গল্প।। মুক্তি ।। মুসা আলি
রবিবার সকালে পূবের আকাশ জুড়ে লাল সূর্যের অপূর্ব উঁকি শুরু হয়েছে। মন ভরে যাবার মতো দৃশ্য। শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের বুকে সোনালি রোদের ঝিকিমিকি চোখে পড়ছে। উঠোনের এক ধারে ঝাঁকড়া লাউগাছের ঝোপ ঝোপ পাতার ফাঁক গলে ফিকে রোদের লুকোচুরি খেলা নিঃঝুম প্রকৃতিকে মাতিয়ে তুলছে। পাশের বাড়ির রাণু বৌদি এ বাড়ির উঠোনে এল পায়ে পায়ে, এত সকালে সেদিন প্রথম। ইমনকে সামনে পেয়ে বলল, হ্যাঁরে, দোতলার বারান্দায় আসর তো বেশ জমে উঠেছে।
ইমনের মনের ঘরে কোনো জানালা ছিল না। রাণুর কথার ভিতরে যে আরও কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে, তা বোঝার এতটুকু ক্ষমতা নেই। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, কোন আসরের কথা বলছ?
তুই কী রে? এত দিন এসব দেখিস নে?
কোন বিষয়ে বলবে তো?
দোতলার বারান্দায় কত পাখি এসে ভিড় করেছে দ্যাখ?
এখন তো রোজ সকালে এভাবে এসে ভিড় করে।
এতে তোর মনে কোনো সাড়া জাগে না?
ইমন দুচোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকল রাণুবৌদির মুখের দিকে। সাড়া পাওয়ার কী সূত্র থাকতে পারে, তা তার মাথায় এল না। মনের ভিতরেও কোনো প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারল না। দুচোখ নামিয়ে বিড় বিড় করে বলল, কী জানি বাপু, জমে ওঠা আসরের মধ্যে রাণুবৌদি নতুন কী দেখতে পেল। তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা, বাইরের পাখি বারান্দায় এসে বসলে মেয়েটির মন অকারণে উড়নচণ্ডি হয়ে ওঠে।
ইমন দোতলার দুটো ঘরে বিদেশি পাখি রেখে ব্যবসা শুরু করেছিল বছর দুই আগে। সকাল হলেই তারের জালঘরে পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দে সমগ্র বাড়িটা মুখর করে তোলে। ঝাঁক ঝাঁক বাইরের শালিক উড়ে এসে বসে দোতলার পুরো বারান্দা জুড়ে। আটটার পরে দিগন্তহীন নীল আকাশে ঝলমলে রোদের খেলা শুরু হলেই আগত পাখিগুলো আর অপেক্ষা করে না দোতলার করিডরে। ডানা মেলে ফিরে যাবার সময় তাদের মনে একটাই অনুভূতি প্রবলতর হয়ে ওঠে, তারঘরের পাখিগুলো সমানতালে নীল আকাশে ডানা মেলতে পারল না কেন?
ইমনের ভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা। বাড়িতে কোনো কাজ নেই বলেই একটা ফালতু প্রসঙ্গ নিয়ে রাণুবৌদি এভাবে ভাবতে পারছে বোধ হয়। বাইরের পাখি কেন এল, তারজালের ভিতরের পাখিগুলোকে তারা কী বলল, আটটার সময় আবার ফিরে গেল কেন, এসব জেনে লাভ কী? তার কাছে একটাই হিসেব ডানা মেলা পাখির মতো সত্যি সত্যি বড়ো হয়ে উঠেছে। মাসান্তে কেবলমাত্র লাভের অঙ্কেই ইমনের সব হিসেব সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ। মননের অঙ্কে সে ঢুকতেই চায় না। ঢুকলে কতটুকু লাভ পাবে সে? সেই উত্তর জানা ছিল না ইমনের কাছে।
পাশের বাড়িতে ফিরে গিয়ে রাণু একটা বিশেষ অনুভূতিতে ছটফট না করে পারল না। বাইরের পাখিগুলো যখন মুক্ত নীল আকাশে সারিবদ্ধ হয়ে ডানা মেলে এগিয়ে চলে, রাণু নিজের বুকের মধ্যে অন্য সুখ অনুভব করতে পারে। কেবল মনে হতে থাকে, পাখিগুলো উড়তে উড়তে তার জীবনের কথা বলে চলেছে। নতুন মূল্যায়ণের আলোয় পুরনো দিনের ভাবনায় রাণুর চিন্তা কেমন যেন ফালা ফালা হয়ে যেতে থাকল। কেবল ভাবতে পারল যে বিড়ম্বনা মানুষকে এত বেশি পোড়াতে পারে? এত বেশি অস্থির করে তুলতে পারে? তুলনার নতুন দ্যুতি মনের ঘরে এমনি অভিনব চেতনা এনে দিতে পারে?
