গল্প ।। দাগ ।। চন্দন মিত্র
দাগ
চন্দন মিত্র
দুদিনের ছুটি পেয়ে সুজন ছুটে যায় দেশের বাড়িতে। একাই। ছেলে ইভান জন্মেছে কলকাতায়। তার মাও কলকাতার মেয়ে। তারা কখনোই গ্রাম দেখেনি। দেখার ইচ্ছেও পোষণ করে না। সুতরাং সে একাই সকাল-সকাল চেপে বসে ট্রেনের কামরায়। বাবা-মা যখন কলকাতায় চলে আসে তখন সুজন সবে মাত্র এইট পাশ করে নাইনে উঠেছে। তারপর আর গ্রামের বাড়িতে ফেরার সময়-সুযোগ হয়নি তার। গ্রাম থেকে কয়েকবার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছেছে শহরে। কিন্তু শহর থেকে কেবল কিছু টাকা গেছে মানুষ যায়নি। আজ এতদিন পর কেন যে সুজন হিজলডাঙায় পা রাখল তা সে নিজেও জানে না। জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও সে একবারের জন্যে গ্রামে যেতে পারেনি, তখন তার ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা চলছিল। দিন সাতেক পরে যখন জেঠিমার মৃত্যুসংবাদ পৌঁছায় তখনও তার পরীক্ষা শেষ হয়নি। সে বাবাকে অনুরোধ করেছিল মাকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার জেদি বাবা সেই প্রস্তাব এককথায় নাকচ করে দিয়েছিল। সুজন বাবার সেই অভিমানের কারণ আজও বুঝে উঠতে পারেনি। তারপর একসময় সুজনের চাকরি হল, সংসার হল, সন্তান এল সংসারে। একদিন বাবা চলে গেল, তারপর মা। সুজন দেখল তার মাথার উপর থেকে ছায়া ক্রমশ সরে যাচ্ছে। আসলে যত বয়স হচ্ছে ততই সে নস্টালজিক হয়ে পড়ছে। বাল্যকৈশোরের দিনগুলো তাকে খুব টানছে। গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সে কোনোদিনও মেনে নিতে পারেনি। যেদিন জ্যাঠা-জেঠিমা ও জ্যাঠতুতো দাদাদের ছেড়ে প্রিয় গ্রামীণ পরিমণ্ডল ছেড়ে সে অচেনা শহরের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল, সেদিন তার মনে হয়েছিল সে ছিন্নমূল একজন; তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে উপড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আজও তার সেই অনুভূতিটা মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে। হয়তো আজ সেই ছিন্ন শিকড়ের টানে তার দেশের বাড়িতে ফেরা।
দুই জ্যাঠতুতো দাদা ও তাদের পরিবার সুজনকে পেয়ে আপ্লুত হয়। চা-জলখাবার খেয়ে সুজন ঘুরে দেখতে থাকে তার জন্মভিটের আনাচকানাচ। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বাগানের দিকে। বাগান ঘেঁষে বয়ে চলা খালটি এখন অনেকটাই শীর্ণ। সুজনের মনে পড়ে ওই খালে সে গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে কতদিন মাছ ধরেছে, ধরাধরি খেলেছে। হঠাৎ সুজনের নজর চলে যায় খালের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি খেজুর গাছের দিকে। প্রায় খানদশেক গাছের মধ্যে মাত্র তিনটি অবশিষ্ট আছে। গাছগুলি যেন সুজনকে ডাকে, সুজন বাধ্য ছেলের মতো এগিয়ে যায়। গাছের তলা থেকে সে কয়েকটা খেজুর তুলে নিয়ে মুখে দেয়। ছেলেবেলার স্মৃতি ও স্বাদে সে তন্ময় হয়ে পড়ে। উপরে তাকিয়ে অবাক হয়ে সে দেখে দীর্ঘ ও শীর্ণকায় গাছগুলি এখনও কাঁদি কাঁদি খেজুর ফলিয়ে চলেছে। সুজন এবার আরও আশ্চর্য হয়, তিনটি গাছেই এখনও জ্যাঠামশায়ের হাঁসুয়ার পোঁচে তৈরি দাগগুলি বহাল তবিয়তেই টিকে আছে। জ্যাঠামশায়ের কথা মনে পড়ে যায় সুজনের। ছেলেবেলায় জ্যাঠামশায়ের অপার আদরযত্ন পেয়েছিল সুজন। চাষবাসের পাশাপাশি জ্যাঠামশাই শীতকালে রসের জন্য খেজুর গাছ কাটত। খেজুর রস, গুড়, পাটালির স্বাদ এখনও যেন সুজনের জিভে লেগে আছে। সে মাথা তুলে দাগগুলি নিরীক্ষণ করতে করতে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। আকস্মিকভাবে সে যেন এক নিগূঢ় সত্যের সন্ধান পায় ! সে ভাবে দাগগুলি আছে মানে জ্যাঠামশাইও আছে। ওই দাগগুলি তার প্রিয় জ্যাঠামশাইকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। হঠাৎ সে পাগলের মতো একটি গাছ জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে।
===================
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর (হরিণডাঙা)
ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা।
সূচক- ৭৪৩৩৩১