Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। বদরুদ্দোজা শেখু




মতিগতি 

 বদরুদ্দোজা শেখু


আজিজুর রহমান উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পোস্টিং লোক্যাল শহরে। রসায়নের শিক্ষক। রসায়ন বেশ খটোমটো বিষয়।মনে রাখা খুব মুশকিল। কিন্তু সেই বিষয়ে সে বেশ দক্ষ ও নাম-করা। তারপর আবার স্থানীয় ভালো স্কুলের শিক্ষক। কাজেই টিউশন পড়ানোর ক্ষেত্রে তার চাহিদা খুব।প্রতিদিন  ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনের     দু'টো  ক'রে ব্যাচ  পড়ায় সকাল বিকাল। সবাইকে পড়ায় না। তার টিউশনে ভর্ত্তি   হওয়ার জন্য  যারা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে এরকম যারা নাম লেখাতে আসে তাদের রীতিমতো নির্দিষ্ট দিনে দু ঘন্টার লিখিত পরীক্ষাও দিতে হয়। তাতে  যারা ভালো ব 'লে তার ধারণা হয়,  শুধু তাদেরকেই তার টিউশন ক্লাশে ভর্ত্তি নেয়। মেধা তালিকায় না এলে  অনেক ভালো ছেলেরাও  ওখানে চান্স পায় না। প্রত্যেক ব্যাচকে সপ্তাহে দু'দিন পড়ায়। তাই তার কাছে সপ্তাহে ওরকম  ছয় ব্যাচ পড়ে।নীচ তলার ঘরটি দুটো ঘরকে একটা ক'রে তৈরী করা হয়েছে। সব ছাত্রছাত্রী  মাদুরে বসে। কেবল স্যারের জন্য একটা চেয়ার আছে। আর ব্ল্যাক বোর্ড নয়, আছে একটা টেকনো  বোর্ড। সাদা রঙের।মার্কার পেন দিয়ে তাতে লিখে কাপড়ের ডাস্টার দিয়ে মুছে দেওয়া যায়। আধুনিক ব্যবস্থা। তার শিক্ষকতার মাইনে থেকে  টিউশনের আয় অনেক বেশী। কাঁচা টাকা যার কোনো হিসাব দিতে লাগে না। অবশ্য  তার একটা রীতি আছে। নিজের পাড়ার কোনো ছাত্রছাত্রী যদি তার টিউশনে চান্স পায় তো তার কাছে টিউশন ফী নেয় না।বিনা পয়সায় পড়ায়। মাসে টিউশন ফী ছ'শো টাকা। তবু শেষ অবধি  অনেকেই চান্স না পেয়ে ঘুরে যায়। জায়গা থাকে না। সপ্তাহের কোনো দিন কোনো কারণে পড়াতে না পারলে, সেই ব্যাচকে রবিবার পড়ায়।

আজিজ দু'বেলা টিউশন পড়ানো , স্কুল যাওয়া আসা এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাজার হাট মোটামুটি যায় না বললেই চলে।যা কেনাকাটা  তার  তরুণী বউ সেই সব খুব দক্ষতার সাথে সামলায়।কিছু ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে নেয় , কিছু বাজার থেকে নিয়ে আসে।আর পাড়ার সব খবর তার কাছে। স্থানীয় মেয়ে।এবেলা ওবেলা ইচ্ছামতো বাপের বাড়ি  থেকে ঘুরে আসে। কোনো অভিযোগ নাই।বছরে দু'বার গ্রীষ্মের ছুটি ও পূজোর ছুটিতে পরিবার সহ ঘুরতে যায়।পরিবার বলতে আজিজ মিঞা , তার বৌ ,আর দুই ছেলে  চৌদ্দ আর আট বছরের হবে।কখনো ট্রেনে কখনো প্লেনে দেশের ভিতরে তারা ঘুরে আসে।আন্দামান ,গোয়া, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু সিকিম শিলং এইসব তাদের ঘোরা হ'য়ে গেছে।স্কুলের সময়ে তার বৌ-ই ছোট ছেলেটাকে স্কুলে নিয়ে যায় ও নিয়ে আসে।

