অণুগল্প প্রসঙ্গে : বিলাল হোসেন
অণুগল্প কী?
জানা নেই। তবে বিশ্বাস আছে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে। এখনও ছায়ালোকে তার বিচরণ, অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মায়াভুবনে অখণ্ড দেহকান্তি নিয়ে দৃপ্তপদভারে অণুগল্প সতত বিরাজমান—আমি অনুভব করি। বুঝতে পারি, অণুগল্প এক আশ্চর্য বস্তু। এমন ছোট, অথচ দানবীয় শক্তির আধার। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার ভেতরে কতখানি লুকায়িত আছে—বলা মুশকিল। কিন্তু অণুগল্পে যে পুরো মাত্রায় পরিপূর্ণ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কতখানি আগুন অণুগল্প ধারণ করে বসে আছে—ভাবতেই শিহরিত হতে হয়। চিন্তায় মননে দাবানল লাগাতে এর জুড়ি মেলা ভার। অণুগল্পের প্রতিটি শব্দ-বাক্য এমন কি যতি চিহ্ন পর্যন্ত একেকটি অগ্নিকণার ভূমিকা পালন করে।
একটি শাণিত শরের নাম অণুগল্প, যার একমাত্র উদ্দেশ্য লক্ষ্যভেদী হওয়া। অণুগল্প গ্রুপে ‘অণুগল্পের শিরদাঁড়া’য় যেসব অণুগল্প লেখক এবং পাঠক বিভিন্ন সময়ে যে চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেছেন—সেইসব থেকে অণুগল্পের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে। এসব বৈশিষ্ট্য একত্রে জড় করলে হয়ত অণুগল্পের একটা ধারণা পাওয়া যাবে। কেউ কেউ আবার উদাহরণ দিয়েও বুঝাতে চেষ্টা করেছেন। যেমন—
১. অল্প পরিসরে অল্প কথায় অনন্য উন্মোচন।
২. অণুগল্পে কোন গল্প থাকতেও পারে কিংবা নাও থাকতে পারে।
৩. অণুগল্পে চমক থাকতে হবে।
৪. অনুভূতি ও ভাব-ভাবনার চমকপ্রদ উপস্থাপনে সময় বা ঘটনার অংশবিশেষের প্রতীকি কথাচিত্র।
৫. একটা বড় গল্প-ভাবনাকে চুম্বকে পরিণত করতে হবে। খুব ছোট আয়তনে ছোট গল্পের সব মাধুর্য এতে থাকবে।
৬. শুরু ও শেষের আকস্মিকতা, বিশেষ চরিত্রের ওপর আলোকপাত করা, স্বল্প চরিত্র, ঘটনার বাহুল্য না থাকা, তত্ত্ব-উপদেশ একেবারেই নয়, কাহিনি একমুখী, অন্তরে অতৃপ্তিবোধ এবং চূড়ান্ত ব্যঞ্জনা।
৭. কাব্যময়তাও এর একটি বিশেষ লক্ষণ।
৮. মুহূর্তের একটা ঘটনাকে সাবলীল আর উজ্জ্বলভাবে উপস্থাপন।
৯. অল্প পরিসরে বিশালতাকে আবৃত করাই অণুগল্প।
১০. একশো দেড়শো শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
১১. জীবনের খণ্ডছবি উঠে আসে।
১২ বর্ণনার বাহুল্য নেই।
১৩. কিছু না-বলা কথা উহ্য রেখে এক দারুণ রহস্য তৈরি করা।
১৪ পাঠ করার পর নিজের মত করে অর্থ খুঁজে নেবে পাঠক।
১৫. খুব অল্প ও প্রয়োজনীয় শব্দে এবং যথার্থ বাক্য বিন্যাসে লেখক দ্রুত ঢুকে যাবেন গল্পে।
১৬. অণুগল্প পাঠকের আভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপে দ্রুত প্রভাব ফেলে।
১৭. অণুগল্প সবটুকু বলে না, বেশিরভাগই থেকে যায় পাঠকদের জন্য।
