গল্প ।। বিষ্ণুপদ বাবুর সংসার ।। সমীর কুমার দত্ত
0
September 01, 2025
বিষ্ণুপদ বাবুর সংসার
—সমীর কুমার দত্ত
গোবিন্দর বিয়ে হয়েছিলো এক গরীব ঘরের উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মেয়ে মালতীর সঙ্গে। বাবা বিষ্ণুপদ দাশের কথায় গোবিন্দ বিয়েতে মত দেয়। না হলে গোবিন্দর মালতীকে পছন্দ ছিলো না। তারা গরীব বলে দেনা পাওনা হিসেবে তেমন কিছু পাওয়া যায় নি।গোবিন্দ একটা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কেরাণী। গোবিন্দর মন্থরা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে অল্পস্বল্প প্রেমালাপ আছে। মেয়েটির 'বারফটকা মেয়ে' হিসাবে পাড়ায় দুর্নাম আছে। সে হিসেবে বাড়িতে বিবাহে রাজি না হওয়ায় সম্ভাবনা প্রবল। এছাড়া এটা একটা শর্ত সাপেক্ষের বিয়ে ছিলো। তাই গোবিন্দকে রাজি হতে হয়েছে।কাজের মেয়ে অষ্টমীকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য প্রায় পাল্টি ঘরের বিয়েতে মত দিতে হয়েছে।
বিষ্ণুপদ বাবু এক সওদাগরী অফিসের প্রধান করণিক পদে নিযুক্ত কর্মচারী। সেই অফিসে মালতীর বাবা যোগেন গিরি চাপরাশির পদে চাকরি করতো। কর্মগুণে যোগেন বিষ্ণুপদ বাবুর খুব স্নেহের পাত্র হয়ে উঠে ছিলো। যোগেন প্রায়শই বিষ্ণুপদ বাবুর কাছে দুঃখ করে বলে, " বড়ো বাবু, চিন্তায় চিন্তায় আমার ঘুম ধরে না।"
উত্তরে বিষ্ণুপদ বাবু বলেন, " কি এমন চিন্তা যে তোমার ঘুম ধরে না। ছেলে তো একটা চাকরি করে। তবে তোমার আবার চিন্তা কি?"
— আমার মেয়েটার জন্য আমার বড়ো চিন্তা বড়ো বাবু। মেয়ে তো আমার তেমন সুন্দরী নয়।শ্যামবর্ণা। তবে মুখশ্রী আছে।এ বছর একটা পাশও দিয়েছে। আর পড়াতে পারবো না। আর পেরে উঠছি না।
— আরে রূপে যখন লক্ষী নয়, গুণে তো সরস্বতী হতে হবে। পড়া বন্ধ কোরো না। দরকার হলে আমি তোমার মেয়ের পড়ার জন্য কিছু দেবো এখন।
— কি যে বলেন বড়ো বাবু। আপনি কতো দেবেন। আপনার বড়ো মন। কারোর দুঃখ শুনলে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
— সে তোমায় ভাবতে হবে না। আমার একটা উপকার করলেই হবে।
— কী যে বলেন বাবু। আমার মতো লোক আপনার মতো মানুষের কী উপকার করবে? হায় হায়, তাহলেই হয়েছে আর কি!
—শোন, ইচ্ছে থাকলেই সবাই সবার উপকার করতে পারে। তবে ইচ্ছে বা মন থাকা চাই।
আসলে বিষ্ণুপদ বাবু কোন দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তার বাড়িতে একটা কাজের মেয়ে আছে। নাম তার অষ্টমী। ছোট থেকে মা মীরার সঙ্গে মাঝে মাঝে এসে হাতে হাত লাগিয়ে মাকে কাজে সাহায্য করতো। মীরার স্বামী অন্য এক মহিলার দ্বার পরিগ্রহ করে অন্যত্র চলে যায়। তাই পরের বাড়ি কাজ করে মীরাকেই সংসার চালাতে হয়। না খেয়ে খেয়ে রক্তাল্পতা রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ একদিন মারা যায়। এখন মেয়েটা বড়ো একা হয়ে পড়ে। তার দায় বিষ্ণুপদ বাবুর ঘাড়ে এসে পড়ে। মীরা প্রায়ই বলতো, " কর্তা মা, তোমরা অষ্টমীকে তোমাদের কাছে রেখে দিও। কোথায় আর যাবে বলো? সোমত্ত বয়সের মেয়ে! তোমাদের সব কাজ ও কোরে দেবে।"
সুতরাং বিষ্ণুপদ বাবু দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাছাড়া ওর তো একটা ভবিষ্যৎ আছে। সারা জীবন এখানে পড়ে থাকলেই তো ওর চলবে না। তারপর নিজের ঘরে একটা সোমত্ত ছেলে আছে। কিছু একটা ঘটে যাওয়াও তো বিচিত্র নয়। এইসব সাত পাঁচ ভেবে অষ্টমীকে পাত্রস্থ করার জন্য চিন্তা ভাবনা করছেন।
এদিকে যোগেন গিরির একটা ছেলে আছে। নাম তার নগেন। ছেলেটা একটা কোম্পানিতে বেয়ারার কাজ করে। স্বভাব চরিত্র ভালো। পরিবারের সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল। একদিন বিষ্ণুপদ বাবু কথায় কথায় যোগেনকে বললেন,
" যোগেন, তোমার তো একটা বিবাহযোগ্য ছেলে আছে নয়? চাকরি বাকরি করে শুনেছি। তবে আমি বলি কি, আমার বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করতো, সে হঠাৎ মারা গেছে। তার একটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে, তার দায় এখন আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। পাত্র খুঁজছি তার বিয়ে দেবো।"
কথার মাঝে যোগেন জিজ্ঞাসা করলো, " আপনার ঘাড়ে কেনো? মেয়েটির বাবা নেই?"
