গল্প ।। ঈগলের থাবা ।। শঙ্কর প্রসাদ সরকার
0
September 01, 2025
ঈগলের থাবা
শঙ্কর প্রসাদ সরকার
শ্মশান মানেই নীরবতা। অথচ সেই নীরবতার ভেতরে হাজারো শব্দ লুকিয়ে থাকে।যারা নিরবতায় সময় অতিবাহিত করে তারাই জানে,নীরবতা নির্জনতা কখনো খালি হাতে ফেরায় না।শ্মশানে এখন পোড়া কাঠের টুকটুক আওয়াজ,বাতাসে উড়ে যাওয়া ভস্মের ফিসফিসানি,নদীর বুক চিরে আসা হালকা ঢেউয়ের স্রোত—সবকিছু মিলে যেন মৃতেরা কথা বলছে।
রাত তখন প্রায় অর্ধেক পার হয়ে গেছে। আকাশের বুক জুড়ে সাদা কুয়াশার চাদর।নদীর ধারে শুকনো কাশফুল নুয়ে পড়েছে হাওয়ার দমকে।ভেজা গাছের ডাল থেকে টুপটাপ জল পড়ছে।আর মাঝখানে শ্মশানের আগুন—কখনও দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে, কখনও আবার নিভে আসছে।
এই পরিবেশেই দাঁড়িয়ে আছে এক তান্ত্রিক। কালো চাদরে জড়ানো শরীর,লাল টকটকে চোখ,নেশাগ্ৰস্থ মুখে পাপীর হাসি।লোকেরা তাকে বরাবর ভয় পায়।বলে,তার তন্ত্রমন্ত্রে মৃতদেহ সাড়া দেয়,ভূত-প্রেত এসে হাজির হয়।কিন্তু আজ তার চোখে অন্য রকম আগুন।
সামনে একটি মৃত নারীদেহ।বেওয়ারিশ লাশ।মৃত হলেও এখনও শরীরে কামনা জাগানোর আগুন জ্বলছে।যদিও আর কিছুক্ষণ পরে সে চিতার আগুনে ভস্মীভূত হবে।শ্মশানের চারিদিকে হাড় আর মাংসের মিশ্র গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।আর সেই গন্ধের মাদকতা তান্ত্রিকের নেশাগ্ৰস্থ শরীরের লালসাকে উস্কে দিচ্ছে।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মৃত শরীরের কাছে।লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে যৌবনোদ্যত শরীরের দিকে।মেয়েটার বয়স কতই বা হবে,চব্বিশ কিংবা পঁচিশ।মাদকতা মেশানো কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে—"জীবন শেষ হলেও,আমার সাধ মেটে না।মৃত শরীর থেকেও ভোগের সুখ চাই।"
শ্মশানের বাতাস হঠাৎ যেন ভারী হয়ে ওঠে।দূরে কুকুরেরা একসঙ্গে ডেকে ওঠে,আবার হঠাৎ চুপ করে যায়।যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি টের পেয়েছে তারা।নদীর কুয়াশা আরও ঘন হয়ে আসছে,যেন প্রকৃতি নিজেই প্রতিবাদ করছে।
তান্ত্রিক মৃতদেহের দিকে এগিয়ে চলেছে।কাছে গিয়ে কামুক দৃষ্টিতে একভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রাণহীন দেহটার দিকে। তারপর হাত বাড়িয়ে এক ঝটকায় খুলে ফ্যালে শরীরের ধূলি মলিন শাড়িটাকে।চিৎ হয়ে পড়ে থাকা দেড়টায় এখন শুধু একটুকরো সায়া।উর্ধাঙ্গ উন্মুক্ত।আগত সন্তানের আহারের আঁধার দুটো বিল্ব ফলের মতো বসে আছে বুকের উপর।তান্ত্রিক বসে পড়ে দেহটার কাছে,হাত জোড়া এগিয়ে দেয় সেই ফল দুটোর দিকে।ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ মাথার ওপর অদ্ভুত শব্দ তান্ত্রিককে বিভ্রান্ত করে।অনুভব করে প্রচণ্ড এক ডানার ঝাপটা। রাতের আকাশে এক বিশাল ঈগল চক্কর দিচ্ছে। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে,যেন আগুনের শিখা।সেই অগ্নি দৃষ্টিতে সে আবার আঘাত করে তান্ত্রিককে। বারংবার ঝাঁপটায় তান্ত্রিক দিশেহারা।কামুক হাতজোড়া দিয়ে এখন তার চোখ ঢেকে নেয়।শয়তানের দৃষ্টি এখন তারই হাতের আড়ালে।ঈগলের আঘাতের ফলে এতক্ষণে লুটিয়ে পড়ে শ্মশানের মাটিতে। যন্ত্রণার অভিঘাতে ছটফট করে।গড়াগড়ি খায়।
ঈগল এখন মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে নেই,তাকিয়ে আছে কেবল তান্ত্রিকের দিকে। সেই চোখে আছে তীব্র অবজ্ঞা,রুদ্র তপস্যা।
তান্ত্রিক থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য।
