Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। চাবি ( পরিচ্ছেদ -৩) ।। সপ্তদ্বীপা অধিকারী

 

প্রেম

 চাবি 

সপ্তদ্বীপা অধিকারী 

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

 

শিপ্রা বলল-- "আরে ধ্যাত তুই তো কলমটা ধরতেই শিখিস নি তুই আবার নাম লিখবি কীভাবে?"

সমবয়সি হলেও  শিপ্রা এবার নয়ানজুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করেছে থার্ড ডিভিশান নয়ানজুলি গ্রামের মানুষগুলো অবশ্য ওই ডিভিশন টিভিশন বোঝে না"বোড পরিক্কায় পাশ" করেছে এইটাই খালি বোঝে

শিপ্রার বান্ধবী অমিতা মণ্ডলের বিয়ে ঠিক হয়েছে সবার মতো ওও নাম-ঠিকানাটা লেখা শিখতে  চায় চোদ্দ পার হয়ে পনেরোয় পড়েছে কী না

ওর ঠাকমা বুড়ি বলে--"মেয়ে মানষির বাড় কলা গাছের ঝাড়!"

অমিতার শরীর স্বাস্থ্য বেশ রসালো মাথা ভর্তি চুল একটু মোটার দিকেই তাই বয়সটা ঠিক ধরা যায় না চোদ্দকে আরামসে ষোলো বলে চালিয়ে দেওয়াই যায় আর এই বয়সের মেয়েদের চোখে-মুখে একটা আলগা চটক থাকে

তাই সবার ধারণা অমিতার বরও তাড়াতাড়িই যোগাড় হয়ে যাবে আর মেয়ে দেখতে এলে শিক্ষিত মেয়েরা কলম দিয়ে ধরে ধরে নাম ঠিকানা লিখবেই নইলে সে কেমন শিক্ষিত?

শিপ্রা বলে--"গত মাসে তোকে যে দেখতে এসেছিল তার খবর কী? "

অমিতা হাসে

বলে--" সে বলে গেচ খপর দেবে তা কিচুই খপর দেয়নিকো মরুকগে যাক বাবা বলতেলো মামার বাড়ির কাচে এট্টা ছেলে আচ তার মোবাইলির দোকান হেব্বি কাঁচা পয়সা সেকেনে ঘটক পেটকেচ কাল ঝতি আসে..!"

অমিতা হেসে থেমে যায় যদি সেই মোবাইলের দোকানদার আসে তাহলে ঠিকানা লিখতে হবে, তাই শিখতে আসা শিপ্রার কাছে

শিপ্রার মা ডাকে

--"শিপু মা ভাত বেড়িচি খেয়ি নে আর অমিতার ঝন্যিও বেড়িচ খেয়ি নিয়ি দুঝনা গল্প করগে ঝা..!"

শিপ্রা বলে--",ভাত খেয়ে নেই গে"

দুজনে খেতে বসে পান্তা ভাত আর আলু ভাতে পিঁয়াজ আর কাঁচা লংকা চটকিয়ে খায় ভাতের আমানি থাকার জন্য সড়াৎ সড়াৎ আওয়াজ ওঠে!

খাবার পর অমিতা বলে--" খাল পাড়ে যাবি?"

শিপ্রা বুঝে যায় গোপন কথা আছে কিছু সে কিছু না বলে হাঁটতে থাকে

গ্রামের বাইরে একটা সরু খাল অনেক নীচে তার অবস্থান খালের দুই পাড়ে ঘাস-লতা-পাতা আর ঝোপ টাইপের জংলা গাছ আর আছে দূর্বা ঘাসের গালিচা সেই দূর্বা ঘাসের গালিচার মাঝখান দিয়ে পায়ে চলা পথ চলতে চলতে ওই পায়ে চলা পথে আর ঘাস গজায় না! তাই তা  সাদা ধবধবে ওই পথ দিয়েই ছেলে-মেয়েরা "নয়ানজুলি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে"  পড়তে যায়শিপ্রাও যেত অমিতা এখনো যায় তবে মাঝে মাঝে বিয়ে ঠিক হলেই ছেড়ে দেবেআশেপাশের বেশ কয়েকটা গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এই স্কুলেই পড়ে এখানেই পলির ভাই সোনা পড়ত শিপ্রার থেকে বছর দুইএর সিনিয়ার শিপ্রা যেত সাইকেল চালিয়ে গ্রামের মেয়েরা প্রায় সব্বাই এখন সাইকেল নিয়েই যায় সোনা হেঁটে হেঁটেই যেত পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে হুশ করে শিপ্রা বেরিয়ে যেত  কবে যে সোনার মনে রঙ ধরেছিল তা শিপ্রা বুঝতেও পারে নি শুধু যাবার সময় দেখত একটা ছেলে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে এক পলকে দেখে ফেলত কিন্তু সেতো অনেকেই দেখে তাতে কী? মনে মনে শিপ্রার খুব অহংকার ছিল রূপের তাছাড়া পড়াশোনাতেও সে যথেষ্টই ভালো প্রতি ক্লাসে স্ট্যাণ্ড করে নয়ানজুলি গ্রামের মেয়েরা তো ওকে ছুঁতেই পারবে না কোনোদিন

পরপর কয়েকদিন স্কুল যাবার সময় দেখেছে, খালের পাড়ে, পায়ে চলা সরু রাস্তার পাশে স্কুল ড্রেস পরা একটা ছেলে বসে রয়েছে স্কুলে যাবার সময় বসে থাকতে দেখে ওর অবাক লেগেছিল তাই তাকিয়েছিল একবারই মাত্র ছেলেটা হেসেছিল শিপ্রার একদম হঠাৎ হাসিটা বেশ লেগে গেল সেও অল্প হেসে আবার তাকাল ছেলেটা হাত নেড়ে উঠে পড়ল তখনি ওর মনে পড়ে গেল ছেলেটা ক্লাস টেনে পড়ে নামটা ঠিক মনে পড়ছে না অবশ্য কিন্তু টেনে পড়ে এটা ঠিক ওর তখন এইট বছর দুইএর বড়ো হবে ছেলেটা উঠেই ওকে দাঁড়াতে বলল কিন্তু শিপ্রা দাঁড়াল না সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছুটির সময়েও সে দেখল ছেলেটা সেই মাঠের মধ্যে বসে ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল এবং ওকে সাইকেল থামাতে বলল শিপ্রা দাঁড়ায় নি ছেলেটাকে ওর খারাপ লেগেছে তা কিন্তু নয় তবে এরকম মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কথা বললেই গ্রামে বদনাম রটে যাবে তাছাড়া কোথাকার ছেলে, নাম-ধাম ওর ঠিক মনেও পড়ছে না তবে সত্যি কথা হচ্ছে এটাই যে, ছেলেটার হাসিটা বেশ! পরের সপ্তাহে অমিতা বলল--"শিপ্রা, সোনাদা তোর মোবাইল নাম্বার চেয়েচদোবো?"

শিপ্রা বলে--"সোনাদাটা আবার কেডারে?"

অমিতা বলে--"আহা! চিনিস না, না? ন্যাকামি করতি মেলা ভাল্লাগে বল!"

শিপ্রার ততক্ষণে মনে পড়ে গেছে বলল--"হ্যাঁ,মনে পড়েচ ওই যে মাঠের মদ্যি বসে থাকে !"

অমিতা বলে--"হুম শুধু তোর  মোবাইল নাম্বার নেবে  বলে স্কুলে যাবার সময় বসে থাকে তুই তো সাইকেল থে নামিসও না!"

শিপ্রা বলে--"যে কেউ নাম্বার চাইলেই বুঝি দিয়ে দিতে হবে?"

অমিতা বলে--"সে তুই ভেবে দেখ দেখতে তো খুব সুন্দর! চোখদুটো সোনাদার কিন্তু দারুণ!"

শিপ্রা বলে--"তা তোর যখন এতই ভালোলাগে তুইই নিয়ে নে না!"

অমিতা হেসে বলে--"আমার দিকে তো তার নজর নেই কো! আমার মোবাইল নাম্বার চাইলি ঠিক দে  দিতুম!"

সেদিন শিপ্রা কিছুতেই মোবাইল নাম্বার  দেয় নি তবে মাঝে মাঝে কোথাও দেখা হয়ে গেলে দুজনেই হাসত এক রবিবারে শিপ্রা আম বাগানে গেছিলজৈষ্ঠ্যমাসের গরমে প্রচুর আম পেকেছিল সেবার গরমের দুপুরে মাঝে মাঝে অমিতা আর শিপ্রা আম বাগানে যেত গাছ পাকা আম নীচেই পড়ে থাকত কতো ওরা দুইজন গল্প করত আর আম খেত সেদিনও সেরকমই আম খাচ্ছিল তবে সেদিন ওরা গাছে উঠেছিল পা ঝুলিয়ে বসে দুটো আম পেড়ে নিয়ে খাচ্ছিল ঠিক সেই সময় ওখানে সোনা আসে সোনাদের গ্রাম কুসুমতলি পাশের গ্রামটাই তাদের এই বাগানে আসাটা বড্ড বেমানান কিন্তু ওকে দেখে শিপ্রার খুব ভালোলেগেছিলশিপ্রার জন্যই সে যে এসেছে তা সে বুঝেছিল এবং  ওরা যে মাঝে মাঝে এইরকম নির্জন দুপুরে আমবাগানে এসে বসে থাকে এই খবরটা দিয়েছিল অমিতা, শিপ্রা তা বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয়ই  সোনা সোজা ওই গাছের নীচে এসে বলে--"শিপ্রা একটু শোনো তোমার সাথে কথা আছে"

শিপ্রা কী বলবে আর কী বলবে না ভেবে পায় নাকেমন যেন অপ্রতিরোধ্য ওর আওয়াজ

শিপ্রা বলে--"বলুন!"

সোনা বলে--"নীচে নামো!"

শিপ্রা বলে--"যা বলার ওখান থেকেই বলুন আমি শুনছি" নাহ! শিপ্রা কথা উচ্চারণ করতে পারে না মনের কথাটা জিহ্বা উচ্চারণ করতে পারল না বরং গাছ থেকে নেমে আসে সে

সোনার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সোনা বলে--"মোবাইল নাম্বারটা দাও!"

শিপ্রা অবাক হয়ে বলে--"আপনি কোন হরিদাস পাল বলুন তো, যে নাম্বার চাইলেই দিতে হবে!"

