মাধব ও মালতি
সমীরণ সরকার
(পূর্ব কথা:--- কৃষ্ণপুরে শিলাই ভিলা দেখতে গিয়ে জমিদার কৃষ্ণ কমল রায়ের সঙ্গে একটি বাজি লড়ে কৃষ্ণ কমল রায়ের প্রিয় ঘোড়া শুভ্র অবর্ণ চেতককে জিতে নিল মানবেন্দ্র নারায়ণ।
ঘোড়ার পিঠে চেপে মানবেন্দ্র ফিরে এলো গড়বেতায়। ঠাকুমা বিধুমুখী দেবীর পিত্রালয়ে যখন ঘোড়ার পিঠে চেপে মানবেন্দ্র নারায়ন প্রবেশ করলো, তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে।
মানবেন্দ্র নারায়ন কে ওভাবে একটা সাদা ঘোড়ার পিঠে বসে থাকতে দেখে বিধুমুখী দেবীর
তিন ভ্রাতৃ বধূ এবং বিধুমুখী দেবী বিস্মিত হলেন। ততক্ষণে বিধুমুখী দেবীর তিন ভাই তারা প্রসাদ, শংকরী প্রসাদ ও অম্বিকা প্রসাদ সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। মানবেন্দ্র নারায়ন কিভাবে কৃষ্ণ কমল রায় কে বাজিতে হারিয়ে তাঁর ঘোড়া
জিতে নিয়েছে, সেই ঘটনা অমরেন্দ্র ও অশোকের মুখে শুনে তাঁরা শুধু বিস্মিত হলেন তাই নয়, মানবেন্দ্র নারায়ণ কে অভিনন্দন জানালেন।
সেদিন রাত্রে ওই বাড়ির একটি পরিত্যক্ত গরুর চালাতে রাখা হলো 'চেতক' নামের ঘোড়াটিকে।
সেদিন রাতেই পূর্ণিমাকে স্বপ্নে দেখল মানবেন্দ্র নারায়ণ। ওকে স্বচক্ষে দেখার তীব্র ইচ্ছা জাগলো মানবেন্দ্র নারায়ণের মনে।)
-----------------------------------------
গোয়ালের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল মানবেন্দ্র নারায়ণ।ওর পায়ের শব্দ পেয়ে চেতক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। মানবেন্দ্র পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল চেতকের কাছে। চেতকের গলায়, মাথায়, গায়ে অতি যত্নে হাত বুলিয়ে দিল। চেতক তার মাথাটি সযত্নে নামিয়ে দিল মানবেন্দ্রের কাঁধে। তারপর খুব ধীরে ধীরে মানবেন্দ্রের গায়ে মাথাটি ঘষতে থাকলো। মানবেন্দ্র তার কানে কানে বললো, চেতক, আমার খুব ইচ্ছে করছে এখন বাঁকুড়া যেতে। আমাদের চৌধুরী ভিলার পাশে কমলাপুর গ্রামে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। একজনের সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে। বলতো, সে কে?
পারবি না বলতে! ঠিকই তো তুই কেমন করে জানবি তাকে ? তুই তো তাকে দেখিস নি কোনদিন! জানিস চেঝ্ঝতক,ও খুব খুব সুন্দর দেখতে। ওকে আমি খুব ভালোবাসি। ওর সঙ্গে পরিচয় হলে দেখবি,
ও তোকে খুব আদর করবে, আমার মতই।
ওর কথা আমার খুব মনে পড়ছে রে। ওকে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছে। বলতো চেতক, আমি কার কথা বলছি, কার সঙ্গে আমার দেখা করতে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার, ভীষণ ইচ্ছে করছে। কথা বলতে বলতে মানবেন্দ্র নারায়ণ চেতকের গলা ধরে কেঁদে ফেলল। ওর চোখের জল পড়লো চেতকের গায়ে।
চেতক কী বুঝলো কে জানে সে তার সে তার প্রভুর কাঁধে মাথা রেখে জোরে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।
মানবেন্দ্র নারায়ণ চেতকের গলা ধরে বলল,
বাঁকুড়ায় যাবি চেতক, পূর্ণিমাকে দেখতে যাবি?
এই গড়বেতা থেকে অনেক দূরের রাস্তা কিন্তু বাঁকুড়া ।তা প্রায় ৪০ মাইল দূর হবে। তুই যেতে পারবি তো? তোর কষ্ট হবে না তো?
চেতক আবার তার মাথাটা ঘষে দিল তার প্রভুর গায়ে।
মুহূর্তের জন্য দ্বিধা জাগলো মানবেন্দ্রের মনে।
এভাবে কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? অনেক দূরের রাস্তা। পথে জঙ্গল আছে, ডাকাতের ভয়ও আছে। তাছাড়া পূর্ণিমা কে দেখে আজ এর মধ্যে তো ফিরতেই পারবে না, ফিরতে ফিরতে কাল বিকেল হবে। ফিরে এসে কী জবাব দেবে ঠাকুমাকে?
সে দেখা যাবে তখন। এখন একবার পূর্ণিমাকে দেখতে খুব খুব ইচ্ছে করছে।
খুব ধীরে সদর দরজা খুলে চেতককে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মানবেন্দ্র নারায়ণ।
(তেরো)
পূর্ণিমার মন ভালো নেই। ভালো থাকবে কী করে? সেই যে ঠাকুরমার সঙ্গে তার বাপের বাড়ি গড়বেতায় বেড়াতে গেল রাজকুমার, আর তো ফেরার নাম নেই। তবে কি তার রাজকুমার ভুলেই গেল তাকে? কিন্তু, সত্যিই সেরকম কিছু হলে, তার কী হবে? তার শরীরে যে বাড়ছে, তার কী হবে?
