স্মৃতিকথা ।। অজ্ঞাতকুলশীল ভরত কথা ।। সমীর কুমার দত্ত
0
July 01, 2025
অজ্ঞাতকুলশীল ভরত কথা
সমীর কুমার দত্ত
মানুষ যতদিন বাঁচে তার স্মৃতি বলে একটা জায়গা থাকে। সেই জায়গায় তার দেখা শোনা কতো ঘটে যাওয়া ঘটনা মজুত থাকে। জীবন সায়াহ্নে এসে সে সেই সব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে দাগ কাটার মতো কতো ঘটনাই না বেরিয়ে আসে। আবার হঠাৎই কতো ঘটনাই না ভেসে ওঠে আমাদের স্মৃতির ক্যানভাসে। আমরা কতো নামী,অনামী মানুষের কথা লিখি কিন্তু অবহেলিত, অপদার্থ, নিরক্ষর কোন মানুষের কথা বড়ো একটা লিখি না। আজ সেরকম একজনের কথা আমার স্মৃতিপটে উঁকি ঝুঁকি মারে, যা আজকের এই কর্মব্যস্ততার ন্যায্য পাওনা বুঝে নেওয়ার যুগে না বললেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যেতে হবে।
ছোটবেলা থেকে দেখা এক অবহেলিত, কায়িক পরিশ্রমী, অজ্ঞাতকুলশীল ও শোষিত- বঞ্চিত মানুষের প্রতিভূ এই মুহুর্তে চক্ষুর সন্মুখে উদ্ভাসিত। আমাদের এক প্রতিবেশীর একটা ছোটখাটো হোটেল ছিলো। সেই হোটেলে যতো জল লাগতো সবই একটা ড্রামে সে দু হাতের বালতি দিয়ে ভরে যেতো। ওইটিই তার পেশা ছিলো। আমি যখন তাকে দেখেছি তখন সে পঞ্চাশোর্ধ। নাম তার ভরত। নিজের পদবী নিজেই জানতো না। জিজ্ঞাসা করলে বলতো, "জানি না।" তা সারাদিনে বিভিন্ন লোকের কাছে কাজের হিসাবে প্রত্যহ পঞ্চাশেরও বেশি বালতি জল সে অতি- অনতিদূরত্বের টিউবওয়েল টিপে বহে আনতো। তখন টাইম কলের জল ছিলো না। তা তখনকার সস্তা গণ্ডার বাজার দরে যদি হিসেব করা যায় তবে একবারে দু বালতি জল বহে আনতে দু পয়সা বালতি হিসাবে পঞ্চাশ বালতির জন্য পঁচিশ আনা অর্থাৎ ষোল আনায় এক টাকা হলে এক টাকা নয় আনা হয়। তখন ট্রামের বা বাসের ভাড়া ছিলো এক আনা। তখন এক টাকার বাজার করলে বুড়ো বাচ্চা মিলিয়ে পাঁচ -ছয় জনের একটা সংসারে মাছ সহ কাঁচা আনাজ মিলতো। তাহলে ভরতের জল তুলে যে আয় হওয়ার কথা তাতে ওর মতো এক জনের সংসারে খরচ করেও হাতে কিছু থেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হতো না। আর তাই সে ছিলো পথের ভিখারি।
ক অক্ষর গোমাংস এই মানুষটি শুধুমাত্র শ্রমকে সম্বল করে কারোর বাড়ির বাইরের রোয়াকে শুয়ে যার রাত কাটে, তাকে সামর্থ্যবান মানুষ ঠকিয়ে কিভাবে শ্রম নিঙড়ে নিয়েছে, তা তখন বোঝার মতো আমার বয়স হয়নি। বিনিময়ে কেউ দয়া পরবশ হয়ে তাকে এক পেট খাবারও অফার করেনি। আর তারও কারো দেওয়া খাবার হাত পেতে নেওয়ার অভ্যাস ছিলো না। নিরক্ষর,অসহায় হওয়া সত্ত্বেও ন্যূনতম আত্মসম্মান বোধটুকু ছিলো। ও কারো ঘরে ঢুকতো না। কেউ এক গেলাস চা দিলে বাইরে দাঁড়িয়ে খেতো। শুধু কি তাই। সঙ্গে থাকতো কাগজে মোড়া লবণ। সারাদিনে পঞ্চাশ বালতি জল তুলে গা গতরে ব্যথা হয়ে যেতো। এই ব্যথা দূর করতে গরম চায়ের সঙ্গে লবণ গুলে খেতো । তাতে ব্যথা কতটা কমতো জানি না। কারণ কমলে লোকে আর ব্যথার ট্যাবলেট খেতো না। তবে কিছুটা তো কমতো নিশ্চয়ই। