বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। সারান্ডার আদিম ডাক : বন কন্যার বিদ্রোহ ।। অভিজিৎ হালদার


সারান্ডার আদিম ডাক : বন কন্যার বিদ্রোহ

   অভিজিৎ হালদার 



ঝাড়খণ্ডের পশ্চিম সিংভূমের গভীরে, যেখানে গাছপালা আর আকাশ এক হয়ে মিশে গেছে, সেখানেই শুয়ে আছে এশিয়ার অন্যতম ঘন বন—সারান্ডা। তার স্নিগ্ধ শীতল ছায়া আর মহুয়ার মাদকতা জড়ানো বাতাসে জন্ম হয় বহু কাহিনীর। সেই সারান্ডার কোলে বসতি ধানপুর নামে একটি ছোট গ্রাম, যেখানে সময় যেন নিজের ছন্দে চলে, প্রকৃতির নিয়মই সেখানে শেষ কথা। এখানকার মানুষ, বিশেষত হো (Ho) উপজাতির নারীরা, নিজেদের কেবল মাটির কন্যা নয়, বনের রক্ষাকর্ত্রী মনে করেন। তাদের জীবন আবর্তিত হয় 'জল, জঙ্গল, জমিন' এই তিনটি শব্দের পবিত্র মন্ত্রকে ঘিরে।
এই গ্রামের প্রাণশক্তি ছিল এক তরুণী, যার নাম বাসন্তী। তার কুড়ি বছরের শরীরে ছিল বনের দৃঢ়তা, আর চোখের মণিতে ছিল আদিম আগুনের দীপ্তি। বাসন্তী গ্রাম থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত পড়া একমাত্র মেয়ে, যে কিনা সাঁওতালি ও হিন্দি ছাড়াও ভাঙা ভাঙা বাংলা আর ইংরেজিও বুঝতে পারত। কিন্তু তার আসল জ্ঞান পুঁথিপাঠের ছিল না, ছিল তার ঠাকুরমা সুমি দেবীর কাছে পাওয়া – বন-ঔষধির চেনা গন্ধ, কোন গাছের মূলে কতখানি জল ধরে রাখার ক্ষমতা, আর চাঁদ দেখে বীজ বোনার সনাতন হিসেব। সুমি দেবী ছিলেন গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত প্রবীণা, একাধারে ধাত্রী, ওঝা এবং পরম্পরার কণ্ঠস্বর। গ্রামের প্রতিটি মানুষ জানত, সুমি দেবীর কণ্ঠস্বরে যতটা মমতা, ঠিক ততটাই সাহস লুকিয়ে আছে। বাসন্তী ছিল তার উত্তরসূরি, তার হাতেই যেন সুমি দেবী তুলে দিতে চাইতেন এই বনের দায়িত্ব।
সেদিন ছিল পূর্ণিমা। ধানপুরের মাঝখানে বিশাল শাল গাছের নিচে গ্রামের বৈঠক বসেছিল। জ্যোৎস্নায় ঝকঝক করছিল সুমি দেবীর কপালে আঁকা সাদা টিপ। বৈঠকের মূল বিষয় ছিল এক নতুন বিপদ। গত এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের পথে আর বনের কিনারে দেখা যাচ্ছিল কিছু অচেনা মুখ। তারা হাতে মানচিত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল, অদ্ভুত যন্ত্র দিয়ে মাটির গভীরতা মাপছিল। তাদের নেতা, একজন সুট-পরা শহরের লোক, যার নাম ছিল প্রশান্ত রায়, সে কয়েকদিন আগেই পঞ্চায়েতের বৈঠকে এসে মহুয়া মিশ্রিত তাড়ির সঙ্গে একটা ভারী ফাইল এগিয়ে দিয়েছিল প্রধানের দিকে। ফাইলের পাতায় পাতায় ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি: 'খনি', 'উন্নয়ন', 'চাকরি' আর 'পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ'।
প্রশান্ত রায় বলেছিল, "মাটির নিচে যে সম্পদ আছে, তা কেবল আপনাদের একার নয়। দেশ গড়ার কাজে লাগবে। আপনারা কিছু জমি ছেড়ে দিন, বদলে আধুনিক গ্রাম পাবেন, বিদ্যুৎ, রাস্তা আর আপনাদের ছেলেদের জন্য ইস্পাত কারখানায় চাকরি।"
পঞ্চায়েতের প্রধান ও কিছু পুরুষ সদস্য প্রথমে দ্বিধান্বিত হলেও, পাঁচ কোটি টাকার লোভ তাদের মনকে টলিয়ে দিয়েছিল। তারা দেখছিল তাদের ছেলেদের শহরে গিয়ে মজুরি করার কষ্ট। এই টাকার বিনিময়ে সেই কষ্টের মুক্তি পেতে পারে! কিন্তু সুমি দেবী তার লাঠি মাটিতে ঠুকে গর্জে উঠেছিলেন। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল শতাব্দীর প্রতিবাদ।
"জঙ্গল, আমার মা। আর মা কে বিক্রি করে যদি রাস্তা আর বিদ্যুৎ আসে, তবে সেই রাস্তা আর বিদ্যুৎ আমাদের চাই না!" সুমি দেবী শান্ত কিন্তু স্থির কণ্ঠে বলেছিলেন। "তোমরা যে মাটিকে কোটি টাকার দাম দিচ্ছ, সেই মাটিতেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা মিশে আছেন। যে নদী আমাদের জল যোগায়, সে খনির বিষে শুকিয়ে গেলে, তখন তোমরা কোন্ টাকা দিয়ে জল কিনবে? তোমাদের 'উন্নয়ন' আমাদের সর্বনাশ!"
বাসন্তী, সুমি দেবীর ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে, তার কথাগুলো গভীর মনোযোগে শুনছিল। কিন্তু সে জানত, কেবল আবেগ দিয়ে এই লোভকে আটকানো যাবে না। শহরের লোকটা তার কথায় কোনো আবেগ দেখায়নি, শুধু হিসেব আর লাভ দেখিয়েছিল।
 বাসন্তীর মনে পড়ে গেল স্কুল শিক্ষকের কথা—'কাগজপত্রের জোর সবচেয়ে বড় জোর'।
সেই রাতেই বাসন্তী একটি বড় শাল পাতা ছিঁড়ে নিয়েছিল। পাতাটি তার ঠোঁটে ছুঁইয়ে সে মনে মনে একটি শপথ নিল। তার শপথটি ছিল সরল, কিন্তু ইস্পাতের মতো কঠিন: "এই বন আমার ঘর। আমার ঠাকুরমার ঐতিহ্য। আমার ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ। টাকা বা ক্ষমতা—কেউ আমার বনভূমিকে স্পর্শ করতে পারবে না। প্রয়োজনে আমি একা লড়ব, কিন্তু মা সারান্ডার একটি গাছও কাটতে দেব না।"
বাসন্তী জানত, এই লড়াই কেবল জমি বা টাকার নয়। এটা হল একটি সংস্কৃতি, একটি জীবনধারাকে বাঁচানোর লড়াই। একদিকে হাজার বছরের পরম্পরা আর অন্যদিকে কর্পোরেট লোভের আধুনিক দানব। এই অসাম্যের যুদ্ধে জয়ী হতে হলে তাকে শুধু বনের শক্তি নয়, আধুনিক সমাজের বুদ্ধি ও আইনকেও বুঝতে হবে। সে তার ঠাকুরমার দিকে তাকালো, যে তখনও নির্ঘুম চোখে জ্যোৎস্নায় তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। সুমি দেবী যেন চোখের ইশারায় বাসন্তীকে সাহস দিলেন—'যা করার কর, মেয়ে। বন তোর সাথে আছে।' বাসন্তীর হাত শক্ত হলো। সে প্রস্তুত ছিল এক নতুন বিদ্রোহের জন্য, যার শুরুটা হবে এই শাল পাতার শপথ দিয়ে। 


