বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প।। বিনা অপরাধে ।। শংকর ব্রহ্ম


বিনা অপরাধে

শংকর ব্রহ্ম



                       সাধন তার পুরনো সাইকেলটা নিয়ে, সকাল ছ'টায় ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের কাজ সেরে, বেরিয়ে পড়ে। সকাল সাড়ে ছ'টা থেকে তার দু'টি টিউশন থাকে। মলয় ক্লাস সেভেসে পড়ে। আর টুম্পা ক্লাস এইটে পড়ে। সব বিষয়ই ওদের পড়াতে হয়। ফলে পড়াতে সময়টা একটু বেশি লাগে। মলয়দের বাড়ি নাকতলা। আর টুম্পারা থাকে বাঁশদ্রোনী খালের ওপারে জয়শ্রী ক্লাবের কাছে। সাইকেলটা থাকায় যাতায়াতের বেশ সুবিধা হয়েছে সাধনের। এতে সময় অনেকটা বেঁচে যায়। সাইকেলটা সে নিজে কেনেনি। সাধন এক বাড়িতে ক্লাস সেভেনের পিঙ্কি নামের একটা মেয়েকে পড়াত। তার বাবা কাজ করতেন বাঁশদ্রোনীর খানপুর রোডের 'পান্ডে ফ্যান কোম্পানী'তে। কোম্পানীটা হঠাৎ লক-আউট হয়ে যায়। পিঙ্কির বাবার আয় বন্ধ হয়ে যায়। তাই তিনি টিউশন ফি দিতে পারবেন না জেনে, একদিন সাধনকে ডেকে, পিঙ্কিকে পড়ানো বন্ধ করে দিতে বললেন। তখন বছরের মাঝামাঝি। সাধন পিঙ্কির বাবা পরিতোষবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, কেন?
- আমার কারখানা এখন লক-আউট চলছে। তাই টিউশন ফি দিতে পারব না তোমাকে।
- ঠিক আছে। তবুও আমি পিঙ্কিকে ক্লাস সেভেনের ফাইন্যাল পরীক্ষা পর্যন্ত পড়াব। লক-আউট উঠে গেলে তখন টিউশন ফি দেবেন।
 এই কথা শুনে তিনি সাধনের উপর কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলেন। সাধন দেখল, তার চোখ দু'টি ছলছল করে উঠছে। জলে ভিজে চিকচিক করছে। তিনি তা লুকোতে আর কিছু বলতে না পেরে, সাধনের কাছ থেকে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
                   সাধন তার কথা রেখেছিল। পিঙ্কি সেবার ক্লাস সেভেনে সব বিষয়ে ভাল ফল করে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। 'পান্ডে ফ্যান কোম্পানী' আর খোলেনি। কারখানাটা বন্ধ হয়ে গেছিল। তখন পরিতোষবাবু তার নিজের সাইকেলটা সাধনকে দিয়ে বলেছিলেন, টিউশন ফির বকেয়া টাকা তো তোমায় দিতে পারব না, তার বদলে তুমি এটা নাও। বলে সে সাধনকে তার সাইকেলটা দিতে চাইলেন।
- না না সে কী কথা। সাধন প্রবল আপত্তি করে বলেছিল, আপনার সাইকেল আমি নিতে পারব না। সাধন বলেছিল আমার টিউশন ফি  আপনাকে দিতে হবে না। কিছুতেই সাধন তার কাছে থেকে সাইকেলটা নিতে চায়নি। 
তিনি তখন সাধনের হাতটা ধরে ফেলে বলেছিলেন, আমার কোম্পানী বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাইকেলটা আর আমার কোনও কাজে লাগবে না। ওটা ছিল আমার কোম্পানীতে যাতায়াতের বাহন। কোম্পানী বন্ধ থাকলে, সাইকেলটা দিয়ে আমি কি করব? ওটা এখন ঘরে পড়ে থেকে থেকে ঝং ধরে নষ্ট হবে। তার চেয়ে বরং তুমি   সাইকেলটা নিয়ে ব্যবহার করলে, ওটা সচল থাকবে। ওটা ঝং ধরে অমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাছাড়া তুমি যেভাবে টাকার কথা না ভেবে আমার মেয়েকে এত মাস ধরে যত্ন নিয়ে পড়িয়েছ, সে ঋণ আমি শুধতে পারব না। তুমি সাইকেলটা নিয়ে ব্যবহার করলে আমার মনটা   তৃপ্তি পাবে। আমি মনে মনে শান্তি পাব।
এরপর সাধন আর কোনও আপত্তি করতে পারনি। সাইকেলটা সে নিয়েছিল।