১৮. কাহিনির ইঙ্গিতময়তা থাকে।
১৯. অণুগল্পের প্রচণ্ড সংযম থাকে।
২০. আকস্মিক পরিণতি থাকে।
২১ ছোটগল্পের নবজাতক শিশু।
২২. অণুগল্প ছোটগল্পের নবজাতক নয়, মা।
নানারকম উদাহরণের মাধ্যমেও অণুগল্পকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন—
১. আমার কাছে অণুগল্প হচ্ছে অনুভূতির পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মত। পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার সাথে সাথে প্রথম যে ছোট্ট বৃত্তটি তৈরি হয় তা হলো—অণুগল্প। তারপর বৃত্তের বাইরে একের পর এক বড় বৃত্ত তৈরি হয়। যা পাঠকের মন অণুগল্পের ভেতরের গল্পগুলো নিয়ে নিজের মধ্যে ভাবনার বড় বড় বৃত্ত সৃষ্টি করে
২. অণুগল্প হতে হবে ওই Rabbit Hole-এর মত, যার ভেতর পাঠক Alice-এর মত হারিয়ে যেতে পারে চাইলে। Magnetism থাকতে হবে, গল্প না থাকলেও চলে।
৩. অণুগল্পকে অনেক সময় ক্যামেরার ফ্ল্যাস লাইটের সাথেও তুলনা করা যায় । তারপর ক্যামেরার বুকে লুকিয়ে থাকে সেই ছবি ।
৪. অণুগল্প হলো ধ্যানীর ধ্যেয় অতিবিন্দু স্বরূপ। ওই অতিবিন্দু-রূপ অণুগল্পকে ওই বিরাটাকার পূর্ণব্রহ্মরূপ দর্শন দর্শাতে পারেন আর এই পূর্ণব্রহ্মরূপ অণুগল্পই হলো একটি সার্থক না-বলা শিল্প।
৫. অণুগল্প হচ্ছে রংতুলি দিয়ে ছোট্ট ক্যানভাসে প্রাকৃতিক বা অপ্রাকৃতিক দৃশ্যকে সুসম বিন্যাসে ফুটিয়ে তোলা, যা আকর্ষক এবং ভাবগম্ভীর হবে …যার মধ্যে পূর্ণতা থাকবে, কিন্তু সেই পূর্ণতা ধোঁয়াশায় মোড়নো ।
৬. অণুগল্প হলো অন্ধকার রাতের আকাশ চিরে নেমে আসা এক ঝলক বিদ্যুৎ যা চকিতে আলো ফেলে চেতনাকে উদ্ভাসিত করেই ডুব মারে কিন্তু রেখে যায় হৃদয়ে গভীর এক দাগ, বারবার মনে হয়—আহা, কি হেরিলাম!
৭. একজন মানুষ যখন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে একটি ডিঙি নৌকা নিয়ে পেরিয়ে যান উত্তাল সমুদ্র। অথবা কনুই জাল ফেলেন ভরা পুকুরে তুলে আনেন গভীর জলের মাছ, তখন তা দেখে হতবাক হয়ে যান দর্শনার্থীরা । অণু-গল্পকারের কাজটিও ঠিক তেমনই বলা চলে ।
৮. শামুকে লুকিয়ে থাকা ঝিনুক অতি ক্ষুদ্র কিন্তু মূল্যবান, আকর্ষণ সর্বজনীন। অণুগল্প এমনি ।
৯. অণুগল্পকারকে সেই হ্যামলিনের বাঁশিঅলা হতে হয়—যে তার বাঁশির বোলে যা খুশি তাই করে ফেলতে পারে।
১০. অণুগল্প হলো ছোটগল্পের নবজাতক শিশু। আধো আধো কথা বলে অথবা সামান্য কিছু শব্দ উচ্চারণ করে মাকে জানাবে তার খিদে-ঘুম পাওয়ার কথা। মা সেটা বুঝে নেবেন অবলীলাক্রমে।
১১ গল্পকার পাঠকের হাত ধরে ছুটতে ছুটতে একটা চৌরাস্তার মোড়ে এনে ছেড়ে দেবেন তার হাত। পাঠকের দায়, সে খুঁজে নেবে নিজের পছন্দ মতো পথ চৌরাস্তায় এসে।
১২ অণুগল্প একটা স্ফুলিঙ্গ যেন। যেন ধারালো তরবারি এক। ছিটকে বেরিয়ে এলো। চোখে এসে লাগলো তার তেজ। অথবা বিদ্যুত চমক যেন। এই এলো এই নেই। কিন্তু তার আলোকিত তরঙ্গের একটা রেশ যেন সে রেখে গেল।