                        ••••••••••



শপথের পর ধানপুর গ্রামে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে শুরু করল। গ্রামটি দু'ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদিকে সুমি দেবী ও বাসন্তীর নেতৃত্বে গ্রামের নারীরা এবং বনের প্রতি যাদের গভীর টান, তারা; অন্যদিকে প্রশান্ত রায়ের দেওয়া 'উন্নয়নের স্বপ্ন' আর পাঁচ কোটি টাকার প্রলোভনে মজে থাকা প্রধানসহ কিছু পুরুষ সদস্য। এই বিভাজন ছিল নীরব, কিন্তু এর ফাটল গ্রামের প্রতিটি ঘরে অনুভূত হচ্ছিল। রাতের বেলা চুপি চুপি আলোচনা হতো, গোপনে গোপনে তর্ক চলত – পরম্পরা বড়, নাকি পেট বড়?
প্রশান্ত রায় এবং তার দলবল এই বিভাজনের সুযোগ পুরোপুরি ব্যবহার করতে চাইল। তারা গ্রামের প্রধানের মাধ্যমে একটি 'জরুরী সভা' ডাকল। সভায় প্রশান্ত রায় অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে তার বক্তব্য পেশ করল। সে বলল, "আমরা তোমাদের মাটির দখল নিতে আসিনি, এসেছি তোমাদের সমৃদ্ধি দিতে। আমরা জানি তোমরা বনকে ভালোবাসো। তাই আমরা শুধু মাটির নিচ থেকে সম্পদ তুলব। গাছ কাটা হবে সামান্যই। আর এই যে বুড়ি মা , সুমি দেবীর দিকে ইশারা করে বলল, ইনি তোমাদের ভয় দেখাচ্ছেন। উনি চান না যে তোমাদের ছেলেরা সুখে থাকুক। উনি চান, তোমরা চিরকাল গরিব আর জঙ্গলের মধ্যে বন্দি থাকো।"
এই কথায় কিছু পুরুষ সদস্য মাথা ঝাঁকাল, কিন্তু সুমি দেবী বা বাসন্তী কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। বাসন্তী জানত, মৌখিক তর্ক করে প্রশান্ত রায়কে আটকানো যাবে না। তার ভাষা আবেগ নয়, তার ভাষা হলো কাগজ, ক্ষমতা আর আইন। বাসন্তী মনে মনে স্থির করল, তাকে সেই ভাষাতেই উত্তর দিতে হবে।
পরের দিন ভোর হতেই বাসন্তী একটি পুরনো কাপড়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে তার ঠাকুরমা সুমি দেবীকে প্রণাম করে বলল, "ঠাকুরমা, এই জঙ্গল আমার মা। মাকে বাঁচাতে হলে আমাকে বনের বাইরে যেতে হবে। শহরের আলোয় একবার দেখতে হবে, এই কর্পোরেট দানবের আসল চেহারাটা কেমন।"
সুমি দেবী তার নাতনির মাথায় হাত রাখলেন। তার চোখে কোনো ভয় ছিল না, ছিল গভীর বিশ্বাস। "যা মা, তোর শিরায় বনের রক্ত। তুই শহরে গেলেও হারাবি না। কিন্তু মনে রাখিস, যত কঠিনই হোক লড়াই, তোর শিকড় যেন তোকে টানে।"
বাসন্তী যাত্রা শুরু করল। ধানপুর থেকে নিকটতম রেল স্টেশন মনোহরপুর পৌঁছাতে তার দীর্ঘ পথ হাঁটতে হলো। এটাই তার প্রথম বড় শহর যাত্রা, উদ্দেশ্য: জামশেদপুর (টাটানগর) – ঝাড়খণ্ডের এক শিল্পকেন্দ্র, যেখানে ইস্পাতের শহর আর আদিবাসী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে।