সোনা বলে--"আমার দুটো পরিচয়ই যথেষ্ট একআমি  পূর্ণিমা মানে পলির ভাই"

বলে সোনা চুপ করে যায় শিপ্রার সম্ভ্রম জাগে পলিকে চেনে না আশেপাশের গ্রামে এমন একজন মানুষও নেই পলি অসামান্য রূপবতী কিন্তু সেজন্য সবাই তাকে চেনে তা নয় পলির গুণের জন্যই সব্বাই তাকে সমীহ করে সে- একমাত্র ব্যক্তি যে অনার্সসহ গ্রাজুয়েট হয়েছে সংসারটাকে সুন্দর করে প্রতিপালন করছে এই অজ পাড়া গাঁয়েও তার ট্যুইশনির পরিমাণ দেখলে অবাক হতে হয় শুধু ছাত্র পড়িয়ে ওদের নিজেদের সংসার চালাচ্ছে ভাইটাকে মানুষ করছে সেই পলির ভাই সোনা সুতরাং তাকে সমীহ তো করতেই হয় শিপ্রা ভাবে অবশ্যই সে তার নাম্বার দেবে সে কোনোরকমে টেনেটুনে পাশ করেছে কী নিয়ে পড়বে বা কোথায় পড়বে এই বিষয়ে সুন্দর গাইড করে দিতে পারবেন তিনি সোনা বলল--"আর দ্বিতীয় কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি"

শিপ্রার ভীষণ হাসি পাচ্ছিলপ্রথম কারণের জন্যই এখুনি মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিতেই যাচ্ছিল! কী বোকা রে ছেলেটা কিন্তু বাস্তবে সেই শিপ্রা নামক মেয়েটা  হঠাৎ পিছন ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করল

সোনা এমন কাকুতি ভরা গলায় ডাকছিল যার কোনো ভাষা নেই অপূর্ব গলা! পুরো মাতাল মাতাল নেশা লাগছিল তার মনে হচ্ছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে যায় সে সোনার এই আহ্বান

কীভাবে বলছিল--"যেও না শিপ্রা প্লিজ শিপ্রা যেও নানাম্বারটা দাও নাগো! কি গো!"

শিপ্রার "কিগো" শুনেই এত্তো জোর হাসি পেয়েছে যা বলবার নয়! ওইভাবে কেউ ডাকে! ইসসস! ছিহ! অমিতাও শুনতে পেল! কি ভাবল! কিচ্ছু বোঝে না যেন সোনাভালোবাসলেই মানুষ মনেহয় এমনই পাগল পাগল হয়ে যায়!

অমিতা সেই আহ্বান উপেক্ষা করতে পারল না অথচ কী ভীষণ লজ্জায় আর ভালোলাগায় সে এগোতে পারে না সোনার দিকে ধীরে ধীরে সে যায় অমিতার কাছে

 বলে--"কীরে,নামছিস না কেন? পাড়ার কেউ দেখলে কী বলবে বলতো?"

অমিতা তখন মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে

লাফিয়ে গাছ থেকে নামলতারপরই দুই বন্ধু দৌড় দৌড় দৌড়!

তারপর যতবার দেখা হয়েছে সোনার সাথে, শিপ্রা মুখখানা নীচু করে নিয়েছে সোনার দৃষ্টি অনুভব করতে পেরেছে সমস্ত মন দিয়ে সোনা মুচকি মুচকি হেসেছে কিন্তু কোনো কথা  বলে নি খালি চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে অমিতা শিপ্রাকে একা পেলেই সোনার মতো কাতর গলায় সোনার স্টাইলকে অনুকরণ করে বলে--"বিশ্বাস করো, তোমাকে খুব ভালোবাসিখুব দাও না তোমার মোবাইল নাম্বারটা" আর দুজনে খিলখিল করে হাসে পাশের গ্রামে বাড়ি সোনাদের এদিক ওদিক যাওয়া-আসার সময় কখনো না কখনো তাদের দেখা হয়েই যেত সোনা আর কিচ্ছু বলে না অথচ  মুচকি মুচকি হাসে

সেদিন দাদুর সাথে হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় শিপ্রাদের বাড়ির পুকুরে সে শিপ্রার সাথে একজন পুরুষকে দেখে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল ভ্যান থেকে নেমে সোজা এগিয়ে যায় শিপ্রার

কাছে শিপ্রাদের বাড়ি চিনত এই মাঝরাতে শিপ্রার পাশে একজন পুরুষকে দেখেই তার মাথায় আগুন উঠে গেছিল কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সে সোজা গিয়েই পুরুষটির চুলের মুঠি চেপে ধরেছিল হকচকিয়ে যায় ছেলেটিও আর  শিপ্রাও রাত দুপুরে ভূতের মতো কে? যখন সে বুঝতে পেরেছে যে এই ছেলেটা কে অথবা বিষয়টা কী ততক্ষণে বাবা-মা জেগে গেছেনআশেপাশের বাড়ি থেকেও দুই একজন করে চলে এসেছে যে ঘটনা শিপ্রার জীবনে মোহময় জ্যোৎস্না রাতের মায়াবী সৌন্দর্যে মোড়া ছিল, প্রখর রৌদ্রে সেই স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটেছিল সোনারা জাতিতে ক্যাওড়া আর শিপ্রারা নিজেদের উঁচু জাতিভুক্ত করেছিল বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করে তারা ছিল ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত ফলে ক্যাওড়াদের তুলনায় উচ্চ জাতি হওয়ায় সোনাকে এক অপমানকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল সবাই একত্র হলে শিপ্রার বাবা পরের রবিবারে বিচার ডেকেছিল সোনাদের নিয়ে বিচার সভা ডাকা মানে অপরাধীকে তার অপরাধ স্বীকার করিয়ে নেওয়া হবে, অর্থদণ্ড এবং জুতোর বাড়িও খেতে হবে

এই সমস্ত ঘটনা ঘটে যাবার অনেক অনেক পরে অমিতা এসেছে শিপ্রার কাছে ওই ঘটনা ঘটে যাবার পরে পরেই সে আসতে পারেনি তাতে অনেক কথাই উঠত আর যেহেতু অমিতা ছিল উভয়ের দূত সুতরাং ওকেও বিচার সভায় ডাকা হতেই পারত ওকেও কারো পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাইতে বলা হলেও  হতে পারত এতোদিন বাদে অমিতা ওই হাতের লেখা শিখতে বা বিয়ের গল্প করতেই আসেনি সে এসেছে মূলত সোনার খবর নিতে সেই জন্যই এই আমবাগানে নিয়ে এসেছে বন্ধুকে

সময় এবং সু্যোগ বুঝে সে জিজ্ঞাসা করল-- "শিপ্রা,সোনাদার খবর কী?

 

ত্রিপর্ণা তার অমলেশকে যেন নতুন করে চিনছে প্রেম-ফ্রেম করে বিয়ে নয় এই বিয়ে তাদের দেখাশোনা করে রূপ ,শিক্ষা,অর্থ  ইত্যাদির  উপর নির্ভর করে শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজের মতো নির্দিষ্ট রঙ নইলে হবে না একেবারে নিঁখুত টেলারের হাতের কাটিং

সেদিন সারারাত তারা সাঁতার কেটেছিল সুখের সমুদ্রেমোবাইলে বেশ বড়ো একটা মেসেজ এসেছে তা খুলেও দেখেনি ত্রিপর্ণা বস্তুত বাড়ি বিক্রি করার পর সে তার সমস্ত নাম্বার থেকে সব্বাইকে ব্লক করেছে ওদেরকে আর দেখতেও চায় না ওদের কথা শুনতেও চায় না মেসেজটা আসার পর মাস দুই কেটে গেছে ত্রিপর্ণা খোলেনি ওই মেসেজ ফোনও করেনি সেদিন ছিল রবিবার উভয়ের ছুটি সকালে রাধুনির সাথে দুজনে রান্না বান্নায় একটু হাত লাগিয়ে ত্রিপর্ণা সবে বাথরুমে ঢুকেছে তখনি ত্রিপর্ণার মোবাইলে ঢুকল একটা  নতুন মেসেজ অমলেশ মোবাইলটা খুলে দেখল লেখা আরম্ভ এভাবে "দিদি,মা...!" এইটুকু দেখতে না দেখতেই  খুট করে  বাথরুমের দরজা খুলে ত্রিপর্ণা বেরল

ঠিক সেই সময় তাদের যত্নের বাগান গভীর কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল একই আকাশের পাশাপাশি দুই রূপ যেন দুই প্রতিবেশীর মধ্যে তুমুল শত্রুতার কারণে রেশারেশি কিংবা  গঙ্গা যমুনার মিলনস্থানের মতো অবস্থা পাশাপাশি কিন্তু নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখেছে মেশেনি কেউ কারো সাথে অথচ জন্মসূত্রে তারা দুজন একই রক্ত বহন করছে শরীরে বাগানের ভিতরে খুব বড়ো বড়ো গাছ লাগিয়েছে অমলেশ সেই গাছের মাথায় আকাশ উঁকি মারে সবসময় আকাশের ধর্ম আকাশ মান্যতা দিয়েই চলে কিন্তু কোথাকার কোন অধর্মের কারণে সেই গাছের প্রতিটি শাখার নীচে গাঢ় অন্ধকার সেই অন্ধকারের চোখ আছে নাক আছে মুখ আছে আছে দুই পাটি ঝকঝকে দাঁত সেই দাঁত বার করলেই আকাশে মেঘ ডেকে ওঠে হুড়মুড় হুড়মুড় করে মেঘেরা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়

দুনিয়ার সমস্ত কিছু নিজের নিয়মে চলছে খালি এই অন্ধকারের সচল দলাকে কেউ যেন চালনা করছে সেই চালিকাশক্তির কাছে যেন নতজানু হচ্ছে সেই অন্ধকারের দলা

ততক্ষনে ত্রিপর্ণা  চোখে মুখে খুশি আর  অকল্পনীয় আনন্দ  নিয়ে  অমলেশের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল কয়েক সেকেণ্ড তারপর সে  নিজেকে সঁপে দিল অমলেশের বুকে

 অমলেশ

বলল-- "আজ আর কোত্থাও যাব না! শুধু তোমাকে  দেখব" বলল বটে কিন্তু একটু পরেই বলল-- "এই, মুভি দেখতে যাবে!"

এই যে কোত্থাও যাব না বলা  এবং মুহূর্তেক পরেই 'মুভি দেখতে যাবে' বলার মাঝখানে একবার মনে মনে গঙ্গা সাঁতরানো হয়ে গেছে একবার বঙ্গোপসাগরে দুজনে হাবুডুবু খেয়েছে তারপর ত্রিপর্ণা ভেসেছে যেন চলন্ত নাগরদোলায় দুলেছে নেশার মতো এক আকর্ষণে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ আকাশের কোনে  শ্লেট রঙের মেঘের আবির্ভাব এবং ত্রিপর্ণা কিছু বুঝতে না বুঝতেই ঝরঝর বর্ষায় ভিজে গেল ত্রিপর্ণা ভিজল আর বাগানের কোনে ওই অন্ধকারের দলাটা লাফ দিয়ে একটা বড়ো গাছের মাথা থেকে অন্য গাছে পড়ল

আর ঠিক এই সময়ই ত্রিপর্ণা অমলেশের কানে কানে বলল--"তুমি বাবা হতে চলেছো!"