এখনো বাড়িতে তার মা জানেনা, বন্ধু-বান্ধবরা জানে না, পাড়া প্রতিবেশী জানেনা। শুধু সে জানে আর মাতু দাই জানে ব্যাপারটা। আর জানার পর থেকেই সেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে তার রাজকুমারের দেখা পেতে। চৌধুরী ভিলার মালিক কনক নারায়ণ চৌধুরীকে সবাই 'রাজাবাবু' বলে। আর তাই তার ছেলে মানবেন্দ্র নারায়ন কে সবাই 'কুমার' বলে। পূর্ণিমা তাকে
সোহাগ করে 'রাজকুমার' বলে ডাকে, যেমন মানবেন্দ্র নারায়ণ আদর করে তাকে 'পুনি' বলে ডাকে।
তার সেই রাজকুমারের সন্তান আজ তার পেটে।
সেই খবরটা এখনো পর্যন্ত রাজকুমার জানেনা।
জানতে পারলে কী বলবে সে?সে খুশি হবে নাকি অখুশি? আর খুশি হলেই বা কী?
চৌধুরী ভিলার কেউ তার এই সন্তানকে কিছুতেই মেনে নেবে না। তাহলে, তাহলে কী করবে পূর্ণিমা?
তার প্রিয় মানুষ রাজকুমারের চিহ্ন বাঁচানোর জন্য সে কি দূরে কোথাও চলে যাবে? কোথায় যাবে সে? বাবার দিকে তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই , যে তাকে ঠাই দেবে।
আর মায়ের দিকে? একজনই আছে। যে তাকে ছোট বেলায় খুব ভালোবাসতো। কিন্তু অনেকদিন তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। শেষবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল , তার শ্বশুরবাড়িতে। তার স্বামী হঠাৎ হার্ট ফেল করে মারা যাওয়ার খবর পেয়ে সে এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে । সেদিন পূর্ণিমার মা ও উপস্থিত ছিল সেখানে। সে মাকে বারবার অনুরোধ করেছিল, পূর্ণিমাকে নিয়ে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মা রাজি হয়নি।
সে শুকনো মুখ করে ফিরে গেছিল সেদিন।
পূর্ণিমার সেদিন খুব ইচ্ছে হয়েছিল তার সঙ্গে তার বাড়িতে, বলাগড়ের কাছে সেই ছোট্ট গ্রাম
সোমড়াতে যেতে। কারণ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে তার মায়ের বাড়ির তরফে ওই একজনকে পেয়েছিল যে তাকে খুব স্নেহ করতো। সে আর কেউ নয়, মায়ের বৈমাত্রেয় ভাই, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণিমার রামু মামা।
খুব ছোটবেলায় সোমড়ায় রামু মামার বাড়িতে
গেছিল সে। বেশ কয়েক মাস ছিল সেখানে।
তবে এখন আর সেসব দিনের কথা ঠিক মনে পড়ে না। কেমন যেন স্বপ্নের মত মাঝে মাঝে নাড়া দিয়ে যায় মন।
সত্যি যদি আজ এতদিন পরে পূর্ণিমা তার রামুমামার বাড়িতে যায়, আশ্রয় ভিক্ষা করে, ঠাঁই পাবে কি?
না ঃ! এসব চিন্তা করে ঘুম আসছে না পূর্ণিমার চোখে। ঘরের দরজা খুলে উঠোনে নেমে এলো
পূর্ণিমা। রাত এখন অনেক। শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ
আলো ছড়াতে শুরু করেছে। উঠোনের একধারে কামিনী ফুল গাছটার নিচে মস্ত বড় কালো পাথরের উপর বসলো পূর্ণিমা। এই পাথরের উপর অনেক দিন পাশাপাশি বসেছে সে আর তার রাজকুমার।সে পূর্ণিমা কে ভরিয়ে দিয়েছে আদরে, সোহাগে। তার কথা ভাবতে ভাবতেই একসময় গাছতলাতেই ঘুমিয়ে পড়ে পূর্ণিমা।
এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল জানে না পূর্ণিমা, হঠাৎ ঘুমটা ভাঙলো, যখন মনে হল কে যেন
দুই বলিষ্ঠ বাহুতে তাকে তুলে নিয়েছে।'কে' বলে চিৎকার করতে যেতেই কে যেন ফিসফিস করে তার কানে মুখ রেখে বলল, চুপ! আমি এসেছি।
ঘুম ঘুম চোখে সে যখন তাকিয়ে দেখলো যে, তার রাজকুমার তাকে দু হাতে তুলে নিয়েছে বুকের কাছে, সে বিশ্বাস করতে পারল না। তাই আবার সে চিৎকার করতে যাচ্ছিল । আর ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন তাঁর ঠোঁট চেপে ধরল পুরুষ্ট ঠোঁট দিয়ে।
(চলবে)
*************************************
Regards
Dr. Samiran Sarkar
Khelaghar, Lautore,
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234
Khelaghar, Lautore,
P.O : Sainthia, Dist : Birbhum.
W.B - 731234