জামশেদপুর শহরে পৌঁছে বাসন্তীর প্রথম ধাক্কা খেল। এখানকার আকাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন, বাতাস ভারী এবং মানুষের চোখগুলো ব্যস্ততা ও ব্যক্তিগত স্বার্থে উজ্জ্বল। সবাই ছুটছে, কারও দিকে ফিরে দেখার সময় নেই। ধানপুরের শান্ত স্নিগ্ধ জীবন থেকে এই পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাসন্তী অনুভব করল, বনের সরলতা এখানে নেই, এখানে সম্পর্কগুলোও যেন লেনদেনের ভিত্তিতে তৈরি।
অনেক কষ্টে, পুরোনো একটি পরিচিতির সূত্র ধরে, বাসন্তী পৌঁছে গেল একজন পরিবেশকর্মী ও আইনজীবী মিঃ অনিরুদ্ধ সেনের অফিসে। অনিরুদ্ধ সেন আদিবাসীদের জমি রক্ষার জন্য বহু বছর ধরে লড়াই করছেন। প্রথম দর্শনেই অনিরুদ্ধ সেন বাসন্তীর চোখে-মুখে এক অদ্ভুত মিশ্রণ দেখলেন—বনের সরলতা এবং অসম্ভব দৃঢ়তা।
বাসন্তী তার আঞ্চলিক ভাষায় এবং কিছুটা ভাঙা হিন্দিতে সবকিছু বোঝালো। সে জানালো, কীভাবে প্রশান্ত রায় তাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে শোষণ করতে চাইছে, এবং কীভাবে তারা এই বনকে 'বন দেবীর' মতো পূজা করে। সে স্পষ্ট করে দিল, তারা কেবল 'ক্ষতিপূরণ' চায় না, তারা তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি, তাদের 'জমিন' ফিরে চায়।
অনিরুদ্ধ সেন মন দিয়ে সব শুনলেন। তিনি প্রশান্ত রায়ের কোম্পানির নাম এবং তাদের পূর্বের কুকীর্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি ফাইলগুলো দেখলেন এবং বললেন, "বাসন্তী, তোমাদের লড়াইটা কেবল একটি গ্রামের নয়, এটা সমগ্র ঝাড়খণ্ডের লড়াই। কিন্তু তোমার লড়াইয়ের একমাত্র অস্ত্র হচ্ছে বন অধিকার আইন (Forest Rights Act, 2006)। এই আইন অনুযায়ী, তোমরা যদি প্রমাণ করতে পারো যে যুগ যুগ ধরে তোমরা এই বনের উপর নির্ভরশীল, তবে সরকারের বা কোনো কোম্পানির ক্ষমতা নেই তোমাদের জমি কেড়ে নেওয়ার। এর জন্য তোমাদের হাতে প্রমাণ থাকতে হবে—গ্রামসভার রেজোলিউশন, পরম্পরাগত ব্যবহার এবং গ্রামের নারীদের ঐক্য।"
বাসন্তী জানতে পারল, কেবল প্রতিরোধ নয়, এবার সংগঠিত হতে হবে। তাকে ফিরে যেতে হবে ধানপুরে, তার ঠাকুরমার কাছে, এবং সবাইকে বোঝাতে হবে এই আইনি লড়াইয়ের গুরুত্ব। শহরের আলো তাকে পথ দেখাল, কিন্তু তার মন কেবল তার গ্রামের, তার বনের ডাক শুনতে পাচ্ছিল।
বাসন্তী যখন তার গ্রামে ফিরছিল, তখন তার চোখে ছিল নতুন দীপ্তি। সে বুঝেছিল, কর্পোরেট দানবের মোকাবিলা করতে হলে তাকে একদিকে যেমন ঠাকুরমার শেখানো বনের ভাষা ও সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করতে হবে, তেমনই অন্যদিকে মিঃ সেনের দেখানো আইনি পথ ধরে এগোতে হবে। এটি কোনো সহজ যুদ্ধ হবে না, কারণ শহরের মানুষ গ্রামের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটিতে আঘাত হানতে প্রস্তুত—আর সেই দুর্বলতাটি হলো কুসংস্কার এবং অভ্যন্তরীণ বিভেদ। বাসন্তী প্রস্তুত হলো, কারণ সে জানত, এই 'নিঃশব্দ বিদ্রোহ' শুরু হয়েছে কেবল, আসল ঝড় এখনও বাকি। 



