পুনরারম্ভ
শ্যামল হুদাতী
সকালবেলার মৃদু আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকছে। ঘরে কেবল একটাই মানুষ—ঈশান। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। মুখে হালকা দাড়ি, চোখদুটো ক্লান্ত, কিন্তু গভীরে যেন জমে আছে বহুদিনের না-বলা কথা। এই ছোট্ট ভাড়া বাড়িটা তার কাছে এখন যুদ্ধক্ষেত্রের মতো—নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ।
আজও সে ঘুম ভাঙতেই প্রথম যে ভাবনাটা মাথায় আসে, সেটা হলো—
"আজ কি কিছু বদলাবে?"
কিন্তু উত্তর সে নিজেই জানে—অধিকাংশ দিনের মতো আজও কিছুই বদলাবে না।
ঈশান একসময় ছিল চঞ্চল, প্রাণবন্ত, স্বপ্নে ভরা এক যুবক। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পর শহরের বড় কোম্পানিতে চাকরি পাওয়া—সবকিছুই যেন ঠিক পথে চলছিল। বাবা-মা গর্ব করতেন, বন্ধুরা হিংসা করত। কিন্তু জীবনে একেকটা ঘটনা এমনভাবে সবকিছু ওলটপালট করে দেয় যে মানুষ নিজের অস্তিত্বই ভুলে যায়।
ঈশানের ওলটপালট করার ঘটনাটা ঘটল তিন বছর আগে—একটি বড় প্রজেক্টে ভুল বোঝাবুঝির জন্য তাকে দায়ী করা হলো। টাকা-পয়সার গরমিলের অভিযোগ, যদিও সবই ছিল তার টিম লিডারের চক্রান্ত। কোম্পানি তাকে বরখাস্ত করল, মামলা হল, সমাজ সন্দেহ করল, আর ঈশানের স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।
আদালতে শেষমেশ প্রমাণ হলো সে নির্দোষ, কিন্তু ততদিনে চাকরি, আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা—সব হারিয়ে ফেলেছে।
প্রায় বছরের পর বছর কোনো স্থায়ী কাজ নেই। ছোটখাটো কাজ করে চলে, টিউশন নেয়, কখনও অনলাইনে কোডিংয়ের পার্ট-টাইম প্রজেক্ট করে। কিন্তু ভেতরের দহন থামে না। রাতে ঘুম আসে না, দিনে মন বসে না।
একাকিত্ব যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, সেটা সে বুঝেছে।
একদিন সন্ধ্যার সময় বৃষ্টি নেমেছিল। পৃথিবীটাকে যেন ধুয়ে-মুছে নতুন করে সাজিয়ে দিল। কিন্তু ঈশানের মনটা ধোয়া যায় কই?
সে দাঁড়িয়েছিল তার বাড়ির ছাদের ধারে—একদম কিনারে। নিচে তাকালে সবকিছু এত ছোট, এত তুচ্ছ।
মনে হচ্ছিল—
"যদি আমি না থাকি, আদৌ কিছু বদলাবে?"
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল—এক অচেনা নম্বর।
"হ্যালো, এটা কি ঈশান?"
একটা মেয়ের গলা—নরম, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী।
"হ্যাঁ… কে বলছেন?"
"আমি নীলাঞ্জনা। আপনি একটা কোডিং সমস্যা নিয়ে পোস্ট করেছিলেন। আমি সাহায্য চাইছিলাম।"
ঈশান একটু অবাক—কেউ এখনো তার কাজকে মনে রাখে?
