Click the image to explore all Offers

গল্প।। অকাল বসন্ত ।। শংকর ব্রহ্ম



 
অকাল বসন্ত

শংকর ব্রহ্ম


                  সাধন প্রথমে রীতাকে দেখতে পায়নি। এক সন্ধ্যাবেলা সাধন টিউশন সেরে এসে, আনন্দআশ্রম মোড়ে লালুর চায়ের দোকানে চা খেতে বসেছে। ধোঁয়া-ওঠা চায়ের গ্লাস এনে লালু টেবিলে রেখেছে। চায়ে একটা চুমুক দিয়ে, সাধন জামার বুক-পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করল। তার থেকে একটা বিড়ি য়বের করল, ধরাবে বলে। ধরাতে গিযে, প্যান্টের পকেট হাতড়ে দেশলাই খুঁজে পেল না। তখন সে বিড়ি-সিগারেট দোকান থেকে দেশলাই কিনবে ভেবে, বাইরের দিকে তাকাতেই, তার চোখ পড়ল,
 একটু দূরে দাড়িয়ে আছে রীতা। খুব সেজে-গুজে এসেছে সে। সাধনের চোখ তার দিকে পড়তেই রীতা ইশারায় তাকে কাছে ডাকল। তার কাঁধে ঝোলানো নীল রঙের একটা চামড়ার ব্যাগ।
                     গরম চায়ে জিব পুড়িয়ে সাধন দ্রত শেষ করে, লালুকে চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে, দোকানের বাইরে এসে, বের করা বিড়ি ও বিড়ির প্যাকেট জামার পকেটে রেখে, রীতার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, কি ব্যাপার?
- বাবা এক মুদিঅলার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছ।
- তো?
- আমি তাই বাড়ি ছেড়ে তোমার কাছে চলে এসেছি, আমার জমানো সব টাকা আর গয়নাগটি নিয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে। চল, আজই আমরা কালীঘাটে গিয়ে বিয়ে করে, কোথায়ও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকব। ঘর ভাড়া দেওয়ার টাকা আমার কাছে আছে। রীতার কথা শুনে সাধনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কথাটা শুনে মাথাটা ঘুরে গেল তার। রীতা অবুঝ পাগলির মতো কী একটা কাজ করে ফেলেছে !  সাধন এখনও বেকার। তাছাড়া বাড়িতে তার ছোট ছোট দু'টি  ভাই বোন রয়েছে। এখন মাথা গরম করে কোনও লাভ নেই। তাই সে মাথাটা ঠান্ডা রেখে ভাবল, এসময়ে রাগারাগি করে এর কোনও সুরাহা হবে না। বরং রীতাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, যা করার করতে হবে।
                    এইভাবে হঠাৎ, কোনও চিন্তা-ভাবনা না করে, হটকারিভাবে, সাধনের উপর ভরসা করে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসাটা রীতার মোটেও ঠিক কাজ হয়নি। সাধন ভাবল অবুঝ মেয়ে বলেই তো এমনটা করেছে, এখন এই নিয়ে বকাবকি করলে কোনও ফল হবে না। বরং সে আরও বিগড়ে যেতে পারে। তাই এখন রীতাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে তার বাড়িতে ফিরাবার ব্যবস্থা করতে হবে। সাধন তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে উষার কোম্পানীর কাঠের ব্রীজের উপর এসে দাঁড়াল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল, খাল দিয়ে অনবরত তিরতির করে জল গড়িয়ে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে এই জলধারা সাধন জানে না। তারপর চোখ তুলে রীতার দিকে তাকিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলল, এখন চাইলেই তো আর ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে না। কে আর আমাদের জন্য ঘর খালি করে রেখেছে বল, যে ভাড়া দেবে? তাছাড়া ভাড়া-ঘর খুঁজতে তো আমার অন্ততঃ দু'চার দিন সময় লাগবে? ঘর ভাড়া ঠিক করে, না হয় তোমায় নিয়ে সেখানে গিয়ে উঠব। এখন মাথা ঠান্ডা করে, তুমি বাড়ি ফিরে যাও, কেমন?
- না, আমি আর বাড়ি ফিরব না। ঘর ভাড়া না পেলে আমরা রাস্তায় থাকব।
- রাস্তায় রাত কাটালে, টহলদারী পুলিশ-ভ্যান, রাতে টহল দেওয়ার সময় আমাদের রাস্তায় দেখতে পেলে, থানায় ধরে নিয়ে যাবে নিয়ে গিয়ে তারপর, তোমার বাড়িতে খবর দেবে। আর আমাকে ঘর থেকে মেয়ে ভাগিয়ে আনার দায়ে আমাকে লকআপে পুরে দেবে। পরদিন অপরাধী হিসাবে আদালতে চালান করবে।
- তাহলে আমরা বড় রাস্তায় নয়, অন্য কোনও অচেনা পাড়ার ভিতর গিয়ে, সেখানে কোনও গাছ তলায় রাত কাটাব।
- তাতেও তো বিপদ আছে। কোন বদমাশ পাজি লোকেরা যদি আমাদের দেখতে পায়, তোমার হাত থেকে গয়না ভরা ব্যাগটা কেড়ে নেবে, আর তা'তে আমরা বাধা দিতে গেলে আমাদের মারধর করে সেখানে ফেলে রেখে, ব্যাগটা  ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাবে। তাছাড়া সুযোগ বুঝে আমাকে একা দেখে তোমার উপর অত্যাচার করতে পারে। রীতা তবুও তার বাড়ি ফিরে যেতে চায় না। সাধন তাকে আদর করে, অনেক রকমভাবে তা'কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, চুমু খেয়ে তাকে বাড়িতে ফেরত পাঠাল। রীতা তার মন খারাপ নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ি ফিরে গেল। 
             