বড়ো সাধ নিয়ে শুরু হয়েছিল রাণুর সংসার জীবন। ইতিমধ্যে একমাত্র মেয়ে সুস্মিতার বিয়ে হয়ে গেছে। বড়ো ছেলেটার কপাল ভাঙল গত বছরেই। ক্যানসারে ভুগতে ভুগতে অচিনপুরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে চিরদিনের জন্যে। বুকের গভীরে সেই যন্ত্রণা আজও উথালপাতাল ঢেউ তুলে রাণুকে বার বার অশান্ত করে তোলে। যাকে ছেলে হিসেবে খুব বেশি করে পেতে চেয়েছিল সে, তাকে হারিয়ে রাণু যেন হিল্লোলিত সমুদ্রের মাঝে মাঝিবিহীন নৌকো ছাড়া কিছুই নয়।
রাণুর ছোটো ছেলে কলকাতায় থাকে, ট্যাক্সি চালায়। মাস গেলে যে নেহাৎ কম রোজগার করে, এমন বলা যাবে না। সব বাদ দিয়ে দিব্যি হাজার পনেরো হাতে থাকে। কিন্তু বড়ো ছেলে রাণুকে যেভাবে টানত, চিনত, ছোটোর মধ্যে সেই চিন্তা চেতনা নেই। তার কাছে রাণু মা তো মা, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। জানতে চায় না, তার ঐকান্তিকতার অভাবে কীভাবে তার মা মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মুড়ো তালগাছ হয়ে উঠেছে। সেই খবরটুকু রাখার ক্ষমতাও তার নেই। বরং রাণুর জীবনে সে নিজেই আর এক মরুভূমি। মমতা দিলেই নিতে পারে কিন্তু ঘুরিয়ে কতটুকু দিতে হবে, সেই বোধ তার নেই।
স্বামীর সোহাগি মনকে ধরে ঝুলে থাকা ছাড়া রাণুর জীবনে দ্বিতীয় পথ ছিল না। লোকটা কোলকাতায় থাকে, রাজমিস্ত্রী হিসেবে কাজ করে। সপ্তাহ বা পনেরো দিন অন্তর বাড়িতে ফেরে। এভাবেই রাণুর জীবন থমকে থেকেও মানসিক স্বপ্নের ঝড়ে এগিয়ে চলত। কিন্তু সেই ঝড়ও হঠাৎ একদিন থমকে গেল যখন রাণু শুনল, দৈনন্দিন কাজের দৌলতে এক যোগাড়ে মেয়ের সঙ্গে মনের লেনদেন করতে করতে শেষ পর্যন্ত সাধের স্বামী নতুন করে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে। কঠোর বাস্তবে রাণুর কপাল ফালা ফালা হয়ে গেল সেই পিঁড়ির আঘাতে।
পরে পরে লোকটার বাড়িতে ফেরার তাগিদ কমতে কমতে ভাটার শেষপর্বে কাদাজলে মেশানো মন্দগতির স্রোতের মতো হয়ে উঠল। দুবেলা পথ চেয়ে থাকলেও লোকটার সঙ্গ পাওয়া নিয়ে রাণুর ভিতরের তৃষ্ণা তখন জষ্টির ভরদুপুরে খাঁ খাঁ প্রান্তর ছাড়া কিছুই নয়। অন্তত ফোটা ফোটা জল পেলে কিছুটা তৃষ্ণা মিটতে পারত কিন্তু সেই সুযোগ মরে মরুভূমি হয়ে গিয়েছিল।