অণুগল্প এবং ছোটোগল্পের মধ্যে একটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যাক। অণুগল্প একরৈখিক। ডালপালাহীনকাণ্ড। অণুগল্প একটি ঢেউ; হতে পারে ছোট বা বড়; কিন্তু একটি। একটি ঠমকেই এর উৎপত্তি এবং বিনাশ। দপ করে জ্বলে উঠে—ঝলসে দিয়ে দপ করে নিভে যাবে আবার। অণুগল্প পাঠ করে পাঠক বিহ্বল হবে। চমকে যাবে। ধাক্কা খাবে। রক্তক্ষরণ হবে। অন্যদিকে, ছোটোগল্পের ব্যাপ্তি (আয়তনের কথা বলছি না) বেশি হতে পারে অণুগল্পের চেয়ে। ছোটছোট ডালপালাযুক্ত হতে পারে। অন্বয়যুক্ত যুক্তিযুক্ত আবহ তৈরির প্রয়াস থাকতে পারে—পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষে, বিশ্বাস যোগ্যতা আনাতে। ছোটোগল্প জ্বলে ওঠে না, জ্বালানো হয় অল্প অল্প করে। চট করে নিভে যাওয়ার বিষয়ও থাকবে না অনুগল্পের মত। ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’—এই অনুভূতি ছোটগল্পে যেমন অনিবার্য একইভাবে ‘অনুভূতিশূন্য করা’ ব্যাপার শতগুণ অবধারিত থাকবে অণুগল্পে।
অণুগল্পের শরীরটাকে আমরা যদি একটু ভেঙেচুরে দেখি ২টি অংশ পাই। যেমন—
ক. কাঠামোগত
খ. ধরন
কাঠামোগত : পহেলাই আয়তন। অণুগল্পের আয়তন কতখানি হবে, এর কয়টি বাক্যের হবে, এর শব্দ সংখ্যাই বা কতটি হবে, হওয়া উচিত? কতখানি জায়গা ধরে বসলে আদর্শ অণুগল্প হিসেবে সম্বোধিত হবে—এ নিয়ে ব্যাপক মতভিন্নতা আছে। তা থাকুক। কিন্তু একটা বিষয়ে অন্তত সবাই একমত—অণুগল্পকে আয়তনে ‘অণু’-ই হতে হবে। তবে অণুগল্পকে ৩০০ থেকে ৩৫০ শব্দেই আঁটানো দরকার।
দ্বিতীয়ত মোচড় কিংবা টুইস্ট, কিংবা অভিঘাত। একেবারে আটপৌরে বর্ণনায় সহজ বোধগম্য বা পড়তে পড়তে মনে হয়, বাক্য বা শব্দ বিন্যাসে লেখক বোধকরি অসচেতন। কর্ষণে-বুননে-নিড়ানিতে গল্পের মাঠ অবহেলিত। বড়জোর ২-৪-৫ লাইনের বা একটি স্তবকে শেষ করেন গল্পের সামগ্রিক অন্তর-বাহির। কিন্তু গল্পপাঠ শেষে পাঠকের মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা হয়, মনে হয় উল্টে গেল সব, পাল্টে গেল সব। অনুভব হয় ,গালে যেন একটা চপেটাঘাত দিল কেউ। এবং, হ্যাঁ, এই চপেটাঘাতটিই হল অণুগল্পের শ্বাস- প্রশ্বাস, প্রাণবায়ু। পরিশেষে, যে লেখক এই আঘাতটি দিতে পারেন তিনি সার্থক, সফল গল্পকার।
তৃতীয়ত বহুস্বর। গল্পের ভেতরে লুকিয়ে থাকে আরেক গল্প, অব্যক্ত—গল্প আসলে অইটি, অইটি আমাদের কাঁদায়, বিহবল করে, মর্মে মারে, কখনও লাল চোখ দেখায়, গলাও টিপে ধরতে চায়। অই প্রচ্ছন্ন, ভীষণভাবে প্রভাব ছড়ানো, আবিষ্ট করানো ওই অনুভূতিটিই আসলে গল্পের নিয়ন্ত্রক এবং কলকাঠি, মুল এবংমূলমন্ত্র। মূলত মূলগল্পকে কখনই বলা হয় না, বলা যায় না। নানা শাখা প্রশাখার বিস্তারে-আচ্ছাদনে মূলকে প্রকাশের চেষ্টা করা হয় মাত্র। মূলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া যায়, পথে পথে হাঁটা যায়—গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। দেখা মেলে না তার।নানা কোন থেকে, অবস্থান থেকে নানামাত্রিক আলো ফেলা হয় মূলের রহস্যভেদ করার জন্যে কিন্তু রহস্য আরও ঘনীভূত হয়।
