বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। কবরখানায় সেই রাতে ।। দীপক পাল

  

 কবরখানায় সেই রাতে

 

  দীপক পাল

 

 

          দুর্গাপুর শিল্পনগরীর সার কারখানা থেকে প্রোমোশন পেয়ে কলকাতার সেক্সপীয়র সরণীর ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে এলাম। এন্টালীতে আমরা ভাড়া বাড়ীতে থাকতাম। এদিকে সেজদার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় সেখানে থাকার সঙ্কুলানের অভাব হওয়ায় আমি গোবরা অঞ্চলে দুটি ঘর ভাড়া নিলাম। আমার খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হবে ভেবে মা বাবাও আমার কাছে চলে এলো। কিন্তু আমার সব বন্ধু বান্ধব সেখানে থাকায় আমি প্রায় প্রতিদিন সন্ধেবেলায় পুরাণ পাড়ায় তাদের সাথে আড্ডা মারতে যেতাম। শনি রবিবার রেশন বা অন্য কোন কারণে আগের বাড়ীতে জিনিসপত্র বৌদির জিম্মায় রেখে চা খেতে খেতে গল্প করে তারপর আড্ডা খানায় যেতাম তারপর ফেরার পথে জিনিসপত্রগুলো আবার নিয়ে যেতাম গোবরার বাড়ীতে। এই যাতায়াতের রাস্তা ছিল বাড়ীর পেছন দিকে। আর সামনের রাস্তা ছিল অফিসে যাওয়ার রাস্তা। পথে একটা ভাঙা লোহার রেলিং দেওয়া বেশ বড় একটা কবরখানা আর তার গায়েই রেললাইন। সেটা ডিঙোলে একটা ছোট রাস্তা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের পাশ দিয়ে বড় রাস্তাটা ডিঙোলেই বাম দিকে পরে পার্ক সার্কাস ময়দান আর ডানদিকে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ। তারপর পার্কসার্কসের সাত মাথার মোড়। সেটাকে পেরিয়ে সেক্সপীয়র সরণীতে ঢুকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই পরে আমাদের অফিস।

          ঐ এলাকায় ছিল আমার এক অফিসের বন্ধু। আমরা দুজনে অফিসে একসাথে হেঁটে যেতাম আর ফিরে আসতাম। আমাদের বাড়ীর পাশেই ছিল এক উঁচু পাচিল ঘেরা গোবরা মেন্টাল হসপিটালের একটা দোতলা পাগলদের হোস্টেল। ঘর থেকে বেরোলেই দোতলার জানলা দিয়ে কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করতো, ' ও দাদা, কটা বাজে, ও দাদা।' কোন কোন সময় দেখা যেতো সিলিং ফ্যান ধরে কেউ ঝুলছে। এরকম সব অদ্ভুত ঘটনা রাস্তা দিয়ে যেতে প্রায়ই চোখে পড়তো।

          জানুয়ারী মাসের এক শীতের রবিবারের সকাল। লেপের তলায় ছুটির দিনের সুখের ঘুমে তলিয়ে আমি। এমন সময় প্রিয় বন্ধু সোমেন এসে "এই ওঠ" বলে আমার লেপ ধরে টানাটানি শুরু করলো। আমি বললাম "কি ব্যাপার একেবারে সাত সকালে এই শীতে আমার ওপর আক্রমণ?" সোমেন বলে, "তুই বলেছিলি না তোকে একবার ডীপ সী তে নিয়ে যেতে। চল আজকে একটা সুযোগ এসেছে। উঠে পর। এক কাস্টমস্ অফিসার গাড়ী নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চটপট তৈরী হয়েনে।" " আমার কিন্তু রেডী হতে দেরী হবে। দাঁত মাজবো বাথরুমে যাব শীতের জামাকাপড় পরবো তারপর চা টা খেয়ে বেরোব। আধ ঘন্টা লাগবে ততক্ষণ তোর অফিসারের গাড়ী আর থাকবেনা।" " আর বেশী না বকে তুই তাড়াতাড়ি কর, আমাকে না নিয়ে ও কোথাও যাবে না। ওনার তো সোজা ডায়মন্ড হারবার যাবার কথা, আমার তো যাবার কথা না। তবুও এসেছে আমার কাছে। আমি বললাম আমায় যেতে হলে আমার সাথে এক বন্ধু যাবে। সে তাতেও রাজী হয়ে গেল। এবার তুই দয়া করে চল।"