রাণু এমনি বেঘোরে থাকলেও তার স্বামী তখন ভীষণ ঘোরের মধ্যে ছিল। মনে মনে সঙ সেজে নতুন সম্রাজ্ঞীর মন যোগাতে ব্যস্ত। মন নিয়ে যে এত বেশি কানাকানি চলতে পারে, চতুর্থ শ্রেণি পাস রাণু তা সেই প্রথম বুঝতে পারল।
পাঁচ ছ’মাস অন্তর একান্ত অনিচ্ছায় গ্রামের বাড়িতে এলেও সাধের স্বামীকে নতুন সম্রাজ্ঞীর কড়া পাহারায় থাকতে হত। গভীর রাতের প্রহেলিকার মধ্যেও সেই অবস্থানের এতটুকু হেরফের হত না। নতুন এ অনুসঙ্গে নিজে নিজেই ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ত রাণু। পাশের ঘরে কাঁটার বিছানায় শুয়ে নিজের স্বামীর গায়ের উপর নতুন সম্রাজ্ঞীর উথলে পড়া গেছো প্রেমের আবেগি কথা শুনতে শুনতে ছটফট করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। নিজের শরীর জাগলেও তা অন্য শরীরের উপর ঢেলে দেওয়ার কোনো অবলম্বন ছিল না। রাণু যেন ইমনের তারের ঘরে বন্দী পাখিদের মতোই। ইচ্ছামতো নীল আকাশে ডানা মেলার স্বাধীনতা তার নেই। প্রতিদিন সকালে উঠে দোতলার বারান্দায় বাইরের পাখিগুলোকে বসে থাকার দৃশ্য দেখার মধ্যে যেন তার জীবন সীমাবদ্ধ। রাণুর কাছে জীবন ভোগ করার স্বপ্ন দুর্গন্ধময় নোংরা পানীয় গ্রহণ করার সমতুল্য। শুধু ভাবতে পারল যে এতদিন পরে সে কীভাবে এত বেশি গ্রহণযোগ্যহীন হয়ে পড়তে পারল।
পরের রবিবার সকালে পূব আকাশের সূর্য সাত রঙ ছড়িয়ে দিল দোতলার বারান্দায়। রাণু এসে দাঁড়ালো উঠানের মধ্যে। দুচোখে রঙিন স্বপ্নের ডালি, বুকের গভীরে সামুদ্রিক গর্জনে পাড় ভাঙার শব্দ, অনুভূতির ছল-ছলানিতে কুল ভাঙার উদ্দাম খেলা। গাছপালার আড়াল ঠেলে ফিকে রোদ ফুঁড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক এসে বসল রোদ ঝলমল দোতলার বারান্দায়। রাণু বিস্ময় চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। ইমন ভীষণ বিরক্ত হল রাণুবৌদিকে দেখে। ক’দিন ধরে সকাল হলেই উঠোনের মাঝে এসে থমকে দাঁড়িয়ে থাকছে, দুচোখ দোতলার বারান্দার দিকে। বিড় বিড় করে বলল, রোজ রোজ একই দৃশ্য দেখার কী আছে শুনি? বাড়িতে কাজকর্ম্ম না থাকলে যা হয়—। সম্পর্কে বৌদি বলেই বাক্যটা শেষ করতে পারল না ইমন।