তারপর আবার উঠে দাঁড়িয়ে বিকৃত ক্রুর হাসি হেসে রাগত স্বরে বলতে থাকে—"ঈগল তুই আকাশের প্রাণী।তোর চোখ সূর্যের দিকে।কিন্তু আমি…আমি অন্ধকারের সন্তান।মৃত্যু আমার কাছে ভোগের মদিরা।"
সে আবার এগোয় অর্ধ উলঙ্গ বেওয়ারিশ লাশের দিকে।
অতঃপর ঈগল ঝাঁপিয়ে আসে আবার তড়িৎ গতিতে।শ্মশানের আগুন একসঙ্গে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে,যেন প্রতিবাদ করছে।বাতাসে হাহাকার ওঠে।গাছের ডালপালা কেঁপে ওঠে।
পাখিটার বিভিষীকাময় আক্রমণে তান্ত্রিক আঁতকে ওঠে।ঈগলের শাণিত নখর তার মুখে ঘুরেফিরে আঘাত করে।চিৎকার করে ওঠে সে। রক্ত ঝরে পড়ে মৃত শরীরের উপর।
এক মুহূর্তে পরিবেশ বদলে যায়। হঠাৎ মৃত শরীর আগুনে জ্বলতে থাকে।এবং সে আগুন দাউদাউ করে আরও তীব্র হয়ে ওঠে।জ্বলতে জ্বলতে ভস্ম হয়। জীবিত অবস্থায় শরীরে যা কিছু বহন করা পাপের স্খলন ঘটে।শরীর ভস্মীভূত হয়।এখন সেই ভস্ম এলোমেলো উড়তে উড়তে আকাশের দিকে মিলিয়ে যায়।মনে হয়,শ্মশানের অশরীরী মৃত আত্মারা নিজেরাই আত্মাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে।নিজেরাই দহন পর্ব ঘটিয়েছে।মৃতের পরেও শয়তানের খপ্পর থেকে মুক্তি দিয়েছে।
এরপর তান্ত্রিক আর অপেক্ষা করে না,পালাতে থাকে তড়িৎ গতিতে।তার চাদর ছিঁড়ে যায়,শরীরে রক্ত সেই চাদরকে সিক্ত করে।সে ভয়ানক ত্রাসে ছুটতে ছুটতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
সবাই জানে ঈগল মৃতদেহ ছোঁয় না।সে এবার নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ায়।কোনো এক অজানা শান্তিতে ডানা মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রাত পেরিয়ে ভোর হয়।আকাশে প্রথম আলোর রেখা ছড়িয়ে সূর্যেও ডানা মেলে দেয়।ততক্ষণে শ্মশানের আগুন নিভে গিয়ে ঠান্ডা ভস্ম পড়ে থাকে।
গ্রামবাসীরা আসে কোনো এক পরিজনের মৃত শরীর নিয়ে ঐ শ্মশানে।দাহ করতে।এসে তারা দেখে,কোনো এক দেহ ভস্মীভূত হয়ে আছে চুল্লির উপরে।কেউ সেই ভস্মকে কলসির জলে ধুয়ে নামিয়ে দেয়নি গঙ্গার বুকে।এরপর তারা দেখে শ্মশানের মাটিতে তাজা রক্তের দাগ।আর অচেনা পদচিহ্ন শ্মশান থেকে দূরে মিলিয়ে গেছে।ধাপগুলো সেই মিলিয়ে যাওয়াকে প্রমাণ করে।এরপর তারা তাদের নিয়ে আসা মৃত শরীর চিতায় তোলার আগে চুল্লিতে জমে থাকা ছাইকে কলসি কলসি জল ঢেলে ধুয়ে নামিয়ে দেয় গঙ্গার বুকে।বেওয়ারিশ মৃত শরীরের ছাই গঙ্গার বুকে পড়ে যেন ঠাণ্ডা হয়।পাপ ধুয়ে মুছে পবিত্র হয়।
উপস্থিত বৃদ্ধদের চোখে তখন ভয়।
কেউ কেউ মুখে ফিসফিস করে বলে—
"তান্ত্রিকের অভিশাপ…হয়তো মৃত্যুর পরেও তাকে ছাড়েনি।"
এক বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে—
"ঈগল মৃত মাংস খায় না,কারণ তার চোখ আকাশে।কিন্তু মানুষ…মানুষ মৃতকেও শান্তি দেয় না।আজকাল মানুষ পশুরও নিচে নেমে গেছে।"
সবাই চুপ করে থাকে।বাতাসে আবার ভেসে আসে গঙ্গার জলের শব্দ।
ঈগল তখনও আকাশে উড়ে চক্কর দিচ্ছে।তার ডানা সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে।তাঁর নিদ্রাহীন চোখে যেন সেই এক বার্তা—
"আমরা মৃতদেহ ছুঁই না,তাদের মাংস খায়না,কারণ আমরা আকাশের প্রাণী।কিন্তু মানুষ?সে আকাশ ছেড়ে নেমে গেছে নোংরার অতলে।"
এ গল্প শেষ হয়,কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—
কেন মানুষ এমন হয়?
কেন ঈগল মৃত্যুকে অস্বীকার করে,অথচ মানুষ মৃত্যু থেকেও কামনা খোঁজে?
শ্মশানের নীরব পরিবেশই যেন উত্তর দেয়—"প্রকৃতি মৃত্যুতেই শান্তি খোঁজে,
কিন্তু মানুষ মৃত্যুর পরেও অশান্তি খোঁজে!"
=========================
***শঙ্কর প্রসাদ সরকার
গ্ৰাম+পোস্ট:শেখপাড়া
থানা:রাণীনগর
জেলা:মুর্শিদাবাদ
পিন কোড:৭৪২৪০৯