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার লবণটা গুলতো ও রাস্তা থেকে নোংরা একটা কাঠি তুলে গায়ে মুছে নিয়ে সেটা দিয়ে। শুধু কি তাই রাস্তা থেকে কারো উচ্ছিষ্ট পোড়া বিড়ির নিম্নাংশ তুলে ধূমপান করতো। দিনের পর দিন তাই করেছে। কিন্তু কখনও এক সর্দি কাশি ছাড়া অন্য কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয় নি। কখনও চায়ের সঙ্গে বিস্কুট ছাড়া আলাদা করে টিফিন খেতো না। দুপুর বেলা যে রোয়াকে ও আশ্রয় নিয়েছিলো সেখানে দুটো ইঁটের ওপর মালসায় চাল আলু চড়িয়ে তলায় গাছের ডালপালা জ্বালিয়ে সিদ্ধ ভাতে ভাত খেতো। রাতের বেলায় কোন হোটেলে বিনা পয়সায় জল তুলে দিয়ে যে খান কতক রুটি তরকারি পেতো , তাই খেতো । কি শীত কি গ্রীষ্ম খালি গায়ে শুধু মাত্র হাঁটুর ওপর কাপড় পরে কাটিয়ে দিতো। সবচেয়ে বড়ো কথা ও কোন দিন জুতো পায়ে দেয় নি। সর্বদা খালি পায়ে থাকতো।এই যার জীবনযাত্রা , তার আয়ের কিছু অংশ তো বাঁচতোই বাঁচতো। কিন্তু তা হতো না। কারণ লোক ওকে হিসেব ভুল বুঝিয়ে পয়সা মেরে দিতো। একপ্রকার বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এ রকম একজন মানুষকে নিয়ে পাড়ার বখাটে ছোকরারা হাসি, মস্করা করতো। কেউ প্রতিবাদ করতো না। যে কারোর ব্যাপারে থাকে না, তাকেও এভাবে সামাজিক দুর্ব্যবহারের শিকার হতে হতো। কোথায় ওর জন্ম, কোথা থেকে ওর আগমন কেউ জানে না। অনেকে মনে করতো ও পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসেছে হবে। কিন্তু না, ওর মুখের ভাষা সম্পূর্ণ এ দেশের। পূর্ববঙ্গের ভাষার কোন টান নেই। স্বভাব চরিত্র খুব ভালো
ছিলো। কখনও কারোর জিনিস ও ধরেও দেখতো না।
ভরত কথা যে সময়ের ঘটনা তখন উড়িষ্যা থেকে কর্মের সন্ধানে আগত ব্যক্তিরা,যারা সাধারণত কল থেকে বাঁকে করে জল তুলে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করার কাজে কিংবা বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজে নিযুক্ত থাকতো । তারা একটি পয়সা কম নিয়ে এ সব কাজ করতো না। ন্যায্যমূল্য নিয়ে অর্থ উপার্জন করে , এখানে অনেক জন একসঙ্গে থেকে, খেয়ে দেশের বাড়িতে টাকা পাঠাতো। তখন এখানে তাদের পরিচয় ছিলো যথাক্রমে 'ভারী' ও 'ঠাকুর' । ভরতের এ সব কোন ব্যাপার ছিলো না। ভরতের কোন পিছুটান ছিলো না। একটা পেট সে যেমন তেমন করে চালিয়ে দিতো। ভরতের কাঁধে বন্দুক রেখে অনেকেই নির্দয়ভাবে তাদের জল তোলার কাজটা বাগিয়ে নিতো। জীবনকে অবহেলা করা এই ব্যক্তিটিকে বড়ো একটা অসুস্থ হতে দেখিনি। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ষাটোর্ত্তীর্ণ ভরত বাইরের সেই রোয়াকে এক দিনের জ্বরে দেখার কেউ না থাকার কারণে অবহেলায় মাথায় রক্ত উঠে ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলো।যারা ওর পিছনে লাগতো তারাই ওর সৎকার করেছিলো। অজ্ঞাতকুলশীল, শ্রম শোষিত হারালে খুঁজতে নেই, মরলে কাঁদতে নেই , এমন একজনের স্মৃতি কথা লেখাটা কিছুটা হলেও তার আত্মাকে শান্তি দেবে নিশ্চয়ই।
ছবিঋণ - ইন্টারনেট
=======================
Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra