
গল্প ।। স্মৃতি সংশয় বাস্তবতা ।। এস.আজাদ
স্মৃতি সংশয় বাস্তবতা
এস.আজাদ
"আপনার আলোকে উদ্ভাসিত হও,
আপনারে আবিষ্কার করো আপনার মাঝে।"
একটা দরকারি কাগজ খুঁজতে পুরনো বইয়ের তাকে হাত দিয়েছিল রমা। 'বনলতা সেন'এর প্রথম পাতায় সোনালী কালি দিয়ে লেখা লাইন দুটি চোখে পরতে সারাশরীরে যেন বিদ্যুতের ঝলক খেলে গেল। উপহারের বার্তাও যে, কখনো কারো জীবনে তীব্র কষাঘাত হতে পারে, সে ধারণা তার ছিল না। বইটি উপহার পেয়েছিল অংশুদার কাছ থেকে তার ২৩ তম জন্মদিনে। অংশুমান দাস, বাড়ি বর্ধমান শহর থেকে দুরে কোনো অজ গ্রামে, শহরে সস্তার মেসে থেকে কলেজে পড়তো। নিজের খরচ যোগাতে টিউশনি পড়াতো।
কলেজে পরিচয় হলেও ঘনিষ্টতা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সিনিয়র হলেও অন্যদের মতো লেজ গজায়নি। শহুরে কৃত্তিমতা নয়, গ্রাম্য সরলতা সারাক্ষণ জারিত করে রাখত তাকে ও তার গভীর দুটো চোখ। দু-চারটে কথা বললেই বোঝা যেত এ ছেলে অন্যদের থেকে একটু আলাদা। হাজারের ভীড়েও সকলেরই চোখে পড়বে ধীরস্থির শান্ত সুমিষ্টস্বরের অধিকারী এই লাজুক ছেলেটাকে। তাদের সম্পর্কটা পড়াশুনা, নোটস ও বই লেনদেন এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
কিন্তু আজ কেন? আজ তো তার জীবনে অংশুমানের কোন চিহ্নই নেই। ডিপার্টমেন্টের বিদায় সংবর্ধনায় রমা নেচেছিল 'আমার মুক্তি আলোয় আলোয়' পরদিন তার জন্মদিন। অনুষ্ঠানের পরের দিন ডিপার্টমেন্ট বন্ধ, অংশুমানদা অনুষ্ঠান শেষ হতেই গ্রিনরুমে হাজির হয়ে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ থেকে জাদুকরের টুপির ভিতর থেকে খরগোশের ছানা বের করার মতো অতি সাবধানে রঙিন কাগজে জড়ানো লাল রিবন দিয়ে সুন্দর করে বাঁধা উপহারটা বের করে হাতে দিয়ে বলেছিলো, — জন্মদিনের আগাম শুভেচ্ছা, অনেক অনেক ভালো থেকো। তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
রমা কোন উত্তর দেয়নি কুয়াশাহীন শীতের সকালের রোদের মতো মিষ্টি করে হেসেছিল। যে হাসিতে, ফুল ফোটে, শব্দ করে বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। যে হাসিতে উল্টো দিকে থাকা মানুষটা যেকোনো মুহূর্তে অবলিলায় হৃদপিন্ডটা খুলে টুপ করে ধরিয়ে দিতে পারে হাতে।
অংশুমান কাব্য করে বলেছিল — রজনীর গন্ধ তুমি, তাইতো রজনীগন্ধা এত সুন্দর।
