ছোটগল্প ।। ঋভু চট্টোপাধ্যায়
ধুলোবালির দিন
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
-সদা, এই সদা একট বিড়ি দে না।
-বিড়ি মিয়াই গিছে, মুত লেগি গিছে।
-বিড়িতেই মুতলি নাকি?
-না'রে, এই যে হাগতে গেলম, শালাদের জ্বালায় কি ভালো করে হাগার জোর আছে, বিড়িট ধরাইলাম ওমনি চেল্লাতে আরম্ভ করলেক, জলদি করতে গিয়ে পুরো ঠোঙাটই গেলেগ পড়ে।
-তু বোস, আমি একট বিড়ি লিয়ে আসি।
-একট লয় দু'ট আনবি, গলাট শুকায় গেছে।
মমিণ চলে যেতেই সদা পা'দুটা ছড়িয়ে বলে ওঠে,'রাধে রাধে।'
এ'নিয়ে তিন বার সদা এই মেলাতে এল।মমিণ অবশ্য এর আগে অনেকবারেই এসেছে, খেয়েছে, আর বাড়ি যাবার সময় বস্তা করে চাল আর পকেটে টাকা ভরে নিয়ে গেছে, তিনবছর আগেই লতিফের চায়ের দোকানে একদিন সকালের চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতেই পাশে মমিণ এসে বসে।সদার চায়ের দামও দিয়ে দেয়, সকালেই একটা গরম চপ খাওয়ায়।সদা একটু হেসেই জিজ্ঞেস করে,'বারে, গেদে মাল কামাইছিস নাকিরে?'
মমিণ কোন উত্তর না দিয়ে গুন গুন করে গেয়ে ওঠে, সদা অবাক হয়।চোখমুখে একটা চাপা কৌতূহল জেগে ওঠে।মমিণের দিকে তাকিয়ে থাকে কোন প্রশ্ন করতে পারে না।তবুও মমিণকে খুব অচেনা মনে হয়, কোন এক অচেনা অজানা গ্রহ থেকে এসে এখানে সদার কথাবার্তা শুনতে এসেছে।মমিণ সদার দিকে তাকিয়ে বলে,'সিগারেট ফুঁকবি?'
-সিগারেট!হাসালি, পয়সা কুথায়?শালার কাজেও এক পয়সা নাই, কিভাবে যে হাঁড়ি চড়ছে সেট আমিই জানি।
-আমি দিব।
তারপরেই বেশ ডাঁটের মাথায় লতিফকে বলে,'দুটো সিগারেট দে তো, ভালো দেখে দিবি।'
চায়ের দোকানের বাকি সবাই মমিণের দিকে অবাক চোখে তাকায়, মমিণ সিগারেট ধরায়, সদাকে দেয়।সদা সিগারেটটা মুখে দেবার আগে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, তারপর মুখে নিয়ে ধোঁযা ছেড়ে মমিণের হাত ধরে দোকান থেকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে,'তুই কি লুটারি কিনেছিস?'
মমিণ ধোঁয়া ছেড়ে গুন গুন করে গান ধরে,'রূপ দেখি আপনার কৃষ্ন(কৃষ্ঞ) হয় চমত্কার/ আস্বাদিতে মনে উঠে কাম।'
-বেশি কাঁঠালি করিস না, বল কেনে কি করলি ?
মমিণের চোখ মুখে তৃপ্তির ছাপ।'তু আসছে বছরকে যাবি?সব বুঝবি মজা লাগবেক, থাকা, খাওয়া, হাগা সব ফিরি, চাল পাবি টাকাও পাবি আমি তো ইবার চার হাজার পেনছি, চালট বিচে আরো শ'তিন।
-কদিন ছিলি ?
-চার দিন।
-বাপরে, চারদিনে এত টাকা!তা আমি কি করব?
