পাহাড়ে নববর্ষের আগে
অঞ্জনা মজুমদার
সমুর মামা বিশ্বরঞ্জন আমেরিকার নাসাতে গোপন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন। অনেক পড়াশোনা করেছেন। তবু যখনই ছুটি পান জলপাইগুড়ির বাড়িতে এসে দিন পনেরো কাটিয়ে যান। সময়টা কেমন করে যেন সমুদের স্কুল ছুটির সময়ে আর নববর্ষের সময়ে হয়। ফলে মামা এলেই সমু মামাবাড়ি।
কাকাই বিনুও সঙ্গী হয়। কি করে যেন কলেজের ছুটি ম্যানেজ করে নেয়। মামাবাড়িতে দাদাই আর দিদিভাই এর আদরে আর মামার নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এর গল্প শুনে আর পাহাড়ে বেড়িয়ে সমুদের ছুটি খুব আনন্দ আর উত্তেজনায় কাটে।
এবার সমুদের দেখেই মামা বললেন, এবার আমরা কালিম্পং পাহাড়ে যাবো।
সমু বলল, সে তো আগেও গিয়েছি।
মামা বললেন, এবার একটা নতুন জিনিসের সন্ধানে যাবো। পেলে একটা দারুণ ব্যাপার হবে। কাল ভোরে রওনা হবো। ব্যাগ রেডি আছে তো?
কাকা ভাইপো দুজনেই একসাথে মাথা ঝাঁকাল। ওদের দুজনের
ব্যাগ গোছানোই থাকে মামার ডাক এলেই রেডি।
পরদিন ভোরে দিদিভাই এর তৈরি চা বিস্কুট খেয়ে আর প্যাকেট ব্রেকফাস্ট নিয়ে তিনজনে মামার জীপগাড়িতে উঠে সেবক রোড ধরে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চললো। করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে লম্বুদার চায়ের দোকানে প্রথম ব্রেক। দিদিভাইএর প্যাকেট ব্রেকফাস্ট আর লম্বুদার দোকানের স্পেশাল মালাই চা খেয়ে দুই ক্রেট জলের বোতল নিয়ে মামা রওনা দিলেন।
কালিম্পং শহরের ক্যাকটাস গার্ডেন ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলল। সমু জানতেও চাইছে না কোথায় যাবে। ওরা জানে মামার ফোনে লোকেশন ঠিক করা আছে।
লোকালয় ছাড়িয়ে পাহাড়ের কোলে পাইন গাছের বনের ধারে মামার গাড়ি দাড়াল। মামা বললেন, টেন্ট এখানেই খাটাতে হবে।
টেন্ট এর ভেতরে গুছিয়ে বসে কাকাই চা আর ম্যাগি তৈরি করল। খেতে খেতে মামা বললেন, এই যে পাইন বন দেখছিস, এর পরেই একটা মালভূমি মত আছে। আমার এবারের কাজ সেখানেই।
কি কাজ মামা?
মামা বললেন, আজ রাতেই সেটা জানা যাবে আশা করি।
সমু বুঝল এখন কিছুই জানা যাবে না। রাতের অপেক্ষা করতে হবে।
সন্ধ্যা নামার আগেই দুজন পাহাড়ি নারী পুরুষ একটা বড় টিফিনের বক্স নিয়ে এলেন। মামা বললেন, আইয়ে বহিনজী ভাইয়াজী। ওরা মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসলে মামা বললেন, কি সব প্ল্যান ঠিক হ্যায় তো?
ওরা মাথা নাড়লো। টিফিনবাক্স রেখে নমস্কার করে চলে গেলেন।
মামা বললেন, পাহাড়ে রাত তাড়াতাড়ি নামে। আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব। রাতে অভিযান আছে।
রুটি মাংস সবজি আর দিদিভাই এর দেওয়া মিষ্টি খেয়ে ডিনার শেষ করে মামা বললেন, ঘন্টা খানেক রেস্ট। তারপর বেরোবো।
সবাই মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়ল।
রাত তখন সাড়ে দশটা। কালো পোশাক পরে টর্চ নিয়ে মামা দুজনকে নিয়ে বেরোলেন।
বনের মধ্যে দিয়ে সরু পথ। কিছুটা দূরে বন হালকা হল। ওরা অবাক হয়ে দেখল পাহাড়ের গায়ে একটা খোলা সমতল অঞ্চল।
রাতে পাহাড়ে আলো থাকার কথা নয়। কিন্তু উপত্যকা জুড়ে যেন আলোর মেলা। ছোট ছোট ঝোপে আলোর ফুল ফুটে আছে যেন।
সমু বলল, বাবাঃ! এত এত জোনাকি?