হঠাৎ করে অল্প অল্প ভালো লাগতে লাগা মানুষটার মুখে প্রসংশা আর হাতে উপহার পেয়ে রমা পুলকিত হয়ে ওঠে একটা অন্যরকম ভালোলাগা বসন্তের রং-রাগের মতো ছড়িয়ে পড়ে তার চোখেমুখে যেটা দৃষ্টি এড়ায়নি অংশুর। কিন্তু শোভনা ম্যামের তাড়ায় শুধু সেদিনের জন্য নয় চিরদিনের মতো অংশুদাকে হারিয়েছে।
সবই তো মনে পড়ে যাচ্ছে। অংশুদার কথার মধ্যে কি, কোন ইঙ্গিত লুকানো ছিল। কিছু কি বলতে চেয়েছিল? তাহলে বলেনি কেন? হয়তো বলেছিল সেই বোঝেনি। মানুষ হারিয়ে যায় কিন্তু কথারা হারায় না। ইথারের সীমার মধ্যে কোথাও না কোথাও ঠিক থেকে যায়। যেমন সময়ের জং পরা মগজে স্মৃতিরা সাজানো থাকে থরে থরে। যেন চৈত্রমাসের কুলের ডাল, আচমকা ধাক্কায় চড়বড় করে ঝরে পরে। ছেঁড়া প্যান্টের পকেট থেকে গলে যাওয়া কয়েনের সাথে শিশু মনের নিথর আনন্দের মতো তারও সময় যেন আজ থমকে গেছে। খসে পড়েছে সময়ের জং।
সেদিন তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরে দেখে মা চোখের জল মুছতে মুছতে ব্যাগ গোছাচ্ছে। রমাকে দেখে মায়ের ভিতরের সব কান্নারা এক সাথে তড়িৎ গতিতে আছড়ে পরে পাথরের শক্ত মেঝেতে। মায়ের কাটা ছেঁড়া কথায় বোঝে মামীমা ফোন করেছিল, দাদুর হার্ট অ্যাটাক হসপিটালে ভর্তি। ৭২ ঘন্টা সময় দিয়েছে ডাক্তার। দু বছর হলো বাবা বদলী হয়েছে পুরুলিয়া, ভাই ব্যাঙ্গালোরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। বাড়িতে সে আর মা ছাড়া কেউ নেই, অগত্যা বাবাকে অফিসে ফোনে করে মাকে নিয়ে ৫:২৫ এর আসানসোল লোকাল। ক'দিন দাদু কে নিয়ে যমে-মানুষে বিস্তর টানাটানির পর সে যাত্রায় বেঁচে গেলো। প্রেসমেকার বসিয়ে বারো দিন পর ছাড়া পেলো।
দাদুর অসুস্থতাকে তার বিস্মৃতির সাথে গুলিয়ে ফেলা মারাত্মক রকমের অপরাধ হলেও কোনদিন তো কিছু মনে হয়নি। পড়াশোনা আর দৈনন্দিন কাজের চাপে অংশুদা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে অংশুদার নামহীন চাঁদের মায়াবী তুলতুলে নরম আলোয় পায়ের পাতা ভেজা জলে দাঁড়িয়ে চাঁদের প্রতিবিম্বে নিজেকে খোঁজা, হারিয়ে গেছে ভাদুগান আর গাজনের আমন্ত্রণ। অংশুদার সাথে শেষ সাক্ষাতের পর জীবনের নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, চোখে ঝরেছে অনেক আনন্দ-বেদনার অশ্রু। তবুও কোনোদিন কোনখানে তাকে মনে পরেনি, বোধহয় মনে পরার দরকার পরেনি। অংশুদা কে মনে না পরায় কারো কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি তো হয়নি, পৃথিবীর গতি থেমে যায়নি, নদীর স্রোত স্তব্ধ হয়নি, বৃষ্টি কাঁদতে ভুলে যায়নি। তাহলে… ?
