সেখ মেহেবুব রহমান
সান্ধ্য আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। অনেক দিন পর এরকম এক মুহূর্ত কাটাচ্ছি। এমনিতেই কর্ম ব্যস্ত জীবনে দম নেওয়ার ফুরসত নেই। কাজের বোঝা মাথায় নিয়ে নিত্য দিন কাটে। আনন্দ ফুর্তির প্রয়োজন অনুভব করেও নীরস দিনযাপন এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাই হঠাৎ পাওয়া এই সাময়িক বিরতি ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ বর্ষিত হচ্ছে। তবে এর জন্য রুপলেখার প্রশংসা প্রাপ্য। ওর বিয়ের অনুষ্ঠানে হাজির থাকতেই এখানে আসা। তারপর এই সুন্দর সন্ধ্যা।
বেশ কিছু দিন ধরেই এক ঘেঁয়ে জীবন থেকে পরিত্রাণের রাস্তা খুঁজছিলাম। হঠাৎই রুপলেখার ফোন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠি। তখনই স্থির করি যেভাবেই হোক উপস্থিত থাকবোই। কথা দিয়ে রেখেছি দেখে সেও বেজায় খুশি। আমি দিল্লিতে থাকায় ফোনেই নিমন্ত্রণ করে। গত সপ্তাহে বাড়ি এসেছি। কিছু দিন রেস্ট নিয়ে এখানে হাজির।
সকাল থেকেই বেশ হইহই করে কাটছে। পুরোনো কয়েকজন বন্ধুদের সাথে দেখা হওয়াতে খুশির মাত্রা দ্বিগুণ হয়েছে। রুপলেখার সাথে সেই কলেজে আলাপ। পাঁচ ছয় জনের এক মজার গ্রুপ ছিল আমাদের। প্রত্যেকের মধ্যে বিশ্বাস যতটাই গভীর, বন্ধন ততটাই মজবুত। কলেজ শেষে প্রত্যেকের রাস্তা আলাদ হলেও কয়েকজন বাদে সকলের সাথেই যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন ছিল। এখনও আছে, অবশ্য আগের তুলনায় কম। আসলে প্রত্যেকেই ব্যস্ততা গ্রাস করছে। পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ককে উজ্জীবিত করার এক সুবর্ণ সুযোগ বুঝে সকলেই নিত্য ব্যস্ততা ছুঁড়ে ফেলে হাজির হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এখানে এসে পুরোনো বন্ধুদের পাশাপাশি নতুন তিন বন্ধুর সখ্যতাও পেয়েছি। এখন তাদের সাথেই গল্পে মজে। রুপলেখা আমাদের কমন ফ্রেন্ড হলেও আমরা চারজন একে অন্যের সাথে প্রথমবার আলাপ করছি। এটা একটু অদ্ভূত হলেও, বাস্তব।
আমরা ঠিক ডান পাশে বসে কৃষ্ণেন্দু শেঠ। আমার সমবয়সী। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, আসানসোলে থাকেন। রূপলেখার বাল্যকালের বন্ধু। ক্লাস টেন অবধি একসাথে পড়াশোনা করেছে। পরে রূপলেখা মামার বাড়ি চলে আসে। তখন স্মার্ট ফোনের এত রমরমা ছিল না, বাধ্য হয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধুত্বে সাময়িক ইতি আসে। পরে যদিও ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপের সৌজন্যে আবার পুরোনো সম্পর্ক নতুন করে গড়ে ওঠে। কৃষ্ণেন্দুর পাশে বসে সপ্তর্ষি দেব, রূপলেখার অফিসের সহকর্মী। আমাদের চারজনের থেকে বয়সে সবচেয়ে বড়ো। সল্টলেকে থাকেন। বেশ রসিক মানুষ। এই আড্ডার শেষ ও চতুর্থ অংশগ্রহনকারী সাগ্নিক পাল আমার বাম পাশে বসে। কলেজ শেষে রূপলেখা আই আই এস এম ধানবাদে মাস্টার্স করতে গেলে ওখানে আলাপ হয় দুজনের। রূপলেখার থেকে বয়সে বড়ো। ঝাড়খন্ড পড়াশোনা করতে গিয়ে এখন ওখানেই চাকরি জীবনের সাথে সাংসারিক জীবনও সূচনা করেছেন। এক সপ্তাহের ছুটিতে কলকাতা এসেছেন নিজের বাড়িতে। সেখান থেকে সপরিবারে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত।