                         •••••••••


জামশেদপুর থেকে ফিরে আসার পর বাসন্তীর চোখে যে নতুন আত্মবিশ্বাস দেখা গেল, তা ধানপুর গ্রামের বিভক্ত মানুষজনের মধ্যে তীব্র আলোচনার জন্ম দিল। কিছু লোক তাকে 'শহরের ছোঁয়া লাগা' মেয়ে বলে কটাক্ষ করল, অন্যদিকে নারীরা তার সাহস দেখে নতুন করে প্রেরণা পেল। সুমি দেবী জানতেন, তাদের এই ঐক্যই কর্পোরেট শক্তির কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি।
প্রশান্ত রায় এবং তার কোম্পানি এইবার বুঝতে পারল, কেবল টাকা আর উন্নয়নের ফাঁকা বুলি দিয়ে এই দুই নারীকে থামানো যাবে না। বিশেষ করে বাসন্তী আইনি সহায়তা নিয়ে ফিরে আসার পর তাদের কৌশল পাল্টানোর প্রয়োজন হলো। প্রশান্ত রায় তার টিমের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, ধানপুর গ্রামের সবচেয়ে দুর্বল অথচ প্রাচীন প্রথার অস্ত্রটি ব্যবহার করবেন: ডাইনি প্রথা। ঝাড়খণ্ডে বহু বছর ধরে এই কুসংস্কারের বলি হয়েছেন অসংখ্য নিরপরাধ নারী, বিশেষত প্রবীণ বা সমাজের মূল স্রোতের বাইরে থাকা নারীরা।
তাদের পরিকল্পনা ছিল সরল ও ভয়ংকর। প্রথমে, তারা গ্রামে গোপনে কিছু লোককে টাকা দিয়ে বশ করল, যাদের কাজ ছিল সুমি দেবীর বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো। সুমি দেবী যেহেতু প্রবীণা এবং গ্রামের ওঝা, তাই বহু বছর ধরে তাঁর ওপর বিশ্বাস যেমন ছিল, তেমনই ছিল গোপন ভয়।
গুজব ছড়ানো হলো: "গ্রামের শিশুদের রোগ কেন সারছে না? গত বছর ফসল কম হয়েছিল কেন? গত সপ্তাহে যে ছাগলটি মারা গেল, তার কারণ কী? সব সুমি দেবীর ডাইন বিদ্যার ফল। তিনি বনের দেবীকে রাগিয়ে দিয়েছেন, কারণ তিনি চান না আমরা উন্নত হই!"
প্রশান্ত রায়ের নির্দেশে, তার লোকেরা প্রধানের অনুগত কিছু দুর্বল পুরুষকে দিয়ে রাতারাতি এই মিথ্যা অভিযোগটিকে উসকে দিতে শুরু করল। তাদের লক্ষ্য ছিল—সুমি দেবীকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা, বা আরও খারাপ কিছু করা, যাতে গ্রামের মানুষ ভয় পেয়ে যায় এবং বাসন্তী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
এক রাতে, একটি অসুস্থ শিশুর বাবা পঞ্চায়েতের সামনে এসে প্রকাশ্যে অভিযোগ করল যে সুমি দেবী তার সন্তানের উপর 'কালো জাদু' করেছেন। প্রধান, যিনি ইতিমধ্যেই টাকার লোভে অন্ধ, সাথে সাথে সুমি দেবীকে গ্রামের জন্য 'অমঙ্গলকারী' ঘোষণা করলেন। সুমি দেবীর দিকে নোংরা ইশারা এবং অভদ্র চিৎকার শুরু হলো। গ্রামের সেই অংশ, যারা কর্পোরেট লাভের দিকে ঝুঁকেছিল, তারা আনন্দে যোগ দিল এই অভিযোগে।
বাসন্তীর কাছে এই আঘাত ছিল অপ্রত্যাশিত। সে বনের বাইরের শত্রুর জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তার গ্রামের ভেতরের এই বিষাক্ত আক্রমণ তাকে স্তব্ধ করে দিল। সে তার ঠাকুরমার পাশে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
"তোমাদের লজ্জা হওয়া উচিত!" চিৎকার করে উঠল বাসন্তী। "আমার ঠাকুরমা অর্ধশতাব্দী ধরে তোমাদের সেবা করেছেন! তিনিই তোমাদের গাছপালা চিনিয়েছেন, সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আর তোমরা শহরের কিছু স্বার্থপর মানুষের কথায় তাকে ডাইনি বলছ? এই মাটির ভাষা কি তোমরা ভুলে গেলে?"
গ্রামের নারীরা—যাদের অনেককে সুমি দেবীই ধাত্রীর কাজ করে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন—তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। পরম্পরাগত শ্রদ্ধা একদিকে, আর ডাইনি প্রথার হাজার বছরের পুরনো ভয় অন্যদিকে।
বাসন্তী বুঝতে পারল, এখন নীরব থাকলে শুধু তার ঠাকুরমাই নন, গ্রামে পরিবর্তন আনতে চাওয়া প্রতিটি স্বাধীনচেতা নারীই ভবিষ্যতে এই প্রথার শিকার হতে পারে। এই অভ্যন্তরীণ সংঘাতের মোকাবিলা করা বাহ্যিক আইনি লড়াইয়ের চেয়েও বেশি কঠিন।
সে তার ঠাকুরমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল। সুমি দেবী শান্ত, তার মুখে কোনো রাগ বা দুঃখ নেই, আছে কেবল গভীর ক্লান্তি। তিনি বললেন, "ডাইনি প্রথা হলো ভয় আর অজ্ঞতার ফসল, মা। যে দিন তারা বনকে ভয় করে না, সেই দিন তারা আমাকেও ভয় করে না। এই ভয় তৈরি করেছে বাইরের লোকেরা। এটাই ওদের শেষ অস্ত্র।"
সুমি দেবীর কথা শুনে বাসন্তী নতুন করে শক্তি পেল। সে শহরের আইনজীবী অনিরুদ্ধ সেনের সাথে যোগাযোগ করল এবং এই পরিস্থিতি জানালো। অনিরুদ্ধ সেন সতর্ক করলেন, "বাসন্তী, এটাই তাদের সবচেয়ে নিচ কৌশল। তারা জানে আইনিভাবে তারা তোমাদের সরাতে পারবে না, তাই তারা সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এর মোকাবিলা করতে হবে সাহস আর বিজ্ঞানের আলো দিয়ে।"
বাসন্তী গ্রামে ফিরে এসে একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিল। সে গ্রামের নারীদের একত্রিত করল। সে তাদের বোঝালো: "যদি আমরা আমাদের ঠাকুরমাকে রক্ষা করতে না পারি, তবে আমরা কখনোই আমাদের জমিন রক্ষা করতে পারব না। এই প্রথা কর্পোরেটের হাতে একটি অস্ত্র মাত্র। আসুন, আমরা প্রমাণ করি, আমাদের বিশ্বাস ও জ্ঞান এই প্রথা থেকে অনেক বড়।"
বাসন্তী প্রতিটি ঘরে গিয়ে সেই সব অসুস্থ শিশু ও ফসলের ক্ষতিগ্রস্থদের সাথে কথা বলল। সে তাদের বুঝাল যে রোগের কারণ ডাইনি নয়, বরং অপরিষ্কার জল এবং অপুষ্টি। সে তাদের দেখাল, সুমি দেবীর ভেষজ ওষুধ কীভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক এবং উপকারী। বাসন্তীর এই নির্ভীক পদক্ষেপ ধীরে ধীরে নারীদের মধ্যে সাহস সঞ্চার করল। তারা বুঝতে পারল, তাদেরই একজন নারী যখন তাদের মুক্তির জন্য লড়ছে, তখন তারা কেবল দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। পরের দিন সকালে, গ্রামের পুরুষেরা দেখল, ধানপুরের নারীরা লাঠি ও কাস্তে হাতে সুমি দেবীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে—ডাইনি অপবাদের বিরুদ্ধে নিঃশব্দ এক নারী প্রাচীর তৈরি করে।