                  সাধন আগে নাকতলা হাই স্কুলে পড়ত। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় সে সাইকেল চড়া শিখে নিয়ে ছিল। নাকতলা স্কুলের পাশের পাড়া অরবিন্দ নগরে তখন একটা বাড়িতে শেখার জন্য সাইকেল ভাড়া পাওয়া যেত। সেই বাড়িতে অনেকগুলি সাইকেল রাখা ছিল। নাকতলা হাই স্কুলের অনেক ছাত্ররাই সেখান থেকে ভাড়া নিয়ে এসে নাকতলা স্কুল মাঠে সাইকেল চালানো শিখত। ঘন্টা প্রতি একটাকা করে দিতে লাগত। সাধনও তাদের সঙ্গে গিয়ে সেখান থেকে সাইকেল ভাড়া করে নিয়ে এসে, সাইকেল চড়া শিখেছে। সাইকেল চড়া শিখতে তার দিন দশেক সময় লেগেছিল। এরমধ্যে  দেওয়ালে ঘষা লেগে হাত ছড়ে গেছে। না হলে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে, সাইকেলের প্যাডেলে পা থেঁতলে গেছে, চেনে পায়ের আঙুল ঢুকে কেটে গেছে। শেখার সময়টা নাকতলা স্কুল মাঠেই সবার মতো সে শিখেছে। শেখার পর রাস্তায় চালাতে গিয়ে, ব্রেক ঠিক সময়ে কষতে না পাড়ায়, একজন লোককে পিছন থেকে সে ধাক্কা মেরে ছিল। ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সে উঠে এসে, সাধনের গালে ঠাস করে কষে একটা চড় কশিয়েছিল। সাইকেল চড়ার আনন্দে সে চড়ের ব্যথা সাধনের গালে বা মনে লাগেনি। একবার তো একজন রাগী ভদ্রলোক সাধনের সাইকেলে ধাক্কা খেয়ে, তাকে ধাক্কা মারার জন্য, ঘুরে দাঁড়িয়ে তার সাইকেলটাই আটকে রেখেছিল। তারপর  অরবিন্দ নগরের সেই বাড়িতে গিয়ে তাদের একজন লোককে ডেকে নিয়ে গিয়ে সাইকেলটা ছাড়িয়ে নিতে যেতে হয়েছিল সাধনকে। এখন সাধনের সেসব ভাবতে বেশ মজাই লাগে। এসব তার সেভেনে পড়ার সময়কার ঘটনা।