অমলেশ ত্রিপর্ণাকে চেপে ধরল বুকে সত্যি? ত্রিপর্ণার এখুনি মা না হতে চাওয়ার পরিকল্পনা কি ভেসে গেল? নি:স্বার্থ ভালোবাসা তাহলে চরম স্বার্থপর মানুষেরাও বাসে ত্রিপর্ণার জেদ চাকরির উন্নতি কিছুই আর নেই সে সার্থক এবং পরিপূর্ণ হয়েছে বলেই মনে করছে ত্রিপর্ণা মুভি দেখতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে আর ঠিক সেই সময় একটা গ্রামে একজন মাঝবয়সির মৃত শরীর কয়েকজনে মিলে বয়ে নিয়ে উঠোনের তুলসি গাছের তলায় শোয়াল ভদ্রমহিলার শরীরে এক বিন্দুও মাংস নেই হাড়ের উপর চামড়া হনু আর চোয়াল প্রকট হয়ে যেন কাকে অভিশাপ দিচ্ছেআসলে মায়েরা যখন সন্তানের ক্ষমার অযোগ্য কোনো অপরাধেও সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন, তখন শরীর এভাবেই প্রকট হয়ে ওঠে

দুটি ছেলে-মেয়ে পায়ের উপর পড়ে রয়েছে একজন মেয়ে এবং একজন ছেলে মেয়েটি কাঁদছে বোঝা যাচ্ছে তার ফুঁপিয়ে ওঠা এবং পিঠ কেঁপে কেঁপে ওঠা দেখে এক মেয়ের চোখের জলের বন্যায় মৃতার পা ভিজে যাচ্ছে যখন ত্রিপর্ণা তখন নিজের সুন্দর চোখ দুটোতে কাজল লাগাচ্ছে অমলেশকে ডেকে বলল--" এই অমল,বলো না কেমন লাগছে আমাকে!"

অমলেশ চুমু খেল আর পাশের বাড়ির সধবা শ্যামলের মা মৃতার মেয়ে আর ছেলেকে জোর করে তুলে ধরলেন

মেয়েটাকে বললেন--"তুই তো বড়ো এভাবে ভেঙে পড়লে ভাইকে সামলাবে কে?"

অন্য একজন ভাইকে জোর করে তুলে বলেন-- "তুই না পুরুষ মানুষ! দিদিকে না সামলিয়ে এভাবে ভেঙে পড়লে  চলবে?"

ছেলেটি মাটিতে গড়িয়ে পড়ল সবাই ছেলেটার মাথায় জল দিতে লাগল এই সময় মেয়েটা কেঁদে কেঁদে ফোলা দুটো চোখ মেলে চাইল

বলল--"কাকিমা, ভাই সাতদিনের বেশি হয়ে গেছে কিছু খায় না...!"

পাশের বাড়ির শ্যামল বলল--"মায়ের ক্যান্সার হবার পর থেকে পাগলের মতো আচরণ করত

বলত--"মাকে চিকিৎসা করাতে পারছি না রে শ্যামলদা চিকিৎসা দূরের কথা, দুবেলা দুমুঠো ভাত মাকে দিতে পারছি না! আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই!"

শ্যামল হাউ হাউ কাঁদে কাঁদে শ্যামলের মা

ঠিক সেই সময় হি হি করে হাসে ত্রিপর্ণা

দামি ডায়মণ্ডের সেটটা পরে অমলেশকে বলে--"কেমন লাগছে গো!"

অমলেশ মুখ ডুবিয়ে দেয় ক্লিভেজে

ভাই এতক্ষনে জ্ঞান ফিরে পায় লাল লাল চোখদুটো মেলে চায়

দিদি বলে--"ভাই রে, মায়ের পায়ের ছাপ নিতে হবে একটা সাদা কাগজ আর আলতা...!"

বোনের কথা শেষ হয় নাশ্যামলের মা এগিয়ে ধরেন সাদা কাগজ এগিয়ে ধরেন আলতার শিশি কেউ কেউ বলে ওঠেন --"বিধবার পায়ে আলতে লাগাস না!"

চমকে তাকায় মেয়েটাবলে--"কেন??"

কথাটা উচ্চারণ করেছেন পাড়ার একাদশী-দ্বাদশীর পরামর্শদাতা ক্ষেন্তি পিসিমা

বলেন--"বেঁচে থাকাকালীন তো তোরা ছেলেমেয়েরা একটু সুখ দিতে পারিস নি মরার পরেও নরকে পাঠাবি?"

মেয়ের মুখটা করুণ হয়ে উঠল "পিসিমা,মায়ের পায়ের ছবি যে সারাজীবন আমাদের আশীর্বাদ দেবে"

পিসিমা বিশ্রী মুখভঙ্গি করে বলেন-- "শুধু নিজেদের পাওনা নিয়েই ভেবে গেলি! মায়ের দিকটা ভাবলি না?বিধবাদের যে লাল রঙ ছুঁতে নেই!"

ঠিক সেই সময় অমলেশ বলল--"অসামান্য লাগছে তোমায়...আজ নাহয় সিঁথিতে সিঁদূর না- দিলে!"

ত্রিপর্ণা বলে--"কেন বলোতো?? সিঁদূর কেন পরব না!"

অমলেশ বলে--"যত্তোসব ব্যাকডেটেড কাজকর্ম ভাল্লাগে না!"

ত্রিপর্ণা বলে--"শাঁখাটাখা তো খুলেই ফেলেছি শাড়ি ছেড়েছি বিয়ের পরপরই মাথার মাঝখানে এক চিলতে সিঁদূর থাকলেই বা কী এমন ক্ষতি!"

অমলেশ বলে--"সিঁদূরে বিষাক্ত পদার্থ থাকে আমি চাই না আমার বাচ্চার কোনোরকম ক্ষতি হোক প্লিজ পর্ণা সিঁদূর পরো না হয়ে যাক যা খুশি কোরো বাঁধা দেবো না!"

মৃতার মেয়ে কাঁদে "মায়ের পায়ের চিহ্ন রাখলে কী এমন ক্ষতি হবে পিসিমা?"

দেখা গেল গ্রামের কেউই এই অনাচারের পক্ষে নয় মা বিধবা সুতরাং তাঁর শরীরের কোত্থাও লাল ছোঁয়ানো যাবে না মেয়ে শুয়ে পড়ল মায়ের পায়ের উপর"মা,মাগো! মা!"

ছেলের চোখদুটো টকটকে লাল আগুন নয়তো? যে চোখে জল নেই, সেই চোখ অতো লাল হলে সেখানে আগুনই থাকে

মৃতার বুকের উপর রাখা হল গীতার একটা ছোট্ট সংস্করণ দুই চোখে দুটো তুলসি পাতাকয়েকজন বাহক একটা কাঠের চৌকি এনে মৃতার পাশে রাখল

ত্রিপর্ণাকে অমলেশ বলছে--"এই গেঞ্জিটা পরো...!"

ত্রিপর্ণা বলে--"এই গেঞ্জিটা তো ভীষণ ডীপ কাট গো...! তুমিই তো এতোদিন পরতে দাও নি...!কী ব্যাপার বলোতো অমল!"

অমলেশ নিজেই জোর করে পরা গেঞ্জিটা খুলে নতুনটা পরিয়ে দিল বুকের অর্ধেকটা ফুলে বেরিয়ে থাকল অমলেশ মুখ ডুবিয়ে দিল

ত্রিপর্ণা বলল--"তোমার কী হয়েছে সত্যি করে বলতো অমল!"

অমলেশ বলে--"আমার সন্তানের মাকে আমি সাজাচ্ছি! তাতে তোমার এতো বাঁধা দেবার কী আছে?"

ত্রিপর্ণা অমলেশের হাত ধরে বার হচ্ছে তারা মুভি দেখতে যাচ্ছে আর এদিকে সেই কাঠের চৌকিতে তোলা হল মৃত দেহ তার গলায় পরানো হল রজনীগন্ধার মালা চৌকির চার কোনায় গোছা গোছা ধূপ জ্বেলে দেওয়া হল বডিটা দড়ি দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেওয়া হল পা দুটো ইংরাজি ভি অক্ষরের মতো অবস্থানে থেকে গেল  চারজন বাহক কাঁধে তুলে নিল কাঠের চৌকি সামনের দুজনের মধ্যে একজন মৃতার ছেলে মেয়ে কাঁধ দিল না কিন্তু পাশে পাশে চলতে লাগল পাড়ার অনেক মানুষ কাঁদছে হাপুশনয়নে হাউ হাউ করে মেয়ের চোখ ভাসছে ছেলের মাথা নীচু শরীরে এক বিন্দুও ক্ষমতা যেন তার আর নেই যেন সেইমাত্র, সেই মুহূর্তে তার প্রাণশক্তি শেষ হয়ে যাবে পড়ে যাবে মাটিতে মুখ থুবড়ে আর উঠবে না আর চলবে না এক পাও আর অক্সিজেন টানবে না  মৃত মায়ের ভীষণ অসহায় ছেলেটি চারজনের তিনজন চিৎকার করল--"বলো হরি...!"

সঙ্গী-সাথিও ধুয়ো দিল "হরি বোল...!"

তিনজন আবার বলল--"বলো হরি!"

সব্বাই চিৎকার করল--"হরি বোল...!"

মোট তিনবারই বলল ঠিক তখুনি ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে মাটির রাস্তার ধুলোর মধ্যে শুয়ে পড়ল

"মা,মাগো ক্ষমা করো না আমাকে...! আমাকে শাস্তি দাও মাগো...!"

তাহলে আগুন নয়, ভিতরে জলই ছিল ছেলেটার! সে রাস্তার ধুলোর মধ্যে বসে পড়েছে শুয়ে পড়ছে হাহাকার করছে!

পাড়ার সব্বাই কাঁদছে

একাদশী-দ্বাদশীর পরামর্শদাতা ক্ষেন্তি পিসি বলে ওঠে--"ডাক্তার বলেলো, মুম্বাই নি গিলি অপারেশান করালি সেরি যাবে পয়সার অভাবে যাতি পারে  নিকো একমাত্র ছেলে তো! আফশোস করে মরতেস!"