যেটি দেখি, পড়ি, পাই অইটি ছায়ামাত্র, অইটি আসলে ভুমিকা। অইটি আমাদের নাড়ায় না, নাড়ায় যেটি—সেটি শাদাচোখে অনুস্তিত্বশীল। চিতকণা যেমন অদৃশ্য কিন্তু সকল শক্তির উৎস। অণুগল্পের চিতকণা তেমনি চির গুপ্ত—সেই প্রভাব, যা পাঠশেষে পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়। যে অণুগল্প পাঠশেষে ক্ষণকাল স্তব্ধ করে না—সে গল্প চেতনাহীন, জড়, নিষ্প্রাণ। সে অণুগল্প ব্যর্থ।
চতূর্থত ক্রিয়াপদের কাল নির্ণয়। দুইভাবেই, গল্প বয়ানের ক্ষেত্রে, সাধারণত ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, সাধারণ অতীত, নিত্য বৃত্ত বর্তমান, পুরাঘটিত অতীত।
সাধারণ অতীত। এই কাল-টিই অধিক লেখক-প্রিয়। ক্রিয়াপদের এই কালটি এত বেশি পরিমান ব্যবহার হয়ে আসছে যে, অনেক সময় মনে হয় কাল বোধ হয় একটি-ই। আমরা যখন কথা বলি অসচেতনভাবে, তখনও এই কাল-টিই ব্যবহার করি। উদাহরণ–বলল–চলল-খেল–দিল।
নিত্য বৃত্ত বর্তমান। ক্রিয়াপদের এই কালটি একটু কম ব্যবহার হলেও অনেক লেখক সাহিত্যিক এমন দক্ষতায় ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে এই কালরূপটি অসামান্য হয়ে উঠেছে। কখনও কখনও যে , নিত্য বৃত্ত বর্তমানই গল্পের ক্রিয়াপদের একমাত্র নিয়তি হয়ে ওঠে , একমাত্র সিদ্ধান্ত হয়ে ওঠে—বিখ্যাত কিছু গল্প পড়ে তাই মনে হয়।
অণুগল্পে আমরা কোন কালটিকে ব্যবহার করব-সিদ্ধান্তটি বড় মারাত্মক। যদি এমন হয়, গল্প লিখতে গিয়ে যথাযথ কালটিকে সঠিকভাবে নির্বাচন করতে পারলাম না, বা একই গল্পে অসচেতনভাবে নানা কালের সংমিশ্রণ ঘটালাম তাহলে গল্পটির সৌন্দর্য আর থাকল কোথায়? গল্পটি মরে যাবে। সচেতন পাঠক অণুগল্পটি পড়তে পড়তে থামিয়ে দিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে অন্য গল্পের দরজা খুঁজবেন—সন্দেহ নেই। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ হকের একটি মন্তব্য উল্লেখ করার মত। তিনি বলেছেন—‘ক্রিয়াপদের কোন কালরূপ ব্যবহার করব, সচেতনভাবে বুঝে না নিলে এবং প্রতিভার আলোয় নির্ণয় করে নিতে না পারলে বাংলা ভাষার ক্রিয়াপদের বিভিন্ন রূপের শক্তিকেই আমরা জং ধরিয়ে দেব।’