                        এখন সাধনের বয়স একুশ। নাকতলা স্কুল থেকে পাশ করে, সাউথ-সিটি কলেজ থেকে বি.কম পাশ করে বেকার হয়ে বসে আছে। খবরের কাগজ দেখে বিভিন্ন অফিসে অ্যাপ্লিকেশন লেখে। আর সকাল সন্ধ্যায় মোট চারটি টিউশন করে। টিউশন ফি পঞ্চাশ টাকার বেশি না। মাসে দু'শো টাকা আয় হয় মাত্র। সেই টাকার বেশির ভাগটাই অ্যাপ্লিকেশন ফি এবং পোষ্ট-অফিস থেকে  পাঠানোর খরচ বাবদ চলে যায়। বাকি যা থাকে, তা'তে  সাধনের চা সিগ্রেটের খরচ চলে। মাঝে মাঝে চায়ের দোকানেও বাকি জমে যায়। সিগারেট ধারে বিক্রি করে না বলে, সেখানে ধার রাখা যায় না। এইভাবেই এখন চলছে সাধনের। বাড়িতে সে আয়ের কিছুই দিতে পারে না। এই জন্য তার মনে একটা অপরাধ বোধ তাকে কুরে কুরে খায়। কিন্তু তার উপায়? কষ্টটা তাই সে তার মনের গোপন কুঠুরীতে লুকিয়ে চাপা দিয়ে রাখে।
                      সাধনরা চার ভাই বোন। সাধন সবার বড়। তারপর দু'টি বোন, সবার ছোট এক ভাই আছে তার। নাম বাঁধন। আর বোন দু'টির নাম সীতা আর গীতা। সাধনের বাবা ফটিক সাহা একটা গেঞ্জির কারখানায় কাজ করতেন। বাবার আয় সামান্যই। বড় অভাবের সংসার। প্রবাদে যাকে বলে,  'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা। তার মা লাবণ্যদেবী  সংসারের কাজ সেরে, খবরের কাগজ কেটে, ঠোঙা বানায়। তা দোকানে বেচে যা আয় হয়, তা সংসারের কাজে লাগে। খুব ফটিক সাহা খুব সৎ মানুষ, তবে চড়া মেজাজের লোক। সাধন তার কাছ থেকে মেজাজটা পেয়েছে। মায়ের নাম একটা আছে বটে, তবে কেউ সেই নামে তাকে ডাকে না। সকলেই তাকে 'সাধনের মা' বলে ডাকে। 