পরের মাসে প্রথম বুধবার। শুভ সকালে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিশেষ ফোন পেয়ে ইমনের মন খুশিতে ভরে উঠল। ভিতরের অনুভূতির গর্বে বার বার আন্দোলিত হতে থাকল। যথেষ্ট কারণও ছিল। একটিমাত্র শ্যালক, তার বিয়ে, জাঁকজমক করে যে হবে, তা নিয়ে ইমনের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না। আরও বড়ো প্রসঙ্গ, শ্বশুরমশাই তার পছন্দের প্রার্থীর সঙ্গে বিয়ের সম্পর্ক ঠিক করেছেন। ফোনে নির্ঘন্ট জানানোর সময় শ্বশুরমশাই ঠারেঠোরে তার পছন্দ নিয়ে কত বেশ খুশি, তাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। তা নিয়ে মনের মধ্যে টুকরো টুকরো জয়ের স্মারক ভেসে থাকলেও চলতি জীবনের আশু সমস্যাকে ইমন কিছুতেই হেলাফেলা করতে পারল না। ব্যবসা ফেলে রেখে কী তার পক্ষে এতদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকা সম্ভব? সকালে বিকেলে পাখিগুলোর পরিচর্যা দেবে কে? একটা বিকল্প অবস্থান তৈরি না করে তো—। জটপাকানো নতুন দুর্যোগ ইমনের মাথার উপর কয়েক কুইন্টাল ভারি বোঝা হয়ে চেপে থাকল। নতুন অবলম্বন কী হওয়া উচিত, তা ভেবে পেল না।
একটু পরে পাশের বাড়ির রাণুবৌদি এল এ বাড়ির উঠোনে। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল, দুচোখ দোতলার বারান্দার উপরে, সূর্যের সোনালি আলোয় ভরে উঠছে। শালিকের দল উড়ে এসে বারান্দায় বসতে শুরু করল। ইমন কিন্তু সেদিন রাণুবৌদির উপর মনে মনে এতটুকু রাগ করতে পারল না। হৃদয়ের আকাশে দুচোখ রেখে দেখল, অভিমানের যে মেঘ এতদিন বিক্ষিপ্তভাবে জমে উঠেছিল, তার ছিটেফোটাও নেই। একান্ত বাস্তব প্রয়োজন জীবনের মান অভিমান, রাগ অনুরাগের ভারী বোঝাকে কীভাবে হাল্কা করে দিতে পারে, ইমন সেদিন তা প্রথম বুঝতে পারল। ভিতরে ভিতরে নিজেই কেমন যেন নরম হয়ে পড়তে বাধ্য হল। পায়ে পায়ে উঠোনের মাঝে গিয়ে বলল, একটা অনুরোধ রাখবে বৌদি?
কী বল্ শুনি?
একমাত্র শ্যালকের বিয়ে, একটু আগে শ্বশুরমশাই ফোন করে তা জানালেন। কটাদিন ওখানে না থাকলে নয়। তাই নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।
এ নিয়ে কিন্তু করছিস কেন?
না মানে আমার সমস্যা তো অন্যরকম।
ভনিতা না করে সেটাই বল্।
এতগুলো পাখি, একটা বিকল্প ব্যবস্থা না করে তো যেতে পারি না।
আমাকে কী কী করতে হবে বল্?
সকালে বিকেলে খাবার দেওয়া, বাটিতে জল দেওয়া, জলের সঙ্গে ওষুধ মিশিয়ে দেওয়া—এমনি টুকিটাকি।
এসবের সঙ্গে অতিরিক্তভাবে আর কী কী করতে হবে আমাকে?