বলতে বলতে ছেলের মাথায় জল দেয় কেউ কেউ বা মুখ হা করিয়ে জল ঢেলে দেয়ছেলেটা উঠে দাঁড়ায় একটুক্ষণ চুপ করে থেকে চলতে আরম্ভ করল যেন কোথাও থেকে শক্তি সঞ্চয় করে নিল তারপর চলতে আরম্ভ করল

আবার গলার শিরা ফুলিয়ে কেউ বলল--"বলো হরি...!"

সব্বাই জবাব দিল--"হরি বোল...!"

বিধবা চার বেহারার কাঁধে চলতে লাগল ঠিক সেই সময় ত্রিপর্ণা গাড়ির এসি চালিয়ে বসল বিধবা মহিলাকে আষ্টেপৃষ্ঠে কাতার দড়ি দিয়ে বাঁধা হল ত্রিপর্ণা সিটবেল্টে নিজেকে আটকে নিল বিধবা চললেন সব কিছু পিছনে ফেলে অমলেশ অন্য দিকের দরজা খুলে বসল ত্রিপর্ণা বলল --"গান চালাও" আধুনিক  হিন্দি গানের লায়লাপ্পা মিউজিক বেজে উঠল মরদেহ বহনকারীর দল চিৎকার করে উঠল--"বলো হরি...!"

সাথি ধুয়ো দিল--"হরি বোল!"

চলার তালে তালে মড়া দেহের মাথাটা দুলে দুলে উঠছে

এসির মধ্যে  সুন্দর মিউজিক বেজে উঠল--"তুমহে যো পাঠান...!"

ত্রিপর্ণা এক হাতে তুড়ি বাজায় আর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তাল দেয়

 

যতখানি সুখী মনে গর্ভ ধারণ করেছিল ত্রিপর্ণা, যত দিন যাচ্ছে ততই যেন  গাছ থেকে  শুকনো পাতা খসে  পড়ার মতো  সুখ খসে খসে পড়ছে ত্রিপর্ণা মাঝে মাঝে ভাবছে তার এই চিন্তা অমূলক অমল তাকে ভালোই তো বাসে কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটা দূরত্ব থেকেই যাচ্ছে যেন মাঝে মাঝে প্রকট হয়ে উঠছে উভয়ের মধ্যেকার দূরত্ব ত্রিপর্ণা ছুটিতে আছে তার খাওয়া-দাওয়ায় অমলেশ এক বিন্দুও অবহেলা করে না কিন্তু ওইটুকুই যেন মনের থেকে অমলেশ অনেক দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে রাতে  অমলেশ শুয়ে থাকে পিছন ফিরে ত্রিপর্ণা যদি ডাকে তো তার দিকে ফেরে কিন্তু দুই সেকেণ্ডের মধ্যে আবার দূরে সরে যায় ত্রিপর্ণা বলে--"আমাকে তুমি আর ভালোবাসো না, অমল!"

 অমলেশ যেন তৈরি হয়েই ছিল

কী বিশ্রী টোন করে বলল-- "আচ্ছা! তাই নাকি? তো কে ভালোবাসে শুনি!"

ত্রিপর্ণা অবাক হয় কষ্ট পায় তার অমল তাকে আর যেন ভালোবাসে না আর যেন  কাছে আসতেও চায় না

কষ্ট গিলে নিয়ে সে  বলে--"কে ভালোবাসল বা কে বাসল না, তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই শুধু তুমি ভালোবাসলে অথবা না বাসলে আমার মাথাব্যথা আছে তোমাকে নিয়েই আমার সুখ আমার শান্তি"

অমলেশ বলে--"এই শোনো আদিখ্যেতা করো না তো! অসহ্য লাগছে!"

ত্রিপর্ণা বুঝতে পারছে সত্যিই অমলেশের একটা কিছু তো হয়েছেই শ্যিওর! কিন্তু কী হয়েছে সেইটা কেন যে তার অমল তাকে বলছে না!

ত্রিপর্ণা আর কিছু বলে না অমলেশকে আর অমলেশের ভালোবাসাও চায় না! জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায় না সে নীরব হয়ে যায় কিন্তু বুঝে পায় না ভালোবাসা নীরব হলে মন এতো কাঁদে কেন? অমলেশ সারাটা রাত পিছন ফিরে ঘুমায় ত্রিপর্ণাও আর ডাকে না

একদিন তখন মাঝরাত ঘুমের মধ্যে পাশ পাশ করতে করতে ত্রিপর্ণা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল শরীরটা তো এখন বেশ দুর্বল খেতে পারে না ঠিক মতো তো কখন যেন গভীর ভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে ত্রিপর্ণা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ সে চমকে ওঠে আর  তার এতো সুন্দর গভীর ঘুমটা ভেঙে যায় এবং কেন ভেঙে যায় বা কী ঘটেছিল কয়েক  সেকেণ্ড পরেই সে বুঝতে পারে ঘুমের মধ্যে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যেন ত্রিপর্ণা পা তুলে দিয়েছিল অমলেশের গায়েঅমলেশ ত্রিপর্ণার পা-টা ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে চমকে জেগে উঠেছে ত্রিপর্ণা! বিষয়টা বুঝতেই ওর চোখদুটো জলে ভরে উঠেছে সে না ডেকে পারল না আজ অমলেশকে অমল তার পা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে কিন্তু এখন কেমন ঘুমের ভান করে তার  বিপরীত দিকে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে ত্রিপর্ণা অমলের পিঠে আস্তে করে হাত ছোঁয়াল

বলল--"কী হয়েছে অমল?"

অমলেশ কথা বলে না কিন্তু ত্রিপর্ণা বুঝতে পারে সে জেগে আছে সে আবার বলে--"অমল কী হয়েছে তোমার?"

অমলেশ নিরুত্তর!

ত্রিপর্ণা এবার অমলেশের  আরো কাছে সরে যায় মাথার চুলে  হাত দিয়ে বলে  --"আমাকে বলবে না,অমল?"

অমলেশ ত্রিপর্ণার হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে বলে--"উফফফফ! একটু শান্তিতে কি ঘুমাতেও পারব না?"

ত্রিপর্ণা উঠে বসে পড়ে

বলে--"আমি তোমাকে শান্তিতে ঘুমাতে দেই না?"

অমলেশ বলে--"আরে ভাই, ঘুমাও না! আমাকেও ঘুমাতে  দাও! তুমি তো সারাদিন ঘরে বসে বসে ঘুমাবে! আমার অফিস আছে সকাল আটটাতে বেরতে হবে আর সেই সন্ধেবেলায় ফেরা!"

ত্রিপর্ণা বলে--"অমলেশ, আমার কথার জবাব আজ তোমায় দিতেই হবে! আমার পা ওভাবে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে মারলে কেন? আমি তোমারই বিয়ে করা বউ আমি এখন  গর্ভবতী কী এমন ভুল বা অপরাধ করেছি যে আমার সাথে এইরকম আচরণ করছো?"

অমলেশ বলে--"জাস্ট মুখটা বন্ধ করো আর আমাকে ঘুমাতে দাও ওকে?"

ত্রিপর্ণা বলে--"না আজ পরিষ্কার করে নিতে হবে এনাফ ইস এনাফ!"

অমলেশ এবার ত্রিপর্ণার দিকে ফেরে

বলে--"কীসের এনাফ ইজ এনাফ! কীসের  কী পরিষ্কার করে  নেবে?"

বলল--"তোমার মুখের দিকে না তাকাতে পারি না! আগে যদি জানতাম না যে তুমি এতো কুৎসিত কোনোদিন  তোমাকে বিয়ে করতাম না!"

ত্রিপর্ণা যেন কী শুনছে তা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না!

সে বলছে--" আমি কুৎসিত? আমাকে বিয়ে করতে না?"

কথাগুলো সে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারণ করছে কিন্তু কথা যে বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী, কথা যে এক মুহূর্তেই মানুষকে মেরে ফেলতে পারে তা আজ সে পরিষ্কার বুঝতে পারল পেটের সন্তানটা তো এই চরম স্বার্থপর এবং নিষ্ঠুর মানুষটার রক্তই  বহন করছে! এক মুহূর্তে  তার কাছে অমলেশের চরিত্র যেন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল! তার মধ্যে শুধুই স্বার্থপরতাই আছে কাজ হাসিল করতে গেলে এই অমল যে কোনো কাজই করতে পারবে তার মনে পড়ে গেল পরানপুরে গিয়ে নিজের মাকে সে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম পর্যন্ত করেনি কারণ সে জানত যে তার বৃদ্ধা মাকে প্রণাম না করলেও সমস্ত সম্পত্তি সে পাবেই আবার তার গ্রাম ধরমপুরে গিয়ে কিন্তু তার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছে কারণ সেখানে টুপি পরানোটা একটু কঠিন ছিল আজ ত্রিপর্ণা গর্ভবতী এই সময় একটু বেশি ভালোবাসা, একটু বেশি যত্ন সব মায়েরাই চায়! ত্রিপর্ণার

এমনই কপাল যে এই সময়েই সে এত্তোখানি অবহেলিত এবং এত্তোখানি উপেক্ষিত হচ্ছে যা তার সহ্যশক্তির বাইরে ত্রিপর্ণা এইসব ভাবছে আর ওর চোখ থেকে হু হু করে জল ঝরে পড়ছে অমলেশের চোখে  ত্রিপর্ণার অশ্রুর বেদনার কোনো অস্তিত্বই যেন নেই এদিকে

অমলেশের কেমন যেন রোখ চেপে গেছে যে কথাগুলো দীর্ঘদিন মনের মধ্যে তোলপাড় করছিল সেইগুলো যেন বিষের মতো উগরে দিতে লাগল সে!

বলল--"কুৎসিত কী না বোঝো না? আয়নায় দেখো না নিজেকে?"

ত্রিপর্ণা চেয়ে আছে চেয়ে আছে তো চেয়েই আছে শিকারি যখন একটার পর এক তির ছোঁড়ে, অসহায় হরিণ শিশু যেমন অবাক হয়ে যন্ত্রণা সহ্য করে ঠিক তেমন করে সহ্য করে ত্রিপর্ণা! বুকের মধ্যে তোলপাড় করে তার! সে কুৎসিত?

ধীরে ধীরে ত্রিপর্ণা বলে--"আমি যদি এতোটাই কুৎসিত তোমার চোখে তো বিয়ে করেছিলে কেন? আমাকে তিন তিনবার দেখতে গেছিলে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, আমার রূপ,আমার স্যালারিও তোমার জিজ্ঞাস্য ছিল বিয়ের আগে...! আর এখন সবে গড়ে উঠেছে আমাদের সম্পর্ক, আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি...! এখন বলছো আমি কুৎসিত?"