 
                       ••••••••••



সুমি দেবীকে ঘিরে তৈরি করা নারীদের সেই 'নিঃশব্দ প্রাচীর' ধানপুরের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। ডাইনি অপবাদের বিষ কর্পোরেট কোম্পানির প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত ছড়াতে পারল না। গ্রামের পুরুষদের একটি বড় অংশ, যারা প্রথমে লোভে পড়েছিল, তারাও এই নারী শক্তির সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হলো। প্রধানও তার ভুল বুঝতে পারল, যদিও প্রশান্ত রায়ের কাছ থেকে নেওয়া টাকার বোঝা তার কাঁধেই রয়ে গেল।
এই অভ্যন্তরীণ বিজয় বাসন্তীকে বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলা করার শক্তি দিল। সে জানত, প্রশান্ত রায় এবার আইন এবং ক্ষমতা দিয়ে আক্রমণ করবে। বাসন্তী তার ঠাকুরমা ও গ্রামের নারীদের সাহায্য নিয়ে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিল—আইনি লড়াইকে বনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে একীভূত করা।
জামশেদপুরের আইনজীবী অনিরুদ্ধ সেনের নির্দেশনায়, বাসন্তী বন অধিকার আইন (Forest Rights Act, 2006)-এর প্রতিটি ধারা গভীরভাবে অধ্যয়ন করতে শুরু করল। এই আইন আদিবাসী সম্প্রদায়ের পরম্পরাগতভাবে বনজ সম্পদের উপর নির্ভরতাকে স্বীকৃতি দেয়। তবে এর প্রধান শর্ত হলো, গ্রামের প্রতিটি পরিবারের পক্ষ থেকে 'গ্রাম সভা'-র মাধ্যমে তাদের বনাঞ্চলের ওপর অধিকারের দাবি প্রমাণ করা।
বাসন্তীর নেতৃত্বে ধানপুরের নারীরা এই তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব নিল। তারা কেবল বইয়ের ভাষা নিয়ে কাজ করল না, তারা বনের ভাষা দিয়ে প্রমাণ তৈরি করল।


গ্রামের প্রবীণতম নারীরা, সুমি দেবীর নির্দেশনায়, বহু পুরনো প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের বিবরণ লিপিবদ্ধ করলেন। কোথায় কোন গাছের পূজা হয়, কোন ঋতুতে কোন পাতা থেকে ওষুধ তৈরি হয়, কোন পথ দিয়ে তাদের পশুপাল চরে বেড়ায়—সবকিছু সযত্নে নথিবদ্ধ করা হলো। এটি প্রমাণ করল যে, এই বন কেবল তাদের জীবনধারণের উৎস নয়, এটি তাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের অংশ।