খুঁজলে হয়তো বর্ধমানের বাড়িতে এখনো অংশুদার দু-চারটে কবিতা পাওয়া যাবে 'আগামী'র পাতায়। কিন্তু সেই কবিতাটি পাওয়া যাবে না আর। না পেলে ক্ষতি নাই। কবিতাটি একদিন তার মগজস্থ ছিল। আজ বিস্মৃতির সাত বছর পর, মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে সবটাই মনে আছে একটা শব্দও বাদ যায়নি। কিন্তু কেন এমন হলো,সাত বছরে এক দিনও কেন এমন করে অংশুদা আর তার সৃষ্টিকে মনে পড়ে নি? নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা করে রমার। নাকি সে গতিময় নদীটার মত ফেলে আসা অতীতটাকে ভুলে যেতে চেয়েছে। মনে একেবারে পরেনি বললে সত্যের অপলাপ হবে। আসলে প্রথম যৌবনের প্রগলভতা আর পরিণত বৈষয়িক মগজের নিরাপদ ভবিষ্যত চিন্তা কে এক করতে চায়নি হয়তো। ভুলে যেতে চাইলেই কি ভুলে যাওয়া যায়? স্মৃতি যেন ছাই চাপ আগুন, দখিনা বাতাসে বেআব্রু হলেই ধক ধক জ্বলতে থাকে, জ্বালাতে থাকে।
রমার মনে পড়ে কলেজের সোসালে সে বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে গিয়েছিল। বোধহয় তাকে দেখেই ওই কবিতা লিখেছিল অংশুদা। কবিতাটা প্রথম পড়ার সুযোগ হয়েছিল অনেক পরে। অংশুদাদের একটা সাহিত্যের আড্ডা ছিল ছিল টাউন হল মাঠে। মাসিক পত্রিকা 'আগামী'র পাক্ষিক বৈঠক। কত কিছু নিয়ে আলোচনা হত সেখানে দেশি-বিদেশি, নবীন-প্রবীণ কবি-সাহিত্যিক ও তাদের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হত। রমা কখনো লেখেনি। শুনতে যেত। তার সবথেকে আকর্ষণের বস্তু ছিল অংশুদার সবুজ মলাটের বাঁধানো মোটা খাতাটা। যেখান থেকে অংশুদা সভায় আলোচনার জন্য কবিতা পাঠ করত। একদিন আলোচনার ফাঁকে খাতাটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার চোখ আটকে গিয়েছিল ওই কবিতাটি তে। অংশুদার অনুমতি নিয়ে কবিতাটি লিখে নিয়েছে। মুখস্ত করেছে। যখন নিভৃতে আপন মনে আবৃত্তি করত তখন তার মনে হতো অংশুদা তার জন্য নয়, অন্য কারো জন্য লিখেছে বোধহয়। সে মোটেই অতটা সুন্দরী নয় কবিতায় যতটা লেখা আছে। একবার ভেবে ছিল জিজ্ঞেস করবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি।
আজ তার মনে হচ্ছে কবিতাটা শুধু তার জন্যই লেখা হয়েছিল। অংশুদা আজ কোথায় তার সাথে তো কোনদিন আর দেখা হলো না। নাকি রমাই তাকে দেখা করতে চায়নি। স্বাভাবিক নিয়মে আর দেখা হবে না জেনেও রমা তো বলেনি - 'যোগাযোগ রেখো' বা চেয়ে নেয়নি ঠিকানাটা। তখন তো চিঠির যুগ মোবাইল এসেছে সদ্য। আজকের মতন স্মার্টফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ছিল না।
অংশুদা কি চাকরি করছে? অংশুদা কি বিয়ে করেছে? হাজারো উত্তর হীন প্রশ্ন ভীড় করে আসে মগজে। পরক্ষণে ভাবে, এ কি ভাবছি আমি? কেন বিয়ে করবে না? সে তো বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে। তার তো কোনো অসুবিধা হয়নি। সে নিশ্চিত আজ যদি 'বনলতা সেন' না খুলতো, তাহলে আজও মনে পড়তো না। উপহারটা নেবার সময় ফিরতি উপহার হিসাবে অংশুদার হাতটা শক্ত করে ধরলে কি হতো?
রক্ষণশীল বাবা রুষ্ঠ হতো। হতো হতো।
মা কাঁদত। কাঁদত কাঁদত।
তাই বলে … ?