চায়ের কাপে চুমুকের সাথে রাজনৈতিক যুক্তি তক্কো বাঙালির সহজাত বৈশিষ্ট্য, আমারই বা তার ব্যাতিক্রম হই কেন? আসরের শুরুর দিকে আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ছিল 'রাজনীতি'। সপ্তর্ষিদা ছাত্র জীবনে দাপিয়ে রাজনীতি করেছেন। এখন অবশ্য করেন না। কাজের প্রেসারকেই মূলত এর জন্যে দায়ী করেছেন। তবে মজার ব্যাপার হল, ' কমরেডস ' শব্দটি শুনলে ওনার বুকের ভিতর আজও বিদ্যুৎ খেলে যায়। কৃষ্ণেন্দু কংগ্রেসী ঘরণায় বড়ো হয়েছে। যদিও রাজনীতির প্রতি ছোটো থেকেই কোনো আগ্রহ নেই। তাই আড্ডার প্রথম দিকে ওর অংশগ্রহন শুধুমাত্র শ্রোতা হিসাবেই ছিল। সাগ্নিকদার কাছে রাজনীতি এক সার্কাস। উনি এসব নিয়ে বেশ মজা করেন। রাজনৈতিক ব্যাঙ্গ চিত্র তৈরিতে বেশ পারদর্শী।
মিনিট তিরিশের রাজনৈতিক কথাবার্তার পর আমরা গান বাজনা, একালের শিক্ষা ব্যবস্থা, চাকরীর করুণ দশা নিয়েও আলোচনা করেছি। এ সকল সিরিয়াস আলোচনার শেষে এখন যে প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে তা যে উত্থাপিত হবেই সেকথা সহজেই অনুমেয়- প্রেম। বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রেম প্রসঙ্গ আসবে না, সেটা হতেই পারে না। তবে আমাদের আলোচনা পরিণত প্রেমকাহিনী নিয়ে নয়। ব্যর্থ প্রেমের ওপর দাঁড়িয়ে অব্যক্ত প্রেমই আমাদের আলোচ্য বিষয়। এমন এক প্রেম কাহিনী যেখানে প্রেমের চিঠি আজও খাম বন্দী অবস্থায় মনের ডাক বাক্সেই রয়ে গেছে, প্রেরিত হয়নি কাঙ্খিত ঠিকানায়।
দেশ দশের আলোচনার ফাঁকে হঠাৎই কথা প্রসঙ্গে "অব্যক্ত প্রেম" শব্দটি কৃষ্ণেন্দু উচ্চারণ করতেই, সাগ্নিকদা ওকে চেপে ধরলেন। সাগ্নিকদা, সপ্তর্ষিদার বয়স ত্রিশ পেরোলেও মনের মধ্যে যে এখনও প্রেমের স্ফুলিঙ্গের বিচ্ছুরণ হয় সেকথা তাদের উৎসাহী আচরণেই স্পষ্ট। বেচারা কৃষ্ণেন্দু! মুখ ফস্কে বেড়িয়ে আসা "অব্যক্ত প্রেম" শব্দটি যে ওকে বিড়ম্বনায় ফেলে দেবে কল্পনাও করতে পারেনি। ও নিজের এরূপ কোন কাহিনী প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়। সাগ্নিকদারাও সহজে ছাড়ার পাত্র নন। অতএব, শেষ অবধি দাদাদের চাপে মনের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জাগিয়ে তুলতে বাধ্য হল। অনেক জোড়াজুড়ির পর কৃষ্ণেন্দু কিছু বলতে যাবে, সাগ্নিকদা হেসে বললেন, 'ঢপ দেবে না, বিয়ে করোনি, সত্যিটা বলো। এখনও চেষ্ঠা করতে পারি'।
কৃষ্ণেন্দু হেসে বলল, 'তার আর প্রয়োজন নেই। সে বিবাহিত'।
সপ্তর্ষিদা মজা করে বললেন, 'দেখো ভায়া, লোকের বউ নিয়ে পালালে দু'চার দিন একটু কুকথা শুনতে হবে, পরে কিন্তু হ্যাপি এন্ডিং হতে বাধ্য'।
কৃষ্ণেন্দু মুহূর্তে সে কথা খন্ডন করে বলল, 'ধুস। কি যে বলো না! তার থেকে অবিবাহিত থাকা অনেক ভালো। আমার মানসিকতা মোটেও সেরকম না'।
আমি দুজনকে থামিয়ে বললাম, 'বেশ বেশ। মূল বিষয় থেকে সরে গেলে চলবে না'।
এই বয়সে প্রেম নিয়ে কথা বলতে লজ্জিত হওয়া স্বাভাবিক। যৌবনের স্পর্ধা কিংবা মনের মাঝে প্রেমের সেই সমধুর রসায়ন এখন অতীত। কর্মজীবনে প্রেম, বসন্তের কোকিলকেও হার মানায়। কৃষেন্দুও তার ব্যতিক্রম নয়। ইতস্তত হয়েই বলল, 'প্রেম টেম কিছু না। জাস্ট ভালো লাগার ব্যাপার ছিল। ছোটো থেকে একসাথে বড়ো হয়েছি। আনন্দ হুল্লোড়ে সেই দিনগুলো কাটাতে গিয়ে অজান্তেই তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করি'।
সাগ্নিকদা থামিয়ে মজা করে বললেন, 'আকর্ষণ! কিরকম অ্যাট্রাকশন ছিল বন্ধু'।
কৃষ্ণেন্দু একটু আগ্রাসী হয়েই বলল, 'ধুর আমি কিছু বলব না। ভাল লাগে না। আমি কিন্তু নিজের মনের কথা বলছি, একটাও বানানো নয়। মনের সেই অনুভূতি কি বলে ব্যাখ্যা দেওয়া যায়!'।
আমি বললাম, 'সাগ্নিকদা মাঝে থামিও না। ওকে বলতে দাও। কৃষ্ণেন্দু তুমি কন্টিনিউ কর'।