অমলেশের ভিতরে এতোখানি নোংরা জমে ছিল তা মনেহয় সে নিজেও জানত না!

সে বলল--" আরে বাবা আয়নায় নিজেকে নিজে দেখো না একবার চোখের কোনে কালি শুকনো যেন শুটকি মাছ হয়ে উঠছে দিনদিন  আমি তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না!"

ত্রিপর্ণার মুখে আজ আর ভাষা নেই কোনো সে সম্পূর্ণ চুপ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখে গেল অমলেশকে! সে কুৎসিত! আর কী যেন বলল...! কী যেন!

"শুকনো যেন শুঁটকি মাছ হয়ে উঠছে দিনদিন!"

ত্রিপর্ণা কয়েক মিনিট হয়ে গেল বসেই থাকল বসেই থাকল তার পৃথিবী আজ শূন্য এক বিশাল মহাশূন্যে সে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সকলকে ছেড়ে সে আশ্রয় নিয়েছিল আকাশে, সেই আকাশ বুঝিয়ে দিয়েছে যে তার বুকে ত্রিপর্ণার ঠাঁই নেই মিথ্যে ভালোবাসা মিথ্যে সংসার মিথ্যে তার জন্মও এমন কি সে যাকে  জন্ম দিতে চলেছে সেও  বুঝি মিথ্যে! ত্রিপর্ণা নিজের পেটে হাত দেয় চোখ থেকে তখনো তার জল গড়িয়ে নামে নামতেই থাকে বুকের মধ্যে কবে কবে জমেছিল এতো দীর্ঘশ্বাস? কই কখনো তো টের পায়নি ! কেঁপে কেঁপে সেই দীর্ঘশ্বাসগুলো যেন বেরিয়ে আসে সঙ্গে করে সে হাহাকারকেও নিয়ে বের হয় মুখ দিয়ে! এতো হাহাকার কোথায় ছিল এতোদিন? দীর্ঘশ্বাসের সাথে হাহাকারের বন্ধুত্ব হলে এভাবেই বুঝি শব্দ হয়? এভাবেই বুঝি ফেটে যেতে চায় বুক

নিজের মধ্যেই নিহিত ছিল এতোক্ষণ ত্রিপর্ণা... গর্ভবতী ত্রিপর্ণা!

হঠাৎ অমলেশ উঠল ওর দিকে ফিরে চেয়ে বলল--" এই কানের কাছে ফচফচ করবে না তো! উফফফ! অসহ্য!"

কানের কাছে ফচ ফচ? ত্রিপর্ণা কাঁদতে কাঁদতে নাক টানছিল সেই শব্দটাও অসহ্য লাগছে অমলেশের!

ত্রিপর্ণার ধৈর্য্যের বাধ ভাঙতে বসেছে বুঝি বা! একইসাথে দুইজনের ধৈর্য্যচুতি ঘটলে ভেঙে যেতে এক লহমাও লাগে না! ত্রিপর্ণা চেষ্টার ত্রুটি করবে না সে চোখদুটো ডলে নিল তারপর বলল--"আমি ঘরে গিয়ে শুচ্ছি! তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব করার জন্য দু:খিত!"

ত্রিপর্ণার মাঝে মাঝে কী যে হয়! পৃথিবীতে কাউকে ভালোবাসে না সে নিজেকে ছাড়া সেই ত্রিপর্ণাই নিজের থেকেও বেশি পছন্দ করে  এই মানুষটাকে! এই একটাই মাত্র মানুষ তাই তাকে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে এই মানুষটাই ভালোবেসে তাকে পাগল করে দিতে পারে! আবার ঘৃণা করে খুনও করতে পারে! ত্রিপর্ণা জানে না সে ভুল করছে কী না কিন্তু সে কী করবে? সে তো অসহায়! মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই তার

অমলেশ হঠাৎ বালিশটা ছুঁড়ে মারল ত্রিপর্ণার গায়ে তারপর বলে উঠল--"নিকুচি করেছে এমন সংসারের ! আজ থেকে আমি বাইরের ঘরে সোফাতেই শোবো!"

ঠিক এই সময়েই  সেই গাছের মাথার কালো অন্ধকার আজ আবার সচল হল এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেই অন্ধকারের দলা কোনো নির্দিষ্ট প্রাণীর অবয়ব তার নেই কিন্তু সেই অবয়বহীন অন্ধকার যেন তার অবস্থান চিনতে চাইছে পৃথিবীতে জন্মসূত্রেই প্রতিটি প্রাণী বা জড় পদার্থ কিছুটা জায়গা জুড়ে থাকে ওই জায়গাটুকুই তার অধিকার ওইটুকু তার নিজের ওই অন্ধকারের তাল যেন তার নির্দিষ্ট জায়গা খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে নিজের অবস্থান জানা না গেলে নিজের অবয়বও আকৃতি পায় না তাই কি তার এতো ছটফটানি?

অশ্রুতে ভাসতে ভাসতে  কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ত্রিপর্ণা

ঘুম ভেঙে দেখে চোখের জলে বালিশ ভেজা গালে জলের দাগ আর অমলেশ তার ঘরে নেই ত্রিপর্ণা ঘড়ির দিকে চাইল সাতটা পঁয়ত্রিশ আটটার আগে কখনো বের হয় না অমলেশ আজ পঁচিশ মিনিট আগেই বেরিয়েছে ব্যাপারটা স্পষ্ট তার সাথে কথা বলতে চাইছে না তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে মারাত্মকভাবে ত্রিপর্ণা অনেকক্ষণ ভাবল কী হতে পারে? যাই কেন না ঘটুক তাকে অমলেশ আর ভালোবাসে না এই যন্ত্রণায় শেষ হয়ে যাচ্ছে ত্রিপর্ণা মনে মনে

নিজের রুম থেকে বেরিয়ে সে দেখল কাজের মেয়েটা গুনগুন করে সুর ভাজতে ভাজতে ঘরে ঝাড়ু লাগাচ্ছে মেয়েটা ভোরে আসে সারাদিন থাকে রাতে ফিরে যায় ত্রিপর্ণা গর্ভবতী হবার পর থেকে এই ব্যবস্থা আগে একজন ঠিকে ঝি ছিল সে দুইবার আসত তাকেই বলা হয়েছিল কিন্তু সে সারাদিন থাকতে পারবে না বলে জানিয়েছিল সে অনেক বাড়ি কাজ করে বেশি টাকা দেবার কথাও বলেছিল ত্রিপর্ণা কিন্তু সেই বয়স্ক মহিলা বলেছিল  যে, সে বহু বছর ধরে যে সব বাড়িতে কাজ করে সেগুলো এখন তাঁর পক্ষে আর ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয় না,বেশি টাকা দিলেও নয় সে- এই অল্প বয়সি মেয়েটাকে এনে দিয়েছিল

মেয়েটা কাজ ভালোই করেখালি একটু চঞ্চল টাইপের খুব সাজগোজ করে কাজ করতে করতে হাসে হাসতে হাসতে গান করে কাজ খারাপ করে না কামাইও নেই কিন্তু ওই চটুল গান করে খুব ত্রিপর্ণা বলল--"তোর দাদাবাবু কখন বেরিয়েছে রে?"

মেয়েটা গান থামিয়ে হাসে বলে --"সেতো অনেকক্ষণ মোরে বললে, এট্টা অমলেট কদ্দে আর চা বলে বাথরুমে ঢুকল আর বেরগে এই অমলেট আর চা খেয়ে চলে গেল"

বলেই বুকের ভিতর থেকে একটা  পাঁচশত টাকার নোট

বার করে বলল--"মোরে এই ট্যাকা দেচে আর তোমার ঝন্যি কাল ভালো দেখে টক-ঝাল আচার নে আসতি বলেচ!”

দাদু আর ঠামি চলে যেতে পলি বুঝতে পারে যে, পুরুষ এক বিষম চিজ সমাজে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও রাত দুপুরে তার দরজায় ধাক্কা মারে কেউ কেউ আবার দূর থেকে ঢিল ছোঁড়ে সোনা একদিন রেগে গিয়ে বলে--"দিদি, আমি বাইরে ঘুমোবো দেখি কে দরজা ধাক্কায়"

পলি জানে ভাইটা তাকে প্রাণাধিক ভালোবাসে

 সেই ভাইকে কিছুতেই বিপদের মুখে ফেলতে পারে না যে ছেলেরা রাতের অন্ধকারে তার দরজা ধাক্কায় তারা সব্বাই ওই সময় তাড়ি খেয়ে মাতাল হয়ে থাকে তখন তাদের কাছে মা-বোনের সম্মানেরও কোনো দাম থাকে না এই নিয়ে অশান্তি করলে চলবে না এই সমস্যার আশু সমাধান দরকার পলি প্রথমেই সোনাকে সামলালো বলল--"দেখ ভাই, এসব নিয়ে মাথা ঘামাস না আমিই দেখছি কী করা যায়!"

পলি অনেক ভাবনা-চিন্তা করল জানে, যে মুহূর্তে ভালো রেজাল্ট করে পাশ করেছে সেই মুহূর্তে গ্রামের মানুষ ওর পড়াশুনা মেনে নিয়েছে যদি কোনো স্কুলে/কলেজে পড়ানোর চাকরি নিত, তাহলে আর কোনো সমস্যাই হতো না!এসেছিল সুযোগ কয়েকটা গ্রামের আশেপাস থেকেই

কয়েকটা স্কুল/কলেজ ডেকেছিল পলি যায়নি মানুষ আজকাল খারাপ-ভালোর বিচার করে ফল দেখে কাজ দেখে নয় যে কাজের ভালো ফল নেই, সেই কাজ মূল্যহীন আর ভালো ফলের সাথে অর্থের একটা সোজাসুজি যোগাযোগ থাকতেই হবে নইলে ভালোর ভালোত্ব টকে যাবে পচে, গলে খসে পড়বে কিন্তু পলিও এতো সহজে হাল ছাড়ার পাত্রী নয়

পলি জানে এখন এইরকম কিছু ঘটনা ঘটলে গ্রামের সব্বাই তারই দোষ দেবে বলবে--"এতোটা বয়স হল তবুও বে কেন করোনিকো?"