ইমন চুপ করে থাকল। মনে মনে বুঝল, রাণুবৗদি রাজি হয়ে গেছে, নাহলে এভাবে কথা বলতে পারত না। তারপরেও একটা অভিনব প্রশ্নে ইমন কিছুতেই উত্তর খুঁজে পেল না। অন্তত মুখ ফুটে তো বলতে পারত, তাকে আর উঠোনে দাঁড়িয়ে দোতলায় চোখ রেখে শালিকের দল দেখতে হবে না। বরং নিজেই দোতলার উপরে উঠে বারান্দায় ভিড় করা বাইরের পাখিগুলোকে দুচোখ ভরে দেখতে পাবে। এটুকুও সরল করে বলতে পারল না কেন? এ তো কপটতার নামান্তর। অন্য সময় হলে ইমন ঠারেঠোরে তা প্রকাশ না করে ছাড়ত না কিন্তু নিজস্ব প্রয়োজনের কথা ভেবে মুখ খুলতে পারল না।
রাণুবৌদি কৌতূহলী হয়ে বলল, ওখানে কবে যাচ্ছিস?
বিকেলে যাব বলে ভেবে রেখেছি।
ফিরবি কবে?
অন্তত তিনটে দিন তো থাকতে হবে।
বললি তো পাঁচদিনের নেমতন্ন।
ওটা শ্বশুরের আবদার কিন্তু আমার পক্ষে এতদিন কী থাকা সম্ভব?
ইচ্ছা করলে থাকতে পারিস কিন্তু ভিতরের ভাবনা এতটুকু প্রকাশ করল না। বরং বিড় বিড় করে বলল, তোকে অনেক ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছা করছে রে ইমন।
ইমনের হতচকিত প্রশ্ন, এভাবে বলছ কেন?
খাচার ভিতরে থাকা রঙিন পাখিগুলো দুচোখ ভরে দেখার সুযোগ পাব। এতদিনে সেই সুযোগটুকু দিতে পেরেছিস আমাকে? তোর মুখ-ভার অবস্থান দেখে বুঝতে পারতুম, কেবল আমিই মহাভারত অশুদ্ধ করে দিচ্ছি রোজ রোজ।
ইমন এসব কথা কানেই তুলল না। এতক্ষণ মনের আকাশে যে মেঘ জমতে দেখেছিল সে, রাণুবৌদি রাজি হওয়ায় দুচোখ বিস্ফারিত করে দেখল, কোথাও তার ছিটোফোটা নেই। বার বার ভাবতে বাধ্য হল, কটা দিন বেশ নিশ্চিন্তে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারবে সে।
রাণুর মনে তখন অন্য নেশার দোল শুরু হয়ে গেছে। ইমনের মুখে অনেকবার শুনেছে, খাঁচার ভিতরে থাকা বিদেশি রঙিন পাখিগুলো দেখতে ভারি সুন্দর। সুযোগ এসেছে তাদের রঙিন ডানায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার। রূপোলি শরীর দেখতে দেখতে আমোদিত হয়ে ওঠার। শুধু রাতটুকুর অপেক্ষা। কাল সকাল থেকে সব পাখি তার তত্ত্বাবধানে চলে আসবে।
রাণুবৌদি সারা রাত না ঘুমিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় সময় কাটিয়ে দিল। খাঁচার রঙিন পাখিগুলোকে নিয়ে তার মধ্যে সোনালি স্বপ্নের বিস্তার শুরু হয়েছে। ভাবনার ঘোরে পাখিদের রঙিন ডানায় আদুরে সোহাগ বিলিয়ে দিতে থাকল। কল্পনা আর বাস্তবের অদ্ভুত মেশামেশি অবস্থান।
পরের দিন সকাল না হতেই রাণু এল এ বাড়ির উঠোনে। আগে কখনো এত সকালে ঢোকে নি। দাঁড়িয়ে দেখল, সূর্যের ঝিকিমিকি রোদ সবেমাত্র দোতলার বারান্দায় জমতে শুরু করেছে। ঘরের ভিতরে তারের জালে রঙিন পাখিগুলো ভিতরের উচ্ছ্বাসে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে দিল। সব শিয়ালের এক রা। ডানা ঝাপটানোর শব্দে রাণু ভিতরে ভিতরে নিজেও কম উতলা হল না।