—না, ওর বাবা ওদের ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে চলেগেছে। তাই আমি বলছিলাম, " তুমি যদি তোমার ঘরের বৌ করে নিয়ে যাও তো ভালো হয়। মেয়েটি খুব সুলক্ষণা এবং কাজের। তবে একটা কথা আছে, এতে তোমার উপকারও হবে।
—আমার উপকার হবে মানে? ঠিক বুঝলাম না, বড়ো বাবু।
—উপকারটা হলো গিয়ে তোমার মেয়েটিকে আমি আমার ঘরের বৌ কোরে নিয়ে যেতে চাই।
— কি বলছেন বড়ো বাবু? আমি কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনার বাড়িতে আমার মেয়ে যাবে,সে তো পরম ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার কি অতো খরচ করার খ্যামতা আছে বড়ো বাবু।
—তোমাকে কিছু দিতে হবে না। তোমার মেয়েকে আমি গহনা পরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। অষ্টমীকে গহনা পরিয়ে পাঠাবো।শুধু তোমরা রাজি থাকলেই হলো। যাও স্ত্রী পুত্রের সঙ্গে কথা বলে আমায় জানাবে।
বিষ্ণুপদ বাবু বাড়িতে পুত্র গোবিন্দ ও স্ত্রী হেমলতা দেবীকে তাঁর উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বললেন। আর এও বললেন যে মালতীকে তিনিই খরচ পত্তর দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকটা পাশ করাবেন। তারপর যদি ও আরও পড়তে চায় তো পড়তে পারে।
এদিকে যোগেনও ছেলে বৌ এর কাছে সব কথা খুলে বললো। সব কথা শুনে ছেলে বৌ তো খুব খুশি।
" ভেবে দেখো, আমার মেয়েকে গহনা উনি পরিয়ে নিয়ে যাবেন। আবার নগেনের বৌকে গহনা পরিয়ে পাঠাবেন। কতো বড়ো মন না হলে এমন কথা বলা যায়।" যোগেন বললো্। বিমলা খুব খুশি। যে মেয়েকে নিয়ে তাদের চিন্তার শেষ ছিলো না। এতো সহজে বড়লোরের বাড়িতে বিয়ে এবং শিক্ষিত, স্কুলে চাকরি করা জামাই পাবে, আবার কোন দেনা পাওনার ব্যাপার নেই। এ কি ভাবা যায়!
গোবিন্দ ইচ্ছা না থাকলেও, কাজের মেয়েকে পাত্রস্থ করে ঘাড় থেকে নামানো যাবে ভেবে নিমরাজি হয়ে যায়। দু পক্ষের আপত্তি না থাকায় গোবিন্দ ও মালতী এবং নগেন ও অষ্টমীর প্রায় পাল্টি ঘরে বিয়ে হয়ে গেলো। অষ্টমী কাজের মেয়ে, কাজের মেয়ের মতোই যোগেনের সংসার সামলাতে লাগলো। আর মালতী সুলক্ষণা, শ্বশুর ও শাশুড়ির মন জুগিয়ে চলতে লাগলো। বছর খানেক বছর দেড়েক কেটে যাবার পর মালতী মা হতে চললো। লেবার পেন উঠলে অনেক কসরৎ
করেও যখন নরম্যাল ডেলিভারি হলো না তখন সিজার করতে হলো। তাতে বাচ্চা বেঁচে গেলেও প্রসূতি বাঁচলো না অতিরিক্ত রক্তপাত জনিত কারণে। মালতী কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেলো। গৃহে বিষাদের কালো ছায়া নেমে এলো। যোগেন ও বিমলা বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে তাদের মেয়ে আর নেই। সবচেয়ে কষ্ট লাগলো মাতৃহারা নবজাতিকার জন্য। ভেবেছিলো নাতনির মধ্যে মেয়েকে খুঁজে পাবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর ঈশ্বর করেন আর এক। আরও কী অপেক্ষা করে আছে কে জানে?