অব্যাক্ত ভালোবাসা যেন খাঁচা বন্দী পাখি। বাইরে তার সঙ্গীদের মুক্ত বাতাসে স্বাধীন বিচরণ করতে দেখেও, নিজের ভবিতব্য মেনে নিয়ে অসহায় চিত্তে সেই লোহার বেড়া জালে আবদ্ধ থাকতে হয়। এভাবেই সে উড়ানের ক্ষমতা হারায়, ঠিক যেমন প্রেমিক হারায় প্রেমের ভাষা। কৃষ্ণেন্দুর আবেগী মন সেই পক্ষীকূলের অংশ। আজ আমরা হঠাৎই কৃষ্ণেন্দুর মনের বদ্ধ খাঁচা খুলে দিয়ে তাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছি। উড়ানে তার প্রাথমিক ব্যর্থতা আছে। এটাই স্বাভাবিক। তবুও সে খোলা বাতাসে উড়তে চায়, বলতে চায় সেই ভালোবাসার কথা। হয়তো সেইজন্যেই এতো টিটকিরি সত্ত্বেও আড্ডা ছেড়ে উঠে যায়নি, অপ্রকাশিত প্রেমকে আমাদের কাছে উপস্থাপিত করে হারানো প্রেমের ভাষা খুঁজছে।
কৃষ্ণেন্দু সাগ্নিকদার দিকে তাকিয়ে ব্যথিত মনে বলল, 'সরি দাদ কিছু মনে করো না। এই ব্যাপারে আমি বেশি আবেগপ্রবণ। নিজের মনের এই দিকটা আগে কখনো প্রকাশ্যে আনিনি। কীভাবে প্রেমের কথা বলতে হয় জানিও না। আর দেখো, সেইজন্যই হয়তো প্রেম অধরাই রয়ে গেছে। ছোটো থেকে বড়ো হাওয়ার পথে এমন বিশেষ কেউ থাকে যাকে সব সময় পেতে চাই। আর যাকে যত কাছে চাই সে ততই দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়'।
আমি বললাম, 'আরে না না, এতে ভাবার কি আছে। তোমায় মজা করে বলছি বটে, কিন্তু তুমি যা বললে সেগুলো সবই বাস্তব। অস্বীকার করার জায়গা নেই'।
ও বলল, 'ঠিকই। একথা গুলো মন প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু কার কাছে করবে? তোমরা জোর না করলে কখনো প্রকাশ করার চেষ্টাও করতাম না'।
কৃষ্ণেন্দুর চোখেমুখে ব্যথার ছাপ স্পষ্ট। বললাম, 'তোমায় পুরোনো কিছু মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দিলাম কৃষ্ণেন্দু। তুমি এই ব্যাপারে এত সফট জানতাম না'।
সাগ্নিকদা বললেন, 'কৃষ্ণেদু তোমার কথা শুনে আমার নিজেরও কিছু না বলা কথা মনে ভেসে আসছে। তোমার মতো আমিও চেপেই রেখেছি'।
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'এরকম অধ্যায় সবারই থাকে। আগে কৃষ্ণেন্দু বলুক তারপর তোমাকেও বলতে হবে কিন্তু সাগ্নিক'।
সাগ্নিকদা হেসে বললেন, 'আমি রাজি। আসলে একথা গুলো আজ গুরুত্বহীন হলেও একবার বহিঃপ্রকাশ করলে মন বড্ড হালকা হয়। বিবাহিত জীবনে একথা প্রকাশের সুযোগ আর কখনো আসবে বলে মনে হয় না। ঈশ্বর হয়তো সেইজন্যই এই বিশেষ মুহূর্ত বরাদ্দ করে রেখেছিলেন'।
আমি বললাম, 'প্রসঙ্গটা উত্থাপিত হয়ে ভালোই হল। কিছুটা হলেও প্রতেকের কষ্ট কমবে'।
সাগ্নিকদা কিছুক্ষণ আগে অবধি কৃষ্ণেন্দু কে নিয়ে মজা করলেও এখন বেশ আবেগ বিহ্বল হয়ে বললেন, 'এটা কিন্তু বিশেষ প্রাপ্তি হতে চলেছে। মনে থাকবে আজীবন'।
সপ্তর্ষিদা কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে ওকে বলতে বললেন। কৃষ্ণেন্দু আবার পুনরায় বলতে শুরু করলো। তবে এখন শুরুর জড়তা অনুভব হল না। পরিতৃপ্তি হৃদয়ে বলল, 'ঠিকই বলেছেন সাগ্নিকদা। এখন নতুন করে হারানোর তো কিছু নেই। তাই এখন কোনো সংকোচ হচ্ছে না। প্রথম প্রথম শুধু মনে হতো আমি ওকে হারিয়ে ফেললাম। কেন ওকে একবারের জন্য বললাম না। এরকম কত যে ভাবনা আসত। কষ্ট পেতাম খুবই। যদি চোখের সামনে থাকত তাও কষ্টের কিছুটা প্রশমন হত। সে সুযোগও দেয়নি। প্রথমে ভৌগলিক দূরত্ব পরে বন্ধুত্বের দূরত্বও বাড়িয়ে নিয়েছিল। এতে যদিও ওর দোষ ছিল না। ভবিষ্যতের স্বার্থে ওকে দূরে যেতেই হত। একটা চোদ্দো পনেরো বছরের ছেলের কাছে তখন এটা বিশ্বাসঘাতকতার সমান। মনের মধ্যে সেই রাগ অনেকদিন পুষে রেখেছিলাম'।
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'কি নাম তার?'
'না দাদা, নাম বলব না। ওটা অপ্রকাশ্যই থাকুক'
'কেনো? আমরা বাদে কেউ জানবে না। প্রমিশ...'