                 রীতা থাকে বাঁশদ্রোনী খালের ওপারে।
টুম্পাদের বাড়ির পাশে। সে আসলে টুম্বার জেঠতুতো বোন। এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
টুম্বার মা সেবার সরস্বতী পূজার দিন সাধনকে তাদের বড়িতে যেতে বলেছিল। সাধন সাধারণত প্যান্ট শার্ট পরে, টুম্পাকে পড়াতে যেত। সরস্বতী পূজার দিন সে সাদা পাজামা আর একটা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরে টুম্পাদের বাড়িতে গেছিল।
রীতাও সেদিন টুম্পাদের বাড়ি গেছিল, বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পরে। বারান্দায় সাধনের সঙ্গে রীতার চোখাচুখি হতেই, দু'জনের চোখ যেন  চুম্বক আকর্ষণে দুু'জনের চোখে আটকে যায়। দু'জনেই চোখ সরাতে ভুলে যায়। সাধনের সম্বিত ফেরে টুম্পার ডাকে। 
- স্যার, ভিতরে চলুন। এখন পুজো শুরু হবে। ঠাকুর মশাই সকলকে ভিতরে ডাকছেন।
- হ্যাঁ, চলো।
বলে সে টুম্বার সঙ্গে পুজোর ঘরের ভিতরে চলে গেল। কিন্ত সাধনের চোখে রীতার মোহমুগ্ধ রূপের ছটা লেগে রইল।

                    সেই প্রথম দেখা তাদের। তারপর টুম্পাকে পড়াতে গিয়ে, মাঝে মাঝে রীতার সঙ্গে দেখা হয়েছে। প্রথম প্রথম তাদের মধ্যে হাসি বিনিময় হত। তারপর আড়ালে-আবডালে, টুকটাক দু'একটা কথা। 
                         রীতা পড়ে খানপুর গার্লস হাই স্কুলে পড়ে। একদিন সাইকেলে চালিয়ে বাঁশদ্রোনী থেকে ফেরার সময় সাধনের সঙ্গে রীতার রাস্তায় দেখা হয়। সে খানপুর স্কুল থেকে ফিরছিল। তাকে দেখে সাধন সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।  রীতা বন্ধুদের সঙ্গে একজোট হয়ে ফিরছিল। সাধনকে দেখতে পেয়ে, বন্ধুদের থেকে আলগা হয়ে, একা এসে তার সঙ্গে দেখা করে,হেসে বলে কেমন আছেন?
- ভাল। তোমার খবর কি?
- ভাল। রীতা হাসে।
- তুমি এখানে খানপুর স্কুলে পড়?
- হুম।
- কখন ছুটি হয়? 
- সাড়ে দশটায়।
- বাড়ি যাবে তো?
- হুম।
-  এস, সাইকেলে বস।
- না না। আমি হেঁটেই  যাব।
- চল তবে আমিও হাঁটব।
- কেন?
- তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।
- রোজ তো একাই যাই আমি।
- এবার থেকে আমার সঙ্গে ফিরবে।
- ইল্লি, মজা আর কি?