সিঁড়ি ভেঙে দোতলার উপরে গিয়ে দাঁড়ালো। শালিকের দল ঝাঁকে ঝাঁকে সোনালি রোদ ফুঁড়ে বারান্দায় এসে বসছে। জালের ভিতরের রঙিন পাখিগুলো কলকলিয়ে সমবেত স্বরে ডাকতে শুরু করল। বাইরে আসার জন্যে সে কী উদ্বেলতা। যে নীল আকাশ তাদের মূল ঠিকানা, সেখানে ডানা মেলার অধিকার তাদের নেই। এতদিনে ইমন এসব বুঝতে পারল না কেন? রাণুর বুকের গভীরে ভাবাবেগের বিচিত্র ঢেউ চলতে শুরু করল। জীবনের এক অদ্ভুত টানাপোড়েন। এভাবে চলতে থাকলে তো—।
নিজেকে সামলাতে যথেষ্ট হিমসিম খেতে হল। অভিনব কাটাকুটির খেলায় অসীমতার হাতছানির মধ্যে রঙিন পাখিগুলোর উদ্বেলিত ভাবপ্রবণতা যেন আছড়ে পড়ছে। প্রবল জোয়ারের স্রোতে যেন এত বেশি গতিশীলতা নেই। রাণু বার বার কম্পিত না হয়ে পারল না।
বিষণ্ণ মনে রাণু ঢুকল তার-জালের ঘরে। রঙিন পাখিগুলো তার দুচোখের দিকে তাকিয়ে। রাণু নির্দিষ্ট পাত্রে খাবার দিল, ওষুধমেশানো জল দিল কয়েকটি পাত্রে। সেসব কেউ খেলো, কেউ খেলো না। যারা খেলো তারা সরে এসে নিজেরাই রাণুর হাতে ধরা দিল। অস্ট্রেলিয়ার রঙিন পাখি মানুষের ব্যবসার প্রয়োজনে ভারতের খাঁচায় বন্দি। অচেনা মমতায় মিশে যেতে থাকল রাণুর মন। বন্দি হলেই বুঝি এভাবেই পরাধীন হয়ে থাকতে হয়? নিজেদের ইচ্ছায় ডানা মেলার কোনো সুযোগ থাকে না? পাখিগুলোর পরাধীনতার গ্লানি রাণুকে বার বার ছ্যাকা দিতে থাকল।
যে শালিকগুলো এতক্ষণ বারান্দায় জড়ো হয়ে কিচিরমিচির শব্দে আনন্দ প্রকাশ করছিল, আটটার পরে তারাই আকাশে উড়তে শুরু করল। দলে দলে ডানা মেলে সামনে এগিয়ে চলেছে। রাণু বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখল। ভারি সুন্দর লাগছিল সারিবদ্ধ রূপের অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে। একটা অপূ্র্ব তুলনার দ্যুতি রাণুর মনের গভীরে খেলা শুরু করে দিল। মুখ ঘুরিয়ে তারজালে বন্দি রঙিন পাখিগুলোর দিকে চোখে রেখে বুঝতে পারল, তারাও কত বেশি বিষণ্ণ।সকলের চোখ তার দিকে, সব চোখের ভাষা একই, একটিমাত্র আবেদনে সকলের একই মিনতি ঝরে পড়ছে।
অসহনীয় লাগলেও রাণুবৌদি ফিরে গেল পাশের বাড়িতে। পাখিগুলোর দুর্দশায় মনের তলানিতে মন্দগতির বলের মতো একটা বিপরীত চিন্তা গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। তাহলে কী পাখিগুলো কোনোদিন মুক্তি পাবে না? ইমনের হাতে বন্দি হয়ে থাকতে বাধ্য হবে? নিছক ব্যবসা জীবনের স্বাধীনতাকে এভাবে হরণ করে নেবে? রাণু হৃদয়ের গভীরে সেই পরিমাপ ভীষণ করে টের পেতে থাকল।