মামা বললেন, ঠিক জোনাকি নয়। জোনাকি লিভিং প্রাণী আর এরা উদ্ভিদ এর ওপর নির্ভরশীল পরজীবি। এদের নিয়ে আমার এবারের গবেষণা। এরা কেবলমাত্র আলো দেয় না, এরা পাহাড়ি মানুষের কিছু কিছু রোগের চিকিৎসার কাজে লাগে। এখানকার স্থানীয় মানুষেরা এই গাছ লোভী মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়।
তবে তোমাকে জানাল কেন?
মামা বললেন, এদের মোড়লের ছেলের একবার খুব জ্বর আর পেট খারাপ হয়েছিল। বাচ্চাটির বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছিল সবাই। আমি আমার কাছে যে ওষুধ থাকে তা খাইয়ে গাড়ি করে কালিম্পং হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছেলেটি সুস্থ হয়ে গেল। তারপর থেকে ওরা বিশ্বাস করতে লাগলো যে আমি ওদের কোনও ক্ষতি করব না। তাই এখন ওই গাছে ফুল ফোটার সময়ে আমাকে খবর দিয়েছে। তবে শুনছি কিছু চোরা শিকারীও এই অঞ্চলের খবর পেয়েছে। আসলে যে ঝোপে ওই ছত্রাক জন্মায় তা হরিণ আর বাইসনের প্রিয় খাদ্য। তাই এখানে হরিণ, বাইসন শিকার করতে চোরা শিকারীরা প্রায়ই এখানে হানা দেয়। ওদের হানায় গাছেদের প্রাণ বিপন্ন। সারা পৃথিবীতে এইটুকুই আলো উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এদের না বাঁচাতে পারলে ভবিষ্যতের মানুষের শক্তির উৎসের গবেষণা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই গাছেদের বাঁচাতে আমাকে পাঠানো হয়েছে।
তুমি কি করবে মামা?
আমি এই গাছেদের মধ্যে একটা জেনেটিক চেঞ্জ আনতে চাই। যাতে এরা নিজেরাই নিজেদের বাঁচাতে পারবে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তাতে বাঁধা দিচ্ছে। আজ তাদের ধরতে হবে। আয় আমরা চুপচাপ বসে থাকি। তিনটে পাইন গাছের পেছনে তিনজন লুকিয়ে পড়ল। কাকাই এর হাতে তীর ধনুক। কাকাই গোল্ড মেডেল পাওয়া তীরন্দাজ। আর সমুর হাতে গুলতি।
রাত প্রায় একটা। জঙ্গলের ভেতর থেকে সরু রেখার মত আলো দেখা গেল। তার আগেই হরিণের পাল এসেছে। পাশে জলের একটা ধারা আছে। ওখানে জল খেতে এসেছে। গোটা চারেক বাইসনও এসেছে। ওরা কিন্তু খুব সাবধানে গাছগুলোর পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সমু নজরে রেখেছে জানোয়ারেরা গাছেদের বাঁচিয়ে চলাচল করছে।
টর্চের আলো দিয়ে চারজন লোকের মধ্যে দুজন রাইফেল তাক করেছে। কাকাই এর তীর আর সমুর গুলতি বন্দুকের নলের গায়ে লাগতেই গুলি ছিটকে গেল। হরিণ আর বাইসনের দৌড়ে যাবার শব্দ। আর ঝোপের ভেতর থেকে একদল পুলিশের লোকজন বেরিয়ে এলেন। হ্যান্ডস্ আপ বলে অফিসার বেরিয়ে এলেন। চারজন লোক ধরা পড়ল।
অফিসার মামাকে নমস্কার করে বললেন, আপনি ডেকেছেন, আমরা এসে গেছি। আর চোরা শিকারি আপনার জন্যই ধরা পড়ল।
আপনি স্যর, আপনার রিসার্চ এর কাজ এবার নতুন করে শুরু করুন।
পাহাড়ি বস্তির দুজন লোক এগিয়ে এলো। বাবুজি, কাল আমাদের বস্তিতে নতুন বছরের উৎসব। নাচা গানা, খানা পিনা হবে। আপনাদের সব্বাইকে আসতে হবে কিন্তু। পুলিশবাবু আপনারাও আসবেন।
মনে পড়ল আগামীকাল নববর্ষ। মামা বললেন, এবারের নববর্ষ তবে পাহাড়ি বস্তির মানুষের মাঝেই কাটুক। আমার স্যাম্পেল কালেক্ট করা হয়ে গেলে পরশু আমরা জলপাইগুড়ি ফিরে যাব।
--------------------------------------
অঞ্জনা মজুমদার
এলোমেলো বাড়ি
চাঁদপুর পল্লী বাগান
পোঃ রাজবাড়ি কলোনী
কলকাতা ৭০০০৮১