ভালো জায়গায় বিয়ে দিলেই যে মেয়েকে সুখী দেখা যায় এমন নয়।গরীবের ঘরে বিয়ে হলেও মেয়ে সুখী হতে পারে। সেটা মেয়ের ভাগ্য । যেখানে বাজনা বেশি সেখানে খাজনা বেশি। যদিও যোগেনকে খাজনা বেশি দিতে হয়নি। হয়নি বললেও ভুল। কারণ সচ্ছল পরিবারে দিয়েও তো মেয়েকে হারাতে হলো। সেটা তো কম ক্ষতি নয়।
বছর খানেক কাটতে না কাটতেই গোবিন্দ তার হবু প্রেমিকা মন্থরাকে বিনা পনে বিয়ে করে আনলো বাচ্চাকে দেখাশোনার অজুহাতে। এক্ষেত্রে বাড়ি থেকে কোন আপত্তি ওঠার সুযোগ ঘটেনি। ঠিকই তো এই মুহূর্তে বাচ্চাকে দেখার জন্য বাইরের কাউকে তো রাখা যাবে না। আবার পরের সন্তান দেখার জন্য কেই বা বিয়ে করতে চাইবে। মালতীর মৃত্যু মন্থরাকে সুযোগ করে দিয়ে গেলো সদ্যজাত মেয়েরও কপাল পোড়ানোর জন্য। ইত্যবসরে বিষ্ণুপদ বাবুর অবসরের দিন ঘনিয়ে এলো।
মন্থরা, নামই প্রমাণ করে দেয় যে মেয়ে সুবিধের নয়, প্রথম প্রথম বাচ্চাটাকে ভালোই দেখাশোনা করছিলো। সে তার যৌবনকে ঠিক রাখার জন্য এই মুহূর্তে নিজের বাচ্চা কাচ্চা চায়নি , তাই বাচ্চাটাকে বছর দুই তিন প্রতি পালন করে চলে। কিন্তু বাপের বাড়ির লোকজন ওর কান ভাঙাতে শুরু করে। তবে যে যাই বলুক কাঁনা মনে মনে জানা, লোকে যাই বলুক, ও কী করবে ওর মনে মনেই আছে। তবুও " পরের বাচ্চা আর কতদিন নাড়বি? বেশিদিন হয়েগেলে ওর বাপের মন ওর দিকেই পড়ে যাবে। তখন তোরটাকে আর মনে ধরবে না। পরে পস্তাতে হবে। নিজের কথা আর কবে ভাববি? সদ্য সদ্য বিবাহিত স্বামীর স্ত্রীর প্রতি যৌনাকর্ষণ থাকে। আর তখন বাচ্চা কাচ্চা হলে, বাচ্চা খুব সুপুষ্ট হয়। আর দেরি করলে, সে আকর্ষণও থাকে না, বাচ্চাও তেমন ভালো হয় না। বাচ্চা রুগ্ন হয়।" ইত্যাদি
কান ভাঙানি শুনতে শুনতে নিজের কথা এখন ভাববো না বললে কী হবে, ভাবিয়ে ছাড়বে। তখন থেকে মন্থরা ভাবতে শুরু করলো —সত্যিই তো , কতোদিন আর সে পরের ছেলে নাড়বে? মেয়ের জন্ম দিয়ে তিনি তো ড্যাং ডেঁঙিয়ে চলে গেলেন। তার সন্তান প্রতিপালন করার দায় কি তার? এইসব কথা ভাবতে ভাবতে স্বামী গোবিন্দকে উত্তেজিত করে গর্ভবতী হলো মন্থরা। সুতরাং মন্থরার পক্ষে মালতীর মেয়েকে দেখাশোনা করা আর ততোটা সম্ভব হলো না। অসুবিধেটা বুঝতে পারলো গোবিন্দ। কিন্তু কী করবে? মন্থরার তো শারীরিক চাহিদা ও সন্তান কামনা থাকতেই পারে। ওতো আর আয়া হয়ে আসে নি।
মালতীর মেয়েটা দেখতে দেখতে দু তিন বছরের হয়ে উঠলো। ওর দায় এখন ঠাকুমা হেমলতা দেবী ও দাদু বিষ্ণুপদ বাবুর ঘাড়ে এসে পড়লো। ওদের বয়স হয়েছে ওনারাও আর পেরে ওঠেন না। বাবা গোবিন্দর তো ওর প্রতি কোন টানই নেই। আসলে মেয়ে তো। ছেলে হলেও না হয় হতো। কিন্তু বাবার কাছে মেয়েরাই প্রিয় হয়ে থাকে জানি। যদিও বাবা মায়ের কাছে সন্তানরা সকলেই সমান। মা চলে গেছে, বাবারও যদি ভালোবাসা না পায় তা হলে এর থেকে চরম দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?মাঝে মাঝে দাদামশাই এসে মামার বাড়ি নিয়ে যায়। দু চার দিন থেকে চলে আসে। দাদু, ঠাকুমাকে খুব ভালো বাসে তো তাই সেখানে বেশিদিন থাকতে পারে না। এই তো ওর জীবন শুরু। জীবনের এখন অনেক বাকি। দাদু ঠাকুমা কী করবেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না। বিষ্ণুপদ বাবু কি চেয়েছিলেন আর কি হয়ে গেলো। মালতী চলে যাবার পর সংসারে মন্থরা নামের অলক্ষ্মী ঢুকেছে। একদিন বিষ্ণুপদ যোগেন ও তার স্ত্রী বিমলার কাছে অনেক দুঃখ করে সব কথা বললেন, এবং অনুরোধ করলেন,যদি তারা তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে মানুষ করেন তো ভালো হয়। কারণ, গোবিন্দ মেয়ের ভালো করার নামে নিজের ভালো করেছে আর মেয়ের কপাল পুড়িয়েছে। তাঁরা আর কদিন। তারপর মেয়েটার যে কী হবে কে জানে। তাই যদি তাদের কাছে নিয়ে এসে রাখে তো ভালো হয়। প্রতি মাসে খরচা যা লাগে তিনি তা দেবেন। প্রস্তাব প্রত্যাখান করে যোগেন ও বিমলা বললো, " এ সম্ভব নয়, বড়ো বাবু। ও মালতীর মেয়ে। আপনার বংশের মেয়ে। আজ মালতী নেই বলে আপনারা ওর দায় এড়িয়ে যেতে চাইছেন? একদিন নিজের ইচ্ছায় দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছেন। তাকে বাঁচাতে পারেননি। আজ তার সন্তানকে বের করে দিতে চাইছেন? না না, বড়ো বাবু, এটা আপনার ঠিক বিচার হলো না। আপনার উদ্দেশ্য তো সফল হয়ে গেলো। আর আমারি ক্ষতি হয়ে গেলো। আমারি ভুল হয়েছিল আপনার কথা মেনে নেওয়া। আসলে তেলে জলে মেসে না —এটা আমাদের বোঝা উচিত ছিলো। আর তাছাড়া আমাদেরও তো বয়স হয়েছে। আমরা আর কদিন বাঁচবো। তারপর মেয়েটার কি হবে? আপনার উচিত ওর ভবিষ্যতের একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে যাওয়া।"
— তোমরা আমায় ভুল বুঝছো। আমি তো ওর ভবিষ্যতের ব্যবস্থা করে রেখেই যাবো। আমি আমার দায় এড়িয়ে যাচ্ছি না। আমি শুধু ওদের হাত থেকে আমার নাতনিকে বাঁচাতে চাই।
—না, বড়ো বাবু,এ আপনার ঠিক বিচার হচ্ছে না। মেয়েটা একবার ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে , আপনারা আর পেছন ফিরে তাকাবেন না। আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে কী লাভ হলো, যদি তার মেয়েকেও আমাদের প্রতিপালন করার জন্য বুড়ো বয়সে খেটে খেটে মরতে হয? আমরা তো চিরকাল বাঁচবো না আর আপনারাও চিরকাল থাকবেন না। মেয়েটা আপনাদের দুজনকে খুব ভালোবাসে। আমরা যদি জোর করে এনে রাখি তাতে কি ফল ভালো হবে? আমাদের কাছে থাকা আর আপনাদের কাছে থাকা এক নয়। আমরা তেমন লেখাপড়া জানি না। আমাদের কাছে ভালোভাবে মানুষ হবে? না না, বড়ো বাবু ,আমরা তা পরবো না। আপনি আমাদের অপরাধ নেবেন না। আমরা দরকার হলে আপনার পায়ে ধরছি।
— সকলেই যদি অবুঝ হয় কী করবো বলো। আর যা আছে ওর কপালে হবে। কী করবো!