'ওটা বলতে মন চাইছে না। ওটা একান্ত আপনই থাক'
'বেশ, সে নাম তাহলে অজানায় থাক। কিন্তু তার সাথে কাটানো কিছু স্মৃতি না হয় শেয়ার করো'
কৃষ্ণেন্দু হাসিমুখে বেশ উত্তেজিত হয়েই বলল, 'একটা মজার কথা বলতে পারি'।
সাগ্নিকদা উৎসাহী হয়ে বললেন, 'কি কথা? জলদি বল'।
কৃষ্ণেন্দু হেসে বলল, 'ছোটবেলায় ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। ও খুব ঝগড়ুটে ছিল। তখন আমি খুব মোটা ছিলাম। ও সব সময় আমায় "গোপাল" বলে রাগানোর চেষ্ঠা করত। আমিও রেগে গিয়ে মাঝে মাঝে দু'চার কথা শুনিয়ে দিতাম। আর সেই নিয়েই ঝগড়া শুরু। সব দোষ শেষে আমার ওপরই গিয়ে পড়ত। একটা মারও মাটিতে পড়ত না। ভাবুন কিরকম বদবুদ্ধি ছিল ওর'।
সপ্তর্ষিদা হাসতে হাসতে বললেন, 'ভাই কৃষ্ণেন্দু, তোমার মত নিরীহ ছেলের এমনটা হওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়। তুমি যদি তাকে একবার বলতে। অন্যরকম হত'।
কৃষ্ণেন্দু বলল, 'তার জন্য আপসোস হয়। তবে আমার মনে হয়, সেই বয়সে আমার প্রতি ওর কোনো অনুভূতি জাগে নি। হয়তো শুধু বন্ধুই ভেবেছিল আমায়'।
কৃষ্ণেন্দু অন্তরের বুক ফাটা কষ্টের সন্ধান নিজেও উপলব্ধি করতে পারছে। যদিও জোরপূর্বক সেই আবেগ সুপ্ত রেখে বলল, 'শুধু কি আমিই বলব! এবার সাগ্নিকদা। কথা দিয়েছ কিন্তু...'।
আমি হেসে বললাম, 'হ্যাঁ, সাগ্নিকদা শুরু কর। তারপর সপ্তর্ষিদা'।
ইচ্ছা করেই সপ্তর্ষিদার নাম বললাম। যদিও তিনি এই ঘোষণার ব্যাপারে প্রস্তুত ছিলেন না। তাকেও বলতে হবে শুনে, একটু দাদা দাদা ভাব নিয়ে বললেন, 'আমি তোমাদের থেকে বেশ বড়ো। ছোটদের সামনে বড়ো দাদার প্রেমের গল্প ভালো দেখায় না। অতএব তোমরা বলবে, আমি শুনব জাস্ট'।
সাগ্নিকদা সেই দাবী নাকচ করে জানালেন, 'আমি তো বলবই, তার আগে সপ্তর্ষিদা বলবেন। ওনার মধ্যে প্রেম আছে, না হলে কি আর এইভাবে রিয়েক্ট করেন'।
'না সাগ্নিক তুমি বলো। আমি শুধু শ্রোতা'
'সেটা হয় না সপ্তর্ষিদা, আপনি কিন্তু আমাদের হতাশ করতে পারেন না'
সাগ্নিকদার সাথে আমারও জোর দিতে সপ্তর্ষিদা শেষে রাজি হলেন। সত্যি বলতে খাঁচায় যে তার হৃদয়ও বন্দী। উম্মুক্ত হওয়ার এই আদর্শ সময় তিনিও নষ্ট করতে চাইছেন না। অর্থাৎ প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে তিনি দুটো বিশেষ শব্দমালা ব্যবহার করলেন - "অবৈধ প্রেম"। এরকম কোনো শব্দ নিবন্ধের প্রত্যাশা করিনি। উত্তেজিত হয়ে বললাম, 'বলছেন কি! "অবৈধ প্রেম" আপনার জীবনে। বিশ্বাসই হয় না'।
আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'এইজন্যই প্রকাশ করতে চাইনি। আমি জানতাম তোমরা এইভাবে রিয়েক্ট করবে'।
বললাম, 'আপনাকে দেখে সেরকম মনে হয় না। বৌদি জানে?'
চমকে উঠে বললেন, 'বউ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে। ও এসব জানে না কিন্তু।
কৃষ্ণেদু বলল, 'এত ভয় পাবেন না তো। বৌদিকে কিছুই জানাব না, প্রমিস'।
সপ্তর্ষিদা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, 'ধন্যবাদ ভাই। সত্যি কি বলত, বিবাহিত জীবনে এসব শোভা পায় না ঠিকই তবে মাঝে মধ্যে হয়ে যায়। সব কিছু তো আমাদের হাতে নেই'।
কৃষ্ণেন্দু বলল, 'বিয়ের পর প্রেম। বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু। কোথায় থাকেন উনি, কিভাবে আলাপ?'
সপ্তর্ষিদা মাথা নেড়ে বললেন, 'না কৃষ্ণেন্দু, তুমিও কিন্তু তোমার অব্যক্ত কাহিনীর পরিচয় দাও নি। আগে তুমি, তারপর আমি বলছি'।
সাগ্নিকদা হেসে বললেন, 'লজিক আছে কথায়। তবে এরকম ওপর ওপর বললে বৌদির কানে কথা পৌঁছতে সেকেন্ডও লাগবে না'।
'ব্ল্যাকমেইল করছ?'