শুধু তাইই নয়, এর সাথে জুড়বে পলির নিজেরই  আরও কোনো না কোনো চারিত্রিক দোষ পলি জানে সে তখন গভীর চিন্তা করছে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী হতে পারে

রাতে আজকাল তার ভালোভাবে ঘুমও হয় না দাদু ঠিকই বলতেন--" একজন মেয়ের পক্কে একা একা কিছু করা প্রায় অসম্ভব রে দিদু"

দাদু আর ঠামি ছিলেন তো তাদের সুখও ছিল আজ যেন সব উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে দাদু মানুষটাই ভীষণ মায়াময় আর ঠামিও দুজনের মিল ছিল দেখবার মতো দাদুকে সাপে কামড়িয়েছে শুনেই ঠামির কার্ডিয়াক এরেস্ট হল আর ঠামিকে চিরকালের জন্য নিয়ে যাবার সময়েই দাদু একদম হঠাৎ কাঠের পুতুলের মতো গড়িয়ে পড়লেন উঠোনে যেন ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু ঠামির শরীর থেকে প্রাণটুকু চলে গেলেই দাদুর শরশয্যা শুরু হল আর ঠামির শরীরটা নেবার সময়েই দাদুও তৈরি হয়ে গেলেন বললেন--"সরমা মোরে  একলা রেখে কোম্নে যাতিচো? ড্যাঁড়াও মুইও এসতিচি"

 মৃত্যুর পর গ্রামের সব্বাই নাকি দাদু-ঠামিকে দেখতে পায় হর-গৌরী রূপে

সে  যদিও দেখেনি একদিনও

পাড়ার বিশের মা তো গলায় কাপড় দিয়ে নাকি প্রণাম করেছে দাদু-ঠামিকে অবিকল হর-গৌরীকেই তিনি নাকি দেখেছেন গ্রামের বারোয়ারি মন্দিরে দাদু-ঠামির মূর্তি বসানোর কথা চলছে পলিকেও অনেকেই বলেছে পলি হেসেছে কী বলবে ? শেষ পর্যন্ত সেদিন সব্বাই মিলে চাঁদা তুলছিল যখন, তখন বলেছে--"আমার দাদু-ঠামির মূর্তি বসাবে যখন আমিই খরচটা করব"

সব্বাই প্রায় হই হই করে উঠেছে

"তোমার দাদু-ঠামি মানে? মোদের কেউ না তিনি?"

পলি হাত জোড় করেছে

"ভুল হয়ে গেছে নিশ্চয়ই তাঁরা দুজন পুরো কুসুমতলি গ্রামের আমার একার কেন হবেন?"

গ্রামবাসীরা বলে--"শুদু মোগা গেরামের নয়কো তাঁরা ছেলো স্বজ্ঞের হর-পাব্বতী কোন জরমে মোগা কী সুক্কিত্তি ছেল তাই মোগা গেরামে জরম নেচে!"

বলে সবাই কপালে হাত ঠেকায় পলির সুখ আর অসুখ সব এই গ্রাম নিয়ে এই গ্রামের মানুষেরা অশিক্ষিত এরা ভালো-মন্দ বোঝেনা নিজেদের বিশ্বাসভালোবাসা নিয়ে চলে পলি তাই এদের দোষ দেখে না যে কোনো মূল্যেই এদের পরিবর্তন করার পক্ষপাতী সে সে জানে তার জন্য সময় লাগবে সময় দিতে সে প্রস্তুত তবুও এই হতভাগা গ্রামবাসীকে ছেড়ে সে কোত্থাও যাবেনা

সেদিন দুপুরে পলি ঘরের কাজ করছিল এখন সে নিজেই ঘর-সংসার সামলায় টিউশানিও করে মাস্টার্স করবে বলে ভাবছে পলি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার খুব সমস্যা কলকাতায় থেকে করা যায় কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাইটা একা হয়ে যাবে সংসারটাও যাবে ভেসে পলি ভাবছে কীভাবে সব দিক রক্ষা করা যায় সেইসময়ই গ্রামের জ্যেঠিমা একদিন দুপুরে এসে হাজির

"পলি মা, কী কত্তিচিস?"

পলি বলে--"এইতো জ্যেটি বলো"

জ্যেঠিমা পলিদের ঘরেই চলে এসেছেন আগে যে দূরত্বটুকু ছিল, এখন সেটুক আর নেই পলির যতোই গুণ থাকুক না কেন, সে এখন অসহায় সে এখন অভিভাবকহীন তাই তার ভালোর জন্য যে কেউই উপদেশ দিতে পারে বিনা অনুমতিতে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতেও পারে আগেও পলিকে সব্বাই ভালোবাসতো কিন্তু আগে যে দূরত্ব ছিল সম্ভ্রমের, এখন আর তা নেই অভিভাবকহীন মেয়েরা সারাজীবনই সবার করুণা কুড়োয় না চাইলেও পলি বলে--"বসো জ্যেটি এট্টু চা বসাই"

জ্যেঠি হাসে বলে--"না, না এই অবেলায় আর চা খাবনিকো খেতি অনেক বেলা হয়ি গিয়েলো প্যাটে কেরাম ভরা ভত্তি নেগতেচ একুন আর চা খাবনিকো"

বলে একান্ত আপন মানুষের  মতো ফিশফিশ করে--"বলি, তোর তো বয়েস হইয়েচ এইবেলা বে টা কন্নিলি পাত্তিস!" পলি চেয়ে থাকে জল কোন্ দিক থেকে কোন্ দিকে গড়াচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে!

জ্যেঠিমা বলেন--"শোন, মুই এট্টা কতা বলি মোর ভাসুরপোর মাসির ছেলের বন্দু খুব ভালো ছেলে অনেক জমি আচ চাষ করে আর মোবাইলির দোকানও আচ আবার ওকেনগার বেশিরভাগ মানুষ তো গরিবগুর্বো তা তাদের গে ট্যাকা দে সাহায্য করে একোন সারা জেবন তো কেউ দেকবে না তুইই বল ভোরডা জেবন কেউ ট্যাকা দিতি পারে? সেই ঝন্যিতি জমি বন্দক রেকে ট্যাকা দেয়"

পলির  কানে কথার অনৈতিকতা ভারী পাথরের মতো যেন আছড়ে পড়ল সে বলল--" কী? কী বললে?"

জ্যেঠি বুঝতে পারলেন

বললেন--"আরে বাবা ঝেরাম করেই হোক না কেন,দুটো পয়সা তো করতি হবে ওদের বাড় সেই উত্তুরে সেকেনে গে দেক গে যা তুই বলে, ঝতদূরি চোক যাবে, ততকানি পেলয়ের জাগা"

পলি বলে--"কী?"

জ্যেঠি বলেন-- "ছোঁড়ার নাম হচ্চে গে পেলয় পেলয় মণ্ডল"

পলি দীর্ঘশ্বাস ফেলল

"কোথাকার কোন্ প্রলয় বসে বসে গরিবদের রক্ত শোষণ করে খাচ্ছে সে নাকি তার বর হবার যোগ্যতা অর্জন করেছে কেমন করে? না, ঘুষের ব্যবসা করে! হায়রে পোড়ার দেশ!"

মনে মনে বলল

জ্যেঠিমা বলেন--" তেবে আর বলচি কী? সেইরাম বাড়ি করেচ এককান!"

পলি ভাবে তাদের গ্রামগুলো এইসব প্রলয়দের হাতে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে! আহা! কতো মা চোখের সামনে দেখছে তাদের সন্তানরা এইসব প্রলয়দের হাতে পড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে!

জ্যেঠি বলেন--" এরাম্ভায় করেচ বলেই না একুন তার সহায়-সম্পত্তি হইয়েচ তা মুই তারে কতা দে দিচি"

পলি অবাক হয়!

বলে--"কী কতা দে দেচো?"

জ্যেঠি বলেন--"বলিচি মোর মেয়িরে বে করো সে দু তিনটে পাশ দেচে"

পলি বলে--"ওমা সেকি কতা জ্যেটি? মুই তো ঝারে-তারে বে কত্তি পারব নাকো!"

জ্যেঠি বলে--"ঝারে তারে বে কত্তি বলতিচি তোরে?"

পলি বলে--"তুমি বুজতি পাত্তিচো নাকো জ্যেটি!"

জ্যেঠি বলে--" খুব বুজিচি বোজবো না কেন? তোমার মা-বাপ মোরে বদ্দি বলতো তোমার দাদু-ঠামি মোরে নিজির প্যাটের সোমতান বলি ভালোবাসতো তা তারা সব গেচে খ্যায় হয়ি একুন মুই আর কেডা!"

বলে জ্যেঠি উঠে পড়ে পলি জ্যেঠিকে জড়িয়ে ধরে

বলে--" জ্যেটি, তুম ঝতি রাগ কোরে মুক ঘুইরে চোল যাও থালি মুই আর কারে বলব মনের কতা!"

জ্যেঠি দাঁড়ান অন্য কিছুর গন্ধ পান বলেন--"তা মুই কি পর তোমার বাছা? মোরেই বলতি পারো?"

পলি বলে--"আসলে সোনার সাতে শিপ্রার বে দিতি হবে তারপর মুই নিজির কতা ভাববো নইলি ভাইডারে একা একা ফেলি কোম্নে সংসার কত্তি যাব বলোদিন জ্যেটি!"

পলি এমন একটা যুক্তি আনতে পেরে মহা খুশি উফফফফ! ফাঁড়া তো কাটাতে পেরেছে! বাপরে! বাপ! সুদখোর প্রলয়কে বিয়ে করবে পলি? মরে গেলেও না!

জ্যেঠি বলেন--"থালি শিপ্রার বাবা মত দেচে ক্যাওড়ার পোর ঘরে মেয়ি দিতি?"

পলি বলে--"তিনি তো অঞ্চল প্রধানের কাচে নালিশ জেনগেচেতা অঞ্চল প্রধানরে শিপ্রা বোলদেচে ঝে সে মোর ভাইরে ভালোবাসে নইলি অঞ্চল প্রধান মোগা ঠিক শাস্তি দেতো

জেঠি বলে—“মোগা পলিরি অঞ্চল প্রধান চেনে না বলতি চাচ্চিস থালি

পলি নিজের কথার খেই ধরে বলে চলে—“শিপ্রা তো একবার চলি এইয়েলো মোগা বাড় বলেমুই আর বাবার বাড়ি ্যাব নাকো দিদি”,কতো বুজকে তেবে বাড়ি পেটকিচি তারে

জ্যেটি বলে--"তা ঠিক কাজ করেচ মেয়ি ঝারে ভালোবাসপা, তারেই বে করা উচিত বটে!"