বিষ্ণুপদ বাবু পড়লেন মহা বিপদে! হেমলতা দেবী হাই প্রসারের রোগী, সঙ্গে আরও অন্যান্য রোগের উপসর্গ নিয়ে নিজেই শয্যাশায়ী। মন্থরা কিছুই করতে পারে না, শুধু ধীরে সুস্থে রান্নাটুকু করা ছাড়া। বাজার, দোকান , মেয়েটাকে দেখাশোনা সবই করতে হয় পাঁশ ফেলতে ভাঙা কুলো বিষ্ণুপদ বাবুকে। গোবিন্দ তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত।স্কুল থেকে এসে টিউশন পড়ায়।মেয়েটাকেও একটু দেখে না।
এদিকে মন্থরার বাড়ির লোকজন মন্থরাকে বোঝাতে থাকে মালতীর মেয়েটা বেঁচে থাকলে তার শ্বশুরের সম্পত্তি দুভাগ হয়ে যাবে। চায় তিন ভাগও হয়ে যেতে পারে। সুতরাং ওই পাপকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চা থাকতে থাকতে সরাতে না পারলে তাকেই পরে পস্তাতে হবে। কথাগুলো মন্থরাকে ভাবায়। মন্থরা যতো ভাবে,ওর মন ততো মালতীর মেয়ের বিরুদ্ধে যায়। মেয়েটার সঙ্গে দূর ছাই করে। হেমলতা দেবী ও বিষ্ণুপদ বাবু সব দেখেন কিন্তু তাদের কী বা করার আছে। এগুলো কি সেখানো যায় যে মা মরা শিশুদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করা যায় না যাতে তাদের মনে কষ্ট হয়। এগুলো সংবেদনশীলতা, সহানুভূতি। মানুষ জন্ম থেকেই নিয়ে আসে।
এগুলোকে শেখানো যায় না। স্বার্থপর হলেই মানুষ এমন ব্যবহার করে। পরকে বলে লাভ নেই, নিজের বাবাই তো এমন ব্যবহার করছে। এদের লেখাপড়া শিখিয়ে কোন লাভ হয়নি। ভষ্মে ঘি ঢালা হয়েছে। তবুও তাঁরা প্রতিবাদ করে বলেন, বলতে হয়, উপায় থাকে না, " বৌমা, তুমি তো মা হতে চলছো। তোমার মেয়ের সঙ্গে যদি কেউ এইরূপ ব্যবহার করে, তাহলে তোমার কেমন লাগবে?
নিশ্চয়ই ভালো নয়। ওর অপরাধ ওর মা ওকে ছেড়ে চলেগেছে বলে? এতে ওর তো কোন দোষ নেই। একটু ভালো কথা বললে কি ট্যাক্স লাগে? বাচ্চাদের প্রতি অতো রূঢ় হয়ো না। বাচ্চারা ভগবানের জাত। ওদের মনে কোন পাপ নেই।"
এদের এইসব দেখেশুনে বিষ্ণুপদ বাবু তাঁর স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি সমান তিন ভাগে করে দিয়ে যান। একভাগ স্ত্রী হেমলতা দেবীর , মালতীর মেয়ের এক ভাগ আর বাকি এক ভাগ তাঁর ছেলে গোবিন্দর নামে। হেমলতা দেবী মৃত্যু কালে যে তাঁকে আমৃত্যু পর্যন্ত দেখবে, তাকে দিয়ে যেতে পারেন। আর যদি তাঁকে বেশিদিন বাঁচতে না হয় তাহলে তিনি যাকে মনে করবেন দিয়ে যেতে পারেন এবং এই কথা তিনি সবাইকেই জানিয়ে দিয়ে যান, এমনকি যোগেনকেও।
ইদানিং বিষ্ণুপদ বাবুর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় ভেতরে ভেতরে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। খাওয়া দাওয়াও প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। শয্যাশায়ী স্ত্রী ও নাতনির কথা ভেবে ভেবে ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করে মারা যান। মালতীর দুর্ভাগ্য এক পা এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগলো।
বিষ্ণুপদ বাবু চলে যাবার পর মন্থরা যেন বেপরোয়া হয়ে উঠলো। কারণে অকারণে মালতীর মেয়ের গায়ে পান থেকে চুন খসলেই হাত তুলতে লাগলো। এমন মার যে পিঠে, গালে পাঁচটা আঙুলের দাগ বসে যায়। ঠাকুমা হেমলতা দেবী বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব দেখেন আর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কাছে ডেকে বলেন,"আয় দিদিভাই, এখানে আয় আমার কাছে। এখানে এসে বোস দিকি। আমার মাথার পাকা চুল বেছে দে দিকি।"
হেমলতা দেবী ভাবেন, তিনি না থাকলে এ মেয়ের কী দশা হবে!
