Click the image to explore all Offers

গল্প ।। ফন্দিগ্রাম ।। সুদীপ ঘোষ

 
 
 
গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের মাঝখানে ছোট্ট একটা গ্রাম। তিলোত্তমা মহানগরী শহর কলকাতা থেকে দক্ষিণে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে সবুজ সমারোহে ঘেরা প্রত্যন্ত একটি গ্রাম ফন্দিগ্রাম। নামে ও যেমন ধৃষ্টতা, তেমনি আছে অন্ধকারের টানা পোড়েন! কারণ, গত এগারো মাস ধরে ঐ গ্রামের কোনো একটি ঘরে বাতির আলো দেখা গেলেও রাজনৈতিক দলা দলিতে ঐ গ্রামে নেমে এসেছিল চরম অনিশ্চয়তা। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল নৈরাজ্যের পরিবেশ। গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ ! সেই সব ঘর ছাড়া মানুষ দের সহানুভূতি দেওয়ার মতো কোনো মানুষ দাঁড়ায়নি তাদের পাশে।" মুক্ত জীবনের স্বাদ পাওয়ার আশায় থাকতে থাকতে একদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের জীবন সংগ্রাম।
      থাক সে সব কথা, আমি কলকাতায় এসেছিলাম উচ্চ শিক্ষার জন্যে। পড়াশোনার সুবিধা হবে বেশিরভাগ সময়ই আমাকে থাকতে হতো হোস্টেলে। বাবা মাঝে মাঝে চিঠি লিখতেন খোঁজ খবর নেওয়ার জন্যে।  ছুটি পেলেই মাঝে মধ্যেই ঘুরে আসি আমার দেশের বাড়ীতে ফন্দিগ্রামে। সত্যি কথা বলতে কি দেশের বাড়ীতে আমাকে খুব টানে, গ্রামের আল পেড়িয়ে মেঠো পথ ধরে বাবা - মা - বোন, প্রতিবেশীর কাছে ফিরে যেতে আমার মন খুব টানে, ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
         একদিন দুপুরে কলেজ থেকে হোস্টেলে ফিরে দেখি, দরজার গোড়ায় একটা চিঠি পরে আছে ; আমাকে দেখতে না পেয়ে পোস্ট মাস্টার হয়তো চিঠিটা ছেড়ে গেছে। চিঠিটা বাবার লেখা, তিনি লিখেছেন- "বহুদিন হলো তোর কোনো খোঁজ খবর নেই, একটা খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিসনা, তুই কেমন আছিস? তোর মা তোকে নিয়ে বড্ড বেশী চিন্তা করে আজকাল। তোর বোনের শরীরটাও ভালো যাচ্ছেনা কদিন ধরে ! ডাক্তার বলেছেন,- ভাইরাস থেকে হচ্ছে এইসব। কিন্তু জ্বর টা তো নামতেই চাইনা, ভয় হয়...! কারণ, তুই আর তোর বোন ছাড়া তো আর কেউ নেই আমাদের। যদি পারিস এবারের কালীপুজোর সময় এখানেই কাটিয়ে যাস কটা দিন। চিঠিটা পড়তে পড়তে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল, তাই পরের অক্ষর গুলো ভালো করে পড়া হয়নি সেদিন। তারপর, কয়েকদিন কেটে গেলো।
          সেদিন ছিল শনিবার রাত ন ' টা সাড়ে ন ' টা হবে, আমি ছুটি নিয়ে ফিরছিলাম গ্রামের বাড়িতে। সঙ্গে ছিল আমারই এক বন্ধু অনিমেষ। ছোটো বেলা থেকে ও শহরেই বড়ো হয়েছে। তাই গ্রাম কি জিনিস সে জানে না। তাই ঘাড়ে চেপেছে সঙ্গে আসার জন্য। অগত্যা...। সেদিন ছিল অমাবস্যা রাত! রাস্তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, সঙ্গে আবার বড়ো বড়ো দুটো ' লাগেজ' । ট্রুথ ব্রাশ থেকে শুরু করে একটা গোটা দিন একটা লোকের যা যা লাগতে পারে, ওই সবকিছুই অনিমেষ ব্যাগে ভরে এনেছে। আমি ওকে বারণ করেছিলাম, কিন্তু কে কার কথা শোনে ?
          কথা বলতে বলতে কখন যে আমরা ' তালচূড়া ' গ্রাম অতিক্রম করে ফেলেছিলাম বুঝতেই পারিনি। এই তালচূড়া গ্রামের শেষেই 'হোগলা সেতু ' যা তালচূড়া আর বাঁশঝুরি গ্রামকে পূব পশ্চিমে বহুবছর ধরে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে। আমরা যখন 'হোগলা সেতু' পার হয়ে  বাঁশঝুরি গ্রামে প্রবেশ করছিলাম ; ঠিক তখনই রুগ্ন -শুকনো - চিচিরে শরীরের কয়েকজন আদিবাসী আমাদের দিকে বোঁটি , কাটারি , লাঠি হাতে রে রে করে তেড়ে এলো ! আমরা তো ভয়ে একেবারে জড়ো - সড় : এই বুঝি প্রাণটা গেল ! ওদের মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করলো -" তোমরা কারা ? আধো আধো কণ্ঠে অনিমেষ বললো -  জা জানি না । ওদের মধ্যে একজন আমার চোখে চোখ রেখে এগিয়ে এলো, কাঁধে হাত রেখে বলল - ' বাঁচতে চাও তো পালাও ! ওর চোখ দুটো তখনও জ্বলছে :