পঞ্চমে আসে বানান। আমি খেয়াল করে দেখেছি ,ছোটছোট ভুলের কারণে অনেক লেখক ভাল ভাল পাঠক হারান । যেমন আমার কথাই বলি, যে লেখক বানান ভুল করেন বা এই ধরণের ‘পিচ্চিপাচ্চা’ ভুল করেন আমি তাদের লেখা মাঝ পথেই পড়া বন্ধ করে দেই। মন্তব্য করা ত প্রশ্নই ওঠে না। বানান ভুলের মত গুরুত্বপূর্ণ ভুল যে লেখক করেন , গল্প লেখা তার পক্ষে শোভা পায় না। এছাড়াও কারো কারো লেখায় অন্যান্য কিছু বিষয় আছে যা একজন লেখকের পক্ষে মানানসই নয়। লেখার প্রতি লেখকের এই অবহেলা মূলত ভাষার প্রতি-ই অবহেলা।
ছয় নম্বরে গল্পকার এবং চরিত্রের কৌণিক দূরত্ব। এখানে লেখক নিজেকে একদম আলাদা রেখে, ঘটনা-চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত রেখে শুধু দৃষ্টিপাত করে করে দেখ যাওয়া, কোনপ্রকারের আবেগ প্রকাশ না করে শুধু নির্মোহ ভঙ্গিতে গল্পটি বলে যাওয়া।
লেখক চরিত্রের সাথে এক সময় পরিচিত ছিলেন, একসাথে উঠাবসা , চলন ফিরন ছিল তবে এখন নেই । এই মুহূর্তে সেইসব কাহিনি বর্ণনা দিয়ে চলেছেন পাঠককে । লেখক এবং পাঠক একাকার । একই ব্যক্তি । উভয়েই কথাবলে যাচ্ছেন একই সমান্তরালে । পাঠক গল্প পড়তে পড়তে নিজেকে লেখক এবং চরিত্রের সাথে মিলিয়ে রাখেন
সপ্তম হিসাবে গল্পের নামকরণ। আমি মনে করি, অণুগল্পের বিষয়বস্তু, শৈলি বা আঙ্গিকের মতই অণুগল্পের শিরোনাম সমান গুরুত্বপূর্ণ। মনে চাইলেই একটি শিরোনাম দিয়ে দিলাম—ব্যাপারটি এমন হলে অণুগল্পের প্রতি মর্যাদাহানীকর ত বটেই, নির্বাচিত শব্দপুঞ্জ দ্বারা গঠিত আবছাময় অণুগল্পের একটি বাড়তি শব্দ হিসেবেই বিবেচিত হবে। অণুগল্প একটি শব্দভারেই ঝুলে যেতে পারে। তবে কিসের ভিত্তিতে অণুগল্পের শিরোনাম হয় বা হবে বা হতে পারে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন সূত্র নেই। তবে দেখা গেছে—বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে শিরোনাম হতে দেখা যায় এবং এর সংখ্যাটাই বেশি। এছাড়া প্রধান চরিত্রের নামানুসারেও শিরোনাম হতে পারে। প্রায়শই দেখা যায় অণুগল্পে একটি প্রচ্ছন্ন মেসেজ থাকে। শিরোনামে বিষয়বস্তু বা চরিত্রের নামে না হয়ে অই বিশেষ মেসেজের নামেও হয়। কিছু শিরোনামটি একেবারেই আলাদা ধরণের হয়ে থাকে। এমনি আলাদা যে গল্পটির সাথে আপাত কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যায় না। কোন কোন অণুগল্প এমনভাবে লিখিত হয় যে পাঠ করার পর পাঠকের মনে নানা ভাবনার উদয় হয় এবং সে-গল্পের ভেতরে না বলা কথা বা গল্প নিয়ে ভাবতে ভাবতে আরেকটি গল্পের অনুরণন ভেতরে অনুভূত হয় । এই ভাবে অণুগল্পকার গল্পের ভেতরে ছড়িয়ে দেন বহুস্বর। এই বহু স্বরের একটি স্বর নিয়ে অণুগল্পকার শিরোনাম করতে পারেন। বহু স্বর সংবলিত এই অণুগল্প এবং এই শিরোনামটিই সবার সেরা।
