Click the image to explore all Offers

ধারাবাহিক উপন্যাস ।। দেবব্রত ঘোষ মলয়

 

সোনালী দিনের উপাখ্যান

 

দিনান্তের সূর্য তখনও ম্রিয়মান সোনালী আলোর ছটায় মোহময় করে রেখেছে বনভূমি, শীর্ণ আকাশি নদী আর ছোট্ট গ্রাম ধানসিঁড়িকে।

বাড়ির উত্তর জানালায় বসে আছে মনন, যার দৃষ্টি নিবদ্ধ  বাইরের ছোট জটোলাটার দিকে। ওখানটায় ডাক্তারখানা। এই গ্রামের একমাত্র ডাক্তার সূর্যশেখর বসুর চেম্বার। যদিও চেম্বার বলতে সচরাচর যে ছবি ফুটে ওঠে চোখে, গ্রামে ঠিক তা নয়। ইটের দেওয়ালের দুখানি বড় ঘর যাদের মাথায় খড়ের ছাউনি, আর সামনে বারান্দা। একটি ঘরে বসেন ডাক্তারবাবু, প্রকান্ড এক প্রাচীন টেবিলের সামনে। আর অন্য ঘরটিতে একটি টেবিল পাতা, রোগীর বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য। সামনের বারান্দায় একটি পায়া ভাঙা টেবিলের সামনে বসে নিলেশ, কম্পাউন্ডার। সে একমনে কাঁচের সিসিতে ওষুধ ভরে দাগ এর লেবেল সাটাচ্ছে। দাগ হল ওষুধের মাপ।




সূর্যশেখর এদিগরে পাঁচ ছয়টি গ্রামের মানুষের বড় ভরসা। একান্ত খুব বাড়াবাড়ি না হলে কাউকেই হাসপাতালে পাঠান না তিনি। কারণ জেলা সদর বর্ধমানে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাবার উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং সঙ্গতি কোনোটাই গরিব মানুষগুলোর নেই। ছোটখাট অপারেশন পর্যন্ত এখানেই হয়ে যায় ডাক্তারবাবুর কল্যানে। এখানকার গরীব মানুষের চোখে তাই সূর্যশেখর দেবতা।

মনন কলকাতার ছেলে। কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র সে। এটি তার মামার বাড়ি। এখানে তার তিন মামাই তাকে খুবই স্নেহ করে একমাত্র ভাগ্না হবার সুবাদে। তার মা মানদাসুন্দরী এ বাড়ির একমাত্র আদরের দুলালী। কলকাতার বিখ্যাত উকিল নকুরচন্দ্র ঘোষের বড়ছেলে ব্যারিস্টার অখীল চন্দ্র ঘোষের সঙ্গে মানদাসুন্দরীর বিয়ের তিন বছর পর মনন ভূমিষ্ঠ হয়। বড়মামা কিঙ্কর বসু তখন এই গ্রামের হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক। তিনিই আদরের ভাগ্নের নাম রাখেন মনন। এই বড় মামারই একমাত্র সন্তান সূর্যশেখর।

বড় সুন্দর গ্রাম এই ধানসিঁড়ি। এখানে এলেই মননের মন ভাল হয়ে যায়। গ্রামের প্রান্তে আকাশী নদীর তীর ছোট থেকেই তার প্রিয় জায়গা। এখন সে মনস্থ করে নদীর তীরে যাবে। জানলার ধার থেকে উঠে পড়ে সে। হঠাৎই বাড়ির ভিতর থেকে একটা আর্তনাদ, কান্নার শব্দ আর চিৎকার মেশানো  শোরগোল ওঠে। দৌড়ের ভিতরবাড়িতে উপস্থিত হয় মনন।

 


- ( ২ ) -

 