         সেদিন কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে ফিরেছি। ওদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল ওরা আমাকে চেনে। পরে শুনেছিলাম, ওরা বাবাকে খুব শ্রদ্ধা করে। কারণ একসময় ওরা বাবার কাছে অনেক উপকার পেয়েছে। আসলে ওরা হলো ওখানকার নিরীহ গ্রামবাসী। ওরা ভেবেছিলো, আমরা 'কীর্তন খোলা ' দলের লোক। কারণ কীর্তন খোলা লোকেদের ওরা ভয় পায়। তারা রাতের অন্ধকারে গ্রামের গরীব মানুষের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়।
ওদের কোনো ধর্ম নেই। ওরা সন্ত্রাস বাদে দীক্ষিত, জঙ্গি উস্কানিতে প্ররোচিত। একসময় গ্রামবাসীরা সবই সহ্য করতো, কিন্তু আজ ওদের ধৈযের সীমা পার হয়ে গেছে। তাইতো বিপদের আশঙ্কা দেখলে ওরা সবাইমিলে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের অপরাধ ওরা খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষ। ওদের অপরাধ ওরা গরীব। রাজনৈতিক দলাদলি তে ওদের জমি ওরা হারিয়ে ফেলেছে, নিজের জমিতে ওদের কোনো অধিকার নেই, না পারে চাষ করতে, না পারে বিক্রি করতে। সব জমি রক্ষা কমিটির হাতে চলে গেছে।
          একদিন সাড়া গ্রাম টা ঘুরে দেখবো বলে অনিমেষ কে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়েছিলাম। ' জেলেপাড়া ' ছাড়িয়ে ' তেলিপাড়ার ' দিকে এগোতে না এগোতেই কানে ভেসে এলো কান্নার শব্দ। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি, একজন অর্ধ বয়স্ক মহিলা হাঁটু মুড়ে বসে বসে কাঁদছে। পরে শুনেছিলাম ওর ছেলে বৌ নাতনি কে কারা যেনো কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে ! তারপর ঘরে আগুন লাগিয়ে চলে গেছে। ওনার সাহারা এখন ভিক্ষা ঝুলি। তাও কোনোদিন জোটে, কোনোদিন জোটেই না। আধ পেটা খেয়ে কোনরকমে ছেঁড়া ঝ্যাদলায় অর্ধ মৃতের মতন পড়ে থাকে : ভাগ্যিস প্রাইমারি স্কুল টায় বহুদিন কোনো বাচ্চা পড়তে আসেনা। শোনা যায় - শিক্ষক শিক্ষিকারা নাকি প্রাণের ভয়ে স্কুল ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তা না হলে এই ঘরহীন, বস্ত্রহীন, অন্মহীন গোবেচারা অর্ধ বয়স্ক মহিলাটার কিযে হতো কে জানে। আমি টাকা দিতে গেলাম ফিরিয়ে দিলো। ওর বদলে গোটা কয়েক পোড়া মাটি মুখের মধ্যে পুরে চিবোতে চিবোতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল....... !
          তাইতো ' জমিরক্ষা 'কমিটি র লোকেরা যখনই সভা করে গ্রামের লোকেদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন ; তখন ওই সভায় উপস্থিত থেকেও কোনো এক রমণী তার কোলের বাচ্চা কে আকড়ে ধরে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল .....অপরিচিতের দিকে ! ঐ চোখে নেই কোনো সৎকার এর আকাঙ্ক্ষা : নেই কোনো করো কীর্তির জন্য কোনও গ্রাহ্য । বাইরের জগতের কোনো অস্তিত্বই তার কাছে নেই।
       প্রকৃত পক্ষে ওই চোখ দুটো গভীর ভাবে তাকিয়ে রয়েছে .... জীবন শক্তির তলানির দিকে ! সেখানের রক্ত মাংসের গাদের দিকে !..... আগামীর দিকে....!

          ---------------++--+-----------
 
সুদীপ ঘোষ
Greenland Enclave
Flat no-L, 3rd floor
West jagtala
Kol-141
Maheshtala
South 24 parganas
West Bengal



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.