আট নম্বরে চরিত্রের নাম। অণুগল্পের শিরোনামের মতই চরিত্রের নাম যথাউপযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় ।এ-ক্ষেত্রে যদি মনোযোগ না দেয়া হয় তবে অণুগল্পের সৌন্দর্যহানি হবেই ,পাশাপাশি অনেক সময় পাঠকের অপ্রিয় হয়ে ওঠার ভয়ও থাকে । শহুরে গল্প লিখছে— চরিত্রের নাম দিচ্ছে গ্রামে বসবাসকারী মানুষদের মত । বা গ্রামীন গল্পে পাচ্ছি শহুরে নাম । গা ছমছমান ভূতের গল্পে চরিত্রের নাম শুনলে যদি গা কাঁটা দেয়ার সুযোগ থাকে— গল্পকার সে সুযোগটি না নেয়ার কোন যুক্তিই নেই । হারাধন বাবু-নিশিকান্ত বাবু—শুনলেই কেমন কেমন লাগে! কিংবা সায়েন্স ফিকশন বা ভাবজনিত গল্প—গল্পের আদলে চরিত্রের নাম বসবে ।
নবমে সংলাপ সতর্কতা। গল্পের ভেতরে গল্প থাকবে, চরিত্র থাকবে, বর্ণনা থাকবে এবং মাঝে মধ্যে সংলাপ থাকবে—এই বিষয়টি এতটাই স্বাভাবিক যে কাউকে বলতে হয় না। কিন্তু একটা গল্পে ঠিক কোথায় সংলাপ হবে, কতটুকু সংলাপ হবে, কী ধারার সংলাপ হবে, আদৌ সংলাপের দরকার আছে কি নেই বা নাকি পুরো গল্পটিই সংলাপ নির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়—সেইসব বিষয়ে অবশ্যই ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন আছে। সংলাপ আপনার গল্পকে সুখপাঠ্য করতে পারে। আবার ঝুলিয়েও দিতে পারে। সুতরাং সতর্ক থাকা দরকার।
দশ নম্বর এবং সর্বশেষ। গল্পের ভাষা ও মেজাজ। মনে রাখতে হবে—গল্পের মেজাজ আর ভাষা দুটি ভিন্ন বিষয়। গল্পের মেজাজ কী হবে আগে সেটা ঠিক করতে হবে। আর চিন্তা করে এটা ঠিক করা সম্ভব নয়। লিখতে লিখতেই সব ঠিক হবে। গল্পের মেজাজ রোমান্টিক ও ধ্বনিময় হতে পারে। ঘরোয়া বৈঠকি হতে পারে। সহজ ঠাণ্ডাও হতে পারে। কাব্যিক হতে পারে। হতে পারে নৈব্যক্তিক। ভাষা-ই গল্পের মেজাজ তৈরি করে। মেজাজ পাঠকের মনে আবেগের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে ওই গল্পের জন্যে ভাষাকে সুনির্দিষ্ট করে।
চলিত আর সাধুর মিশ্রণ যেমন দূষণীয়, একইভাবে গল্পের মেজাজ আর ভাষা ভিন্ন হলে গল্পের ‘ম্যাচিং’ ঠিক থাকবে না–গল্পের জন্যে এটা বড় ধরণের ধ্বস। সুতরাং, গল্পের মেজাজ ও ভাষা অনুযায়ী গল্পের শব্দ-বাক্য রচিত হয়। গল্পের উপমা, চিত্রকল্প আর পংক্তির আকার ছোট-বড় হয়। পাল্টে যায় যতি চিহ্নের ব্যবহার। আর এভাবেই সৃজন হয় গল্পের ছন্দ । গল্পছন্দ ।
ধরণ : অণুগল্পের নানা ধরণ। যেমন—বিষয়ভিত্তিক। শৈলিভিত্তিক। ভাব ভিত্তিক। তো, বিষয়ভিত্তিক যেমন, আধিভৌতিক-অতীন্দ্রিয়, গোয়েন্দা, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ, হাস্য রসাত্মক। ফ্ল্যাশ ফিকশন। না-মানুষ চরিত্র। মানব-মানবী। অথবা প্রকৃতি বা দেশপ্রেম।
অনুগল্প বনাম কৌতুক বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা ঠিক যে অণুগল্প নানা রকমের হলেও একটি লক্ষণ অতি আবশ্যিক, সবসময় থাকতে হয়—সেটি তার পরিসর-আয়তন। অণুগল্পকে অবশ্যই আয়তনে সংক্ষিপ্ত হতেই হবে। কিন্ত ইদানিং লক্ষ্য করা যায়, বেশ কিছু অনুগল্প ‘অণু’ বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে গিয়ে গল্পের সৌন্দর্যটাকে ব্যহত করে।