'মোটেই না। আপনার প্রেমের গভীরতা মাপতে চাইছি'
'লাভ নেই বন্ধু'
'কেন? আপনি তো তাকে ভালবাসেন!'
সপ্তর্ষিদা একটু সিরিয়াস হয়ে বললেন, 'ভালোবাসি জোর গলায় বলতে পারব না। এটা ভালো লাগা বলাই বেটার। ওই হয় না, কারও সাথে দীর্ঘ সময় কাটালে, ভাবনা চিন্তা শেয়ার করলে একটা টান অনুভব হয়, আমারও সেরকম। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই বুঝি প্রেমে পড়েছি। কিন্তু, তার কি আমার প্রতি একই ফিলিংস আছে? কখনো তো দেখে সেকথা মনে হয়নি। পরমুহূর্তেই উপলব্ধ হয়, এ তো একতরফা! তাহলে এসবের মনে কি? সত্যি বলতে, নিজের কাছে কিছু বিশেষ মুহূর্তেই এটা প্রেম বা অবৈধ প্রেম বলে মনে হয়, আদারওয়াইজ উয় আর জাস্ট ফ্রেন্ড'।
সাগ্নিকদা বললেন, 'তাকে বিশেষ কিছু ইন্ডিকেশন দিতে পারতেন। সে নিশ্চয় ধরে নিত'।
'সেটা খারাপ হত সাগ্নিক'
'কেন? মনের কথার ইঙ্গিত দেওয়া কি খারাপ?'
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'আমি বিবাহিত ও জানে। আমার স্ত্রীর সাথে ওর দুবার দেখাও হয়েছে। এরপর কিছু বলা মানে নিজেকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করা। সেসব চাই না'।
কৃষ্ণেন্দু বলল, 'সেই দিক থেকে ভাবলে ঠিকই করেছেন'।
আমি বললাম, 'সে সব না হয় বুঝলাম। কিন্তু তার প্রতি আকৃষ্ট হলেন কিভাবে? একজন বিবাহিত পুরুষকে কোন মন্ত্র বলে কাবু করল?'
উনি বললেন, 'কি যে বল! এসব এমনিই হয়ে যায়। আগে ভাগে কিছু বোঝা যায় না'।
'আচ্ছা'
'হ্যাঁ ভাই, আগে বিয়ে কর। তারপর দেখবে'
সকলে হাসতে শুরু করলেন। আমি বললাম, 'বেশ বেশ, তাহলে কাছে আসার পর কাটানো কিছু মুহূর্তের কথা বলুন। নাকি সেগুলোও অজান্তেই...'।
মৃদু হেসে বললেন,'বিশেষ মুহূর্ত তুহূর্ত বলে কিছু নেই। তবে হ্যাঁ ও খুব ঘুরতে ভালোবাসে। কাশ্মীর ওর ফেভারিট প্লেস। একবার হানিমুন প্ল্যানিং নিয়ে কাশ্মীরে বেড়াতে যাবার কথা ওঠে। সেদিনই প্রথম ওর সাথে দু'ঘণ্টারও বেশি সময় কথা বলেছিলাম। তখন তোমাদের বৌদির সাথে বনিবনা চলছিল না। মানসিক চাপে ছিলাম বড্ড। ওর সাথে কথা বলে কিছুটা হাল্কা হয়েছিলাম। ওইদিন যে মানসিক রিলিফ পেয়েছিলাম আজীবন মনে থাকবে। মাঝে মাঝে ভাবি সম্পর্কটা সত্যি কেন হয় না? উত্তর যদিও তৎক্ষণাৎ পাই। সেটা মাথায় নিয়েই এগিয়ে চলেছি'।
প্রেমের অনুভূতি বড়োই বিচিত্র। ব্যক্তি পাল্টায়, প্রেমের পরিস্থিতিও পরিবর্তিত হয় কিন্তু প্রেমানুভূতি আবহমান কাল ধরে অপরিবর্তনশীল। কথা বলতে বলতে সপ্তর্ষিদা উদাস হয়ে পড়লেন। সাগ্নিকদা পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমাদেরও অফার করলেন। আমি বিশেষ নেশা করি না। কৃষ্ণেন্দু এ সবে অভ্যস্ত। সানন্দে অফার গ্রহন করল। পরোক্ষ ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশি ক্ষতিকর জেনেও একটা কথাও খরচ করলাম না। সপ্তর্ষিদা নাক মুখ থেকে বিষাক্ত ধোঁয়া বের করে বললেন, 'মনের মধ্যে হঠাৎ করে ঝড় শুরু হয়ে গেছিল। দু'টানে কিছুটা শান্ত'।
কৃষ্ণেন্দু বলল, 'এগুলোই বাঁচার ভরসা। এই কাজের প্রেসারে এরা না থাকলে এতদিনে আমরা ঈশ্বরের দরবারে হাজির হতাম। শরীরের ক্ষতি করেও আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে!'
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'সত্যিই ভাই, গভীর উদ্বেগ উৎকন্ঠায় থাকলে তখন খায়। এমনিতে খুব বেশি স্মোকিং করি না'।
'আমিও তাই'
'মদের নেশা আছে নাকি?'