এখানে ভিতরবাড়িটা চমৎকার। দক্ষিণমুখো অট্টালিকার প্রবেশপথে সদর দেউড়ি, যার দুপাশে বেশ কয়েকটি কক্ষ, যেগুলি মূলতঃ বাইরে থেকে আসা অতিথিদের বসার ঘর, অতীতের অফিসঘর, খাজাঞ্চীখানা ইত্যাদি। উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিমদিকে পুরোন আমলের চওড়া দেওয়ালের দ্বিতল দালানবাড়ি, তিন দিকে সব মিলিয়ে আঠারোটি ঘর। মধ্যিখানে বিশাল খোলা বাঁধানো উঠোন। তিনদিকে দালানঘেরা এই সানবাঁধানো উঠোনই হল এ বাড়ির ভিতরবাড়ি, যেটা মূলতঃ বাড়ির অন্দরমহল। একটু আগে এখানেই যে যার কাজে ব্যাস্ত ছিল, বড়মামী রাজলক্ষ্মীদেবী মেয়ে মানদার চুল বাঁধছিলেন আর গল্প করছিলেন উত্তরের বারান্দায়। তাঁর পাশে বসে একটা বড় তরমুজ ফালি ফালি করে কেটে একটি বড় থালায় রাখছিলেন মেজোমামী বিনতা, তাঁর স্বামী শুভঙ্কর উকিল, আজ সকাল সকাল কোর্টে বেরিয়ে গেছেন কি একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলার কাজে। এঁদের একমাত্র ছেলে চন্দ্রশেখর, সেও শিক্ষক, তবে এই গ্রামের নয়, জেলা স্কুলের শিক্ষক। সেও এখন, এই পড়ন্ত বিকালবেলায় স্কুল থেকে ফেরেনি। তার তিন পুত্রসন্তান, অমলকান্তি, কমলকান্তি এবং নির্মলকান্তি এখনও প্রাথমিকের ছাত্র, যাদের স্কুল সকালবেলায়। অমলকান্তি একটু বড়, সে ক্লাস ফোরে পড়ে, ফলতঃ ছোট দুই ভাই কমল এবং নির্মলের উপর বেশ শাসন ফলাবার চেষ্টা করে। এই তিনজনে এতক্ষন ক্রিকেট খেলছিল বাঁধানো উঠোনে। এদের মা অর্থাৎ চন্দ্রশেখরের সহধর্মিনী ছায়াছবি পশ্চিমদিকের বারান্দায় বসে এদের খেলা দেখছিল।

 

    সমবেত কান্না আর চিৎকারের শব্দে বিহ্বল মনন এক দৌড়ে উত্তরের ঘর থেকে ছুটে আসে ভিতরবাড়িতে। ক্রন্দনরত মহিলাদের ভিড় ঠেলে উঠোনের মাঝখানে পৌঁছে সে দেখে অমু, অর্থাৎ অমলকান্তি তার মা ছায়াছবির কোলে মাথা রেখে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অঝোরে কাঁদছে ছায়াছবি, মেজোমামী বিনতা এক ঘটি জল এলে তার মাথায় ঢালছে, আর মাথার একপাশ থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত।

 

    মনন কলকাতার ডাকাবুকো ছেলে, প্রাথমিক চিকিৎসার কিছুটা জ্ঞান অর্জন করেছে কলেজে সেন্ট জন্‌স্‌ এ্যম্বুলেন্সের ট্রেনিংয়ে। সবাইকে সরিয়ে অমুর মাথার রক্তমাখা চুল সাবধানে সরিয়ে কাটা জায়গাটা ভাল করে দেখে ডুকরে ওঠে সে — ''বেশ গভীর আঘাত, মনে হয় স্টিচ করতে হবে। সরো সরো সবাই ...'' বলতে বলতেই সে অমুকে কোলে তুলে দৌড় দেয় বাড়ির পিছনের ডাক্তারখানার দিকে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে রোগীদের জটলাকে সরিয়ে মামাতো দাদার চেম্বারে ঢুকে পড়ে। তখন সূর্যশেখর এক রোগীর বুকে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করছিল। রক্তমাখা অমুকে কোলে নিয়ে হাঁফাতে থাকা মননের দিকে একপলক তাকিয়েই অভিজ্ঞ ডাক্তার বুঝে যায় ঘটনার গুরুত্ব। কপাল কুঁচকে ওঠে তার, কিন্তু মুহূর্তেই পেশাদারী দক্ষতায় আবেগ সামলে বলে — ''ওকে ওই টেবিলটায় শুইয়ে দে মন আর টেবিল ফ্যানটা ওর মাথার কাছে চালিয়ে দে''। সামনে বসে থাকা রোগীকে খসখস করে প্রেসক্রিপশান লিখে দিয়ে বলে — ''এই ওষুধগুলো কাল থেকে খাওয়া শুরু করো, সকালে আর রাত্রে খাবার পর একটা করে। তিনদিন বাদে এসে রিপোর্ট দিয়ে যেও।''

 