মন্থরার দেখাদেখি গোবিন্দও মেয়েকে ছেড়ে কথা বলে না। প্রয়োজনে গায়ে হাত তোলে। বাবা হয়ে গোবিন্দ যখন এ রকম ব্যবহার করতে পারে, তবে পরকে দোষ দিয়ে লাভ কি। এক একদিন এমন হয় এবেলা মন্থরা মারে তো ওবেলা গোবিন্দ। আসলে সম্পত্তির একটা ভাগ ওকে দিয়ে যাওয়ার জন্য বাবার ওপর রাগটা ওর ওপর ছাড়ে। মার খেতে খেতে মেয়েটা ভীত হয়ে পড়েছে। ভিখারীর মেয়ের মতো একটা থালায় একটু আধটু খাবার দিয়ে থালাটা ওর দিকে ঢেলে দেয়। খাবারে তার পেট ভরে না। ভয়ে চাইতেও পারে না। ওইটুকু খাওয়া নিমেষে শেষ হয়ে যায়। সবার বাসন কাজের লোক মাজে। আর ওর একটা বাসন ওকে ধুয়ে নিতে হয়। ইতিমধ্যে মন্থরার বাচ্চা হলো।পুত্র সন্তান জন্ম দিলো। বাচ্চা নিয়েই পড়ে থাকে সারাদিন। হেমলতা দেবী কোন রকমে রান্নাটা করেন। নিজে কম খেয়ে নাতনিকে যত্ন আত্তি করে খাইয়ে দেন।
একদিন মন্থরা মালতীর মেয়েকে তার বাচ্চাকে দেখতে বলে বাথরুমে স্নান করতে ঢোকে। মালতীর মেয়ে বাচ্চাটার কাছে বসে ছিলো। এমনসময় সে অচেনা কাউকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে। তাই সে রান্না ঘরের দিকে দৌড়ে যায়। গিয়ে কাউকেও দেখতে পায় না। ঠিক তখনই মন্থরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে মালতীর মেয়েকে দেখতে পায়। বলে, " তোকে আমি ভাইকে দেখতে বলে এলাম, আর তুই ভাইকে ছেড়ে চলে এসেছিস রান্না ঘরে চুরি করে খাওয়ার জন্যে।" বলেই ওকে চড়, থাপ্পড় মারতে থাকে। মেয়েটি যতো বলে," না মা, আমি রান্নাঘরের দিকে কাউকে যেতে দেখলুম,তাই দেখতে এসে ছিলুম।" মেয়েটির কথায় কর্ণপাত না করে ওকে মারতেই থাকে। মেয়েটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। মেয়েটির আর্তনাদ হেমলতা দেবীকে যার পর নাই আঘাত করে। দৌড়ে গিয়ে মন্থরার হাত থেকে মেয়েটাকে বাঁচাতে যেতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যান। সেই অবস্থায় হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে তক্ষুনি মারা যান। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। সেই যে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো তারপর পর থেকে মেয়েটির কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। মনে হয় এটা পূর্বপরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা। কাউকে ওই ভাবে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো, যাতে মেয়েটি দৌড়ে যায় আর সেই সময় মন্থরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে ওকে মারতে মারতে বের করে দেয়। আর ঠিক সেই সময়ে যে ছেলেটিকে মেয়েটি চলে যেতে দেখেছিলো, সেই ছেলেটি ওকে ভুলিয়ে ভালিয়েই হোক আর চেতনা নাশক দিয়ে অজ্ঞান করেই হোক তুলে নিয়ে যায়। এক বা একাধিক ছেলে এতে যুক্ত এবং এ বা এরা মন্থরার দ্বারা নিযুক্ত। হয়তো গোবিন্দ এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। গোবিন্দ বাড়ি ফিরলে গোবিন্দকে মিথ্যে বুঝিয়ে এবং ওই শাশুড়ির মৃত্যুর কারণ বলে প্রতিপন্ন করে থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করে আসতে বলে।যারা ওই পঞ্চম- ষষ্ঠ বর্ষীয় বালিকাটিকে তুলে নিয়ে গেছে হয় তারা ওকে কোন নিষিদ্ধ পল্লীর মালকিনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, নয়তো বা পৈশাচিকভাবে ধর্ষণ করার পরে নিষ্ঠুরভাবে তার নিষ্পাপ দেহটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ভাসিয়ে দিয়েছে নদীর জলে। এইভাবে হয়তো মালতীর মেয়ে হারিয়ে গেলো পৃথিবী থেকে চির নিরুদ্দেশের পথে প্রশ্নচিহ্ন রেখেগিয়ে।
কিন্তু সত্যটা ছিলো ভিন্ন। হেমলতা দেবীকে আসতে দেখে ছেলেটা লুকিয়ে পড়ে। মেয়েটি তখন কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বেরিয়ে যায়। মন্থরা ও ওই ছেলেটি হেমলতা দেবীকে নিস্তব্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে। ওরা ওনাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মালতীর মেয়েটি তখন রাস্তার তেমাথার মুখে এসে ডানদিকে মামাবাড়ির দিকের রাস্তা ধরে। ওই পথটাই তার জানাছিলো। কারণ ওই পথ দিয়েই সে কয়েকবার মামার বাড়ি গিয়েছিলো। সৌভাগ্যবশত ওর মামারবাড়ির দাদু যোগেন ওকে দেখতে আসছিলো। মাঝে মধ্যে যেমন আসে আর কি। ওকে ক্রন্দনরত অবস্থায় একা আসতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, " মামনি, তুই একা একা কাঁদতে কাঁদতে কোথায় যাচ্ছিস?" দাদুকে দেখে ততোধিক কাঁন্নায় ভেঙে পড়ে বলে, " দেখো না, আমি কিছু করিনি তবুও আমায় মেরে বার করে দিলো।
— কে মেরে তোকে বের করে দিলো?
