গল্প ।। অসম প্রেম ।। গৌতম সমাজদার
0
September 01, 2025
অসম প্রেম
গৌতম সমাজদার
মনিরুল দশম শ্রেণীর ছাত্র, রুনা অষ্টম শ্রেণী। একই মাদ্রাসায় একই বিদ্যালয়ে পড়ে। রুনার হাত থেকে বই পড়ে যাওয়ায় মনিরুল তা মাটি থেকে তুলতে সাহায্য করলে রুনা ধন্যবাদ জানায়। Love at first sight এ পড়ে যায় মনিরুল। একদিন আলাপও হয়। ওই কিশোর বয়সেই ওরা একে অপরের ভালবাসায় পড়ে যায়। দুজনে দুজনকে চোখে হারায়। ক্রমশঃ দুজনে দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারে না। মনিরুল বেশ অবস্থাপন্ন, স্বচ্ছল ঘরের ছেলে। তুলনায় রুনা সাধারণ পরিবারের মেয়ে। লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করাও কঠিন। তাই মনিরুল একদিন বলে, "রুনা চল, আমরা স্বাদী করে নিই।" রুনা বলে, "সে কি? তুমি আমি দুজনেই কম বয়সী। তাছাড়া তোমার চাকরি নেই। এখনই এটা কি সম্ভব? চল, আজ তোমাকে আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।" মনিরুল বলে, "হ্যাঁ, সে তো যাওয়াই যাবে। যেতেও চাই। তবে তোমায় একটা কথা বলি। আমি কিন্তু কোন মূল্যেই তোমাকে হারাতে চাই না, এটা মনে রেখ।" রুনা বলে, "আমিও তো তোমাকে হারাতে চাই না। তোমায় ছাড়লে আমিও বাঁচব না।" দুজনে গেল রুনার বাড়ি। রুনার মা ওকে সরবত দিল। মনিরুল আসলে রুনার মাকে বোঝাতে এসেছে এবং বলেও ফেলে, "আমি কিন্তু রুনাকে বিয়ে করব।" রুনার মা বলে, "বাবা মনিরুল, এখনো তোমরা ছোট। পড়াশোনা কর। তারপর আমার রুনাকে ভালবাসলে নিশ্চয়ই ঘর বাঁধবে। তবে তোমার বাবা মাকেও তো রাজি থাকতে হবে।" মনিরুল বলে, "তা তো বটেই"। এভাবে আরো কিছুদিন কাটলে মনিরুল উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে। রুনাও মাধ্যমিক ভালভাবে উত্তীর্ণ হয়। একদিন গঙ্গার ধারে দুজনে দেখা করে লুকিয়ে। রুনা বলে, "আমার মাকে তো ভালই পটিয়েছ। মা তোমায় খুব পছন্দ করে, স্নেহ করে। কিন্তু তোমারও তো তোমার বাবা মাকে রাজি করাতে হবে।" মনিরুল বলে, "বাবাকে বলেছি, বাবা রাজি। মাকে নিয়েই চিন্তায় আছি। কিন্তু আসল কথা, রুনা, আমি আর তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। আজই মাকে জানাব। দেখি কি হয়।"
রাতে খাবার টেবিলে মনিরুল মাকে বলে, "মা, আমি রুনাকে বিয়ে করব। তুমি না বলো না।" মা হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে বলে, "এটা কিছুতেই হবে না। ওদের সঙ্গে আমাদের কোন মিল নেই। এটা আমি হতে দেব না।" মনিরুল বলে, "মা, আমার আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমি রুনাকে ভালবাসি। বিয়ে করলে ওকেই করব।" মা বলে, "মনি, আমি তোকে সুন্দরী মেয়ে দেখে সাদী দেব। মন খারাপ করিস না।" "না মা, এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়", মনিরুল বলে। "আমার কথা না শুনলে নিজে রোজগার করে বউকে খাওয়াবি।