বাসন্তী নিজে গ্রামে ঘুরে প্রতিটি পরিবার কোন জমি কত বছর ধরে চাষ করছে, বনের কোন অংশে তারা ছোট বনজ পণ্য যেমন মহুয়া, কেন্দু ফল, শাল বীজ সংগ্রহ করে—তার হাতে আঁকা মানচিত্র তৈরি করল। এতে বোঝা গেল, গ্রামবাসীরা খনির জন্য প্রস্তাবিত অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি বহু যুগ ধরে ব্যবহার করছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ছিল—বন সংরক্ষণে ধানপুরের নারীদের ভূমিকা। বাসন্তী প্রমাণ করল যে, বন থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের জন্য পুরুষেরা গাছ কাটার চেষ্টা করলে নারীরাই প্রথমে প্রতিরোধ করে। নারীরাই নতুন চারা রোপণ করে এবং বনের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। এর ফলে, বন অধিকার আইনে নারীকে দেওয়া বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহারের পথ খুলে গেল।
এই সমস্ত প্রমাণপত্র নিয়ে বাসন্তী আবার জামশেদপুরে অনিরুদ্ধ সেনের কাছে গেল। অনিরুদ্ধ সেন এই তথ্যের গভীরতা দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি বললেন, "বাসন্তী, তোমার এই প্রমাণগুলো কেবল নথিপত্র নয়, এগুলো বনের হৃদয়ের কথা। একটি কর্পোরেট কোম্পানি কখনোই এমন আবেগপূর্ণ ও মজবুত প্রমাণ আদালতে পেশ করতে পারবে না।"
অবশেষে মামলার দিন এল। এই মামলাটি কেবলমাত্র ধানপুরের ছিল না; এটি হয়ে উঠেছিল ঝাড়খণ্ডের 'জল, জঙ্গল, জমিন' রক্ষার এক প্রতীকী লড়াই। আদালতের বাইরে বিশাল জনসমাগম হয়েছিল। আশেপাশের গ্রামের আদিবাসীরা, পরিবেশকর্মীরা, এমনকি সাংবাদিকেরাও ভিড় করেছিল।
আদালতে প্রশান্ত রায়ের পক্ষের আইনজীবীরা বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুক্তি পেশ করল। কিন্তু যখন অনিরুদ্ধ সেন বাসন্তীকে সাক্ষী হিসেবে ডাকলেন, তখন পরিবেশ পাল্টে গেল।
বাসন্তী পোশাকে ছিল সরল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিল দৃঢ়। সে হিন্দিতে নয়, বরং নিজের হো (Ho) ভাষায় কথা বলা শুরু করল, যা আদালতকে অনুবাদকের মাধ্যমে শুনতে হচ্ছিল। সে বলল "আপনারা জিজ্ঞেস করছেন, আমরা ক্ষতিপূরণ নেব কিনা। আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করি, আপনারা একটি মায়ের দাম কত দেবেন? এই বন আমাদের মা, আমাদের পূর্বপুরুষের আত্মা। আপনারা বলছেন, এখানে শুধু লোহা আর কয়লা আছে। আমরা বলছি, এখানে জীবন আছে। যে মাটি আমাকে শ্বাস নিতে দেয়, সেই মাটিকে আমি কীভাবে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করব?"
বাসন্তী যখন তার হাতে আঁকা মানচিত্র এবং সুমি দেবীর হাতে তৈরি ওষুধপত্রের তালিকা পেশ করল, যখন সে বনের পবিত্র স্থানের বর্ণনা দিল, তখন বিচারক থেকে শুরু করে উপস্থিত সবার মনে এক গভীর প্রভাব ফেলল। এই প্রথম আদালত দেখল, কীভাবে শত বছরের পরম্পরা আধুনিক আইনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিচারক তার রায় ঘোষণার জন্য সময় নিলেন। ধানপুরে ফিরে এসে বাসন্তী বুঝল, আইনি লড়াই হয়তো শেষ, কিন্তু প্রকৃত বিজয় নির্ভর করে নিজেদের শক্তির ওপর। তারা কেবল আদালতের রায়ের অপেক্ষায় বসে রইল না। তারা গ্রাম সভার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল—কেউ, কোনো অবস্থাতেই, কোম্পানীর প্রস্তাবে সম্মত হবে না। তাদের এই ঐক্যই ছিল আইনি লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় জয়।