অতি অণুগল্পের পাঠে দেখা যায়, ভাষা, বাক্য কিংবা গল্পের আবহ নির্মাণ তেমন গুরুত্ব পায় না, মাথার উপরে তুলে পাঠককে আছাড় মেরে আত্ম-সচেতন করার দিকেই বেশি মনোযোগ থাকে। পাঠক আছাড় খেয়ে ছত্রখান হয়ে পড়ে থাকেন কিছুক্ষণ। গল্প শেষে পাঠকের বিহ্বলতা ঠিক আছে, তবে এই ধরণের গল্প লেখায় অনেক ধরণের ঝুঁকি আছে, আমি দেখেছি। অনেকেই লিখতে গিয়ে-ব্যর্থ হয়ে যান। অণুগল্প লিখতে গিয়ে কৌতুক পরিবেশন করে ফেলেন-সে জন্যে হাত পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত, এধারার গল্প না লেখার পরামর্শই থাকে আমার, নিজেকে আমি এভাবেই পরামর্শ দেই সব সময়।
বেশ কিছু গল্প পাওয়া যায় বিষয় গুলো মানুষ সংলগ্ন হলেও এর চরিত্ররা মানুষ নয় । এরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত । অ-প্রাণবন্ত চরিত্র—সবাই ধরতে পারছেন ধরে নিয়ে ব্যাখ্যায় গেলাম না । আ-নিষ্প্রাণ চরিত্র বলে আরেকটা ব্যাপার দাঁড়ায়। অচেতনকে চেতনরুপে কল্পনা করার তুমুল পর্যবেক্ষণ আর কল্পনাশক্তি নিয়েও ব্যতিক্রমী উত্তীর্ণ অণুগল্প রচনা করা সম্ভব। এসব গল্পে হয়ত সমকালীন ব্যক্তি সমাজ কাল উঠে আসে না কিন্তু অদেখা বা মূল্যহীন ভুবনের বাসিন্দাকে চরিত্র করে এমন কিছু কথা অনায়াসে বলে ফেলা যায়, অন্য কোন উপায়ে সেটা প্রকাশ করাটা হয়ত দুঃসাধ্যই থাকে । এমনি গল্প আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথে, বনফুলে, ক্রিশ্চায়ানা এন্ডারসনে কিংবা ইশপে। শৈলিভিত্তিক আকারে ভাগ করলে, অণুগল্পে কাহিনি থাকবে, চরিত্র থাকবে ,সংলাপ থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। এটা প্রথাগত গল্পরূপ। অন্যদিকে, এ-প্রথার বাইরে এরকমও দেখা যায়—.কাহিনি আছে। চরিত্র আছে।সংলাপ নেই। অথবা, কাহিনি আছে। চরিত্র নেই। সংলাপ নেই। অথবা, কাহিনী নেই। চরিত্র নেই। সংলাপ নেই। শুধু বর্ণনা আছে। অথবা, কাহিনি নেই। চরিত্র আছে। সংলাপ আছে।
এইখানে কাব্য আক্রান্ত নিয়ে কিছু কথা থাকে। শব্দ নিয়ে খেলা, বাক্য নিয়ে তেলেসমাতি। অনেকেই হয়ত বলবে–ইতোমধ্যে বলেছেও কেউ কেউ, গল্প লিখতে বসে অন্য কিছু লিখে ফেলা একধরণের প্রতারণা পাঠকের সাথে। নাটক লিখতে গিয়ে কেউ উপন্যাস লেখে? কবিতা লিখতে দিয়ে কেউ প্রবন্ধ লেখে? তেমনি অণুগল্প লিখতে গিয়ে কেন তবে কবিতা বা কবিতার মত কিছু একটা লিখবে? প্রশ্নটি গুরুতর। হয়ত সত্যও বটে কিছুটা। আবার এটাও তো ঠিক যে—ঐ রকমও হয়। অণুগল্প অনেক রকম, অনেক ধাঁচের, অনেক স্বাদের, অনেক আঙ্গিকের। অনুগল্প বিশদ, অনুগল্প ভিন্ন থেকে ভিন্নতর।—‘হাজার পাখি হাজার হাজার ফুল। একেক ফুলের একেক রকম গন্ধ, একেক পাখির একেক রকমের ডাক। সব নিয়ে বন, সব নিয়ে জীবন।’
