৃষ্টি করে নিলে তো হয়, তাই না পন্ডিতমশাই? তিনি বলেছেন বলে অনুষ্ঠান নাই। তাই ফসল কাটা থেমে গেছে। এখান সংসারে এতগুলো মুখ খাওয়াবে কী? ঘরে আজ একটু চাল নেই। কিছু বীজধান ছাড়া, সব শেষ। সব ঘরেই এক অবস্থা। কে কাকে দেখবে, সবারই এক অবস্থা। কারো কাছে থেকে খাবার ধার পাওয়ার আশা নেই। এ যেন এক যোগী আরেক যোগীর কাছে ভিক্ষা করা, যেখানে প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নেই।"
হোলির পর থেকে সবাই আধপেটা খেয়ে, যে করে হোক খোরাকির মজুদ কদিন বাড়াবার চেষ্টা করে। যাদের আগেভাগে শেষ হয়ে যায় তারা নিঃশব্দে ভোগে। ভিতর থেকে দুই বছরের মেয়ে তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। তার বুড়ো মা বাচ্চাটার পাশে বসে থামানোর চেষ্টা করছে। বড় ছেলেটি দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে জিভ দিয়ে বারবার ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করছে। তার মনে হলো কেউ যেন তার গলায় ছোরা দিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে।
স্ত্রী বিমলা কিছু ঘাস এনে ষাঁড়টার সামনে ঢেলে দিল। কাঁচিটা বেড়ায় গুজে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলো, "ও ঘরের রায়বাবুর কাছে যাও না। কিছু ফসল টাকা যদি ধার দেয় আমাদের!"
ও তবু ও চুপ থাকে। সমস্ত রাগ আর হতাশা নিজের ভিতরে আটকে গেল। স্ত্রী মন খারাপ নিয়ে সামনে থেকে সরে যায়। জীবনে অনেক ক্ষুধা সে সহ্য করেছে। কিন্তু, স্বামী সন্তান আর বৃদ্ধা শাশুড়ীর অনাহার সে আর সহ্য করতে পারছে না। সরকার বাড়ি গিয়ে দেখলো, দামী কোট, ধুতি ও মাথায় টুপি পরা কিছু লোক। সরকারদের বউ তাকে ঠেলে বাড়ির পিছনের দিকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
"কি খবর বিমলা? কি মনে করে?"
ও কিছুটা বিভ্রান্ত, কথা খুঁজে পায় না। শেষে মুখ ফসকে বলে,"ছোটটার কদিন থেকে জ্বর জ্বর ভাব। কিছু ওষুধ দিতে পারেন?"
"এখানে? দেখছিস না বোতল খালি!"
আর কিছু না বলে চলে আসে। তাকে খালি হাতে ফিরে আসতে দেখে স্বামী জিজ্ঞেস করে,"তা, কি বললো ওরা?"
"ও বাড়িতে অতিথি এসেছে দেখলাম। লোক এর সামনে কিছু ধার চাইনি।"
"হ্যাঁ তা ঠিক!" স্বামী মাথা নাড়ালো। খিদে আর লজ্জা তো একসঙ্গে চলতে পারে না। লজ্জা বাদ দিতে না পারলে তো না খেয়ে মরতে হবে।
"জঙ্গল সাফ করার কাজ নিতে চাইলাম, তুই তো করতে দিলি না।" হতাশায় বলে এবার সৌম্য।
স্ত্রী মাথা নিচু করে বললো স্বামীর দুঃখে। তার শ্বশুর ছিল সম্পন্ন কৃষক। সৌম্য চার ভাইয়ের মধ্যে বড়। সে চাইতো, সবার জন্য এক হাঁড়িতে রান্নাবান্না হোক। তাদের সেই যৌথ পরিবারটাকে এক মাপে একই ছাদের তলায় রাখার চেষ্টা কম করেনি। তারপর, সম্পত্তি ভাগ করার দাবি ক্রমশ তীব্র হয়। ফলে ঝগড়া বিবাদ লেগেই থাকতো। শেষমেশ জমি আর ঘরদোর ভাগ করে দিতে বাধ্য হলো সে। সেই থেকে আর সংসারে কোনো উন্নতি হলো না।
"রাঘব বাড়ী থেকে কিছু চাল আনতি পারবি তুই?"
"তুমি জানো সকাল থেকে আমি কত বাড়ী গেলাম?"