                        ••••••••••



আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর ধানপুর গ্রামে এক তীব্র অপেক্ষার প্রহর শুরু হলো। প্রতিটি দিন কাটছিল এক একটি শতাব্দীর মতো। গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, সকালে বনের কাজে বেরোনোর আগে সুমি দেবীর কাছে আসত এবং তাদের সংগ্রামের ফলাফলের জন্য প্রার্থনা করত। তারা যেন তাদের ভাগ্যকে আদালতের হাতে তুলে দিয়েছিল, কিন্তু তাদের মন বলছিল, তাদের ঐক্য ও বিশ্বাস বৃথা যাবে না।
একদিন সকালে, মনোহরপুর স্টেশন থেকে এক সাইকেল আরোহী এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বাসন্তীর হাতে একটি সরকারি চিঠি তুলে দিল। চিঠিটি ছিল আইনজীবী অনিরুদ্ধ সেনের পক্ষ থেকে, সাথে ছিল আদালতের রায়ের কপি। বাসন্তী দ্রুত চিঠিটি খুলল। তার হাত কাঁপছিল, আশেপাশে ভিড় করা গ্রামের নারীদের নিঃশ্বাস বন্ধ। বাসন্তীর চোখগুলো দ্রুত বাংলা হরফগুলোতে ছুটে গেল।
রায়টি ছিল পরিষ্কার ; ধানপুর গ্রামের পক্ষেই গেল রায়!
আদালত রায় দিল যে, ধানপুর গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের, বিশেষত নারীদের, বনজ সম্পদের ওপর পরম্পরাগত অধিকার (Community Forest Rights) সুপ্রতিষ্ঠিত। বন অধিকার আইন (FRA, 2006)-এর ধারা অনুযায়ী, গ্রামের সম্মিলিত অধিকারকে কোনো বাণিজ্যিক প্রকল্প খর্ব করতে পারে না, বিশেষত যখন গ্রাম সভা নিজেরাই সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন যে, এই মামলা কেবল জমি রক্ষার নয়, একটি প্রাচীন সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের সুরক্ষার। কর্পোরেট কোম্পানির খনি প্রকল্পের আবেদন খারিজ হয়ে গেল।
বিজয়ের খবর ধানপুর গ্রামে পৌঁছতেই এক অভূতপূর্ব উৎসবের সৃষ্টি হলো। এটি কেবল একটি আইনি জয় ছিল না; এটি ছিল লোভের বিরুদ্ধে বিশ্বাস, আধুনিকতার বিরুদ্ধে পরম্পরা এবং কর্পোরেট শক্তির বিরুদ্ধে মাটির মানুষের 'অস্তিত্ব রক্ষার জয়'। সন্ধ্যা নামতেই গ্রামের মাঝখানে বিশাল শাল গাছের নিচে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে জড়ো হলো। মহুয়া ফুলের তাড়ি আর লোকনৃত্যের তালে তালে শুরু হলো বিজয়ের ফাগুন। ঢোল আর মাদলের আওয়াজ সারান্ডার গহীনে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
এই বিজয়ের রাতে সুমি দেবী এক ঐতিহাসিক ঘোষণা করলেন। তিনি বাসন্তীকে ডেকে পাশে বসালেন।
"এই বন রক্ষা কেবল একটি লড়াই ছিল না," সুমি দেবী শান্ত কণ্ঠে বললেন। "এটি ছিল তোমার যোগ্যতার পরীক্ষা। তুমি প্রমাণ করেছ, তুমি একইসঙ্গে মাটির ভাষা ও আইনের আলো—দুটিকেই বুঝতে পারো। আমি এতদিন এই পরম্পরার রক্ষক ছিলাম, আজ থেকে তুমি, বাসন্তী, এই গ্রামের 'শাল পাতার প্রতিনিধি'।"
সুমি দেবী আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রামের তরুণ প্রজন্মের হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে দিলেন। বাসন্তী সেই শাল পাতার শপথ রক্ষা করেছিল, আর এখন সে প্রস্তুত ছিল তার গ্রামের জন্য এক নতুন পথ তৈরি করতে।
বাসন্তী জানত, তাদের লড়াই এখানেই শেষ নয়। জমি রক্ষা হয়েছে, কিন্তু দারিদ্র্য এবং অজ্ঞতার অন্ধকার তখনও গ্রামে ছিল। তাই বিজয়ের উন্মাদনা শেষ হতেই বাসন্তী তার নতুন দায়িত্ব শুরু করল।