— মা। আমাকে রোজ মারে। একটুখানি খাবার দেয়। আমার খুব ক্ষিদে পায়। ঠাকুমা আমাকে অনেকটা খাবার দেয়।
ঠাকুমা যেদিন বিছানা থেকে উঠতে পারে না, সেই দিন মা কম খাবার দেয়।
কথাগুলো শুনতে শুনতে যোগেনের বুক ফেটে যায়। বলে,
"আয় সাইকেলে উঠে আয়। নাতনিকে সাইকেলে তুলে নিয়ে বাড়ি চলে যায়। বাড়ি গিয়ে স্ত্রী বিমলাকে সব কথা বলে। বিমলা কথাগুলো শুনতে শুনতে আর নাতনির মুখের দিকে চেয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। চোখের জল মুছতে মুছতে বিমলা বলে," সেদিন যদি হাসপাতাল থেকে ওকে আমরা আমাদের ঘরে আনতাম, তাহলে গোবিন্দ ওই ডাইনিটাকে বিয়ে করে ঘরে আনতে পারতো না।"
"কি করে জানবো যে বাচ্চাকে দেখার নাম করে ওকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে। তোর যদি প্রেম, ভালবাসা ছিলো তুই আমার মেয়েকে বিয়ে করলি কেন? তাহলে আমাদের নগেনকে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতুম না। কাজের মেয়েকে আমার ছেলের ঘাড়ে চাপাবে বলে আমার মেয়েকে বৌ করে নিয়ে গেছে। ছেলে কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে না জেনে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলে।"
যোগেন রাগে কথাগুলো বলেগেলো।
— আর গোবিন্দই বা কি? তোর মনে মনে এইসব আছে, তুই বিয়েতে মত দিলি কেন।
— তার না হলে আমার মেয়ের কপালটা পোড়াবে কি করে। মেনে নিয়েছে কেন জানো? ওই কাজের মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাবার জন্যে। কিন্তু বড়ো বাবু, ও কর্তা মা খারাপ লোক নয়। ওনারা জানলে কি দিতেন।
যোগেন নাতনিকে একপ্রকার তাদের কাছে লুকিয়ে রাখে।তবে পুলিশের কাছে গিয়ে ওর নিরাপত্তার কথা জানিয়ে সব কথা বলে আসে।
এদিকে ছেলেটি ও মন্থরা বুঝতে পারে যে হেমলতা দেবী আর বেঁচে নেই। ওরা ওনাকে ধরাধরি করে ওই খানেই ভালো করে শুইয়ে দেয়। ছেলেটি বেরিয়ে পড়ে মেয়েটিকে ধাওয়া করতে। মামনি তখন তার দৃষ্টির বাইরে চলেগেছে। ফিরে এসে মন্থরাকে খবর দেয় যে মেয়েটিকে সে দেখতে পায়নি। মন্থরা তাকে চলে যেতে বলে।কারণ গোবিন্দ জানতে চাইবে ছেলেটি কে এবং কেন সে এসেছে। যথা সময়ে গোবিন্দ ফিরলে মন্থরা তার মায়ের মৃত্যুর কথা তাকে জানায় এবং আরও জানায় যে মালতীর মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েগেছে।
—বাবা! এতো কিছু ঘটে গেছে? কেন? ও চলেগেছে মানে? ওইটুকু মেয়ে ও যেতে পারে? তুমি কিছু করেছো নিশ্চয়ই।
— আরে মানে পরে খুঁজবে।
তুমি আগে যাও। ওখানে না পেলে একটা এফ আই আর করবে। একেবারে ডাক্তারবাবুকে ধরে আনবে।
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।
—আরে, আমাকে তো একটা খবর দিতে পারতে।
—মায়ের লাশটা নয় ঘরে। ওইটুকু মেয়ে ও তো বেরিয়ে গেছে। তখন কি আর মাথার ঠিক থাকে?