এই সংসারের পয়সায় নয়", মা বলে। মনিরুল বলে, "সেই শর্তেও রাজি। আমি রোজগার করব।" এরপর মনিরুল কাজের খোঁজে থাকে, পেয়েও যায়। অফিসে থেকেই কাজ শুরু করে। এর মধ্যে একদিন রুনার বাড়িতে এসে দেখা করে বলে, "রুনা, মা মেনে নিচ্ছে না। কিন্তু আগামী মাসে শুক্রবার তোমাকে আমি তোমাদের বাড়িতে এসেই বিয়ে করব। তোমার আপত্তি নেই তো?" রুনা বলে, "তুমি যা চাইবে তাই হবে। আমিও তোমার সাথে বাকি জীবন কাটাতে চাই।" এরপর মনিরুল পরদিন সকালে আবার কাজের জায়গায় চলে যায়। এরপর বেশ কয়েকদিন যোগাযোগ ছিল না। বাংলা জুড়ে একটানা বৃষ্টি। ক্রমশঃ নদীর জল বাড়তে থাকায় বন্যা দেখা দিল। চারদিকে থৈ থৈ জল। প্রশাসন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। রুনা ভাবল, বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। চারদিকে জল, মেঘ ভাঙা বৃষ্টি চলছে। মনিরুলের আসার কোন সম্ভাবনা নেই। কারোর পক্ষেই এই আবহাওয়ায় আসা সম্ভব নয়। এদিকে মনিরুল ভাবে, যত কষ্টই হোক, যেতে হবে। নাহলে ওর মন ভেঙে যাবে। আমার প্রতি বিশ্বাস হারাবে, বিশ্বাস হারাবে ভালবাসা। ফোন করে জানানো যাচ্ছে না। কোথাও ফোন কাজ করছে না।
বিয়ের দিন সকাল, অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে, জল ক্রমশঃ বাড়ছে। মন খুব খারাপ। বহুদিন মনিরুলকে দেখেনি। তারপর একটি বিশেষ দিন। এরকম পরিস্থিতি, ওর হঠাৎই জানালা থেকে নজর পড়ল, একটি মানুষ জলে ভেসে আসছে। মাথাটা দেখা যাচ্ছে। আরো কাছে আসতে বুঝল, একটা টিউবে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে মনিরুল টিউব থেকে বেরিয়ে রুনার উঠোনে, সবাই অবাক। এও কি সম্ভব! রুনা বোঝে, ও ভীষণ ক্লান্ত, অবসন্ন। ওকে ঘরে নিয়ে গেল। জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ল মনিরুল। কিছু বাদে রুনা বলল, "এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে জীবন বাজি রেখে কেন এলে? বিয়েটা তো পরে করলেও হতো। জীবন তো আগে।" মনিরুল বলল, "তাহলে তো ভালবাসা, বিশ্বাস, আস্থা হারাতো।" সে রাতেই রুনাকে বিয়ে করে। পরের দিন রুনা নিজের প্রিয় 'কোরান' গ্রন্থ নিয়ে মনিরুলের বাড়িতে গেলে ওর মা বেরিয়ে এসে ঢুকতে বারণ করল ঘরে। এক হাতে ঝাঁটা নিয়ে রুনাকে মারতে লাগল। মনিরুল অবাক হয়ে দেখছে। রুনার বুকে চেপে ধরা কোরান দেখার পরেও মা রুনাকে ঝাঁটা দিয়ে এভাবে বার করে দিচ্ছে।
বিয়ের দিন সকাল, অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে, জল ক্রমশঃ বাড়ছে। মন খুব খারাপ। বহুদিন মনিরুলকে দেখেনি। তারপর একটি বিশেষ দিন। এরকম পরিস্থিতি, ওর হঠাৎই জানালা থেকে নজর পড়ল, একটি মানুষ জলে ভেসে আসছে। মাথাটা দেখা যাচ্ছে। আরো কাছে আসতে বুঝল, একটা টিউবে ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ বাদে মনিরুল টিউব থেকে বেরিয়ে রুনার উঠোনে, সবাই অবাক। এও কি সম্ভব! রুনা বোঝে, ও ভীষণ ক্লান্ত, অবসন্ন। ওকে ঘরে নিয়ে গেল। জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়ল মনিরুল। কিছু বাদে রুনা বলল, "এরকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে জীবন বাজি রেখে কেন এলে? বিয়েটা তো পরে করলেও হতো। জীবন তো আগে।" মনিরুল বলল, "তাহলে তো ভালবাসা, বিশ্বাস, আস্থা হারাতো।" সে রাতেই রুনাকে বিয়ে করে। পরের দিন রুনা নিজের প্রিয় 'কোরান' গ্রন্থ নিয়ে মনিরুলের বাড়িতে গেলে ওর মা বেরিয়ে এসে ঢুকতে বারণ করল ঘরে। এক হাতে ঝাঁটা নিয়ে রুনাকে মারতে লাগল। মনিরুল অবাক হয়ে দেখছে। রুনার বুকে চেপে ধরা কোরান দেখার পরেও মা রুনাকে ঝাঁটা দিয়ে এভাবে বার করে দিচ্ছে।