-মমিণ সিগারেটটা নিচে ফেলে শেষ ধোঁয়াটা ছেড়ে বলে ওঠে,'বুলব সব বুলব, তার আগে শহর যাব, টুম্পা মাগিটাকে একবার চটকে আসি।'
সদা মমিণের কথা শোনে আর বাড়িতে টুসির কথা মনে আসে, কবে থেকে একটা ভালো কাপড় খুঁজছে কিন্তু যা হাতের অবস্থা দিতে লাড়ছে।নিজের এক শতকও জমি নাই, মুনিষ খেটে রোজগার হয়, আর ঐ এদিক ওদিক।ছিলাটর লগেও কিছু কিনে নাই।মমিণের কথাতে লেশা লাগে। লিয়ে যাবেক বলিছে, তাও ভয় হয়, কথা কি রাখবেক ?
মমিণ অবশ্য কথা রেখিছে।শীত পড়তেই একদিন সকালেই সদার ঘরে এসে সব কথাবার্তা বলে, চা খেয়ে সদার বউ এর সাথে একটু রঙ্গ রসিকতা করে, ছোট ছেলেটাকে একটু চটকে তার হাতে একটা লেড়ো বিস্কুট দিয়ে ঘর ছাড়ে।যাবার সময় সদাকে সব কিছু বলে যায়।সদা সব মনে রাখে, তারপর মমিণের কথা মতই একটা ঝোলা নিয়ে বাসে চেপে যায়, মমিণও থাকে। বাস থেকে ট্রেন, ট্রেন থেকে নেমে আবার বাস।সব ভাড়া মমিণ দেয়, সদা কিছু টাকা ধার নিয়ে এসেছিল, কিন্তু মমিণ বলে, 'তুকে এখন দিতে হবেক নাই, পরে দিবি।'
সদা এদিকে আগে আসেনি, তবুও বাস থেকে নেমেই বুঝতে পারে।মমিণের দিকে তাকিয়ে বলে,'বাবা, তুই ইখানে এলি, ছুটু বেলাকে এসিছিলম।'
-ভালো, শুন, ইবার প্যান্ট জামা খুলি লে।
-মানে ল্যাংটো থাকব ?
-না'রে, আমার ঝোলায় কাপড় রইছে, দুজনাই পড়ব।
সদা একটা বাসের পিছনে গিয়ে তার পরনের জামা কাপড় খুলে ঝোলাতে থাকা একটা গেরুয়া লুঙ্গি আর হাতকাটা ফতুয়া পরে, মমিণ এসে মাথায় একটা পাগড়ি বেঁধে, কপালে একটা তিলক কেটে দিয়ে সামনে দাঁড়ানো একটা ছোট গাড়ির লুকিং গ্লাসের দিকে দেখিয়ে বলে,'যা দেখগা।' সদা নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না।মমিন বলে ওঠে,'লে ইবার চ।' কিছু দূর গিয়ে মমিণ রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে দু'দিকটা একবার ভালো করে দেখে বলে ওঠে,'লে ইখানে তুই, পাশটতে আমি, বসি যা, নইলে আর লাড়বি।'
-বসি কি করব ?
-কিছু না শুধু মুখে রাধা রাধা বলবি, তাতেই দেখবি সব হইযেছে।
সদা চারদিকটাতে আরেকবার তাকিয়ে নেয়।আরো অনেকেই রাস্তাতে আছে, কেউ একটা ঠাকুর বসাচ্ছে, কেউ তাঁবু বানাচ্ছে, কেউ একটা মাটির শিব বানিয়ে কালো রঙ করছে।মমিন সদার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,'লে লে বসি যা, কাল থেকে পোঁদ পাততে লাড়বি।'
সদা চোখে সামনে তার বাবা মা কে দেখে।দুজন, ছোট্ট সদাকে ধরে ধরে এই পৌষ সংক্রান্তির ভোরেই নদীতে স্নান করিয়ে রাস্তায় হাঁটবার সময় পাশে বসে থাকা হাজার হাজার মানুষকে চাল ছড়িয়ে দিয়ে যায়।অল্প চাল, কিন্তু লোক তো অনেক, তিনদিন ধরে স্নান, বেশ, মজার ব্যাপার।
-কি'রে বস, আমি একট পেলাস্টিক লিয়ে আসি।
-কি করতে হবেক?