    ইতিমধ্যে কম্পাউন্ডার নীলেশ এসে পড়েছে ঘরে এবং কাঁচি, গজ, তুলো ইত্যাদি নিয়ে টেবিলে রাখতে শুরু করেছে। নীলেশ বাইরের কেউ নয়, সে এঁদেরই এক জ্ঞাতির সন্তান। বিয়ে থা করেনি, এই বাড়িরই উত্তরের দোতলার ধারের ঘরটিতে থাকে, প্রায় সারাদিনই তার এই ডাক্তারখানার তদারকিতে চলে, অবসর সময়ে একমাত্র বিনোদন সেতার বাজানো। এখন মন টেবিলে শায়িত অমুর পায়ের দিকটা চেপে ধরে আছে, নীলেশের সাহায্যে অভিজ্ঞ হাতে অমুর মাথার কাটা জায়গার চুলগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে স্টিচ করতে থাকে সে। তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদছে অমু, আর ডাক্তারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে তার কান্না শুনে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে তার মা সমেত এ বাড়ির অন্য মহিলারা। প্রায় আধঘন্টার চেষ্টার পর সেলাই সম্পূর্ন হয়। এখন অমুর মাথায় মস্ত সাদা ব্যান্ডেজ, ফরসা মুখে চোখের জল শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে, গায়ের রক্তের দাগলাগা জামা খুলে দেওয়া হয়েছে, হাফ প্যান্ট পরে টেবিলের উপর বাবু হয়ে বসেছে সে, তার হাতে সূর্য ডাক্তারের দেওয়া একটা ক্যাডবেরীতে সে মনোনিবেশ করেছে, ছোটদের কান্না থামানোর এই উপাদানটি সূর্যশেখর মজুত রাখে সবসময়।

 

    এখন টেবিলে বসে প্রেসক্রিপশানের প্যাডে খসখস করে কিছু ওষুধ লিখতে লিখতে সামনের চেয়ারে বসা মননকে জিজ্ঞাসা করে সূর্যশেখর — ''হ্যাঁ, মন, এবার বলতো কি করে এতবড় আঘাতটা লাগল ওর মাথায়?''। ইতিমধ্যে চেম্বারে অমুর মাথার পাশে উপস্থিত হয়েছে ওর মা, সে সংক্ষেপে জানায় ঘটনাটা।

 

        তখন ব্যাট করছে অমু। কমু অর্থাৎ কমলকান্তি বল করছে। একমাত্র ফিল্ডার হিসেবে উইকেটে দাঁড়িয়ে আছে নিমু অর্থাৎ নির্মলকান্তি।  কমুর একটা আস্তে বল পেয়ে সোজা ব্যাটে খেলে অমু, কিন্তু বলটি বেশী দূর যায় না, গড়িয়ে গড়িয়ে কমুর কাছেই যেতে থাকে। এই ফাঁকে একটা রান নেবার জন্য খুব জোরে দৌড়ায় অমু, কিন্তু হঠাৎই শানবাঁধানো উঠোনে পা মুচকে মুখ থুবড়ে পড়ে সে, গোটা শরীরের ভরটা পড়ে তার মুখের উপর। মাথাটা সজোরে ঠুকে যায় শানের মেঝেতে, আর নরম মাথা মুহূর্তের মধ্যে ফেটে গিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে থাকে। এরপরই সবাই চিৎকার করে শোরগোল তুলে দেয় আর মনন এসে তাকে ডাক্তারখানায় পৌঁছে দেয়।

 

        ''কিচ্ছু হয় নি, অমুবাবু তো খেলোয়াড়, খেলোয়াড়দের কতই তো চোট লাগে, কি অমুবাবু, আয় আমার কাছে'' — সূর্যর স্নেহের ডাকে টেবিল থেকে উঠে অমু চলে আসে সূর্যর কোলের কাছে। তাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে দেয় সূর্য, ছায়াছবির দিকে তাকিয়ে বলে — ''একটু হালকা জ্বর হতে পারে, ভয়ের কিছু নেই, আজকের দিনটা ঘরে শুয়ে থাকুক, কাল সকালেই চাঙ্গা হয়ে যাবে। তবে মাথায় জল লাগাবে না একদম, কেমন'' — বলে অমুর গালটা টিপে দিয়ে উঠে পড়ে ডাক্তার সূর্যশেখর বসু।



(ক্রমশঃ)

 

===================


দেবব্রত ঘোষ মলয়

১৮/১/১/২, নবনারিতালা ১ম বাই লেন

বাকসারা, হাওড়া - ৭১১ ১১০

ফোন - 9331271825

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.