মনিরুল মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। মনিরুলের বাবা চেষ্টা করলেও ফল হল না। মনিরুল ধীর পায়ে রুনাকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল। রুনার বাড়িতে এসেই উঠল। কয়েকদিন মন খারাপ নিয়ে দিন কাটল। মনিরুল বলল, "জানো রুনা, মা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, ভাবতেই পারছি না।" রুনা উত্তরে বলে, "মন খারাপ কর না। আল্লা নিশ্চয়ই আমাদের ভাল দিন আনবে। ধৈর্য্য ধর।" মনিরুল কাজের জায়গায় চলে যায়। কয়েকদিনের মধ্যেই খবর পায়, রুনা মা হতে চলেছে। আনন্দে ভরে উঠল মন। রুনাকে বলল, "নিজের আর আগত সন্তানের প্রতি নজর দিও। ভাল করে থাকা খাওয়া কর। আমাদের বাচ্চার যেন অসুবিধা না হয়।" কিছুদিন এভাবে কাটার পর সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার দিন এসে গেল। ও ছুটি নিয়ে রুনার বাড়িতে এল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কন্যা সন্তানের জন্ম হল। কিন্তু হঠাৎই রুনার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটল। চিকিৎসকদের সব রকম চেষ্টার পরেও রুনাকে আল্লা নিজের কোলে টেনে নিল। মনিরুল একদম ভেঙে পড়ল। কি করে ও বাঁচবে? বাচ্চা কে মানুষ করবে? পাগলের মত অবস্থা হল। মরে যেতে ইচ্ছে হল। আবার ভাবল, রুনার উপহারকে বড় করতে হবে। একদিন উদ্ভ্রান্তের মত নিজের বাড়ি গেল। মাকে বলল, "তোমার শত্রু তো আর নেই। এবার নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তো বাঁচাতে হবে। তুমি একটু আমায় সাহায্য কর।" মা কিছুতেই রাজি হল না। বলল, "তুই এই বাড়িতে থাকতেই পারিস। কিন্তু বাচ্চা ঢুকবে না।" মনিরুল বলল, "এ কি বললে মা, এই আল্লার পবিত্র সৃষ্টি কি অপরাধ করেছে? তাহলে আমারও বাড়ি থাকা হল না।"
আবার রুনার বাড়িতে গিয়ে নানীকে দায়িত্ব দিল বাচ্চাটাকে দেখভালের জন্য। যে ঘরটায় রুনা থাকত, কত স্মৃতি, কত মধুর মুহূর্ত কাটিয়েছে। একটা একটা আসবাবপত্র স্পর্শ করে রুনার স্পর্শ খুঁজল। রুনার মাথার বালিশে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদল। ঠিক করল, আর না, এই পৃথিবীটা ওর জন্য নয়। ঠিক করল, আর রাখবে না এই জীবন। ক্ষমা চাইল রুনার কাছে। চিঠি লিখল, নানী যেন সুন্দরভাবে রুনার সন্তানকে মানুষ করে আর রুনার সমাধির পাশে যেন ওর সমাধি করা হয়। সকালে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল মনিরুলকে। পাশে ঘুমের ওষুধের শিশি। ওর মা এল, ছেলেকে যাতে ওর বাবার সমাধির পাশে রাখা হয়, সেই দাবি করল। গ্রামের লোক ওনাকে মারতে উদ্যত হলে পুলিশ এল। বলল, মনিরুলের শেষ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে রুনার পাশেই সমাধিস্থ করা হবে। সেই ইচ্ছাই ভালবাসার অক্ষয় নিদর্শন হয়ে থাকল।
-------------------
Goutam Samajder, 22/86 Raja Manindra Road, kol-37