-কি আবার রাধা রাধা বলবি আর যারা স্নান করে যাবে তাদের কাছে হাত পাতবি।
-ভিক্ষা!
-শালা আমি মুছলমান হয়ে রাধা গেয়ে দুনিয়া করছি আর তুই হিঁদুর বেটা হয়ে লাড়বি?শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই মমিণ বলে ওঠে,'ভিক্ষা মেগে খায় সদা হরিনাম জপে/হাসে কাঁদে নাচে গায় শিবের মণ্ডপে।'
-তুই এত সব কুথাকে শিখলি?
মমিণ হেসে ওঠে,'আমার ইট লিয়ে ছ'বছর হবেক।' সদা সব দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, তারপর ক্ষীণ শরীরের নদীর জলে স্নান করে নিজের ভিতরের সদাকে বিসর্জন দিয়ে মেলার সদাঠাকুর হিসাবে সেজে নেয়।
সে'বছরেই প্রথম মমিণ আর সদা দুজনা একসাথে প্লাস্টিকের একটা তাঁবুর নিচে দুটো ঠাকুরের ফটো নিয়ে বসে বসে গান আরম্ভ করে।সকালে সন্ধায় আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ স্নান করে দু'পাশে বসে থাকা মানুষদের চাল, টাকা, কেউ ফল দিয়ে যায়। তিনদিনের মেলায় শেষ দিন একজন এসে পুরানো পোশাক দিয়ে যায়।মমিণ আগে এসেছে, সদার প্রথমে বসতে একটু অসুবিধা হয়, কিন্তু কিন্তু লাগে, তারপর আর কোন কষ্ট নাই।কেউ তো আর ভিখারির মুখ দেখে না।তার ওপর সদা গেরুয়া লুঙ্গি ফতুয়ার সাথে মাথাতে একটা পাগড়িও বেঁধে নিয়েছে।মেলার তিন দিন সব ফ্রি, সকালে চা বিস্কুট, বেলাতে খিচুড়ি, দুপুরে কোন দিন ভাত, কোন দিন খিচুড়ি, রাতেও কোন অসুবিধা নাই, মমিণের চেনা আখড়া রইছে।রাতে দিব্যি বাউল গান শুনতে শুনতে ঘুম।হাগা মুতার কষ্ট নাই।সেই বছরই বাড়িতে বেশ কয়েক হাজার টাকা নিয়ে যায়।শেষদিন এক জন এসে সব খুচরো নিয়ে নোট দেয়, চালও কিনে নেয়, তাও ঘরে টাকা, চাল ফল কাপড় বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে।বউ খুশি হয়, জিজ্ঞেস করে, সদা কিছু বলে না, মমিণ বারণ করে দিয়েছে, শুনে কেউ বলতে পারে,'শেষ কালে মেলাতে গিয়ে ভিক্ষা!' মমিণকে কথাগুলো বলতেই রেগে যায়।এবছর সদা সব কিছু জেনে নিয়েছে।নদী পোশাক তাঁবু, মূর্তি আর মুখে রাধা রাধা।এবারেও নদীতে প্রচুর লোক, সবাই স্নান করে এবারেও টাকা দিয়েছে, চাল দিয়েছে।বিনা পয়সায় চা বিস্কুট খেয়েছে, খিচুড়ি খেয়েছে, ভাত খেয়েছে, আখড়াতে গান শুনেছে।শুধু মেলাতে ঢোকার পর থেকেই শুনে যাচ্ছে এবার ভিখারিদের থেকেও টাকা নেওয়া হবে।কয়েকজন নাকি দিয়েও এসেছে।সদার তারপাশে বসা একটা নাগার থেকে শোনে, ঐ লোকটাও লেবার খাটে।প্রতিবছর মেলাতে আসে, আর এমনি ভাবে বসে থাকে মমিণও তার মুখ থেকে সব কিছু শুনেছে, তবে গা করেনি।মেলার শেষ দিন সবকিছু গুটিয়ে বাড়ির ফেরার জন্য তৈরী হচ্ছিল, খুচরো পয়সা, চাল সব কিছু নেবার বা পরিবর্তন করবার লোক দেখা করে গেছে।নদীর দুটো দিকে সন্ধা নামছে।মেলার আলোর ব্যবস্থা বন্ধ হয়েছে, মমিণ একটা মোম জ্বালিয়ে তাঁবুর নিচে বসে বসে পয়সা গুনছে, সদা পাশে বসে।এমন সময় মেলা কমিটি থেকে দুজন এসে মমিণের তাঁবুর কাছে দাঁড়িয়ে বলে,'এই শালা মেলার টাকাটা কে দেবে?'
