অণুগল্প ।। শহরের গোপন ক্ষুধা ।। সুচন্দ্রা বসু
0
September 01, 2025
শহরের গোপন ক্ষুধা
সুচন্দ্রা বসু
শহর কলকাতার বুকের ভেতর কত গোপন কাহিনি চাপা পড়ে আছে, কেউ খোঁজ নেয় না। কিন্তু এক বর্ষায় সেই চাপা ইতিহাস যেন ফিরে এলো।
বর্ষার দুপুর। শহরের এক ব্যস্ত মোড়ে জল জমে আছে হাঁটু সমান। গাড়িগুলো কচ্ছপের মতো ধীর হয়ে যায়, রিকশাগুলো কাত হয়ে ভেসে যেতে চায়। চারদিক জ্যাম, গরমে মানুষ বিরক্ত।
সন্ধ্যা নামছে। কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে হাঁটু সমান জল। লাল বাস কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যাপসা গরমে ছাতার নিচে মানুষ অস্থির। তখনই তিনজন মানুষ—এক বৃদ্ধ, দু'জন যুবক—জল কেটে রাস্তা পার হচ্ছিল।
হঠাৎই জমা জলের ভেতর অদ্ভুত এক ঢেউ উঠল। আকাশে বাতাস নেই, আশেপাশে বৃষ্টিও পড়ছে না। তিনজন যেন হু-হু করে ভেতরে টেনে গেল অদৃশ্য হাত।
মানুষের হাহাকার। "বাঁচাও! বাঁচাও!" কিন্তু কাকে বাঁচাবে? এক মুহূর্তের মধ্যে তিনজন মিলিয়ে গেল।লোকজনের চিৎকার শুনে পুলিশ ছুটে এলো,খবর দিতেই দমকল এলো, কিন্তু কিছুতেই তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না।
অদ্ভুত ব্যাপার—জল তো সামান্য, ড্রেনের কিছু উপরেই। হাঁটু সমান জমে থাকা জল অথচ তাদের যেন এক অদৃশ্য স্রোতে টেনে নেওয়া হলো।
এই খবর ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। পরদিন সব কাগজের প্রথম পাতায়— "রাস্তার জল কি গিলে খেল তিনজন মানুষকে?"
সাংবাদিক অনির্বাণ সেনগুপ্ত প্রথমে বিষয়টিকে নিছক গুজব ভেবেছিলেন। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজ হাতে পেতেই থমকে গেলেন। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—জলের ভেতর হঠাৎ ঘূর্ণি তৈরি হলো, তারপর তিনজন মানুষ ডুবে গেল। আরেকটা দৃশ্য আরও রহস্যময়—ক্যামেরার স্ক্রিনে ঢেউ ওঠার ঠিক আগে এক ঝাপসা ছায়া নড়ল।
অনির্বাণ লিখলেন— "এটা নিছক বন্যা নয়, শহরের বুকের ভেতর অন্য কোনো শক্তি নড়ছে।"
পুলিশ তদন্ত শুরু করল।তদন্তে বেরোলো—ড্রেনের ভেতর সেই রাতে তীব্র জলচাপ বা কোনো প্রবাহের রেকর্ড নেই।
ক্যামেরায় দেখা যায় শুধু হঠাৎ এক অস্বাভাবিক ঢেউ জমা জলের মধ্যে উঠল,
আর তিনজন মানুষ মিলিয়ে গেল।
পুলিশ বলল,এ নিয়ে লোককথা আছে। ওই রাস্তার মোড়ে একসময় পুরনো শ্মশান ছিল। সেই জায়গাটা পরে রাস্তা হয়েছে। মানুষ ফিসফিস করে—"শহরের জমা জল শুধু ড্রেনের নয়, কিছু ছায়া ক্ষুধা মেটায়।"
আজও যখন বর্ষায় সেই মোড়ে হাঁটু সমান জল জমে, লোকেরা ভয় পায়। ট্যাক্সিচালকরা বলে— "ওই পথে যাব না, জল জমে থাকলে গিলে নেবে।"
তিনজন নিখোঁজের কোনো হদিশ পাওয়া গেল না খবরটা কানে যেতেই পথ যাত্রীরা বলল—"জল এত গভীর নয় যে মানুষ ডুবে যাবে। ভেতরে টেনে নেওয়ার মতো কোনো স্রোতও নেই।"
এক বৃদ্ধ হকার, নাম তার হরু, বলল— "আমি চোখের সামনে দেখেছি। ওদের গায়ের সঙ্গে ছায়ার মতো কিছু লেপ্টে গেল। তারপর তারা গড়িয়ে পড়ল ভেতরে। আওয়াজ শুনলাম—ঘোঙানি।"
পুলিশ হাসল। "বুড়ো মানুষ বৃষ্টির রাতে হ্যালুসিনেশন করেছে।"
কিন্তু তদন্তে আরেকটা তথ্য বেরোল। কলেজ স্ট্রিটের ওই জায়গায় একসময় ছিল শ্মশানঘাট। উনিশ শতকের শেষে রাস্তা তৈরি হয়, দোকান গড়ে ওঠে। কিন্তু বয়স্করা বলত—ওই জায়গায় শান্তি নেই।