'ওটাও চলে, তবে খুবই কম'
আমি দুজনকে থামিয়ে বললাম, 'মদের ব্যাবস্থা রাতে হবে। কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরুন সপ্তর্ষিদা। সাগ্নিকদা অনেক্ষণ ধরেই নিজের কথা বলতে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে দেখছি '।
কৃষ্ণেন্দু আমায় উদ্দেশ্য করে বলল, 'একদম, তবে তুমিও বাকি। কি ভাবছে? না বলে বেড়িয়ে যাবে, সেসব হবে না'।
আমি বললাম, 'হবে হবে। আমি কনক্লিউশন দেব। এবার সাগ্নিকদা বলুন'।
কৃষ্ণেন্দ সাগ্নিকদাকে উত্তেজিত করতে বলল, 'আপনারও কি অবৈধ...'।
সাগ্নিক দা এতক্ষণ নিশ্চুপ ছিলেন। মনে হল, নিজের মনের কথাগুলো গুছিয়ে প্রকাশ করতে একান্তে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অদূরে ছুঁড়ে ফেলে বললেন, 'এই সিগারেটই আমাকে তার প্রতি দূর্বল করেছিল। আই আই এস এম ধানবাদে থাকাকালীন খুব নেশা করেছি। বিড়ি, গাঁজা সবই চলত। বয়সের হাওয়া বলতে পারো। বাড়ির শাসন ছিল না। বেহিসাবী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সে প্রথম আমায় সতর্ক করে। খুব বুঝিয়েছিল তখন। কেন এত ভাবতো জানি না। কিন্তু আমার একাকী জীবনে যত্ন নিত'।
কৃষ্ণেন্দু মৃদু হাসি নিয়ে বলল, 'হয়তো সে আপনাকে ভালোবাসত। আপনার কষ্টে ব্যথা পেয়েই যত্ন নিত। এত খেয়াল রাখার কারণ জানতে চাননি কখনো?'
সহাস্যে সাগ্নিকদা বললেন, 'সুযোগ হয়নি। তবে একবার বন্ধুদের চাপে পড়ে স্থির করি ওকে মনের কথা বলব। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তার আগেই জানতে পারি ও আগে একটা রিলেশনে ছিল। সেটা কোনো ভাবেই হোক ভেঙে যায়। তখন অন্য কোনো সম্পর্কে আর জড়াতে চায়নি। সেসব শুনেও আমিও নিজের মনের কথা বলার সাহস পায়নি। যদি খারাপ ভেবে বসে। বন্ধুত্বটা দুজনের কাছেই তখন সব থেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট ছিল'।
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'এখন দেখা সাক্ষাৎ হয়?'
'হুমম। তবে মাঝে মধ্যে। ও কলকাতায় আর আমি তো...'
'দেখবে পুরোনো কথাগুলো তখন বেশি মনে ভেসে আসে'
'সে তো আসেই। ভোলার চেষ্ঠা করি'
সাগ্নিকদা কথা বলতে বলতেই আরও একটা সিগারেট ধরালেন। দু'তিন টান দিয়ে বললেন, 'দেখা হলে কি বলে জানো, পুরনো নেশায় আবার ডুবেছি কিনা জানতে চায়। সতর্কও করে। মনে আছে সবই। আমিও ভুলতে পারিনি'।
কৃষ্ণেন্দু বলল, 'তাকে কথা দিয়ে এত সিগারেট খাচ্ছেন কেন? শরীরের জন্য তো ক্ষতিকর। সে যদি এখন জানতে পারে?'
সাগ্নিকদা কোনো উত্তর দিলেন না। শুধু এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি বললাম, 'কি হল? ওতো ঠিকই বলছে'।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন, 'আগে ওর বারণে অভ্যাস পাল্টেছিলাম। এখন ওর ভাবনাতে ডুবে গেলে খাই! এখন ওর আপত্তি কানে বাজলেও মনে বাজে না'।
সপ্তর্ষিদা পিঠ চাপড়ে বললেন, 'তোমাকে আর কি সান্ত্বনা দিই বলো'।
সামান্য হাসি নিয়ে বললেন, 'সত্যি বলতে "প্রেম পড়ায় বারণ"। গানটার মর্মার্থ বেশ বুঝি'।
আমি বললাম, 'বৌদি জানে?'
সাগ্নিকদা বললেন, 'হুমম, ওকে বিয়ের আগেই জানিয়েছিলাম। তখন আমাকে বেশ বুঝিয়েছিল। সত্যি বলতে ওর জন্যই অতীতের সম্পর্ককে সহজে ভুলে থাকতে পারি'।
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'ঠিকই বলেছ সাগ্নিক। ওদের জন্যই আমাদের লাইফ এতো অর্গানাইজড'।
সাগ্নিকদা মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। বিয়ে না করলেও আমি, কৃষ্ণেন্দু কথার গুরুত্ব বেশ বুঝতে পারলাম। এভাবেই আরও দু'চার কথা হল। কিন্তু তারপর হঠাৎই সাগ্নিকদার ফোন বেজে উঠতে আবেগঘন আড্ডায় ছেদ এল। ফোনের স্ক্রিনে ফুটফুটে এক বাচ্চার মিষ্টি মুখ ভেসে উঠতে দেখে বললাম, 'মেয়ে বুঝি?'
ফোন হাতে নিয়ে রিসিভ করার আগে বললেন, 'হুমম, আমার মেয়ে- মৌনী'।
আহ্লাদের ভঙ্গিমা নিয়ে বললাম, 'বাহ্, বেশ মিষ্ট'।
'একদম ওর মায়ের মতো। ওরা এসেছে, দেখা হয়নি?'