গোবিন্দ ঘরে ঢুকে দেখলো মায়ের শ্বাস প্রশ্বাস চলছে কিনা। না চলছে না। বুঝতে পারলো মা মারা গেছে।বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেলো সোজা মালতীদের বাড়ি।
গিয়ে শুনলো মালতীর মেয়ে ওখানে যায় নি। তারপর থানায় একটা এফ আই আর করে সোজা ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
ডাক্তার সব জিজ্ঞাসাবাদ করে পালস্ এবং হার্ট বিট দেখে বললেন, "এক্সপায়ারর্ড ! হার্ট অ্যাটাক। প্রায় ঘন্টা দেড়েক, দুয়েক আগে। তুমি এসো ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়ে যাবে।" তারপর মাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার জন্য লোক ডাকতে গেলো।
বিষ্ণুপদ বাবু মারা যাবার পরে যখন মন্থরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে ছিলো আর গোবিন্দ তখন স্কুলে,সেই সময় একদিন যোগেন নাতনিকে দেখতে আসে। হেমলতা দেবী যোগেনকে বলেন," আমি আমার ভাগের সম্পত্তি বৌমার মেয়ের নামে করে দিতে চাই। আপনি উকিল বাবুকে ডেকে নিয়ে আসুন। এই সময় ওরা নেই।"
যোগিন হেমলতা দেবীর কথা মতো উকিল বাবুকে ডেকে আনে। হেমলতা দেবী উকিল বাবুকে সব বুঝিয়ে বলেন এবং এও বলেন," আপনি পেপার রেডি করে নিয়ে আসবেন আমি সই করে দেবো। যোগেন গিয়ে উইলের কপি নিয়ে আসবে।" এইভাবে যে উইল করা হলো তাতে বিষ্ণুপদ বাবুর সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ মালতীর মেয়ে পাবে। একথা হেমলতা দেবী যোগেনকে জানিয়ে দেন। মালতীর মেয়ে যাতে ভালভাবে মানুষ হয়ে যায় এবং ভালো ঘরে পাত্রস্থ হতে পারে তাই এই ব্যবস্থা ওনারা করেছেন এবং যোগেন গিরিকে অভিভাবকের অধিকারের কথা উইলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এও উল্লেখ করা হয়েছে যে ছেলে গোবিন্দ যদি দুই তৃতীয়াংশ মূল্য দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি ক্রয় করে নিতে চায় নিতে পারে অথবা তার ভাগের এক তৃতীয়াংশ বিক্রয় করে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায় তাও করতে পারে। আবার নিজের অংশ ভাগ করে নিয়েও থাকতে পারে দলিলে সমস্ত কথাই উল্লেখ আছে। ইতিপূর্বে বিষ্ণুপদ বাবুর উইল সম্পর্কে যোগিন অবহিত আছে।
দলিলে উল্লিখিত সকল কথা শুনে যোগিন উকিল বাবুর সাক্ষাতে হেমলতা দেবীকে বলে, " যদি কিছু মনে না করেন তো ছোট মুখে একটা কথা বলি? "
—বেশ তো বলুন।
—এটা কি ঠিক হলো
গোবিন্দকে এতোটা বঞ্চিত করা?
—গোবিন্দ যদি ওকে বিয়ে না করে মেয়েটার জন্যে একজন রেখে দিতো তাহলে ওই বৌ এসে ছোট্ট বাচ্চার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করতো না।উল্টে ও বৌ এর সঙ্গে তাল দিচ্ছে। মেয়েটার ভবিষ্যৎ কী হবে সেটা তো আমাদেরই ভাবতে হবে। বিশেষ করে কর্তা ওর মাকে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছেন।
যোগেন মনে মনে ভাবে যথার্থই বিচক্ষণ মানুষ। কটা বাবা মা এরূপ করতে পারে।
মন্থরা ও গোবিন্দ জানতো মালতীর মেয়ে শুধুমাত্র এক তৃতীয়াংশ ভাগ পাবে। মা হেমলতা দেবীর এক তৃতীয়াংশ ভাগ তারা পাবে। অর্থাৎ মোট সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ ভাগ তারা পাবে। মালতীর মেয়ে ফিরে না এলে অর্থাৎ কোন সন্ধান না পাওয়া গেলে, তার পিতার প্রাপ্য হবে। অর্থাৎ সমস্ত সম্পত্তিটাই তারা পাবে। এদিকে যোগেন গিরির পাড়ার লোকজন মালতীর মেয়ের হয়ে যোগেনের পক্ষ নেয়। যে ছেলেটিকে মন্থরা মালতীর মেয়েকে সরিয়ে দেবার চক্রান্ত করে নিযুক্ত করেছিলো, সে মালতীর মেয়ে উধাও হওয়ার জন্য তার প্রাপ্য দাবি করলে মন্থরা তা দিতে অস্বীকার করে এই যুক্তিতে যে মেয়েটি নিজে থেকে উধাও হয়ে যায়। কিন্তু সে তো নিশ্চিত হতে পারছে না মেয়েটির ভবিষ্যতে ফিরে না আসার ব্যাপারে। ছেলেটি তখন ভাবলো সে অর্থের জন্য এই চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলো। অর্থই যখন সে পেলো না,তখন ওই বদ্ মহিলার মুখোশ খুলে দেবে। সে সোজা থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে জানায় এই অপরাধে সামিল হওয়ার জন্য, যা তার দ্বারায় সংঘটিত হয় নি, হয়েছে ওই মহিলার দ্বারায় মেয়েটি প্রহৃত হওয়ার জন্য। মেয়েটি তাকে এই চক্রান্তে সামিল করে অর্থের লোভ দেখিয়ে। পুলিশ অফিসার জানেন যে ছেলেটি যা বলছে তা সত্য।কারণ তিনি জানেন মেয়েটি কার কাছে আছে। সে জবানবন্দি যোগেন তাকে দিয়েগেছে। আর তাছাড়া ছেলেটি যদি তাকে অপহরণ করতো, তাহলে থানায় ছুটে এসে জানাতো না।
একদিন যোগেন পুলিশ অফিসার ও পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে গোবিন্দর কাছে গিয়ে মালতীর মেয়ের ভাগের দুই তৃতীয়াংশ সম্পত্তির ভাগ দাবি করলে গোবিন্দ ও মন্থরা বলে, "মালতীর মেয়ে তো উধাও, নিরুদ্দেশ। তার ভাগ আপনাকে দেবো কেন? আর তা ছাড়া দুই তৃতীয়াংশ নয় ও পাবে এক তৃতীয়াংশ।"
উত্তরে যোগেন বলে, " তোমার প্রথম উত্তর ও নিরুদ্দীষ্ট নয়। ও আমার কাছে আছে। আমি ওর আইন মোতাবেক অভিভাবক।
—বা বা, ওর বাবা বেঁচে থাকতে আপনি অভিভাবক। কোন হিসাবে?