                    এরপর থেকে মাঝে মাঝে সাড়ে দশটায় সাধন খানপুর স্কুলে গিযে রীতার সঙ্গে দেখা করেছে, তার সঙ্গে কথা বলছে। টিউশনির টাকা পেয়ে, রীতাকে টুকি-টাকি  উপহার দিয়েছে। যেমন তার জন্মদিনে এক শিশি সেন্ট। দোলের দিন প্রথম তার মুখে আবির দেওয়ার পর, তার হাতে এক প্যাকেট ক্যাডবিরি দেওয়া। পুজোের সময় পন্ডস পাউডার কিনে দেওয়া। বিজয়ার পর, একবার তারা দু'জনেই  দুঃসাহসে ভর করে গড়িয়ার মহুযা হলে একটা সিনেমা দেখতে গেছিল। ফেরার পথে বিন্দু রেস্টুরেন্টে মোগলাই খেয়ে বাড়ি ফিরেছিল। এইভাবে কখন যে তারা নিজেদের মধ্যে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে, পরস্পর পরস্পরকে, আন্তরিকভাবে ভালবেসেছে ফেলেছে, নিজেরাও টের পায়নি। 

                      একদিন রোডিওতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গানটা শুনে,
"এ ব্যাথা কি যে ব্যাথা বোঝে কি আনজনে -
সজনী আমি বুঝি মরেছি মনে মনে।
....................................................
অঙ্গে চোট পেলে- সে ব্যাথা সারাবার
হাজার রকমের ঔষধি আছে তার।
মরমে চোট পেলে সারে না এ জীবনে-
সজনী আমি বুঝি মরেছি মনে মনে।"

রীতার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠে। মনে মনে  আকুলভাবে, এ তো আমারই মনের কথা। গীতিকার সে কথা জানল কি করে?

                      বিভিন্ন জায়গায় সাধন চাকরির জন্য অ্যাপ্লিকেশন পাঠাত। একবার তিনবন্ধু ব্যাঙ্ক সারভিস কমিশনে লিখিত পরীক্ষায় বসেছিল। তিনজনই লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে, 
ইন্টারভিউ পেয়েছিল। তিনজনই ইন্টারভিউ দিয়ে ছিল। ফল বেরলে দেখা ওর দুইবন্ধু ব্যাঙ্কে চাকরী পেলেও, সাধন পেল না। সে একটু হতাশ হয়েছিল মনে মনে। কিন্তু কারও কাছে তা প্রকাশ করেনি।
বরং দুই বন্ধু যখন চাকরী পাওয়ার সেলিব্রাসনের আয়োজন করে ছিল ব্লু-ফক্স বারে, সে সবার আগে সেখানে গিয়ে হাজির হয়েছিল। সকলের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠে, তার নিজের হতাশা কর্পূরের মতো উবে গেছিল।

                       ব্যাঙ্কে ইন্টারভিউ দিয়ে আসার পর, সে রীতাকে বলেছিল, এবার বোধহয় ব্যাঙ্কে চাকরিটা হয়ে যাবে, এত ভাল ইন্টারভিউ দিয়েছি। অথচ তার হল না, হল তার বাকি দুই বন্ধুর। ভাগ্য ছাড়া আর এটা কি? কেন এমনটা হবে তার জীবনে? এর কোনও মানে হয়?
                      আগে সাধন ভাগ্য মানত না। এখন  মনে মনে মানে। অবশ্য সে তা কারও কাছেই প্রকাশ করে না। প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে।
 
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।  

----------------------------------------------------------------------------
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.