তাদের কুসুমতলি গ্রামে এই জিনিসটার বড্ড কদর এই প্রেম করে বিয়ে ছেলে-মেয়েরা পটাপট প্রেমে পড়ে আর ঝটাঝট বিয়ে সেরে নেয় বাড়িতে অপছন্দ করলেও ছেলে-মেয়েরা তা পাত্তাও দেয় না নিজেরাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রেমিকার   হাত ধরে পালিয়ে যায় বেশিরভাগই কলকাতার কালিঘাটের মা কালীর মন্দিরে গিয়ে ঠাকুরের সামনে মালা বদল করে বিয়ে করে শাঁখা-সিঁদূর-শাড়ি পরে বাড়ি চলে আসে এমন বিয়েতে অপছন্দ করলেও মানতে সব্বাই বাধ্য হয় বিশেষ করে এখন সবাই জেনে গেছে যে  আঠারো বছর বয়স হয়ে গেলেই মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া যায় না

ফলে গ্রামের জ্যেঠিরাও এখন প্রেমের বিয়ে মেনে নেন সমাজের জগদ্দল পাথরটার গায়ে চিড় ধরাতে আইন একটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে পলি সেইদিন এইভাবে জ্যেঠিমাকে পার করতে চাইলেও ভবি ভুলবার নয় তিনি বলেন--"তা ভাইএর বে দিতি কেডা মানা করেচ? সে মেয়িও আসুক আর তুইও যা শ্বশুরবাড়ি একসাতেই হয়ি যাক বয়স তো থেমে থাকে না মানষির! তোর তো অনেকটাই বয়স হইয়েচ তোর মা-বাপ থাকলি ফেলতি পারতিস একুন তাদের কতা?"

পলি বলে--"না গো জ্যেটি তোমার কতা ফেলব কেন? তোমার কতাই তো একোন শোনা লাগবে!  কেডা আচ মোর তুমি ছাড়া?"

খুশি হয়ে জ্যেঠি বলে--"থালি মুই পাকা কতা দে ভুল কিচু করিনি তো?"

ঠিক সেই সময়, যেন বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্যই সোনার আবির্ভাব হলো সোনার এই বাইশ বছর বয়স হলো খুব সুন্দর দেখতে হয়েছে কুচকুচে কালো চুলে আর দাড়িতে মাথা আর মুখ ঢাকা

সে ঠিক এই সময়েই যেন কোথা থেকে এসে হাজির হলো

আর দিদির মুখের দিকে চেয়ে এক মুহূর্তেই সব বুঝে গেল

বেশ গার্জিয়ান গার্জিয়ান ভঙ্গি করে বলল--" কিসির পাকা কতা? কারে দেচো পাকা কতা? মোর দিদির ঝন্যি পাত্র দেকোচ তুম? তা মা-বাপ নেই বলে কি অনাথ হই গিচে নাকি মুই আর মোর দিদি?"

বলে দুজনের দিকে একটু চাইল ঠিক মতো নিশানা লেগেছে বুঝতে পেরে বলল--"মুই নিজি দিদির বের ঝন্যি পাত্র দেকতিচি দাদু-ঠামা নেই বলে কি দিদি তুই মোরেও একবার না বলে পাড়ার লোকের সাতে বের ঝন্যি আলাপ করতিচিস?"

পলির যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সে কৃত্রিম অভিমান দেখিয়ে বলল--"মুই ককুনো এমুন কতা বলিনিকো ভাই!"

সোনা বলে--"তুই না বললি কেরাম্ভায় পাড়ার লোক মোরে না জেনগে পাকা কতা দেয়?"

জ্যেঠি আমতা আমতা করেন--"নারে সোনা তোর দিদি কিচুই বলেনিকো মোরে!"

জ্যেঠির কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, সোনা রেগেমেগে বলে--"ঝতি তুই নিজি নিজিই বিয়ের ঝন্যি পাত্তর দেখতি বলে থাকিস, থালি দিদি তুই বাড়িত্তে বেরগে ঝা! ঝেকেনে খুশি!"

দিদিকে আর বেরতে হলো না জ্যেঠি বেরিয়ে গেলেন মুখ পুরো বন্ধ করে

তিনি চলে যেতেই পলি হাসতে হাসতে বলল--"তুই বুঝলি কেরাম্ভায় ভাই?"

সোনা বলে--"ওর ওই কে ঝেন এট্টা সইএর বউএর বকুল ফুলের বোজঝি জামাই-এর পাত্রী দেখছেন উনি বহুদিন ধরে সব্বাই তো ঝানেই তাঁর কথা লোকটার অনেকগুলো বিয়ে বউ আসে আর চলে যায়  সুদখোর প্রচুর বিষয়-সম্পত্তি তাই দেখেই মেয়ের বাবারা ওই পাত্রের হাতে মেয়েদের তুলে দেয়" বলে একটু চুপ থেকে বলল--"তুই কিন্তু ভাই হয়ে আজ দাদার দায়িত্ব পালন করলি!"

সোনা বল--"দাদা আর ভাই কি আলাদা?"

পলি হাসতে হাসতে বলে--"একদম নয় আলাদা তো নয়ই বরং একদমই এক কয়েকদিন আগে আসা আর পরে আসা!"

দুজনেই খুব খুশি হয়েছিল সেদিন কিন্তু তাদের সেই সুখ যে ক্ষণস্থায়ী তা বুঝতে পারল একটা রাত পার না করেই তখন মধ্যরাত দরজা ধাক্কায় কেউ! কে? কে ওখানে? আওয়াজ না দিয়ে পারেনা সোনা! কিন্তু আগন্তুক কোনো জবাব দেয় না আরও দ্রুত দরজা ধাক্কায়! পলি ভয় পেয়ে গুটিয়ে বসে থাকে বিছানায় সোনা কিন্তু রেগেমেগে ধমাস করে দরজা খুলে দেয়

 

 তার হাতে ছিল দরজার মোটা কাঠের খিল খিল  দিয়ে বাড়ি মারার উদ্দেশ্যেই সোনা খিল হাতে নিয়ে দরজা খুলেছে মারতে আর হলো না তার হাত থেকে শব্দ করে খিল পড়ে গেল মাটিতে আর তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তির বেগে ঘরে ঢুকেই পলিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ভাসাল আর কেউ নয়, শিপ্রা পলি অবাক হয়ে  যায় শিপ্রাকে ধরে বিছানায় বসায় সোনা দরজার খিল তুলে দেয় তারপর মুখোমুখি বসে তিনজনে শিপ্রা বলে যে তার বাবা তাকে ঘরে আটকে রেখেছেন কয়েক ঘণ্টা বাদে যে ভোর হবে সেই ভোরে ওর বিয়ে পাত্রও ঠিক হয়ে গেছে শিপ্রার বাবা শিপ্রার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়েছেন এক কথায় এই কয়দিন তাকে বন্দি জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছেন আজ রাতে একটু সুযোগ পেতেই সে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে! এইরকম নিঝুম রাতে একটা অল্পবয়সি মেয়ে একা একা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে দেখলেই তো মাংসখেকো জানোয়ারদের মুখের থেকে লালা ঝরবে

পলি ওই রাতেই আগে শিপ্রাকে দিয়ে পুলিশে একটা কমপ্লেইন লেখালো শিপ্রা সমস্ত সত্যি কথাই লিখেছে সে লিখেছে যে, বাবা-মা তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে কিন্তু সে এই বিয়ে করতে চায়না সে সোনাকে ভালোবাসে সোনাও এডাল্ট এবং সেও তাই তাদের বিয়েটা আইনত সিদ্ধ "দয়া করে আমাকে আমার মতো থাকতে দিন" বলে আর্জি জানিয়েছে শিপ্রা পলি তারপর শিপ্রার বাবাকে ফোন করেছে তিনি ফোন তোলেন নি পলি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে যে, শিপ্রা তার ভাই সোনাকে ভালোবাসে তিনি জোর করে তাঁর মেয়ের অন্যত্র বিয়ে দিচ্ছিলেন মেয়ের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়েছেন ঘর থেকে বার হতে দেন না! এইসব  লিখেছে পলি আরও লিখেছে যে, তার বা তার ভাইএর বা তার ভাইএর বউএর যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে সেই ক্ষতির জন্য সম্পূর্ণ দায়ী   থাকবেন শিপ্রার বাবা ব্রজবন্ধু মণ্ডল ব্রজবন্ধু মণ্ডলের মেয়ে শিপ্রা মণ্ডল  নিজে তার বাবার

বিরুদ্ধে যে অভিযোগ জানিয়েছে সেই অভিযোগের একটা কপি পলি মেইল করে দেয় শিপ্রার বাবাকেও সারারাত তাদের আর ঘুম হলো না তিনজনেই গল্পে গল্পে রাতটা কাটিয়ে দিলপলির শুধু একটা কথাই বারবার মনে হচ্ছিল যে, এইটুক একটা মেয়ে সেই নয়ানজুলি থেকে এই রাতের বেলা কীভাবে এসেছে এমনিতে তাদের গ্রামের বা আশেপাশের গ্রামের মানুষ খারাপ নয় কিন্তু পেটে যখন তাড়ি পড়ে উঠতি বয়সের ছেলেগুলো সব অমানুষ হয়ে যায় এই ভয়েই পলি আরো বেশি ভালোবেসে ফেলেছে শিপ্রাকে আহা! প্রেম তো এমনই! তোমার জন্য সকলই সহিতে পারি! কোনো মতেই তোমাকে হারাতে রাজি নই প্রাণ গেলেও পলির আজ কেন যেন বারবার করে সুবলকেই মনে পড়ছে জীবনে সেও তাহলে ভালোবেসেছে ভালো না বাসলে কে জানে সে শিপ্রা বা সোনার এই প্রেম হয়তো এভাবে বুঝতেও পারত না সোনা একবার শিপ্রার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল শিপ্রা সেবারও তাদের বাড়িতে চলে এসেছিল আচ্ছা  সেওতো আর কথা বলেনা সুবলদার সাথে কই, সুবলদা তো খোঁজ নিতে একবারো এলো না? কথাটা মনে পড়েই পলির কেন যেন খুব কান্না পেল! আজ তার খুব দাদুকে মনে পড়ছে ঠামিকে মনে পড়ছে বাবা-মাকে সেভাবে তার বা সোনার মনে পড়ে না খুব আবছা একটা স্মৃতি যেন রয়ে গেছে কিন্তু দাদু-ঠামি যেন এখনো আছেন,

 যেন ডাকলেই দাদু বলবেন--"দিদুভাই কেঁদো নাকো"

 বলে ঠিক একটা সমাধানের পথ  বার করে দেবেন! পলিকে হঠাৎ একটা ধাক্কা দিয়ে শিপ্রা বলল--"দিভাই, কী ভাবছো গো?"

পলি বলে--"কই! নাতো, কিছু নাতো!"