বাসন্তী অনিরুদ্ধ সেন এবং অন্যান্য পরিবেশ কর্মীদের সাহায্যে গ্রামে একটি ছোট 'বন বিদ্যালয়' শুরু করল। এই বিদ্যালয়ে একদিকে যেমন আধুনিক পাঠ্যক্রম শেখানো হতো, তেমনই সুমি দেবীর তত্ত্বাবধানে শিশুদের শেখানো হতো ঐতিহ্যবাহী বনৌষধি জ্ঞান, বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি এবং আদিবাসী হস্তশিল্প।

বাসন্তী গ্রামের নারীদের স্বনির্ভর করার উদ্যোগ নিল। শাল বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন, মহুয়া ফুল থেকে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যদ্রব্য তৈরি, এবং স্থানীয় হস্তশিল্পকে জামশেদপুরের বাজারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি 'নারী সমবায় সমিতি' গঠিত হলো। এই সমবায় সমিতির প্রতিটি সদস্য ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা প্রমাণ করল, উন্নয়ন বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার জিনিস নয়, এটি আসে নিজেদের দক্ষতা ও শ্রম থেকে।

গ্রামে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হলো। গাছ কাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ; কেবল শুকনো ডাল বা পতিত পাতা জ্বালানির জন্য ব্যবহার করা যাবে। প্রত্যেকেই এখন বনের প্রতি আরও বেশি সচেতন, কারণ তারা জানত, এই বন তাদের অস্তিত্বের ভিত্তি।
কয়েক বছর পর ধানপুর গ্রামের দৃশ্য পাল্টে গেল। গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছিল, কিন্তু সেটা এসেছিল সৌরশক্তির মাধ্যমে, যা বনের ক্ষতি করে না। গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুলমুখী হয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের শিকড় ভুলে যায়নি। বাসন্তী, এখন গ্রামের সম্মানিত নেত্রী, তার ঠাকুরমা সুমি দেবীর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছিল। সুমি দেবী বার্ধক্যের ভারে যখন একদিন চিরদিনের জন্য সারান্ডার কোলে আশ্রয় নিলেন, তখন বাসন্তী জানত, তার সংগ্রাম কেবল একটি জমি রক্ষার গল্প নয়, এটি ছিল সেই অদম্য আদিবাসী নারীর গল্প, যিনি শত প্রতিকূলতা পেরিয়েও তার সংস্কৃতি ও ভূমিকে ভালোবেসেছিলেন এবং তাকে জয়ী করেছিলেন। বিজয়ের সেই ফাগুনের রং ধানপুরের প্রতিটি নতুন সূর্যোদয়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠত।

===================

Name - Abhijit Halder 
Vill- Mobarockpur 
Dist - Nadia 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.