সকাল গড়িয়ে দুপুর। দুপুর থেকে বিকাল, এখনও ওই বাড়ীর কারও পেটে দানা পানি পড়েনি। সন্ধ্যা সাথে করে নিয়ে এলো একরাশ অন্ধকার। পৃথিবীর উপর জেঁকে বসে সেই অন্ধকার। চারিদিক থেকে ঝিল্লিরা কলরব করে তাদেরকে স্বাগত জানায়। ক্ষুধায় সৌম্য ভাবে, জ্বলন্ত উনুনটাই না হয় জ্বালিয়ে দেয়। এই হয়তো পারে তার সংসারটাকে সংসারে পরিণত করতে। একদিন যদি চুলায় আগুন না জ্বলে তবে সংসার তার সব হারায়। তখন সব শান্তি আর আরাম, হারাম হয়ে যায়। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, জেগে উঠে আবার ফোঁপাচ্ছে। বিমলা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তাকে শান্ত করার জন্য, ছেলেটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে ছিল, ঘুমের ভেতরে সে আরও নুয়ে পড়েছে।
"কই গো বিমলা।" বাহির থেকে কার ও ডাকার আওয়াজ এলো। সৌম্য বিমলা ছেলে তিনজনে দৌড়ে বের হয়ে এল। সরকার বাড়ীর বউ তার সাথে একজন কামলা তার মাথায় দুই বস্তা ধান আর হাতে, আর বালতি ভরা খাবার।
"মন ছোট করো না গো তোমরা। নাও খেয়ে নাও। আর কাল তোমরা দুজন যদি চাও আমাদের ধান ভাঙ্গার কাজে সাহায্য করতে পারো। তিনি বলছেন দিন হিসাব করে টাকা দিব গো তোমাদের।"
"হ্যাঁ বুবু, কাল খুব সকালে আমরা চলে আসব তোমার এখানে।" স্ত্রী ব্যাকুল হয়ে বলে উঠলো।
"জ্বি ভাবীসাব আমরা দুইজনে আসব। আমাদের আর কি ভাবী পেটটা ভরানো। আমাদের ফসল নাই। আনন্দ অনুষ্ঠান নাই। কোন নবান্ন ও নাই।" বিমলা অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছলো শাড়ির আচলে। স্বামীর ছোট হওয়া তার খুব বিধছে। একসময়ে তাদের ঘরে এরকম নবান্ন আর ফসলের সময় কামলা খাটতো কত সিন্নি পায়েস রান্না হত। আর আজ তারা আরেক ঘরে কামলার কাজে যাবে। এই ক্ষুধা আর এই পেট আর এই অভাব ই বর্তমান সত্য। এই বছর নবান্ন নাহয় এইভাবে হলো। তাও তো ভগবান ওনার আশ্রয়ের ছায়া নিয়ে নেননি একেবারে।
একটা চাটাই বিছিয়ে সবাই বসলো গোল করে। এক পাত্রে কিছু তরকারি, আরেক পাত্রে ভাত আর একটা জগে ডাল। সব একসাথে মিলে সবাই এক পাত্র থেকে খেতে শুরু করলো। পাশে কামলাটি দাড়িয়ে। আজ কার ও কোন লজ্জার বালাই ছিল না। বলা যায় অনেকটা ঝাপিয়ে পড়লো এই এক পাত্রের এতটুকু খাওয়ারে। খেতে খেতে হঠাৎ সচেতন হল যেন সৌম্য কামলাটি ওদের খাবার এর দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল আহা বেচারা মনে হয় না খেয়ে আছে। হয়তো ও কাজের কিছু মজুরী পাবে বাড়ীতে ফিরে কিছু চাল এক থালা ডাল ভাত।
"আহা ঈশ্বর, এই নবান্নের দিনে তোমার বান্দার ভাগ্যে একমুঠো খাওয়ার জোটে না?" দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গভীর থেকে।
"আয়রে দাদা আয়।" ছেলেটিকে হাত ধরে টেনে পাশে বসালো । আরেকটা পাত্রে একটু ভাত তরকারী দিয়ে দিল কামলা ছেলেটিকে। তার ছেলেটি আরেকটু ভাত নিতে গিয়ে হাত গুটিয়ে বসে পড়ে। কামলা ছেলেটি এবার লজ্জা পেয়ে যায়। বলে, "লাগব না দাদা।"
"আরে খা খা। আমাদের পেট ভরে গেছে না রে বাপ।" ছেলের মাথা ঝাকিয়ে আদর করে দিল। খাওয়া শেষ করে কামলা ছেলেটি পাত্রগুলি নিয়ে চলে গেল। ওরা সবাই একই চাটাইয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পূর্বের আকাশ ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত বিছানায় নিঃসাড় পড়ে রইলো সৌম্য । তারপর কারোর ঘুমের বিঘ্ন না ঘটিয়ে পা টিপে টিপে বাড়ির বাইরে মাঠের দিকে হাঁটা শুরু করলো। গাছের তলা থেকে খড় জড় করে এনে গোয়াল ঘরে ষাঁড়টাকে খেতে দিল। এবার সে সবার নজরে না পড়ে এমনভাব করে আবার মাঠের দিকে রওয়ানা হলো। মাঠে আজ তার জন্য বড় চমক অপেক্ষা করছিল। মনে হচ্ছে একরাতে ভগবান তার এই ধানক্ষেতে সোনা ছড়িয়ে দিয়েছেন। লকলকে সোনালী ধানের শীষ আজ গর্বিত ভাবে মাথা উচু করে দাড়িয়ে রয়েছে। দৌড়ে গিয়ে ক্ষেতে লাফিয়ে পড়লো খুশীতে। ধানের শীষগুলিকে দুইহাতে আগলে ধরলো।
পরিশিষ্টঃ হ্যাঁ এবার অনেক আনন্দে নবান্নের উৎসব করেছে সৌম্য বিমলারা। ভগবান তাদের বঞ্চিত করেননি একেবারে। বরং এবারের ফসল আগের দ্বিগুন হয়েছে। মোটামুটি পরের হেমন্ত নবান্ন আসা পর্যন্ত এই ফসলে তাদের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে এ আশা তারা করছে।
সমাপ্ত।।
Hosne Ara Arzu
40 Teesdale Place
Unit no 1903
Scarborough, Ont
M1L 1L3
Canada