'এমনি দু'একবার দেখলাম। কিন্তু সেভাবে কথাবার্তা হয়নি '
'খাওয়া দাওয়ার সময় ভালো করে আলাপ করিয়ে দেব '
'নিশ্চয়'
আমার সাথে কথা শেষ দ্রুত ফোন রিসিভ করলেন। বোধহয় কথা অস্পষ্ট আসছিল। বেশ কয়েকবার "হ্যাঁ বলো" বলার পর শুনতে না পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দু চার কথা বলার পর মুখে সামান্য দুঃখী ভাব নিয়ে এসে আমাদের উদ্দেশ্য বললেন, 'বউ ফোন করেছে, ডাকছে। বোধহয় মৌনী খায়নি ঝামেলা করছে। একটু গেলাম'।
সকলেই তার কথায় সম্মতি দিতে তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। সাগ্নিকদা ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলে সপ্তর্ষিদা বেশ উৎসাহ নিয়ে বললেন, 'বউয়ের নামটা দেখতে পেলে?'
সপ্তর্ষিদা মানুষটাই এরকম। আমি মজা করে বললাম, 'আপনার "অবৈধ প্রেমিকা" ছেড়ে এবার সাগ্নিকদার গৃহিণীর প্রেমে পড়তে চাইছেন নাকি!'
হেসে বললেন, 'ব্যাপারটা মন্দ হবে না'।
কৃষ্ণেন্দু বলল, 'কথা বলি তাহলে, কি বলেন?'
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'কি যে বল ভাই। একটা প্রেমের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে এই দশা। আরও একটা! এ রকম রোমিওগিরি কথা বউ জানতে পারলে, পরের দিনই ডিভোর্স'।
আমরা তারস্বরে হেসে উঠলাম। আমি বললাম, 'বৌদির খুশি হওয়া উচিত'।
'কেন ভাই?'
'এই যে আপনার মধ্যে এত প্রেম। বউকে দিয়ে শেষ করতে না পেরে অনত্র বিলিয়ে দিচ্ছেন'
সপ্তর্ষিদা হেসে বললেন, 'বেশি বকো না। বিয়ে কর, তারপর বুঝবে...'।
এতক্ষণ আড্ডায় মন কখনো আবেগী হয়েছে কখনো আবার সুপ্ত প্রেমের বর্ণনা দিতে গলা কেঁপেছে। ফেলা আসা দিনগুলোর গোছানো স্বপ্ন আরও একবার হৃদয় দোলনা আন্দোলিত করেছে। তবে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা প্রেমাগুনের কথা প্রত্যেকে প্রকাশ করে নেভানোর চেষ্ঠা করলেও আমি নিজের প্রেম নিয়ে নীরব রয়েছি। মনে মনে ভাবলাম, এবার তো নির্ঘাত আমার পালা। কিন্তু কি বলব সকলকে। আমার প্রেম তো অব্যক্ত নয়! ব্যক্ত প্রেমকাহিনীর প্রেমিকা রুপলেখার কথা কিভাবে সকলের কাছে প্রকাশ করি? মুহূর্তে এক অদ্ভুত ভাবনায় নিমজ্জিত হলাম।
প্রেম নিয়ে আমার প্রথম থেকে সেরকম কোনো উৎসাহ ছিল না। রুপলেখাই আমার ভাবনাচিন্তা পাল্টে দেয়। শুরুর দিন থেকেই ওকে ভালো লাগত। অ্যাট্রেকশন ভেবে প্রথম দিকে নিজের মনের অনুভূতিকে সেভাবে পাত্তা দিইনি। তারপর যা হয়, ওর প্রতি দুর্বলতা কোনোভাবে আমার বন্ধুরা টের পায়। এখনকার মতো হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক না থাকলেও, প্রেমের খবর তো, ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় নেয় নি। ও প্রথমে মেনে না নিলেও পরে নিজেই কাছে আসে। গড়ে ওঠে এক মধুর সম্পর্ক। চার বছর এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেলেও কিছু অকাঙ্খিতো ঝড়ে হঠাৎই একদিন মুচড়ে পড়ে। রাগে অভিমানে দীর্ঘদিন কোনো যোগাযোগ রাখিনি। আমাদের বন্ধু বৃত্তের ওই একজন যার থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলাম। মানসিক যন্ত্রণা চেপে রেখে সে কাজে সাময়িক সফল হয়। তার ভাবনাকে কখনোই একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারিনি। বন্ধুরা বোঝানোর চেষ্টা করলেও ভেঙে যাওয়া বন্ধন আর জোড়ে নি।