দুপুরে সূর্যের তেজ বেড়ে গনগনে হলেও বিকেলে সেই তেজ কমতে কমতে পশ্চিমে নামল। আবার রাণু এল এ বাড়ির উঠোনে। ইমন পই পই করে বলে গিয়েছিল সন্ধের আগে পাখিগুলোকে খাবার জল আর খাদ্যসামগ্রী দেওয়ার জন্যে। নাহলে নাকি রাতে ভীষণ কষ্ট পাবে তারা। রঙিন পাখিগুলোর আবদ্ধ অবস্থান জীবনের এক নির্মম সত্য প্রকাশ করলেও রাণুকে নিজস্ব আবেগের কলতানে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে বাধ্য হতে হল। বাটিতে বাটিতে খাবার দিল, অন্য কয়েকটা পাত্রে ওষুধ মেশানো জল খেতে দিল। সন্ধের শুরুতে নিজের বাড়িতে ফিরে এল রাণু।
পাখিদের পরাধীনতার জন্যে তাকে যে এত বেশি ভাবতে হবে, তা রাণুর মাথায় আগে ছিল না। না ঘুমিয়ে উসখুস করতে করতে সারা রাত সাবাড় করে দিল। পরের দিন সকাল হতেই আবার রাণু এল এ বাড়ির উঠোনে। সকাল থেকে মেঘে ঢাকা আকাশ মুখ ভার করে আছে। একটু আদটু সূর্যের মুখ দেখা গেলেও পুরো রোদ ঝলমল আকাশকে আদৌ দেখা মিলল না। প্রকৃতির রাজ্যে অপূ্র্ব লুকোচুরি খেলা চলছে তো চলছে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে আর অপেক্ষা করল না রাণু। পায়ে পায়ে দোতলার উপরে গেল। ইমনের কথা তাকে রাখতেই হবে। জল আর খাবার দেবার কাজ যথাসম্ভব শীঘ্র শেষ করল। বাইরে এসে একবার চোখ তুলে দেখে নিল গেরুয়া রোদে ভরপুর দিগন্তহীন নীল আকাশকে। তারপর চোখ বুজিয়ে বেশ কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। কে বা কারা যেন তার হৃদয়ের নরম মাটিতে এঁকে চলেছে চিত্রবিচিত্র ছবি। রাণু তাতেই অনুভব করতে পারল অনুরাগের বিন্দু বিন্দু ছোঁয়া। মনের তলানিতেও রঙিন অনুযোগের অনুশীলন এগিয়ে চলেছে তরতর করে। খাঁচার ভিতরের পাখিগুলোর দুষ্টু মিষ্টি চাহনি তখনও রাণুর দুচোখের তারায় ভাসছে।
আগে বারান্দায় ভিড় করা শালিকদের দেখে রাণু যেভাবে আনন্দ প্রকাশ করত, সেদিন কিন্তু শালিকদের কথা সেভাবে ভাবতেই পারল না। কখন এল, কখন ফিরে গেল, সেই হিসেব রাণুর হৃদয়ে এতটুকু স্থান করে নিলনা। বরং আটটার পরে ক্লান্ত বিধ্বস্ত রাণু ফিরে গেল পাশির বাড়িতে।
বিকেল হলে সন্ধের ঠিক আগে রাণু আবার এল এ বাড়িতে। সময় গড়াতে থাকল প্রকৃতির নিয়ম মেনে, রাণু বারান্দায় আনমনে দাঁড়িয়ে থাকল। এমন কী পাখিগুলোকে খাবার কিংবা জল দিতেও ভুলে গেল। বরং সন্ধের ঝাপসা অন্ধকারে দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল। বেশ অনেকটা সময় ধরে। মনের গভীরে এক টুকরো আনকোরা অনুভূতি এসে রাণুকে বার বার ধাক্কা দিতে থাকল। এক অদ্ভুত রাগিনীর সুর বাজছে হৃদয়ের গভীরে। উতলা হয়ে উঠছে রাণুর বুক।