আসলে হিসেবী মধ্যবিত্ত মা-বাবার মেয়ে তো! তাই নির্লিপ্তের মত অংশুমানকে চলে যেতে দিয়েছিল। কিন্তু যখন ইউনিভার্সিটির বাসটা চোখের আড়াল হয়ে গেল তখন হাতে ধরা বইটা হঠাৎ উত্তাপ সঞ্চার করতে শুরু করল হাত থেকে পায়ে মাথায় ধীরে ধীরে সারা শরীরে। সে বেশ বুঝতে পাড়লো ভিতরটা যেন পুড়ছে। যেমন আজ পুড়ছে। সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছে সেদিনের ক্ষনিক শূন্যতার কারণ।
অংশুমানের সাথে চলে গেছে আগামীর স্বপ্ন। রমা এম.এ. তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। মা-বাবার পছন্দে ব্যাংকের ম্যানেজার স্বামী আর শাশুড়ির গোছানো সংসার পেয়েছে। স্বামী সারাদিন অফিসে থাকে, মাঝে মাঝে ছুটির দিনেও তাই রমাও বায়না করে সারাদিন সেও একা বাড়িতে বসে থাকবে না। বৌমার চাকরিতে শ্বশুরের আপত্তির সাধারণ নিয়মকে অগ্রাহ্য করেই রমার স্বামী তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। রমা স্থানীয় গার্লস স্কুলে শিক্ষিকা। তাদের ঘরে নতুন সুখ এসেছে। শ্বশুর মারা গেছে চার বছর। সেই থেকে শাশুড়ি গ্রামের পাট চুকিয়ে তাদের সঙ্গেই থাকে। যদিও বড় ছেলে মাকে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু বড় বউয়ের আচার আচরণ নাকি খুব ভদ্র নয়, তাই ছোট ছেলের কাছে থাকেন। নাতনিকে নিয়ে কেটে যায় সময়। তাতে রমার একটু সুবিধাই হয়েছে শাশুড়ির কাছে মেয়েকে রেখে সে নিশ্চিন্তে স্কুল যেতে পারে। ইচ্ছে মতো বাইরে যেতে পারে।
তপন, রমার স্বামী ঘরকুনো, অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় বিশেষ জরুরী কাজ না থাকলে বাইরে বেরোয় না। আপাত অর্থে সুখ-স্বাচ্ছন্দ যাকে বলে, রমার সবই আছে। আপাত অর্থে কেন? বাস্তবিকই সে সুখী! জীবনে দুঃখের লেশমাত্র নেই। দুঃখের ছায়াহীন নিরবিচ্ছিন্ন সুখের সাগরে ভাসমান জীবনে এরকম টুকরো স্মৃতির হালকা ব্যথার মোচড় বেশ উপভোগ্য হলেও, আজ তার মনে হচ্ছে যেন গোটা জীবনটাই মিথ্যা হয়ে গেল। সে কি অংশুদাকে ঠকালো? নাকি নিজেকে?
এমন সময় রান্নাঘর থেকে শাশুড়িমার ডাক শোনা যায় - "রমা, একবার এদিকে এসো তো মা।"
শাশুড়ির ডাকে রমা ধাক্কা খায়, স্মৃতির তর্পন মাঝপথে থামিয়ে বাসায় ফেরে গোধুলীর পাখির মতো। সে বুঝতে পারে না, কেন বনলতা সেন হাতে করে আলমারির সামনে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে? সে ভুলে গেছে, কি জন্য আলমারি খুলেছিল? রমা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে,
—"যাই মা।" বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
—"কোথায় ছিলে ?"
—"এই তো মা।"
—"দেখো না। লতার মাকে এঁচোড় কাটতে দিয়ে আমি একটু তুতুর কাছে গেছি, অমনি বারান্দা থেকে হাঁক পেড়ে দিলো। 'জেঠিমা হয়ে গেছে চললাম', বলে চলে গেল! দেখো কেমন মোটা মোটা করে কেটেছে।"
—"ঠিক আছে মা, আমি সাইজ করে নিচ্ছি।"
—"তোমাকে আগেও বলেছি, কাজের লোককে মাথায় তুলো না। তুমি বাড়ি থাকলেই এমন করে।"
—"ঠিক আছে মা ,আমি না থাকলে এমন করে না তো ?"
