বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। স্বপ্ন ।। স্বপন চক্রবর্তী

 স্বপ্ন 

 স্বপন চক্রবর্তী 

 

চিত্রার স্বপ্ন ছিল বড় ফ্ল্যাটে থাকার। ছোট্ট দুকামরার ফ্ল্যাটে যেন তাঁর হাঁফ ধরছিল। অনেকদিন ধরে একমাত্র ছেলে রাজাকে বলছিলেন , কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। কারণ তার স্ত্রী নন্দিনী বড় ফ্ল্যাট কেনার ঘোরতর বিরোধী। যদিও রাজা এবং নন্দিনী দুজনেই সরকারী কর্মী এবং ভালই বেতন পায়। অবশেষে তাঁর প্রয়াত স্বামীর জীবন বীমা সম্পর্কিত বেশ কিছু অর্থ হাতে পেয়ে চিত্রা রাজাকে বললেন - "এবার একটা বড় ফ্ল্যাট কেন্ বাবা। আর ত' টাকাপয়সা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার সব টাকাকড়ি তোরা রেখে দে।"  

মায়ের এমন কথায় রাজা বা নন্দিনীর খুশী আর ধরে না। তারা ত' এটাই চাইছিলো।বড় ফ্ল্যাট না কেনার আর কিসের অসুবিধা ? তারপর ছেলেটাও বড় হচ্ছে। একটা বড় ফ্ল্যাট কেনা খুব জরুরী বলেই এবার তাদের মনে হল। অতএব ছোট ফ্ল্যাটটা এক বন্ধুকে ভাড়া দিয়ে চার কামরার একটা বড় ফ্ল্যাট কিনে ফেলল রাজা। চিত্রার আনন্দের বুঝি আর কোন সীমা পরিসীমা নেই। 

কিন্তু অলক্ষ্যে বিধাতা বুঝি হাসলেন। বড় ফ্ল্যাটে আসার একমাসের মধ্যেই তাঁর সব খুশী কর্পুরের মত বিলীন হয়ে গেল। নন্দিনীর পরামর্শে রাজা তার মাকে সেই পুরানো ছোট ফ্ল্যাটেই রেখে এল। ফ্ল্যাটটা খালিই ছিল। রাজার বন্ধু তখনো সেখানে আসে নি। আসলে নন্দিনী তার শাশুড়ীকে একদমই পছন্দ করতো না। প্রায়ই চিত্রার সাথে তার সামান্য বিষয় নিয়ে খিটিমিটি লেগে থাকত। মনে মনে নন্দিনী এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিল। অতএব সুযোগ আসতেই সে তার সদ্ব্যবহার করলো। এতটুকু দেরী তার বুঝি আর সইল না, আর এমন একটা অনৈতিক কাজে রাজাকে প্রবৃত্ত করতে তার এতটুকু দ্বিধাও হল না, কারণ সে জানতো যে তার স্বামী রাজার, তার কথার অন্যথা করার কোন সাহসই নেই। চিত্রার বড় ফ্ল্যাটে থাকার সখ একেবারেই মিটে গেল। দিনের বেলা নিজের মত যা হোক কিছু ফুটিয়ে নিতেন আর রাতের খাবারটা রাজা রোজ দিয়ে যেত। কিন্তু তিনি কি খেতেন,কতটা খেতেন-সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার কোন দায়বদ্ধতাই ছিল না তাঁর ছেলে বা বৌমার । 

ছোট ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে নন্দিনী কোনদিন তাঁর সঙ্গে দেখাও করে নি আর তার মেয়েকে আসতেও দেয় নি। যে নাতনীকে ছোট্ট বয়স থেকে কোলেপিঠে করে তিনি বড় করলেন, তাকে আর দেখতে না পেয়ে চিত্রার মনটা গুমরে গুমরে উঠতো। এমন করেই তিনি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রাজা দেখেও বুঝি না দেখার ভান করতো।আর এইভাবে একদিন তিনি সেই বন্ধ ফ্ল্যাটের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। রাজা রাতে খাবার দিতে গিয়ে মায়ের কোন সাড়া না পাওয়ায় ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের সাহায্যে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখলো যে চিত্রা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। রাজাদের আবাসনের কাছে বেশ কয়েকটি বড় বড় বেসরকারী হাসপাতাল থাকা সত্বেও রাজা তার মাকে অনেক দূরে এক সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করলো। তাঁর চিকিৎসা সেখানে কিছু কিছু হল ঠিকই, কিন্তু ডাক্তারবাবুরা বললেন যে বহুদিন ধরেই অপুষ্টি, রক্তাল্পতা , স্নায়ুর রোগ তথা হৃদযন্ত্রের গোলযোগের কারণে তাঁর সুস্থ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। 

অবশেষে যা হবার তাই হল। এক বড় ফ্ল্যাটের থাকার স্বপ্ন তথা অতৃপ্ত বাসনাকে সঙ্গে নিয়ে চিত্রা চলে গেলেন চিরতরে। যে সন্তান জীবদ্দশায় মায়ের কোন খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করে নি, মায়ের মৃত্যুর পরে সে ধূমধাম করে তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করলো। হায় রে কলিকাল। দশ মাস দশদিন গর্ভে ধারণ যে সন্তানকে মা গভীর মমতার সঙ্গে বহু কষ্টে লালনপালন করে মানুষ (?) করে তুললেন, সেই কিনা তার মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করলো ! তার এহেন আচরণে বোধ হয় বিধাতা পুরুষও সেদিন চিত্রার জন্য অশ্রুস্নাত হয়ে উঠেছিলেন। নয়তো চিত্রার মৃত্যুদিনে কেন সেদিন সারা শহরে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছিল ! 

তবে প্রশ্ন একটাই - রাজা কি সত্যিই মানুষ নাকি দু' হাত দু' পা ওয়ালা এই পৃথিবীর একটি তথাকথিত সব থেকে উন্নত প্রাণী, যার মান বা হুঁশ কোনটাই নেই। ঠিক যেমনটি আমরা আজ আরও বেশী করে দেখতে পাই। মনুষ‍্যত্বহীন , বিবেকহীন সেইসব মানুষের সংখ্যাই যেন দিনকেদিন বেড়ে চলেছে।

আজ রাজা এক কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তা, দুটো ফ্ল্যাট, দুটো গাড়ির মালিক, তার একমাত্র মেয়ে এখন বিদেশে ডাক্তারী পড়ছে। তাই মাঝে মাঝেই ভাবি যে সত্যিই আজকের পৃথিবীতে ঐ সমস্ত বিবেকহীন মানুষেরা যারা অন্যের স্বপ্নকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে হাওয়ার ভাসিয়ে দেয়, তারাই বোধহয় সবথেকে সুখী। 

———————————————————————-

               - এক সত‍্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে -                    

                             ॥স্বপন চক্রবর্তী॥

মাতৃ কুটীর, শিবাণী পীঠ লেন, শিবাণী পীঠ মন্দিরের সন্নিকটে, 

ভট্টাচার্য্য পাড়া, ওয়ার্ড নং - ৫ , বারুইপুর, ২৪ পরগণা (দক্ষিণ), কলকাতা-৭০০১৪৪.


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.