বেশ চলছিল রমরমিয়ে। হঠাৎ তাতে দাঁড়ি টেনে দ্যায় মার্চের শেষ থেকে সাম্প্রতিক লকডাউন। হঠাৎ তার টিউশন ক্লাশ বন্ধ,  স্কুল কলেজ বন্ধ , বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ, সমস্ত যানবাহন বন্ধ, হাটবাজার দোকানপাট
খেলার মাঠ চায়ের দোকানে আড্ডা সমস্তই বন্ধ ক'রে দেওয়া হয়েছে  সরকারী আদেশে অতিমারী  করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো রুখতে। এইবার আজিজ মিঞা সম্পূর্ণ কর্মহীন, যদিও তিনি মাস গেলে স্কুলের মাইনেটা ঠিকঠিক পেয়ে যাচ্ছেন।
তবে বাড়তি আয় টিউশন এক্কেবারে বন্ধ।
কাজেই আজিজ মিঞার হাতে করার মতো কোনো কাজ নাই।কতো আর  বাড়িতে বন্ধ হ'য়ে থাকা যায় ? তাই সে এখন নতুন একটা উপায় বের করেছে । যে লোক সপ্তাহে একটা দিনও বাজার যেতো না সে এখন রোজ বাজার যায়। তার বৌয়ের এখন বাজার যাওয়া একেবারেই দেখা যায় না। এমন-কি ফেরিওয়ালারাও হেঁকে ঘুরে যায়। ঘরে এখন বাজার থাক বা না থাক,
দৈনিক বাজার এই সময়ে যেখানে ক'রে দেওয়া হয়েছে,  মোটর সাইকেলে সেই চার্চের মাঠে তাঁর রোজ সকালে যাওয়া চায়।বাজার যাওয়া বা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার অজুহাতে  অনেকেই লকডাউন ভাঙছে, সেও ভাঙছে।  কোনোদিন আবার বাইরের পরিস্থিতি কী দেখে আসি ব'লে বেরিয়ে যায়। আবার রবিউল মিঞার বাড়িতে  নাকি তাসের আসর বসছে সামাজিক দূরত্ব রাখা ও লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে , সেখানেও কোনো কোনো দিন ঢুঁ মেরে  কিছু সময় কাটিয়ে আসে। তাদের একটা কাজের মাসী ছিল বরাবর, করোনার ভয়ে তাকেও ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে গত তিন মাস। আর তাদের ছেলে দুটোর অবস্থা আরো করুণ। তাদের ঘর থেকে  এমন-কি দু'চার মিনিট  নীচের গেটে আসাও বন্ধ হয়েছে। সারাদিন দোতলার বৈঠকঘরে বন্ধ থাকে। তাদের গলার আওয়াজ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। কেবল বিকাল বেলায়  দোতলার ছাদে কখনো ক্রিকেট বল/ ফুটবল মারামারি করে , কখনো বাপ-মার উপস্থিতিতে ঘুড়ি ওড়ায়। তাদের জান ওষ্ঠাগত।

কিছুদিন থেকে আজিজ মিঞা নতুন পদ্ধতি নিয়েছে ঘোরাঘুরি করার জন্য। বিশেষতঃ হাঁটাহাঁটির জন্য। রাত এগারোটার পর সে তার ছেলে দু'টোকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয় পাড়ার ভিতর, বিশেষভাবে গঙ্গার পাড়ের দিকের রাস্তায়।যখন রাস্তা একেবারে জনশূণ্য। শুধু সারমেয়কুল জটলা পাকায়।তারা কখনো ঘেউ ঘেউ করে বটে ,তবে চেনা মানুষ তাই উচ্চবাচ্য করে না । দিব্বি বেশ ক'দিন এই প্রায় মধ্যরাতে তার হাঁটাহাঁটি চলছিল। ছেলেদের ধমকি দ্যায়, হাঁটাহাঁটি ক'রে ইমিউনিটি বাড়াতে হবে যাতে করোনাহ'লেও এ মারণ ভাইরাস তাদের কাবু করতে না পারে। তার বৌ এতো রাতে ছেলেদেরকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার পক্ষপাতী নয়। কিন্তু সে নাছোড় ।অমন রাতে রাস্তায় কেউ থাকবে না , তাই তাদের থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকবে না আর দৈনিক হাঁটাহাঁটিও হবে। ছেলেরা ঘুম চোখে তার পিছু পিছু বাধ্য হ'য়ে ঘুরে আসে।   
 