—"না, তা করে না।"
—"মা আপনি জানেন তো লতা এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।"
—"তা জানি। তা বলে কাজে ফাঁকি দেবে।"
—"আমিই বলেছি , আমি যে দিন বাড়িতে থাকবো সে দিন ও যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যায়।"
মা আর কিছু বলে না।
অন্য দিন পৌনে ন'টার মধ্যেই রান্না হয়ে যায়। আজ রমার ছুটি তাই রমা ভেবেছিল মাকে রান্নাঘর থেকে ছুটি দিয়ে নিজেই সব রান্না করবে। ছুটি থাকলে বেশিরভাগ দিনই তাই করে, কিন্তু আজ আর ভালো লাগছেনা তাই রমা মাকে বলল - "মা আমি এঁচোড়টা করবো। আপনি অন্য গুলো করুন। আমি মেঘনাকে খাইয়ে দি।"
কোনো রকমে শাশুড়ির হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে শোবার ঘরে গিয়ে দেখে খাটে বসে খেলতে খেলতে মেঘনা ঘুমিয়ে গেছে। রমা তাকে জাগালো না। আবার পাশের ঘরে গিয়ে আলমারির দরজাটা বন্ধ করল সবকিছু যথাস্থানে রেখে শোবার ঘরে গিয়ে ফ্যানের গতিটা বাড়িয়ে দিল। তাতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর সারা দেহ মনে এক নিদারুণ অস্বস্তি যেন ভর করে আছে। রমা শুয়ে পড়ে ভাবতে থাকে, কিবা অসুবিধা হতো যদি অংশুদার চলে যাওয়াটা সে আটকাতো, যদি তার কাছে সারা জীবন ধরে রাখতে পারতো, নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, যা হবার নয় তা হয়নি। তার জন্য দুঃখ পাবার কি আছে? কিন্তু মন কি মানে? মন যে দুঃখ পাচ্ছে। জীবনের এমন এক পর্যায়ে এসে তার মনে পড়ল, যখন অংশুদার জন্য করার কিছুই নেই। তাহলে এই সাত বছরের হাসিখুশির জীবন কি মিথ্যা অভিনয়? না মিথ্যাও নয় অভিনয়ও নয়। সে বোঝে আসলে সে সুখী নয় সুখের মুখোশ আর বৈভবের প্রাচুর্যে আড়াল করে রেখেছে দুঃখকে।
শৈশব, কৈশোর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি, বিবাহ, স্বামী-সন্তান, অর্থ, আপাত সুখ, জীবনের এই সব কিছুর বাইরে একটা সত্য থাকে। কেউ স্বীকার করে, কেউ করে না। যারা করে তারা যেমন কষ্ট পায়, যারা করে না তারাও কষ্ট পায়। রমা মেয়েটার দিকে চায় নিষ্পাপ সরল একটা মুখের ছবি যেন এক মায়া জাল বিস্তার করে বসে আছে। এ মায়া কি জীবনের মায়া, নাকি ব্যক্তি মানুষের মায়া। তাই যদি হয় তবে অংশুদার প্রতি তার কেন কোন মায়া জন্মায়নি। হয়তো জন্মেছিল সে সেদিন স্বীকার করেনি, করতে চায়নি। সে ভাবে আসলেই ভালোবাসা বলে কিছু হয়? আমরা যাকে ভালোবাসা বলি তাতো এক প্রকার 'শর্তহীন আত্মসমর্পণ'। অসম্পূর্ণ নিজেকে অন্যের পূর্ণতার বেদীমূলে অর্পণ করা। আর প্রেম সে তো আকাঙ্খার পূরণ মাত্র। সেদিক থেকে দেখলে দুটোর কোনটাই তার জীবনে ঘটেনি। তাহলে তখন থেকে মন খারাপের মেঘলা আকাশ, বুক ফাটা না হলেও অংশুমানের জন্য ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এগুলোর কি মানে? হাজারো চেষ্টা করেও কোনো মানে খুঁজে না পেয়ে ঝঞ্ঝা বিধ্বস্ত হৃদয়টা গড়িয়ে পরে মেয়ের স্পর্শে। হাত বাড়িয়ে খামচে ধরে ব্লাউজ।
