বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। আত্মার সাথে বিবাহ ।। সমীর কুমার দত্ত

 

আত্মার সাথে বিবাহ

 সমীর কুমার দত্ত 

            
শ্রাবণ মাসে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ বিয়ের আয়োজন করে না। শ্রাবণের ধারা সব বিনষ্ট করে দেয়। কিন্তু উপায় ছিলো না। রাধিকা‌ও  কৃষ্ণেন্দু'র বিয়েটা  শ্রাবণেই  করতে হলো। কিন্তু ভালো দিন পেতে গেলে অনেক অপেক্ষা করতে হতো। অপেক্ষা করার আর সময় নেই। কারণ  কৃষ্ণেন্দুর মা শোভা দেবীর অবস্থা ভালো নয়। ব্লাড ক্যান্সারের রোগী। প্রতি মাসে ব্লাড চেঞ্জ করতে হয়। কিন্তু এবার আর সম্ভব নয়। তিনি আর ব্লাড নিতে পাচ্ছেন না। সময় ঘনিয়ে এসেছে। সেই জন্য শ্রাবণেই বিয়ের আয়োজন করতে হলো।  ভাগ্যিভালো যে সেদিন ছিটেফোঁটা বৃষ্টি আর মেঘলা আকাশ ছাড়া দিনটা কর্মে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান মিটে গেলো। শোভা দেবীর  শেষ ইচ্ছা ওরা হানিমুনটা সেরে নিক্। তাঁর সময় শেষ হয়ে এসেছে। এরমধ্যে ওনার কিছু হলে, ওদের হানিমুনটাই আর হবে না। ওনার স্বামী দীপেন্দ্রনাথ মারা যাবার পর থেকে ছেলে কৃষ্ণেন্দুর ওপর প্রচন্ড চাপ পড়েছে। স্বামী যে টাকা রেখে গিয়েছিলেন , তাও ওনার চিকিৎসাতেই শেষ হয়ে যেতে বসেছে। বাবা বেঁচে থাকতে কতো বার বিয়ের কথা বলেছিলেন। পিতৃহারা রাধিকার দায়িত্ব ছিলো সংসারের, তাই তখনি করে উঠতে পারে নি। এখন শুধু কৃষ্ণন্দুর মাতৃ বিয়োগের সম্ভবনা প্রবল বলে বিয়েটা সেরে ফেলতে হলো। দুজনের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও মায়ের অনুরোধে হানিমুনে যাওয়া স্থির হলো।

একে বর্ষাকাল । বাইরে বের হবার মতো পরিস্থিতি নয়। তবুও   যেমন তেমন করে দিন চার পাঁচেকের জন্য  কাছে পিঠে কোথাও  একটা যাবার ব্যবস্থা করলো। যাতে বিপদে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারে। গাড়ি তো সঙ্গে আছেই। 
বিয়েতে বড়ো মামা ,ছোট মামা,মামীরা 
মামাতো ভাই , বোন এরা সবাই এসেছিলো। বিবাহ মিটে যাবার পর ওদের কদিন থেকে যাবার অনুরোধ করে মায়ের চিকিৎসার সবকিছু, ওষুধ ,পথ্য ওদের বুঝিয়ে দিয়ে ওদের দায়িত্বে রেখে ওরা বেরিয়ে পড়লো মধুচন্দ্রিমা করতে মন্দারমণি'র উদ্দ্যেশ্যে গাড়ি নিয়ে।  দুই মামাই এখন ঝাড়া হাত পা। অবসর নিয়ে ঘরেই থাকেন। সুতরাং ওদের কটা দিন থেকে যাওয়ার কোন অসুবিধে নেই। দুটো গাড়ি নিয়ে এসেছিলো, বাড়িতে রাখা আছে। রাত বিরেতে কিছু হলে অসুবিধে হবে না। তবে  মামাতো ভাই বোনরা দু এক দিন পর চলে যাবে। কারো অফিস, কারো কলেজ রয়েছে। 

একটা হোটেল বুকিং করাই ছিলো—সুইট ড্রিম বীচ রিসোর্ট। পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল ন'টা—সাড়ে নটা। জামা কাপড় চেঞ্জ করে,হাত মুখ ধুয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লো সী বীচে হাঁটতে। ওরা শান্ত সমুদ্রকে উপভোগ করছে জীবনের ব্যস্ততা থেকে কটা দিনের জন্য ছূটি পেয়ে। একটু পরেই নেমে পড়লো সমুদ্রের অতল জলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে। দুপুরের লাঞ্চ সেরে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে দু একটা সুখ দুঃখের কথা বলতে বলতে চোখ টেনে আসে। কৃষ্ণেন্দুর মন পড়ে থাকে বাড়ির দিকে। মায়ের জন্য মনটা উতলা হয়ে আছে।বাবার মৃত্যুর পর থেকে মাকে নিয়ে ব্যস্ততা আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটে। বাড়িতে একমাত্র বিধবা পিসি বকুল রয়েছে ঘর সামলাতে। ছোট্ট বয়সে বিধবা হয়ে এসে দাদার সংসার সামলাচ্ছে । কৃষ্ণেন্দু 'মেডিকি‌ওর' নামের মেডিসিনের দোকান চালায়। বেশ বড়ো দোকান। তিন চার জন বিশ্বস্ত কর্মচারী দোকান চালায়। কৃষ্ণেন্দু সব সময় দোকানে থাকতে পারে না। অনেক দিন পর একটু বের হবার ফুরসৎ পেয়েছে। মন্দারমণির শান্ত ও আরামদায়ক ঢেউ ,শান্ত সমুদ্র সৈকত এক অন্তরঙ্গ এবং রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করেছে। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের মতো প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর মধ্যে একে অপরের সান্নিধ্যে সময় কাটানোর অবিস্মরণীয় স্মৃতি দাম্পত্য জীবনের প্রেরণা হয়ে থাকবে। তারা একে অপরের আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে জানালা দিয়ে প্রবেশ করা জ্যোৎস্নার নির্যাস পান করতে থাকে।