একদিন হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো
দুটো পুলিশ তাকে ধরলো ।এতো রাতে সে  গলি রাস্তায় কী করছে ? তাকে আটকানো দেখে তার ছেলে দুটো পিছু ফিরে ছুট লাগানোর ঊর্দ্ধশ্বাসে বাড়ির দিকে। কিন্তু পুলিশ দুটো তাকে আটকে' সমানে জেরা করতে লাগলো।তিনি যে একজন শিক্ষক আর কাছেই তার বাড়ি ,এটা তারা মানতে রাজী নয়। তারা বলে, সে চুরির মতলবে এতো রাতে গলিরাস্তায় ঘোরাঘুরি করছে ।  তারা কিছুতেই  তাকে ছাড়বে না , থানায় নিয়ে যাবে। ধমক দিয়ে তার কোনো বক্তব্যই  তারা শুনছে না।

এইসব গোলমাল ও কথা কাটাকাটি শুনে
ঘটনাস্থলের সামনের বাড়ির দরজা খুলে হঠাৎ একজন বিধবা অথচ মাঝ বয়সী সুন্দরী মহিলা বের হ'য়ে এলো কী হয়েছে দেখার জন্য। সে তো দেখে তাজ্জব ! আজিজ ভাইকে পুলিশ ধ'রে নিয়ে যাচ্ছে !
কেন ?  কোন অপরাধে? সে নূরজাহান ভাবি, খুব সাহসী মহিলা ; একাই তার বাড়িতে থাকে। সে সামনে গিয়ে বললো, আরে , আজিজ ভাই , এতো দেরী হলো যে !  রাস্তা কি ভুল করেছিলে ? সটান পুলিশ 'দু'টোকে বললো, আরে , উনি তো নাম-করা শিক্ষক, একটু দূরেই বাড়ি, আমার দেওর হয় সম্পর্কে । আমার কাছেই আসছিলো।  কী আপদ , আপনারা ওনাকে ধ'রে  নিয়ে যাচ্ছেন মানে ? ছাড়ুন, ছাড়ুন , শীগগির ছাড়ুন  বলছি ।! চোর ছ্যাঁচোড় কি দেখে মনে হচ্ছে ?----  - তখন আজিজ মিঞা  ব'লে উঠলো, দ্যাখেন তো ভাবি, আমার কোনো কথাই শুনছে না, বলছে, চুরির মতলব নিয়ে ঘুরছি !
---- আরে না ,না।  লকডাউনে  দিনে আসতে পারেনি তাই হয়তো রাতে আমার খোঁজখবর নিতে আসছিল। আপনারা ওনাকে ছেড়ে দ্যান, অফিসার! অনর্থক ঝামেলায় জড়াবেন না, মানী মানুষ, প্লীজ ছেড়ে দ্যান !

পুলিশদের তার কথা বিশ্বাস হলো। এতো রাতে একজন তো তাকে চিনেছে, তার হ'য়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে  !  তারা তাকে ওয়ার্নিং দিয়ে এ রকম মাঝ রাতে  বের হ'তে মানা ক'রে চ'লে গেলো।

নূরজাহান তার এতো রাতে বেরোবার কারণ জেনে হেসেই খুন ! কী সর্বনাশ হ'তে যাচ্ছিল, ভেবেছো ?