এরপরে নাট্য আক্রান্ত বিষয়েও কথা আছে। সংলাপ প্রধান বা দৃশ্য প্রধান লেখা। এই সংকলনে উদাহরণ হিসেবে পাওয়া যাবে।
এবার ভাবভিত্তিক দৃষ্টিকোণ। এই ধরণের গল্পগুলি নিয়েই মূলত প্রশ্ন ওঠে এবং এই প্রশ্নটিই অণুগল্পের অস্তিত্ব ধরে টান মারে। কিন্তু অনেক রকম অণুগল্পের মধ্যে এই ভাব প্রধান অণুগল্প একটি।
শেষ কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিপিকায় বলেছেন—শুধু শিশু বয়সে নয়, সকল বয়সেই মানুষ গল্পপোষ্য জীব। তাই পৃথিবী জুড়ে মানুষের ঘরে ঘরে, যুগে যুগে, মুখে মুখে, লেখায় লেখায়, গল্প যা জমে উঠেছে তা মানুষের সকল সঞ্চয়কেই ছাড়িয়ে গেছে। গল্পরচনার নেশাই হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সবশেষের নেশা। আর এই নেশাটি কীভাবে কত রঙে ঢঙ্গে পরিবেশিত হবে তার মাত্রা-ই বলে দেবে সাহিত্যে তার অবস্থান, মূল্য কি-রকম হবে।
[এই লেখাটি লিখতে সরিত চ্যাটার্জী ‘অণুগল্পের বিবিধতা’ পড়ে প্রথম অনুপ্রাণিত হয়েছি। পাশাপাশি আমাদের প্রতিদিনের আড্ডাস্থল—‘আসমান তলা’য় সেলিম শাহেদের সাথে বিষয়টি নিয়ে ক্রমাগত আলোচনার সুবাদে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সৈয়দ শামসুল হকের ‘মার্জিনে মন্তব্য’, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’ জগদীশ গুপ্তের গল্পসমগ্র-এর ভুমিকা এবং হাসান আজিজুক হকের একটি প্রবন্ধ—এইসব বই ও লেখকদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।]
বিলাল হোসেন সাহেব কে ধন্যবাদ। অসাধারণ আলোচনা করে ছেন। সমৃদ্ধ হলাম। অনেকেই উপকৃত হবে আশা করি।একদম প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে দিয়েছেন।খ বশি হলাম।
উত্তরমুছুননিরাশা হরণ বাবুকে হার্দিক শুভেচ্ছা কথা কাহিনী বিভাগ চালু করার জন্য। গদ্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা করবেন বিশিষ্ট জনেরা। এই আশা করি।
বিলাল হোসেন সাহেব কে ধন্যবাদ। অসাধারণ আলোচনা করে ছেন। সমৃদ্ধ হলাম। অনেকেই উপকৃত হবে আশা করি।একদম প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে দিয়েছেন।খ বশি হলাম।
উত্তরমুছুননিরাশা হরণ বাবুকে হার্দিক শুভেচ্ছা কথা কাহিনী বিভাগ চালু করার জন্য। গদ্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা করবেন বিশিষ্ট জনেরা। এই আশা করি।
বিলাল হোসেন সাহেব কে ধন্যবাদ। অসাধারণ আলোচনা করে ছেন। সমৃদ্ধ হলাম। অনেকেই উপকৃত হবে আশা করি।একদম প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে দিয়েছেন।খ বশি হলাম।
উত্তরমুছুননিরাশা হরণ বাবুকে হার্দিক শুভেচ্ছা কথা কাহিনী বিভাগ চালু করার জন্য। গদ্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা করবেন বিশিষ্ট জনেরা। এই আশা করি।