আসল কথায় আসা যাক। রাধিকা ও কৃষ্ণেন্দু মধুচন্দ্রিমা করতে হোটেলে এসে ভৌতিক পরিবেশের মুখোমুখি হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তা বর্ণনা করাই এই গল্পের লক্ষ্য। প্রথম যে রাতটা কাটলো তা অতি ভয়ঙ্কর। প্রথম দিনান্তের পর ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে প্রেমালাপ চলছিলো। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা হাঁটার  শব্দ শোনা গেলো। মনে হলো যেন কেউ হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছে। দুজনেই প্রেমের ঘোর কাটিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। ঘরের মধ্যে নাইট ল্যাম্প জ্বলছিলো, হঠাৎ নিভে গেলো। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৃষ্ণেন্দু ভাবলো পাওয়ার চলেগেছে বোধ হয়। যাবার আর সময় পেলো না! রাধিকা কৃষ্ণেন্দুকে জড়িয়ে ধরলো। কৃষ্ণেন্দু স্বভাবসিদ্ধ ভাবে কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়। ভূত প্রেত বিশ্বাস করে না। কিন্তু কখনো কখনো সিচোয়েশন বাধ্য করে বিশ্বাস করতে বা তৎ জাতীয় কিছু। বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটলো। কিন্তু এক চিলতে বাইরের আলো জানলা দিয়ে ঘরে এসে পড়লো। কেউ একজন মনে হলো যেন দ্রুত জানলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে চলে গেলো। এতে রহস্য যেন আরও ঘনীভূত হলো। হঠাৎ  দরজায় টক টক করে আওয়াজ হলো। মহা মুস্কিলে পড়া গেলো। রাধিকাকে সরিয়ে কৃষ্ণেন্দু বড়ো আলো জ্বালাতে চেষ্টা করলো। আলো জ্বললো না। ভাবলো অন্ধকারে দরজা খুললে যদি কোন বিপদ হয়। শুধু জানতে চাইলো কে। উত্তর এলো না। কৃষ্ণেন্দু যা হয় হোক বলে দরজা খুলতে গেলো। রাধিকা বাধা দিলো। কৃষ্ণেন্দু শুনলো না। দরজা খুলে দেখলো সাদা গাউন পরা কেউ একজন অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো। দরজা বন্ধ করে দিতেই ঘরের আলো জ্বলে উঠলো।সুইচ দেওয়াই ছিলো। রাধিকা এ ঘরে আর থাকতে চাইলো না। এখানে নিশ্চয়‌ই কোন ভৌতিক উপদ্রব আছে। কৃষ্ণেন্দু যদিও ভূত বিশ্বাস করে না, তবুও ভাবলো, শান্তি বিঘ্নিত হলে মধুচন্দ্রিমা তো দূরের কথা অনিদ্রায় কাটাতে হবে। ওয়েটারকে বেল টিপে ডেকে পাঠালো । ব্যাপারটা তো জানতেই হচ্ছে। দরজা খোলার আগেই দরজা আপনা হতেই খুলে গেলো। কৃষ্ণেন্দু অবাক হয়ে গেলো! সামনে দাঁড়িয়ে রাধিকা! মুখ ঘুরিয়ে দেখলো রাধিকা বিছানায় নেই! আবার মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে দেখলো একজন সাদা ইউনিফর্ম পরা অল্প বয়সী ছোকরা । কৃষ্ণেন্দুর  মুখ দিয়ে কোন কথা বের হলো না। স্তম্ভিত হয়ে ' রাধিকা '  ' রাধিকা ' বলে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে গেলো। কাউন্টারে যে লোকটি বসে ছিলো, তার কাছে কৃষ্ণেন্দু  রাধিকার খোঁজ করলে, লোকটি জানালো যে তিনি তো গতকাল একাই এই হোটেলে এসে উঠেছিলেন। তাঁর সঙ্গে তো কেউ ছিলো না। কৃষ্ণেন্দু মোবাইলে রাধিকার ছবি দেখিয়ে জানতে চাইলো, ওই মহিলা ‌ওর সঙ্গে গতকাল এসেছিলো কিনা।  উত্তরে লোকটি বলেছিলো যে হ্যাঁ, ওই মহিলা কয়েকদিন আগে ওই হোটেলে একজন পুরুষের সঙ্গে স্ত্রী পরিচয়ে এসে উঠেছিলেন। তারপর উনি খুন হন। পুরুষটি ফেরার হয়ে যায়! তারপরেই কৃষ্ণেন্দুর ঘুমটা ভেঙে যায়। কৃষ্ণেন্দু পরে লেখককে গল্পটা বলেছিলো।
===============
 
 

Samir Kumar Dutta
Pune, Maharashtra 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.