কতক্ষন এমন ভাবে কেটেছে সে জানে না। কানে আসে মায়ের ডাক।
— "আমার হয়ে গেছে, তুমি স্নান করে নাও গে যাও।"
রমা সাড়া দিতে চায় কিন্তু পারে না তার অবশ শরীর বিবশ মন যেন হাতের নাগালের মধ্যে নেই। শুধু টেরপায় মেয়েটা উঠে এসেছে হাতের উপর। কোনোরকমে চোখ খুলে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। সে ভয় পায়। তার মনে হয় মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে, না। মেয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। তাহলে সে কি ভুল দেখলো? না সে স্পষ্ট দেখেছে মেঘনা তার দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসছিল। সে হাসিতে ঠিক আনন্দ নয়, উত্তেজনা নয়, অন্য কিছু একটা ছিল? নাকি সে নিজেই নিজেকে দেখেছে? বুঝে উঠতে পারে না রমা। তার সাড়া না পেয়ে শাশুড়ী পায়ে পায়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পর্দাটা সরিয়ে চমকে যায়, রমার ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টিতে বিহ্বল হয়ে পরে।
— "একি! কি দেখছো অমন করে?"
রমা খনিক স্তম্ভিত থেকে নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে উত্তর দেয় —"না, কিছু না। এমনি, দেখুন না মা, কেমন দুষ্টু মেয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসছে।" বলে প্রসঙ্গটা পাল্টাতে এবং নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করল। আলতো করে মেয়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে গেল। স্নানের বদলে শুধু কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে। এতদিন যে বাথরুম ছিল তারা একান্ত নিভৃত যাপনের সবথেকে পছন্দের জায়গা। বিরাট এই পৃথিবীর ভিতর বালুকণা সম একমাত্র নিজস্ব জায়গাটাও আজ বন্দিশালা মনে হয়। খেতে বসেও খেতে পারে না।
মা বলে, — মেঘনা কে একটু জাগাও খাইয়ে দিই। রমা ভয় পায়। তার মনে হয় মেয়ে যদি পড়ে ফেলে মায়ের মনের গোপন সব অন্ধিসন্ধি কথা। তাহলে কি হবে! সে তাড়াতাড়ি করে বলে,— না থাক, আর একটু পরে জাগাবো। রমার চোখে মুখে ত্রস্ত ভাব মাকে চিন্তিত করে বলে, —তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? কি হয়েছে বলতো, দু-তিনবার না ডাকলে শুনতে পাচ্ছ না, তুমি কিছু ভাবছো। বলেই মাতৃসুলভ স্বভাবিকতায় বাম হাতটা রমার কপালে ছোঁয়। 'নাহ ! একদম ঠান্ডা!'