শিপ্রার সাথে সোনার যেন চোখে চোখে কিছু কথা হলো মানে একবারই তেমন মনে হলো পলির পরক্ষণেই ভাবল যে ওর মনের ভুলও হতে পারে ভোর রাতের দিকে তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বেশ বেলায় ঘুম থেকে উঠেছে ওরা তারপর ঘরের কাজ করতে করতে সবাই ভাবছিল ব্রজবন্ধু মণ্ডল কিছু গণ্ডগোল পাকান কিনা কিন্তু নাহ! তিনি আর কিছু করতে মনেহয় চাইবেন না কারণ মেয়ে নিজে পুলিশে অভিযোগ করেছে পলি নিজেই তখন ভাইএর সাথে যুক্তি করে একটা দিনক্ষণ দেখে ভাইএর সাথে শিপ্রার বিয়েটা দিয়েই দিল গ্রামের সব্বাই খুব আনন্দ করেছে এই বিয়েতে এই প্রথম একজন ওবিসি সম্প্রদায়ের মেয়ে এলো ক্যাওড়াদের ঘরে ব্যাপারটা কিন্তু সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র আইন করে  মেয়েদের বিয়ে আঠারোর নীচে বন্ধ করার ফলে নইলে শিপ্রাকে অনেক আগেই ওর বাবা ব্রজবন্ধু মণ্ডল বিয়ে দিয়ে দিতেন যদিও এখন আর মেয়েরা আগের মতো অসহায় নয় তারা এখন লেখাপড়া শেখে, বড়ো হয় চাকরি করে

সোনা-শিপ্রার বউভাতের দিন পলির বাড়িতে গ্রামের সব্বাই এসেছে সব্বার সাথে সোনা আর শিপ্রাকে মন খুলে গল্প করতে দেখে পলির সত্যিই খুবই ভাল্লাগছে সেও মনে মনে চাইছে যেন

কাউকে কিন্তু তারও যে কাউকে হলে হবে না ওই একজনকেই চায় সে সেই একজনই তার প্রাণের মানুষ

খাওয়া-দাওয়া চলছিল যখন, সে প্রত্যেককেই জনে জনে বলছিল যে, "পেট ভরে খাবেন আমার ভাই-ভাই-বউকে আশীর্বাদ করবেন ওরা যেন সুখী হয়"

সেরকমই একবার বলতে গিয়ে পলি দেখে সুবলদাকে পলি খেয়াল করে দেখল পাশে ওর বউ নেই পলি এগিয়ে গিয়ে বলল--"কী সুবলদা, একা এলে যে! বউদিকে আনোনি?"

সুবল কিছু বলার আগে তার মা- বলল--"ওর আবার বউ কবে হলো পলি? তো সারা জীবন একাই!"

পলি অবাক হলো খুব সে যে শুনেছিল তেমনই শুনেছিল তো যে নাকি বিয়ে করছে ওর বউ নাকি ওদের বাড়িতেও এসেছে তাকে নিয়ে ঘুরতেওতো সে নিজেই দেখেছে তাহলে?

পলি এতো কিছু ভাবলেও মুখে কিচ্ছু উচ্চারণও করল না সে খুব সাবধানে সেখান থেকে ফিরল ভাই তার কতোগুলো বন্ধুর সাথে গল্প করছে সে একবার দেখে সেখান থেকে সরে গেল কে বিয়ে করেছে কিংবা কে বিয়ে করেনি তাতে তার কী? সে তার মতো বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কিন্তু এক সেকেণ্ডের মধ্যে আবার ফিরল দেখল ভাইটা তার খুব হাসতে হাসতে গল্প করছে সে ফিরে গেল বিয়ে বাড়ির বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে কিন্তু ওই সেকেণ্ডের মধ্যে আবার এসেছে আবার সেখান থেকে সরে গেছে আবার খাবার জায়গায় গেছে সুবলদাকে কী অপূর্ব লাগছে কোনোদিন তো এই রকম পোষাকে তাকে দেখেনি পলি মেরুন পাঞ্জাবিতে কী অপরূপ লাগছে সুবলদকে পলি আড়াল থেকে অনেকক্ষণ দেখল দেখাতে এতো সুখ? সে কখনো জানেনি আগে! না পেলেও কেমন সুন্দর করে সুবলদাকে সে মনে ধরে রেখেছে হঠাৎ সোনা তার একদম কাছে এসে বলল--"দিদি, কী হয়েছে তোর?"

পলি চমকে উঠে বলল--"-কই, কোথায় কী হয়েছে? কিছু নাতো?"

সোনা বলে--"এইদিকে আয়" বলে দিদিকে সে প্যাণ্ডেলের বাইরে নিয়ে যায় সেখানে কোনো লোকজন ছিল না সেখানে অন্ধকার সেখানে দুই ভাই-বোন এক হয়ে দাঁড়াল ভাই বলল--"দিদি, শুধু তোর জন্য আজ আমার এতোটাই সুখ দিদি, তুই আমার শুধু দিদি নোস তুই আমার মা আমার বাবা আমার বন্ধু আমার সব কিছু তুই"

সোনা কাঁদছে পলি সোনার হাত দুটো ধরে বলল--"তুই সুখী ভাই আমার দুজনে খুব সুখে থাক"

সোনা বলে--"আজ তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো, দিবি দিদি?"

পলি বলে--"কেন দেবো না রে ভাই?"

একটু থেমে আবার বলল--"আমি পারবো না এমন কিছু যে তুই চাইবি না, তা আমি জানি ভাই!"

আবার একটু থেমে সে বলল--"কোথায় যেতে চাস হানিমুনে বল দেখি পারি কীনা!"

সোনা বলে--'দিদি, আমি হানিমুনে যাব যেমন করে যেতে চাই তেমন করে যেতে দিবি?"

পলি বলল--"এটা আবার কেমন কথা?"

সোনা বলল--"রাগ করবি না দিদি তোকে একজন খুব ভালোবাসেরে দিদি! সে ভয়ে বলতে পারছে না!"

পলি হকচকিয়ে যায়

বলে--"ওয়েট ওয়েট! তোর হানিমুনের সাথে এসব কথার সম্বন্ধ কোথায়?"

সোনা বলল--"সম্বন্ধ আছে দি গভীর সম্বন্ধ আছে!"

পলি বলল--"বেশ বলে যা ব্যাখ্যা করে করে বলে যা"

সোনা বলে--"তোকে একজন খুব ভালোবাসে দি বলতে সাহস পায় না তুই তো খুব রাগি এতো রাগ দেখালে চলে না কিন্তু তুই কি কোনোদিন বিয়েই করবি নাআমার কিন্তু তেমনই মনেহয়"

পলি বলে--"বিয়ে আমি কখনো করব না এমন  নয় তবে অবশ্যই আমার যোগ্য হতে হবে"

সোনা বলে--"সেই যোগ্যতাটা কী রে দি? বলবি?"

পলি বলে--"আমার জীবন আমি আমার মতোই চালাতে চাই এই বিষয়ে আমি কারও সাথে আলোচনাও চাই না"

হঠাৎ সেখানে শিপ্রাও হাজির হয় বলে--"সবার খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে আমাদের খেতে ডাকছে তোমাদের না পেয়ে অনেকেই খুঁজছে"

সোনা তখনো বলছে--"শুধু তোকে পাবার জন্য সে কতো যে নাটক করেছে দিদি সে আমাকে বলেছে সব দিদিমেনে নে নারে"

পলি বিরক্ত হয়ে বলে--"কী আশ্চর্য  তো! কে সেই ব্যক্তি যিনি আমাকে কিছু না বলে শুধু তোকেই বলে যাচ্ছেন? তুই কে? তাঁর যদি আমাকে পছন্দ হয় তাহলে তিনি আমাকে কেন কিছু বলছেন না?

তিনি কি বোবা না কালা? কথা বলতে পারেন না? নিজে ভালোবাসার কথাটুকুও বলতে পারছেন  না এমন কাপুরুষকে কেউ কি ভালোবাসতে পারে? ছিহ!"

ঠিক সেই সময়, সেই মুহূর্তেই যেন এই ঘটনাটা ঘটাবার জন্যই সেখানে, সেই অন্ধকারে হাজির হলো সুবল দাদা

সে বলল--"হ্যাঁ আমিই  সেই ব্যক্তি আমি আমি তোমাকে ভালোবাসি কাপুরুষ নই শুধু তোমার শত্রু হতে চাইনি কখনো তাই চুপ ছিলাম।।"

পলি কোনো কথার কোনো জবাব দিতে পারল না সে ফ্যালফ্যাল চেয়ে ছিল চেয়েই রইল

সোনা বলল--"সুবলদা আমাকে অনেকদিন আগেই বলেছে সে কথা"

পলি বলল--"সোনা তুই আর একটাও কথা বলবি না একদম চুপ!"

সোনা চুপ করে যায় শিপ্রা সোনার কনুই ধরে ইঙ্গিত করে সোনা চোখ মোটা মোটা করে তাও চেয়ে থাকে দিদির দিকে সুবলদার দিকে

দুজনে তখন দুজনের দিকে চেয়ে রয়েছে তো চেয়েই রয়েছে  শিপ্রা এবার সোনার হাত ধরে টানতে থাকে সোনা বলে--"কী বলছো?"

শিপ্রা ওকে টানতে টানতে আলোয় নিয়ে যায়

বলে--"ওদের এখন একটু একা থাকতে দেওয়া উচিত বুঝলে হাঁদারাম!"

সোনা বলে--"কেন? ওরা যদি ঝগড়া করে?"

শিপ্রা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে

বলে--"ওদের সাথে ঝগড়া হবে না অন্তত এখন তো হবে না!"

সোনা বলে--"তুমি আমার দিদিকে চেনোনা! দিদির প্রচণ্ড রাগ! এইসব প্রেম-ফ্রেম দিদি একদম সহ্য করতে পারে না!"

শিপ্রা বলে--"মিথ্যা কথাগুলো আর বলো না বুঝেছো? দিদি ওই ভদ্রলোককে ভীষণ ভালোবাসে"

এবার অবাক হয়ে শিপ্রার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে সোনা!

তারপর বলল--"আমি কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস করি"

শিপ্রা বলল--"আর আমি তোমাদের দুজনকেই বিশ্বাসও করি ভালোওবাসি"

সোনা হাসল বলল--"চলো দেখে আসি দিদি কী করছে ওই লোকটার সাথে"

শিপ্রা খিলখিল করে হেসে বলল--"এই সময় ওদের বিরক্ত করতে হয় না আর কবে তুমি বুঝবে গো!"

সোনা চুপ করে থাকল কিন্তু তার চোখ তবুও বারবার সেই অন্ধকারের দিকেই যাচ্ছিল।

====================  

চলবে....  

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.