এইভেবে দীর্ঘ সময় কাটে। তারপর দুই বছর আগে হঠাৎই হাওড়া স্টেশনে দেখা। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারিনি। দুজনে আধঘন্টা একান্তে কথা বলেছিলাম। প্রথমে অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। ওকে দেখেও মনে হচ্ছিল, আমার মুখোমুখি হওয়াতে বিরম্বনায় পড়েছে। যদিও ধীরে ধীরে সেই জড়তা দু'দিক থেকেই কেটে যায়। তবে অনুভব করেছিলাম, আমার প্রতি ওর সেই টান আর নেই। না থাকায় স্বাভাবিক। মনের দূরত্ব অনেক প্রশস্ত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে সেদিন অতীত নিয়ে কোনো কথায় হয়নি। ইচ্ছা করেই সে প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করিনি। রুপলেখাও বর্তমান, ভবিষ্যতেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিল। ওইদিনই ওর বিয়ের কথা জানতে পারি। ও নিমন্ত্রণ করবে এই আশা যদিও তখন করিনি। পরে আরও একবার দিল্লিতে ওর হবু স্বামীর সাথে দেখা হয়। বিশেষ কিছু কাজে ওরা দুজনেই সেখানে গিয়েছিল। জমজমাট আড্ডায় সেদিন মন অনেক বেশি হাল্কা হয়। রুপলেখাকে দেখেও বেশ সুখী মনে হয়েছিল। মনের পরিস্থিতি তারপর থেকেই পাল্টে যায়। এখন রুপলেখাতো বটেই ওর স্বামীর সাথেও বন্ধুত্বটা বেশ গড়ে উঠেছে। এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি সম্মান জানিয়ে হাসি মুখে আমি এখানে উপস্থিত। মন থেকেও বেজায় খুশি। সত্যি বলতে অন্তরের পরিতৃপ্তি আছে।
এদিকে রুপলেখার বিয়েতে আমার উপস্থিতি আমার কলেজের বন্ধুদের প্রাথমিকভাবে অবাক করেছিল। সব কিছু পরিষ্কার করে জানাতে তাদের সন্দেহ দূর হয়। পুরষ্কার স্বরূপ কিছু বিশেষ মুহূর্ত আর মনের ক্যানভাসে চিত্রায়িত করে রাখার মতো কিছু অমূল্য স্মৃতি।
ওরা আমাকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করবে তার আগেই সকলের ডাক এলো। বোধহয় খাওয়া দাওয়ার জন্য। এর আগেও দু'একবার ডেকেছে। গল্পে মশগুল থাকায় কেউই শুনতে পায়নি। সপ্তর্ষিদা আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, 'খাওয়ার পর তোমার থেকে শুনব। উত্তেজক পানীয়ের ব্যবস্থাও আছে। পুরো ব্যাপারটা জমে যাবে কিন্তু'।
কৃষ্ণেন্দু ও দেখি ওনার কথায় সায় দিল। কিছুক্ষণের জন্য নিস্তার পাওয়ায় মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। ভাবলাম, খাওয়ার পর অন্য গল্প উত্থাপন করে এ প্রসঙ্গ ভুলিয়ে দেব। অতএব মুখে কিঞ্চিৎ হাসি নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, 'বেশ বেশ। এখন দেরি করলে সব মিস হবে কিন্তু। দারুণ আয়োজন আছে'।
কথা শেষ হওয়ার আগেই দুজনে উঠে দাঁড়াল। আমি কিছুক্ষণ পরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বসে রইলাম। কৃষ্ণেন্দু বলল, 'ওঠো। আমাদের এত বুঝিয়ে নিজেই বসে আছো যে'।
কৃষ্ণেন্দু কে আশ্বস্ত করে বললাম, 'আরে যাচ্ছি ভাই। তোমরা চলো আমি মিনিট দশের মধ্যেই যাচ্ছি'।
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'কি হল? শরীর ঠিক আছে তো?'
'হ্যাঁ দাদা, শরীরের আবার কি হবে!'
'না তোমায় দেখে মনে হচ্ছে উদাস হয়ে পড়েছ, কিছু অসুবিধা হচ্ছে?'
'আরে, না না, অহেতুক চিন্তা করবেন। আই এম ফাইন'
সপ্তর্ষিদা বললেন, 'ঠিক আছে, আমরা এগোলাম। জলদি এসো কিন্তু। খাওয়ায় পর আবার একসাথে বসবো'।
কথা শেষে ওনারা চলে গেলেন। আমি বসে রইলাম। মন খারাপ হয়নি, হবেই বা কেনো? শুধু বুকের খুব খুব গভীরে ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছিলাম। কারণ সহজেই অনুমেয়। এই দৃঢ়তাশূন্য ব্যথা নিরাময়ের ঔষধ আমার জানা ছিল না। হাজার সন্ধান করলেও এই জগতে এরূপ ব্যাধির কোনো প্রতিষেধক পাওয়া সম্ভব নয়। এভাবেই বাঁচতে হবে- সীমাহীন কষ্টের ওপর ইস্পাত কঠিন বাঁধ দিয়ে মনের বেদনাকে লোকচক্ষু থেকে আড়াল করে কিংবা মৃত হৃদয়ের ওপর দাঁড়িয়ে ভালো থাকার অভিনয় করে, যেমনটা এতক্ষণ করলাম।
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট ।
---------------------------------
লেখক পরিচিতি ঃ
নাম- সেখ মেহেবুব রহমান
গ্রাম- বড়মশাগড়িয়া
ডাকঘর- রসুলপুর
থানা- মেমারী
জেলা- পূর্ব বর্ধমান
রাজ্য- পশ্চিমবঙ্গ
ডাকঘর সংখ্যা- ৭১৩১৫১



শেষের পংক্তিটা হৃদয়ের গভীরে গাঁথাই থাক! অনবদ্য লিখেছিস ভাই, তোর লেখনী উত্তরোত্তর ঋদ্ধ হোক!🌷💝👏👏👏
ReplyDelete