          চা টা খেয়ে গাড়ীতে উঠতেই গাড়ী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো। ডায়মন্ড হারবার পৌঁছে লঞ্চে যখন উঠলাম তখন বাজে আটটা চল্লিশ। নিচের ডেকে সোমেনের কোম্পানীর আসল মালিক বাগচীদা, তার সব স্তাবকদের নিয়ে জমিয়ে অকসন্ ব্রীজ খেলার সাথে মদের আসর বসিয়েছে। সোমেন আর কাস্টমস অফিসারকে দেখে ওরা সব হৈহৈ করে উঠলো। সোমেন কোম্পানীর ওয়ার্কিং পার্টনার হলেও ওই কোম্পানীর সব। সোমেন তাদের বললো, " আপনারা চালিয়ে যান, আমি বন্ধুকে নিয়ে ওপরের ডেকে যাচ্ছি।" আমরা দুজন ওপরের ডেকে উঠলাম আর অফিসার ওদের দলে যোগ দিল। উঠতে উঠতে দেখলাম কয়েকটা রূপালী শস্য মানে ইলিশ মাছের ওপর সূর্যের সোনা রোদের মাখামাখি। দেখতে যেমন লাগলো ভাল তেমনি খেতে হবে নিশ্চয়ই খুব স্বাদু। তিনজন লোককে দেখলাম স্টোভ জ্বালিয়ে ডিম সিদ্ধ করে একজন নামাচ্ছে এক গামলা জলের ওপর আর দুজন ছাড়াতে ব্যস্ত। আমরা বসে বসে গঙ্গার সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলেছি। হলদিয়ায় গঙ্গা বেশ চওড়া। গঙ্গায় ড্রেজিং চলছে পুরোদমে। ব্রেকফাস্ট এসে গেল হাতে। বড়ো স্লাইজ পাঁউরুটির দু পিস বাটার টোস্ট, ডিম সেদ্ধ, কলা, জয়নগরের মোয়া। একেবারে দারুণ ব্রেকফাস্ট। ইতিমধ্যে আমরা সমুদ্রে এসে পড়লাম। জলের রঙের পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। দুটো সীগাল আমাদের লঞ্চটাকে ঘিরে ঘুরপাক খেতে খেতে চলেছে। লঞ্চে রান্নাবান্না হচ্ছে যে। তারওপর ইলিশের গন্ধ। লঞ্চ চালকের সাথে আমাদের একটু আধটু কথা হচ্ছিল। সে একবার বললো এই দিকে গঙ্গাসাগর আবার কিছুক্ষণ পরে উল্টো দিকে হাত দেখিয়ে বললো ঐদিকে দীঘার তীর। তারপরেও লঞ্চ চলতেই থাকলো জল কেটে। চারিদিকে জল আর জল। এমন সময় ডাক পড়লো লাঞ্চের। আমরা নেমে এলাম নিচে। দুরকমের ইলিশ রান্না। আবার মাটন। আমি অবশ্য মাটন খাইনি। সবার শেষে দুটো করে রসগোল্লা। দারুণ এক জমাটি পিকনিক। আমি অবশ্য সোমেনের গেস্ট। খাওয়ার মাঝপথেই শুনেছি লঞ্চ জাহাজের সিমানায় এসে ভীড়েছে। খাওয়ার পরে দেখলাম গ্রীক জাহাজটা কি বিশাল যেন আকাশ ছুঁতে চায়। জাহাজে মাল তুলছে বিরাট ক্রেনের সাহায্যে। একটা বিরাট এবং খুব উঁচু সিঁড়ি উঠে গেছে ডেক পর্য্যন্ত। সোমেন আর অফিসার উঠে গেল ডেকে। সোমেন বারে বারে বললেও আমি উঠিনি অত উচ্চতায়।