ইমনের ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। পথ চলার ক্লান্তি তার সমস্ত শরীর জুড়ে। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে আনা মিষ্টি মুখে দিয়ে এক গ্লাস জল টেনে বিছানায় শরীর মেলে দিল। সারা রাত কেটে গেল ঘুমের অচিনপুরে। ফেরার সময় ইমন শ্বশুরকে বলে এসেছিল, আরও দুদিন পরে সুস্মিতা ফিরলে কোনো অসুবিধা নেই।
কত আগে সকাল হয়েছে, ইমন তা জানতে পারে নি। বেশ বেলাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে উঠোনের মাঝে এসে দেখল, পূব আকাশের সূর্য এক বাঁশ উপরে উঠে গেছে। চারদিকে সোনালি রোদের ছড়াছড়ি। ইমন মনে মনে ব্যস্ত না হয়ে পারল না। কটাদিন বাড়ির বাহিরে থাকার কারণে পাখিগুলোকে ঠিকমতো দেখভাল করা সম্ভব হয় নি। নিজের হাতে যত্ন নেওয়ার তাৎপর্য সম্পূর্ণ আলাদা। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল, ভাবল, শালিকের দল নিশ্চয় একটু আগে ফিরে গেছে। আটটার পরে ওরা থাকে না এখানে।
উপরে উঠে দেখল, ঘরের মূল দরজা হাট করে খোলা। রাণুবৌদি কী দিতে ভুলে গিয়েছে? অবশ্য তারজালের মুখ ভালোমতো বন্ধ থাকলে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবুও হৃদয়-সমুদ্রের গভীর ধুকপুকুনি থেকে সরে আসতে পারল না। পায়ে পায়ে সামনে সরে গিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখল, তারজালের ভিতরে ঢোকার মুখও হাট করে খোলা। ইমনের বুকের গভীরে চাপা যন্ত্রণা শুরু হল। তীব্র অনুভূতির সাগরে বিশেষ প্রতিবাদ আছড়ে পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা লোন নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিল সে। মাথার উপরে সেই বোঝার চাপ তখনও এতটুকু কমে নি। খুব করে আশা করেছিল, ব্যবসায় আয়ের যোগফল গাঁটিতে এলে ঋণমুক্ত হয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারবে। এ সব রাণুবৌদি রীতিমতো জানত। তারপরেও—?
ভিতরের তীব্র যন্ত্রণায় অস্থির হতে থাকল ইমন। দোতলা থেকে দ্রুত পায়ে বাড়ির উঠোনে নামল। ডাকতে ডাকতে পাশের বাড়িতে গেল, রাণুবৌদি, ও রাণুবৌদি, এভাবে তুমি আমাকে—।
ঘরের ভিতর থেকে কোনো উত্তর পেল না ইমন। তাহলে কী এখনও ঘুম থেকে ওঠে নি? আবার ডাকল, ও রাণুবৌদি, আমি ইমন বলছি।
তাতেও কোনো কাজ হল না। বাধ্য হয়ে বারান্দার উপরে উঠে ডাকল, ও বৌদি, সাড়া দিচ্ছ না কেন?
ইমনের দুচোখ হঠাৎ থমকে গেল তেরচা নীল আকাশের দিকে। সূর্যের ঝলমলানি আলো, দিগন্তে দিগন্তে তার বিস্তার। দুচোখ বিস্ফারিত করে দেখল, ঘরের ভিতরে তারজালে বন্দি রঙিন পাখিগুলো ডানা মেলে উড়ে চলেছে নীল আকাশের বুক বেয়ে।
এ দৃশ্যের অন্তরাল বেয়ে যে গভীর জীবনসত্য উঁকি দিচ্ছিল, তা কিছুতেই ইমনের মাথায় ঢুকল না।
-------------------------
খুব ভালো লাগলো ভাইজান।
উত্তরমুছুন