মমিণ শুনেও না শোনার ভান করে আগের মতই কাজ করে যায়।এবার একজন তাঁবুটা টান মেরে খুলে চিত্কার করে ওঠে, 'কি রে কথা কানে গেল না?'
-আমরা তো কুনু বছর দি নাই, ইবছর কেনে দিব?
-অতো কেনে বুঝি না, পাঁচকিলো চাল, আর তিনশ টাকা দিবি।
এবার সদা রেগে ওঠে,'কিছু দিব নাই, এক পয়সা না।'
'তবে রে... ' বলেই একজন এগিয়ে এসে সদার পাশে রাখা চালের পোঁটলাতে টান দেয়।পোঁটলার চাল মিশে যায় রাস্তার ধুলোয়।অন্ধকার আস্তে আস্তে আঁকড়ে ধরে আশপাশ।আকস্মিকতায় সদা কিছু বলতে না পেরে পুঁটুলিটা বুকে চেপে ধরতে গেলেও সেই দুই জন পুঁটুলি সরিয়ে নেয়।অন্ধকার রাস্তার বুকে খুচরো পয়সা আছড়ে পড়বার শব্দ শোনা যায়, সদা মমিণ দু'জনেই ধুলোর উপর শুয়ে বুকে পেটে পয়সা চেপে রাখে।অন্ধকার বড় করুণ, বড় অদ্ভুত, ধুলো চাল পয়সায় মাখামাখি হয়ে শুয়ে থাকে দুটো শরীর, তখনই মন্দিরের কাঁসর বেজে ওঠে, খোল কর্তালের ধ্বনিতে চারদিকে একটা অন্য রকেমর ভাব হয়।এদিকে মেলা শেষে সবাই নিজেদের মত ঘরমুখী।মাঝখানের রাস্তাটাও এখন অনেক ফাঁকা।এই ফাঁকা রাস্তাতেই সদা মমিণ দুজন ধুলো মেখে শুয়ে থাকে।কিছু সময় পরেই মমিণ ডাকে,'সদা, খুব লেগিছে?'
-না, রে সেরকম লয়, টাকাগুলান চলি গেল, চালটও ছিল, ধুলাতে লুটোপুটি খেচে।
-উঠ, ধুলা ঝাড়।
সদা আর ওঠে না।চারদিন ধরে বসে বসেও শরীরে একটা ক্লান্তি গ্রাস করেছে।সন্ধার একটু আগে মনট খুশি হইছিল খুব, বউ'এর লগে, ছিলাটর লগে মনটা আসার দিন থেকেই খারাপ, আর আনন্দ নাই।শুয়ে শুয়েই বলে,'আর আসব নাই বল?'
-কেনে?
-এইরম যদি সব টাকা কেড়ি লেয়, উদিকটও গেল ইদিকটও।
মমিণ উঠে এসে সদার পিঠে হাত রেখে বলে,'শুন, উঠ, কপালের ফের কি করবি বল, তবে আমার টাকাট লিতে পারে নাই।উঠ গুইনতে হবেক,উটোই না হয় ভাগ করি লিব।' তারপরেই সদা মমিণ দুজনেই অন্ধকার সন্ধের বুকে টাকা ভাগ করতে বসে, মন্দিরে আরতির বাজনা বাজে, ঘরমুখী নদীর স্রোতে যেন নতুন প্রাণ লেগেছে।
***********************************************************************
Sougata Chatterjee
B1-85/1, V.K.Nagar, M.A.M.C,
Durgapur-713210
Paschim Barddhman,
Phno-9002157241/9732381127