— তাহলে খোকাকে অফিসে একটা ফোন করে দিই, তুমি বরং ডাঃ চক্রবর্তী চেম্বারে চলে যাও। খোকা অফিস থেকে ফেরার পথে তোমায় নিয়ে আসবে।"
— আপনি অযথা উতলা হবেন না মা, তেমন কিছুই না। একটা দরকারি কাগজ খুঁজে পাচ্ছি না তাই আর কি। কিন্তু বলতে পারল না দরকারি কাগজটা খুঁজতে গিয়ে জীবনের কোন অনাবিষ্কৃত সত্য নাকি সংশয়! আবিষ্কার করেছে সে, যার জন্য তার এই আংশিক অসংগতিপূর্ণ আচরণ।
— কাগজটা কি খুব দরকারি? আমি খোকাকে বলে দেবো, যেন বকাবকি না করে। তুমি তুতুকে একটু খাইয়ে আমার কাছে দিয়ে বিশ্রাম নাও।
— না মা, তেমন নয়, আর আপনার ছেলে কি কোনদিন বকাবকি করে? ওটা আমারই দরকার, এখন পাচ্ছিনা, পরে ঠিকই পেয়ে যাব। মাঝে মাঝে হয়না? আসলে সে ভুলে গেছে কি খুঁজছিল।
— এরকম হলে চোখ বন্ধ করে মনে মনে তিনবার বলতে হয় 'সবার ভালো হোক'। এতক্ষণে রমা মায়ের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকায়, আবার আজগুবি গল্প বলা শুরু হবে দুষ্টু আত্মা আর ভালো আত্মায় ভরে আছে পৃথিবী। আমরা দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু তার আছে আমাদের ঘিরে আমাদের চারিপাশে। দুষ্টু আত্মা আমাদের চোখে বিস্তার করে মায়াজাল। চোখের সামনেই থাকে তবুও দেখতে পাওয়া যায় না, রয়ে যায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সকলের মঙ্গলকামনা করলে ভালো আত্মা মায়াজাল ছিন্ন করে দেয়। চোখ খুললেই দেখবে যেখানের জিনিস সেখানেই পরে আছে। এ গল্প মায়ের মুখে অনেক বার শুনেছে। শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গেছে, সে শুধু ভেবেছে ভালো যে আত্মা সে ত ভালো কাজই করবে তার জন্য সবার মঙ্গলকামনা করতে হবে কেন? তাও আবার তিনবার!
রমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মা উঠে যায় নিজের ঘরে। রমা মেয়েকে খাইয়ে মা'র কাছে দিয়ে আসে। কাগজ কলম নিয়ে বসে, কিন্তু অনেকক্ষণ ভাববার পর যখন একটাও শব্দের জন্ম হলো না। আঁকিবুকি কাটল কাগজে, ভাবল সব অনুভূতির প্রকাশ বোধহয় ভাষায় হয় না। তাকে শুধু জপ করতে হয় মনের ভিতরে, তাই বা কেন? তার তো কথা আছে, সে তো প্রকাশ করতে পারে আনন্দ-বেদনার ভাষা। তাহলে আজ কেন পারছে না? অক্ষম অক্রোশে সাত সতের আঁকিবুকি ভাবতে ভাবতে গলিত মগজ গড়িয়ে পরে বিছানায়। একটু যেন তন্দ্রা এসেছিল। স্বপ্নের ভিতর একটা ছায়া তার কাছে আসে, সে একা, শুধু একা, বিরাট এই পৃথিবী যেন এক জনশূন্য ধু-ধু দিগন্ত বিস্তৃত মরু, নির্বাক আর বধির। সে সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করছে কিন্তু স্বরতন্ত্রীতে কোনো ধ্বনির জন্ম হচ্ছে না।
এমন সময় ছায়া কথা বলে, ভয় পেয় না, আমি তোমার অস্তিত্ব যাকে তুমি খোঁজো। আমি সবার জীবনে মায়াবী অন্বেষণ এক বিন্দু আলো। আমি আপনি আপনার মাঝে আসি, শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে লক্ষ কোটি আলোক বিন্দুর সংযোজন ঘটিয়ে আলোকিত করি আপনারে। তাইতো বলি, আপনার আলোকে উদ্ভাসিত হও। আপনারে আবিষ্কার করো আপনার মাঝে।
________________
এস. আজাদ (সেখ মহঃ সানি আজাদ)
শিবপুর দীঘিরপাড়, পোস্ট - রাজবাটী,
জেলা - পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ৭১৩১০৪