"আপনি এখন কথা বলতে পারবেন?" মেয়েটি বলল।
ঈশান থমকে গেল।
ছাদের কিনারটা হঠাৎ দূরে সরে গেল।
সে ফোনটা কানে চেপে বলল—
"হ্যাঁ, পারব।"
কখনও কখনও একটুকরো অচেনা কণ্ঠও মানুষকে মৃত্যুর কিনারা থেকে ফেরাতে পারে।
নীলাঞ্জনা ছিল কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। কোডিং ভালো পারে, কিন্তু এইবার যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল, সেটা নতুন।
সে ঈশানের সঙ্গে অনলাইনে আলোচনা শুরু করল।
আলোচনা থেকে কথাবার্তা বাড়ল, কথাবার্তা থেকে বন্ধুত্ব।
নীলাঞ্জনা খেয়াল করত—ঈশান কথা বলে ভদ্রভাবে, যুক্তি দিয়ে, কিন্তু তার মাঝে একটা গভীর ছায়া আছে। সে প্রায়ই চুপ হয়ে যায়, মাঝেমধ্যে খানিকটা হতাশা প্রকাশ পায়।
একদিন সে জিজ্ঞেস করল—
"ঈশান দা, আপনি কি কিছু লুকোচ্ছেন?"
ঈশান একটু থেমে বলল—
"সব মানুষ সব কথা বলে না, নীলু।"
"তবু… না বলা কথাগুলোই কখনও মানুষকে ভেঙে দেয়।"
ঈশান হাসল—
"তুমি খুব বুদ্ধিমান।"
"না, আমি শুধু মানুষের চোখ দেখতে পারি," নীলাঞ্জনা উত্তর দিল।
এভাবে কথা বলতে বলতে ঈশানের ভিতরের জমে থাকা বরফ একটু একটু করে গলতে লাগল।
একদিন নীলাঞ্জনা তার বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করতে শহরে এল।
ঈশান বলল—
"চাইলে দেখা করতে পারো।"
মেয়েটি রাজি হলো।
কফিশপে ঈশান অপেক্ষা করছিল। তার মনে হচ্ছিল—
"আমি কি ঠিক করছি? আমি তো ভগ্নপ্রায় মানুষ। আমার সঙ্গে কেউ স্বাভাবিকভাবে কেন কথা বলতে চাইবে?"
নীলাঞ্জনা এসে দাঁড়াল। গাঢ় নীল শাড়ি, বৃষ্টিতে ভেজা চুল, মুখে একরাশ সরল হাসি—কিন্তু চোখে বুদ্ধির জ্যোতি।
"ঈশান দা?"
ঈশান মাথা নেড়ে হাসল।
তারপর দুজনে গল্প হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
সেদিন প্রথমবার ঈশান নিজের অতীতের কথা বলল—অভিযোগ, অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা—সব।
নীলাঞ্জনা একবারও বাধা দিল না। শুধু শুনল।
শেষে বলল—
"আপনি জানেন? আপনার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে সেটা আপনার দোষ নয়।
আর মানুষকে একবার হারালে সব শেষ হয়ে যায়—এটা ভাবাও ভুল।
যারা আপনাকে হারিয়েছে, তারা আপনাকে চেনে না।
আপনি হারেননি—শুধু পথ হারিয়েছিলেন।"
ঈশানের বুকের ভিতর কেমন হালকা লাগতে লাগল।
অনেকদিন পর সে অনুভব করল—
কেউ তাকে দোষী ভাবে না। কেউ তাকে মানুষ বলে মনে করে।
এরপর শুরু হলো ঈশানের নতুন যাত্রা।
নীলাঞ্জনার উৎসাহে সে আবার কিছু বড় প্রজেক্ট নিল।
নিজস্ব অ্যাপ বানানোর পরিকল্পনাও করল।
কিন্তু জীবন তো সবসময় সরল নয়—
কখনও কাজ নষ্ট হল, কখনও ক্লায়েন্ট টাকা দিল না, কখনও আবার আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ল।
একদিন নীলাঞ্জনা ফোন করতেই ঈশান বলল—
"আমি পারব না। বারবার ব্যর্থ হচ্ছি।"
নীলাঞ্জনা একটু কঠিন গলায় বলল—
"পারবেন না?