—বাবা বেঁচে থাকতে যদি মেয়েকে অস্বীকার করে। তাকে জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চায়, তবে সে আর যাই হোক অভিভাবক হতে পারে না।
—মানে?
—মানেটা জানতে পারবে। আগে যা বলি মন দিয়ে শুনে নাও। ও দুই তৃতীয়াংশেরই মালিক। তোমার মা অর্থাৎ হেমলতা দেবী তার এক তৃতীয়াংশের ভাগ তাঁর নাতনির নামে করে দিয়ে গেছেন।
আলমারি থেকে দলিল বের করে দেখে গোবিন্দ চক্ষু চড়কগাছ। বললো," এসব কখন হলো আমাকে না জানিয়ে। তাহলে কি আমি এক তৃতীয়াংশের ভাগ পাবো।"
— হ্যাঁ, তোমরা এক তৃতীয়াংশের ভাগীদার। হয় তোমরা এক তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দেবে, নয়তো তুমি দুই তৃতীয়াংশের মূল্য দিয়ে কিনে নেবে। যা করবে তা তাড়াতাড়ি করতে হবে। কারণ মেয়েটাকেও মানুষ করতে টাকা লাগবে। বেগতিক দেখে গোবিন্দ বলে, " ও আমার মেয়ে। আমিই ওর আইনী অভিভাবক। আমি বর্তমান থাকতে আপনি কিভাবে ওর অভিভাবক হতে পারেন?
—বড়োবাবু ও হেমলতা দেবীই আমাকে ওর অভিভাবকত্ব দিয়ে গেছেন এই উইলে।কারণ তুমি ও মন্থরা দুজনেই সে দায়িত্ব পালন করো নি। অর্থাৎ তোমাদের ওপরে ওনারা ভরসা করতে পারেন নি।
— আপনি আমার মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখেছেন মানে তো আপনি বেআইনি কাজ করেছেন।
—বাঃ, তোমরা ঐ একরত্তি মেয়েকে সম্পত্তির লোভে মেরে তাড়িয়ে দেবে, সেটা আইনি আর আমি তোমাদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য লুকিয়ে রাখলে সেটা বেআইনি। তাই কি? আর তুমি কি আইনের রক্ষক,যে তোমাকে কৈফিয়ৎ দেবো?
পুলিশ অফিসার বলেন, " না, উনি কোন বেআইনি কাজ করেন নি। উনি পুলিশকে সব জানিয়ে ওর নিরাপত্তার কথা ভেবে করেছেন। আপনার স্ত্রী ওকে জীবন থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার সাক্ষী আছে।
—সাক্ষী আছে মানে?
—এই যে তুমি সামনে এসো তো।
যে ছেলেটিকে মন্থরা এই নোংরা কাজে নিযুক্ত করেছিলো, সে এগিয়ে এসে বললো," হ্যাঁ স্যার, এই মহিলা ওই ছোট্ট মেয়েটিকে
জীবন থেকে সরিয়ে দিতে বলেছিলো, যাতে ওর ভাগটা পুরো পেয়ে যায়। ইনিই সেদিন বাচ্চাটিকে মেরে তাড়িয়ে দেয়। যার জন্য ওনার শাশুড়ি মারা যান। আমি অর্থের লোভে এসেছিলাম ঠিকই, তবে আমি কিছু করিনি।
"এবার বুঝতে পারছেন তো যে আপনারা ধরা পড়ে গেছেন।" পুলিশ অফিসার বললেন।
এবার মন্থরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। গোবিন্দ মন্থরার দিকে ক্রুদ্ধ ভাবে চেয়ে থেকে বলে ," আমি তো এর বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানি না। তুমি আমার মেয়েকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন? আমি ভাবতে পারছি না।"
পুলিশ অফিসার বললেন, "একটা বাচ্চা মেয়েকে হত্যার ষড়যন্ত্র করার জন্য মন্থরা দেবীকে গ্রেপ্তার করা হলো।"
বিচারে তার দু বৎসরের কারাদণ্ড হয়। গোবিন্দ একজন জেলখাটা আসামীকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এবং তার কাছে ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেয়। তবে ছেলেটা তার। যদি মন্থরা ছেলেকে নিতে অস্বীকার করে তবে ছেলেকে সে গ্রহণ করতে পারে। মন্থরাও ছেলের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে। সুতরাং আর কোন দ্বার পরিগ্রহ না করে মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে থাকবে এবং উইল যেমন আছে তেমনই থাকবে। যোগেন খুশি হয়ে গোবিন্দকে মালতীর মেয়ের অভিভাবকত্ব ফিরিয়ে দেয় এবং এও স্থির হয় যে মালতীর ও মন্থরার ছেলের প্রতিপালনের দায়িত্ব তার শ্বশুর যোগেন গিরির হাতেই থাকবে। খরচ পত্তর যা লাগবে সব সে বহন করবে। কারণ তার পক্ষে বাচ্চা দুটিকে মানুষ করা অসম্ভব।
=======================
Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra