পাড়ার দিলীপবাবু। সম্পর্কে কাকা। এসে বলল - মামন তো চাকরি পেল। এবার তো বিয়ে দেবেন নিশ্চয়ই।
মহীপদ মাথা নাড়ল। বলল - আজকালকার ছেলে। মামন যা বলবে তাই হবে।
দিলীপবাবু তা জানেন। তাই মামন ঘরে আছে দেখেই এসেছেন। সব শুনে মামন বলল - সে তো বুঝলাম। কিন্তু কার কথা বলছেন?
দিলীপবাবু এবার একটু খোলসা করলেন - দেখো বাবাজী, তুমি তো যাতায়াত করে চাকরি করতে পারবে না। নিশ্চয়ই সেখানে বাসা নেবে। তাই পাড়ার মেয়ে হলেও অন্য জ্ঞাতি অন্য গোত্র। আশা করি তোমার অসুবিধা হবে না।
- আরে বাবা, সে তো বুঝলাম। কিন্তু মেয়েটি কে?
- মণ্ডলবাবুর ছোট মেয়ে, মনীষা।
চুপ করে গেল মহীপদ মামন দুজনেই। মহীপদ একটু রাগতস্বরে বলল - দিলীপবাবু, আপনি এখন আসুন।
- না মানে বলছিলাম কি। আমি কুণ্ডলী মিলিয়ে দেখেছি। একেবারে রাজযটক।
মামন প্রায় চিৎকার করে উঠল - বাবা আপনাকে চলে যেতে বলেছে, যাবেন?
- বাবাজী রাগ কর কেন? দেনাপাওনা যা চাইবে দেবে। দুহাতে ভরিয়ে দেবে।
মহীপদ মামন দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল - যাবেন আপনি?
- ভাই, পুরোন কথা ভুলে যাও। অমন সুন্দরী মেয়ে সোনাদানাসহ কিন্তু আর পাবে না। তাছাড়া মণ্ডলের যা আছে তাতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র প্রফেসর পাত্রের খুব একটা অভাব হবে না। শুধু -----
কথা শেষ না করেই চলে যেতে হল দিলীপবাবুকে। মামন কলসী থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে ঢক ঢক করে খেল। তারপর দেওয়ালের ধারে চেয়ারটায় বসে বলল - দেখলে বাবা, এই তো অবস্থা।
- তাই তো দেখছি।
এ গ্রামের সবচেয়ে ধনী বিনয় মণ্ডল। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না। অন্যজনের জমি হাতানো, ভাগচাষের ধান তুলে নেওয়া, খালের মাছ বেচে দেওয়া, পঞ্চায়েত দখল এসব তো আছে। তার উপর এই তো বছর পাঁচ সাত আগে মামনের পড়ার জন্য কিছু টাকা ধার চাইতে গিয়ে মহীপদকে যাচ্ছেতাই অপমানের মুখে পড়তে হয়।
তার উপর মামনকে একদিন রাস্তায় পেয়ে যারপরনাই উল্টোপাল্টা বলে বসল - পড়ে কি করবি? চারদিকে তো চাকরির আকাল। তার চেয়ে আমাদের পার্টিতে যোগ দে। তোদের মত ট্যালেণ্ট ছেলেদের তো দরকার। তোর দুহাত ভরে দেবো।
সেদিন থেকে মামনের আরো জেদ চেপে যায়। খুব খুব ভাল পড়ে এখন চাকরি পেতেই সেই বিনয় হয়ে উঠল বিনয়ের অবতার। চাকরির উইটনেশে সই লাগে পঞ্চায়েতের। সেই সই করাতে গিয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল মহীপদ।
- মহী, সেই তো আসতে হল আমার কাছে। আমরা সবসময় দরাজ দিল। লোকে শুধু মিথ্যে মিথ্যে আলটপকা কথা বলে। গালিগালাজ করে। কি হে মহী, আমার এই এইট পাস সই কিন্তু মনে রেখো।
সেইদিন মামন মহীপদ কিছু বলে নি। হেসে চলে এসেছিল।
আজ সেই জবাব দিতে পেরে মামনের বুকের ভেতরটা আনন্দে আকুলি বিকুলি করে উঠল। পেছনের ফাঁকা মাঠে গিয়ে অনেকক্ষণ হো হো করে হাসল। তাতে বিকেল সূর্য, নতুন দীঘির জল, তালসারি, ধানক্ষেত, সরু আল সবই বাতাসে মৃদু মন্দ উচ্ছ্বাসের সাথে সাথে দুলে উঠল।
ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করল - হ্যালো, বলছি কি একটু রুদ্রগড়ের বাজার পেরিয়ে মাচানতলায় আসতে পারবে?
- হ্যাঁ, যাচ্ছি। কিন্তু মাকে কি বলে বেরোব?
- তুমি এখনো কচি খুকিটিই আছো নাকি। আমাদের কথা তোমার বাড়ির সবাই তো জানে, তাহলে? বলছি বাড়িতে কিছু একটা বলে এক্ষুণি এসো, আজ তোমাকে একটা দারুণ কথা শুনাবো।
- বাপরে! তোমার কথায় যেন অন্য রকম উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ছে।তাহলে তো যেতেই হচ্ছে। আসছি।
মাচানতলায় অনেক লোকের সমাগমে মামন আর অরিত্রা মুখোমুখি। কিছুটা শুনেই অরিত্রা বলে বসল - ঠিক করে বলো, মনীষার সঙ্গে তোমার কোন চক্কর নেই তো?
- আরে বাবা আমরা তো ওদের কাছে অচ্ছুত ছিলাম। ওদের ঘরের দরজার সামনে কোনদিন দাঁড়াতেই পারি নি। আজ সরকারী চাকরি পেতেই জাতে উঠে গেছি। টাকায় কি মানুষ হওয়া যায়?
- না মানে। তাও। নামে নামে মিল আছে কি না। মামন মনীষা। মনীষা মামন।
- তুমি না কেমন যেন। বলছি তো কিছু নেই। তাও রসিকতা করে যাচ্ছ।
- কি আর করা যাবে বলো। আমারও একটু ভাল্লাগছে না। এখানে একটা ভাল রেস্টুরেণ্ট সিনেমাহল মল কোন কিছু নেই। এখানে একটু প্রেমালাপও তো করতে পারছি না। সব কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আজ আসি।
আসি বলল বটে অরিত্রা, তবে মাস ছয়ের মধ্যে একেবারে বধূর বেশে মামনের দু কামরার ছোট্ট ঘরে। আর গ্রামে ঘরে যা হয়। নেমতন্ন পেয়ে হাজির হতে হয় সবাইকে। সামাজিক বাঁধন।
অরিত্রার পাশে ভাড়া করা সিংহাসনে বসে মামন চিনিয়ে দিল বিনয় ও তার মেয়ে মনীষাকে। আর কানে কানে বলল - বিয়ের জন্য মনীষার সম্বন্ধ যে আমার কাছে এসেছিল এই পাড়ার এই গ্রামের কেউ কিন্তু কিছুটি জানে না। অরিত্রা হাসল।
----------------