আপনি কি সত্যিই ব্যর্থ?"
"হ্যাঁ।"
"না। ব্যর্থ হলো আপনার চেষ্টা নয়, ব্যর্থ হলো আপনার আশা।
যে আশাকে আপনি মরতে দিচ্ছেন।"
ঈশান অনেকক্ষণ চুপ।
তারপর নরম গলায় বলল—
"আমার ভয় লাগে।"
"সবাই ভয় পায়," মেয়েটির গলা নরম হলো,
"কিন্তু কেউ কেউ ভয় নিয়েই এগোয়।
আপনিও পারবেন।"
ঈশান মাথা নিচু করে বসে রইল। চোখের কোণে একটু জল জমে উঠল।
এই একলাইনে তার প্রাণে নতুন সাহস ঢুকে গেল।
পরের কয়েক মাস ঈশান যেন নতুন মানুষ হয়ে গেল।
দিনরাত কাজ করল, পুরনো জ্ঞান ঝালিয়ে নিল, নতুন দক্ষতা শিখল।
তার কোডিং অ্যাপটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে লাগল।
অনেক ট্রেনিং সেন্টার তাকে চাইতে শুরু করল—গেস্ট লেকচারার হিসেবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তার কাজ ছড়িয়ে পড়ল।
একদিন একটি বড় কোম্পানি তাকে অফার দিল—
"টেক লিড হিসেবে যোগ দেবেন?"
ঈশান যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
কিন্তু এবার সে ভয় পেল না।
একটা গভীর নিশ্বাসে বলল—
"হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত।"
চাকরি পাওয়ার খবর শুনে নীলাঞ্জনা বলল—
"দেখলেন তো? আপনি পারতেন সবসময়ই। শুধু বিশ্বাসটা হারিয়েছিলেন।"
ঈশান চুপ করে তাকিয়ে রইল।
তার চোখে অদ্ভুত মৃদু স্বীকারোক্তির আলো।
"নীলু… তুমি না থাকলে আমি হয়তো বেঁচে থাকতাম না।"
নীলাঞ্জনা একটু চমকে গেল।
তারপর ধীরে উত্তর দিল—
"মানুষ মানুষকেই বাঁচায়, ঈশান দা। আমরা সবাই কারও না কারও আলো।"
ঈশানের গলায় যেন কিছু আটকে গেল।
সে শুধু বলল—
"তুমি কি আমার জীবনে থাকবে? শুধু বন্ধু হয়ে নয়…"
নীলাঞ্জনা একটু লজ্জা পেল।
তার চোখে হাসি, ঠোঁটে নরম উত্তাপ—
"আমি তো অনেকদিন ধরেই আছি, ঈশান দা। শুধু আপনি বোঝেননি।"
বছর ঘুরে গেল।
ঈশান এখন প্রতিষ্ঠিত, আত্মবিশ্বাসী, এবং সবচেয়ে বড় কথা—শান্ত।
তার জীবনে আর হতাশা নেই, আছে ব্যস্ততা ও স্বপ্ন।
সন্ধ্যার সময় সে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই একই জায়গায়,
কিনারার দিকে নয়—
আকাশের দিকে।
নীলাঞ্জনা এসে পাশে দাঁড়ায়।
দুজনের চোখে একটাই অনুভব—
অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরারও একটা গল্প আছে।
যার নাম—'নিরাশা' নয়, 'আশা'।
জীবন কখনও কখনও অযৌক্তিকভাবে ভেঙে দেয়, কিন্তু মানুষ আবারও উঠতে পারে।
কখনও একজন মানুষের সহানুভূতি আরেকজনকে মৃত্যুর কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
হতাশা স্থায়ী নয়—সাহস, সমর্থন ও বিশ্বাস থাকলে জীবন নতুন করে শুরু করা যায়।
---------------------------------------------------------------
শ্যামল হুদাতী