আজিজ মিঞা আবেগের বশে তার পায়ে প'ড়ে গেলো, ভাবি, এসব কথা কাউকে বলবেন না, আপনার শুধু বদনাম শুনেছি , খুব অন্যায় করেছি , কোনো কিছু না জেনে সে সবে বিশ্বাস করেছি।
নূরজাহান ব'লে উঠলো, ওঠো দেওর ওঠো , এমন ক'রে আর বেরিও না ।আমি পাগল নাকি , এসব রটনা করবো ? শীগগির বাড়ি যাও, আর এ ভাবে এসো না । ইচ্ছা হ'লে দিনের বেলায় এসো, খুব ভালবাসবো ।

*            *            *

আজিজ ঊর্দ্ধশ্বাসে বাড়িতে এসে পৌঁছলো।
ছেলে দুটো তখন ওদের মাকে সব ব'লে ফেলেছে।ওদের মা তখন ফোন করতে যাচ্ছিল এমন সময় সে হাজির হলো। বললো, আর ফোন করতে হবে না ।আমি এসে গেছি। শালার পুলিশরা, আসল চোরদের ধরে না, আর আমাকে নিয়ে ফাজলামি ! আসলে কিছু টাকা কামাতে চেয়েছিল। নূরজহান  ভাবি বেরিয়ে এসে বাধা দেওয়ায় আর ঘাঁটাতে পারেনি !

ওঁর বৌ জাকিয়া তো থ' ।হলো তো ! মাঝ রাতে হাঁটার শখ মিটলো তো ! এক্কেবারে বাঁদর !  লকডাউনের সময় রাতে হাঁটাহাঁটি করবে ! ঘুরতে যাবে ! এবার পাড়ার সবাই শুনবে আর হাসাহাসি করবে ! খুব ভালো হবে !

সেই দিনের পর থেকে রোজ সকালে বাজারে বেরোলেও তারপর আর ঘর থেকে আজিজ মিঞা বের হয় না।ঘরদোর পরিষ্কার করে , দুপুরে ঘুমায়  আর বিকালে ছেলেদের সাথে ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়।  এখন মুশকিল তার বৌয়ের। সব সময় কিছু-না-কিছু টকঝক লেগেই থাকে। আর ঈদের দিন সেজেগুজে নামাজের পর ভাবির বাড়িতে  গিয়ে  আজিজ মিঞা এই প্রথম  তাকে সালাম দিয়ে এলো। ভাবি বললো , যাক, তোমার সুমতি হয়েছে তাহলে! কটাক্ষ ক'রে বললো, আজ অনেকেই সালাম দিতে আসছে , তাই তোমাকে তেমন ভালবাসা যাবে না দেওর !

*     *      *
আসলে মানুষ পশু পাখি কোনো প্রাণীই বন্দী জীবন কাটাতে চায় না।পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়। তাদের স্বাধীনতা চায় , ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা। যেখানে বাধা সেটাকে তারা ভাঙতে চায়। এই লকডাউনে  মানুষেরা অসহায়।
(১২৪৫ শব্দ)
©  বদরুদ্দোজা শেখু , বহরমপুর
--------------------------------------

লেখকের নাম-- বদরুদ্দোজা শেখু 
ঠিকানা-- 18 নিরুপমা দেবী রোড ,  বাইলেন 12 ,
        শহর+পোঃ-  বহরমপুর ,   জেলা--মুর্শিদাবাদ, 
        PIN -742101
         পঃ বঙ্গ , ভারত ।  
        হো• অ্যাপ  নং  9609882748
       e-mail :  mdbadaruddoza@gmail.com
----------------------

পরিচিতি

-------------------

বদরুদ্দোজা শেখু-র জন্ম ১৯৫৫ সালে ফেব্রুয়ারীতে মুর্শিদাবাদ জেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামে ।ক্ষুদ্রচাষী সাইফুদ্দীন সেখ ও গৃহবধূ ফজরেতুন্নেশা বিবির সন্তান। দারিদ্র্যের মধ্যেই গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ।পেশায় অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। নেশায় কবিতা লেখালেখি। শোভা গোস্বামীকে বিবাহ করেছেন।

    এযাবৎ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ  অলৌকিক আত্মঘাত, দুঃস্বপ্নের নগরে নিভৃত নগ্ন,শব্দ ভেঙে সংলাপ,আরো থোড়া দূর,এবং পরী ও পেয়ালা ।তাঁর কবিতা অদলবদল , সপ্তাহ, দৌড় , কবিতীর্থ ,শব্দনগর, ঋতুযান ,একুশে বর্ণমালা প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ।  বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী থেকে একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন।- - - 

তিনি কিছু কিছু অণুগল্প ও ছোট গল্পও লিখেন

--'''------------------------------------------------

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.