বর্ষা এলে এই শহর কেমন যেন অন্য চেহারা নেয়। আজও সকালের কাগজে খবর—"নগরীর ১২টি ওয়ার্ডে জলমগ্ন অবস্থা।" অফিসপাড়ায় গাড়ির চাকা ঘুরতেই চাইছে না। শহরের লোকেরা অভ্যস্ত, তবু বিরক্ত এবারের বৃষ্টি যেন অন্যরকম। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে একেবারে একই জায়গায়, কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে, হাঁটু সমান জল জমেই আছে কিছুতেই সেখানের জল নামে না। যাত্রীরা বলে— "এই মোড়টা অভিশপ্ত। জল যেন নামতে চায় না।"
এক সন্ধ্যায়, সেই জমা জলের ভেতরেই ঘটেছিল অবিশ্বাস্য ঘটনাটি।
সন্ধ্যা সাতটার সময় অফিসফেরত ভিড়। রাস্তার হকাররা তাড়াহুড়ো করে মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ছাতার নিচে মানুষ এঁটে যাচ্ছে।
বৃষ্টি ঝিরিঝিরি পড়ছে, কিন্তু জমা জল নামলো না। অন্য সব জায়গায় পাম্পিংয়ের জোরে জল নেমে গেছে, শুধু ওই মোড়ে হাঁটু সমান জল থেকে গেল। মানুষ এখন এড়িয়ে চলতে লাগল জায়গাটা। অটোচালকরা যাত্রী তুলে ওই পথে যেতে চায় না।
রাতে অনেকেই বলল, জলের ভেতর থেকে বুদবুদ উঠতে দেখা যায়, কখনো নীলচে আলো জ্বলতে দেখা যায়। কেউ বলে —"ওই তিন জনের মুখ দেখেছি, যেন তারা আতঙ্কে চিৎকার করছে।" কেউ বলল—" হ্যাঁ ওরা ওই তিনজন যারা নিখোঁজ।"
অবশেষে পুরসভা সিদ্ধান্ত নিল সেই জায়গায় ড্রেন খুঁড়ে পুরো নতুন করে নির্মাণ করবে।
পুরসভার মিস্ত্রিরা অবশেষে খননকাজ শুরু করল। দু'জন মিস্ত্রি ড্রেন খুঁড়তে নেমেছিল।
তারা যখন ইট তুলে জলের গর্তে নামল, আচমকা তাদের কণ্ঠস্বর আর পাওয়া গেল না। কী আশ্চর্য কিভাবে ওদের কন্ঠস্বর থেমে গেল।
কয়েক মিনিট পর কোনো শব্দ না পেয়ে সেখানে মানুষজন ছুটে গেলো।
গর্তে তাকিয়ে দেখা গেল—মিস্ত্রিদের কোন অস্তিত্ব তারা খুঁজে পেল না।
কিন্তু কয়েক মিনিট আগেই তাদের ওখানে কাজ করতে দেখেছিল। হঠাৎ খনন কাজের আওয়াজ শুনতে না পেয়ে মানুষ ছুটে গেছিলো দেখতে। এসে অবাক গর্ত ফাঁকা। দু'জন মিস্ত্রি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
এবার শহর থরথর করে কেঁপে উঠল। এটা আর নিছক গুজব নয়।
সাংবাদিক অনির্বাণ আরও খোঁজ শুরু করলেন। এক পুরনো নথি তাঁর হাতে এলো— ১৮৯৯ সালের এক পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছিল: "কলকাতার শ্মশানঘাটে রহস্যময় নিখোঁজ—বর্ষার রাতে মৃতদেহ ভেসে যায়, ফের পাওয়া যায় না।"
অদ্ভুত মিল! শতাব্দী আগে যে কাহিনি শোনা গিয়েছিল, আজও সেই ইতিহাস ফিরে এলো জমা জলে।
অনির্বাণ লিখলেন— "হয়তো শহর তার পুরনো অভিশাপ মুছতে পারেনি। রাস্তার ওপর জমা হওয়া জল শুধু ড্রেনের নয়, সেটা হলো অতীতের গোপন ক্ষুধা।"
এরপর থেকে শহরের মানুষ কলেজ স্ট্রিটের সেই মোড় এড়িয়ে চলতে শুরু করল। বর্ষা এলে আজও ভয় পায় সবাই। লোকেরা বলে— "জল কেবল জুতো ভিজিয়ে দেয় না, মাঝে মাঝে মানুষও গিলে ফেলে।"
আর সাংবাদিক অনির্বাণ? তিনি শেষ প্রতিবেদনে লিখেছিলেন— "শহরের প্রতিটি জমা জল শুধু নর্দমার ব্যর্থতা নয়, প্রতিটি ফোঁটার ভেতর আমাদের ইতিহাস জমা আছে। আর ইতিহাসের ক্ষুধা কখনো শেষ হয় না।"
এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায়, বৃষ্টির রাতে কেউ যদি সেই মোড় দিয়ে যায়, জলের ভেতর থেকে ফিসফিসানি ভেসে আসে— "আমাদের জায়গা দাও… আমাদের জায়গা দাও…"
রাস্তার জমা জল আর সাধারণ জল নয়— ওটা হলো শহরের গোপন ক্ষুধা।
================
২৬৭/ ৫ জি.টি.রোড
পানপাড়া শ্রীরামপুর হুগলি
পিন নং ৭১২২০৩