                       সাধন যেবার ক্লাস এইটে পড়ে, সেবার সাধনের বাবা ফটিক সাহা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি হলেন। সেখানে তাকে কয়েক মাস থাকতে হল। তখন বাবার আয় বন্ধ। সংসারের হাল নাজেহাল হয়ে পড়ল। সাধনকে তখন গাঙুলীবাগান বাজারে সকালে সব্জি বিক্রি করে, বাড়িতে এসে স্নান খাওয়া সেরে স্কুলে যেতে হয়েছে। সাধনদের বাড়ি বলতে শাল খুটির উপর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা দু'খানা ঘর। খোলা টালির চাল। একটা ঘরে মা বোনেরা থাকে। আর একটা ঘরে বাবা আর সাধন থাকে। উপরে খোলার টালি দিয়ে ছাওয়া চালে তড়তড়িয়ে লতিয়ে উঠেছে একটা লাউ গাছ। এখনও লাউ ধরেনি তাতে। তবে শিগগিরই ধরবে মনেহয়।
                সকালে বাজারে সবজি বেচতে হলেও,  তবু সে স্কুলে অ্যাবসেন্ট করেনি। ছ'মাস পড়ে বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। তারপর গেঞ্জির কারখানায় গিয়ে শুনেছিলেন, তার জায়গায় নতুন লোক নেওয়া হয়ে গেছে। ফটিক সাহা মালিককে অনুনয়-বিনয় করে বলে হাত পা ধরলে হয়তো সে কাজটা ফিরে পেত। কিন্ত কড়া ম্বভাবের জন্য সেটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ, তাই সে তা করে নি। তার মেজাজী স্বভাবের জন্য সে আর কিছু না বলে বাড়ি ফিরে এসেছিল। সেই কাজটা ফিরে পাওয়ার কোনও তোয়াক্কা না করেই ফিরে এসে সবজির দোকানে বসতে শুরু করছিল। তারপর থেকে বাবাই সেই সবজির দোকানটা দু'বেলা চালাতে লাগলেন। সাধন ছাড়া পেয়ে পড়াশুনায় ঠিক মতো মন দিল। এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় তখন, পরীক্ষার ফল দেখে সেই সময় ঠিক করা হতো, ক্লাস নাইনে কে কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে। কে সাইন্স নিয়ে পড়বে, কে কমার্স আর কে আর্টস নিয়ে পড়বে।
                    সেই সময় নাকতলা স্কুলের সুরঞ্জন স্যারের নকল ধরার জন্য খুব নাম ছিল। পরীক্ষার সময় সে মাঝে মাঝে সব পরীক্ষার হলেই ফ্ল্যাইং ভিজিটে আসতেন। তিনি ক্লাসে ঢুকলেই নকল নবিশরা সতর্ক হয়ে যেত। তা'কে আড়ালে সকলেই টেলিস্কোপ স্যার বলে ডাকত। 
                  পরীক্ষার হলে সাধনের টোক-টুকি করে লেখে না। সে বাতিক, তার কোনও কালেই ছিল না। সে বাড়িতে মন দিয়ে পড়া-শুনা করত। পরীক্ষার হলে বসে, সে নিজে যা জানত তাই লিখত। তাই সুরঞ্জন স্যারকে তার কোনও ভয় ছিল না। 
                    সেবার ক্লাস এইটের অংক পরীক্ষাার দিন। সাধন সম্পূর্ণ প্রশ্ন-পত্রটা পড়ে নিয়ে, যে অংকগুলি সে পারবে, সেগুলির সমাধান করা শুরু করল। বাকি গুলি পরে চেষ্টা করে দেখা যাবে ভাবল। 
                    কখন সুরঞ্জন স্যার ফ্ল্যাইং ভিজিটে এসেছে সাধন টের পাইনি, অংক করায় এমন মসগুল ছিল। সুরঞ্জন স্যার ফ্ল্যাইং ভিজিট দিয়ে বেরিয়ে যাবার পর, সাধনের পিছনের বেঞ্চে বসা তাদেরই ক্লাসের গনেশ দত্ত তার কাছে জানতে চাইল, চার নম্বরের অংকটা তুই করেছিস? উত্তর কত বল তো?
                   সাধন পিছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে বলল, না চার নম্বর এখনও আমি করিনি। ক্লাসের ভিজিটিং গার্ড বিনয় স্যার তখন সাধনকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দীপাঞ্জনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে,  হলে বসে অন্য ছাত্রর সঙ্গে কথা বলার অপরাধে তিনি এসে তার পরীক্ষার খাতায়, মাইনাস টেন লিখে, সই করে দিয়ে বললেন, আর একবার কথা বলতে দেখলে, তোমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেব। 
                       বিনা অপরাধে, বিনয় স্যার তাকে এমন শাস্তি দেওয়ায়, সাধনের মাথাটা এমন গরম হয়ে গেল যে, সে ভাবল বিনয় স্যারকে সে খুন করবে। কাল বিনয় স্যার যখন রাস্তা দিয়ে স্কুলে আসবেন, তার পেটে ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দেবে। সেই জন্য সে বাড়ি ফিরে, বিকেলের পর গাঙ্গুলীবাগান বাজারে গেল। বাজারে ছ'মাস সবজির ব্যাবসা করার ফলে, বাজারের অনেক বিক্রেতার সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়েছিল। 
সে মুরগীর দোকানে মাংস কাটা কসাই হানিফের সঙ্গে দেখা করে বলল, আমাকে একটা ধারালো ছুরি দিতে পারিস?
- কেন কি করবি?
- একজনকে খুন করব।
- কবে?
- কাল।
- আজ তো দিতে পাবর না। ছুরিগুলি দোকানে ধার করতে দিয়েছি। কাল আসিস। নিয়ে যাস।
সাধন ব্যর্থ মনে বাড়ি ফিরে এল।
পরের দিন তার রাগ অনেকটা পড়ে আসায়, তার আর হানিফের কাছে যাওয়া হয়নি। ছুরি জোগাড় করতে না পেরে সে বিনয় স্যারকে সেবার মতো ক্ষমা করে দিয়েছিল। তবে সেবার অংকে কম নম্বর পাওয়ার ফলে, সাধন সাইন্সে চান্স পায়নি। কমার্স নিয়ে তাকে ক্লাস নাইনে পড়তে হয়েছিল।

----------------------------------------------------------------------------
নাম - ঠিকানা - ফোন নম্বর
----------------------------------------------------------------------------
SANKAR BRAHMA.
8/1, ASHUTOSH PALLY,
P.O. - GARIA,
Kolkata - 700 084.
PHONE NUMBER - 98306 36623 (Whats App).
----------------------------------------------------------------------------




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.