          সব কাজ সেরে টেরে যখন মোটর লঞ্চ ছাড়ল তখন চারটে বেজে গেছে প্রায়। ডায়মন্ডহারবার পৌঁছে গাড়ীতে উঠার পরে গাড়ী যখন ছাড়লো তখন দশটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে আগেই। গাড়ী চললো গড়ে একশো কিলোমিটার বেগে। রাস্তা ফাঁকা। আমি যখন পার্কসার্কাসের কাছে ন্যাশনাল মেডিকেল হসপিটালের উল্টো দিকের ফুটপাথে তখন রাত বারোটা বেজে গেছে। আমাকে নামিয়ে গাড়ীটা স্টার্ট দিয়ে নিমেষে হাওয়ার গতিতে কুয়াশা ভেদ করে চলে গেল। রাস্তাটা পেরিয়ে ওপারে যাব বলে যেই পা বাড়িয়েছি ওমনি উল্টো দিকের হাসপাতালের মেন গেট দিয়ে একটা মড়া কাঁধে নিয়ে একদল লোক ' বলো হরি হরিবোল ' বলে বেরোল। প্রথমে একটু আস্তে তারপর রাস্তায় নেমে পার্কসার্কাস ময়দানের পাশ দিয়ে সাত মাথার মোড়ের দিকে যেতে যেতে চীৎকার করে নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিয়ে ' বলো হরি হরিবোল ' বলে দৌড়ে দৌড়ে মিলিয়ে গেল। কিন্তু শব্দটা এখনও কানে বাজছে হাল্কা। আমি ত্রস্তে পা বাড়ালাম আমার পথে। ডাবল রোড ডিঙিয়ে হাসপাতালের পাশের রাস্তায় ঢুকলাম। রাস্তাটায় কুয়াশা কেমন লেপ্টে আছে। রাস্তার ধারে কুয়াশায় ঘেরা গাছগুলোর ভেতর দিয়ে একটা হালকা ঠান্ডা হাওয়া পাতায় পাতায় সর্ সর্ করে শব্দ তুলছে। রেললাইনের ধারে এসে দেখি কুয়াশা এখানে আরো জমাট। আগে কান পাতলাম ভাল করে রেললাইনের কোন ট্রেনের শব্দ আসছে কিনা। একটু আগে মড়াটা নিয়ে ' হরি বোল ' শব্দটা কানে বেজে উঠলো। খুব সন্তর্পনে লাইন পেরোলাম। রেললাইনের মধ্যেকার বড় বড় পাথরগুলোতে পা দুটো সমানে হড়কাতে থাকছিল। পা হড়কালে ভারী বিপদ হতো। কিন্তু বিপদের কি শেষ আছে। রেললাইন থেকে রাস্তায় নামতেই আমার পায়ের জুতোর একটা শব্দ উঠলো। ভাঙা রেলিংয়ালা কবরখানার টিমটিমে হলদেটে আলোয় দেখলাম একদল সাদা চাদরে ঢাকা লোক গোল হয়ে বসেছিল, তারা সব একযোগে আমার দিকে মনে হয় ফিরে তাকিয়ে আছে। মনে হয় বলছি কেন, কারণ কুয়াশা। কিন্তু ভাবছি এই ঠান্ডায় এত লোক এই কবরখানার মধ্যে বসে বসে কি করছে। আর ঠিক তখনই পীঠের ওপর দিয়ে আমার একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। একটা লোক উঠে দাঁড়িয়ে কেমন টলমল পায়ে এদিকে আসছে না? ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম আমি। আবার ভাবছি বাড়ীর কাছেতো এসেই গেছি প্রায়। এখন ভয় পেলে কিছুতেই আর চলবেনা। মনে সাহস সঞ্চয় করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। যে রাস্তার মোড় থেকে অফিসের সেই বন্ধুর সাথে একসাথে অফিসে যাতায়াত করি, সেই মোড়ে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি সাদা চাদর গায়ে একটা লোক কেমন করে যেন হেলে দুলে পেছন পেছন আসছে আমার। কত জোরে হাঁটতে পারি আর আমি। ঐতো দেখা যাচ্ছে পাগলদের হোস্টেল তারপরেই তো আমাদের বাড়ী, তবে আর ভাবনা কি। কিন্তু বিধি বাম। সামনে থেকে সাদা চাদরে ঢাকা চারজন লোক এগিয়ে আসছে এদিকে। এখন আমি কোন দিকে যাই। সামনে পেছনে যে দুদিকেই সমন। কারণ সামনে যারা নিশ্চুপে আসছে তাদের হাঁটাটাও ঐ পেছনের লোকটার মতো। এছাড়া একবার সামনের দিকে ওরা তাকাতে আমি যেন ওদের চোখগুলো জ্বলতে দেখেছি। আমার পাদুটো কেমন অসাড় হয়ে পড়লো। কিন্তু তখনও অবাক হবার কিছু বাকি ছিল। ওই চারজন অদ্ভূত লোক সোজা আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। পেছনের লোকটার কাছে গিয়ে একটু দাঁড়াল। সবাই মিলে একবার ফিরে তাকালো আমার দিকে। সবার চোখ যেন জ্বলছে। তারপর পাঁচজনই একসাথে ফিরে চললো মনে হয় কবরখানার দিকে। হঠাৎ হুঁশ ফিরলো আমি আমার বাড়ীর কাছে এসে গেছি। দরজা জোরে জোরে ধাক্কা দিলাম দুবার। ভেতর থেকে মায়ের কথা শোনা গেল, " আসছি, দাঁড়া।" দরজা খুলে মা বললো, " কিরে সেই কোন সকালে তুই সোমেনের সাথে বেরিয়ে এই রাত দুটোর বাড়ী ফিরলি? কি ব্যাপার বলতো?" আমি ঘড়ির দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। সত্যি রাত দুটো বেজে গেছে।

          জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ভয়ানক শীত করতে লাগলো। হাত-পা না ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। আর কিছু মনে নেই। অচেতনে  শুনতে পারছি, ' এতো জ্বর ডাক্তার ডাকতে হবে। কদিন আমার জ্বর গেল। সেজদা বৌদির আনাগোনা বাড়লো। তারপর সেজদার চেষ্টায় দমদম স্টেশনের কাছে একটা বাড়ী ভাড়া করে তাড়াতাড়ি জোর করে পাঠিয়ে দিল আমাদের। সেটা ছিল ওর বন্ধুর বাড়ী।

 

                                __________________________

Dipak Kumar Paul,

DTC Southern Heights

Block-8  Flat-1B

Diamond Harbour Road,

Kolkata - 700104.

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.