গল্প।। স্বপ্নসুন্দরী ।। গোবিন্দ মোদক
স্বপ্নসুন্দরী
গোবিন্দ মোদক
অশোক। মাধ্যমিকে থার্ড ডিভিশন পেয়েছিল বছর দশেক আগে। এখন হকারি করে। পুরোনো শাড়ি-জামা-কাপড়ের বদলে প্লাস্টিকের বালতি, গামলা, মগ, এমনকি নগদ টাকা পর্যন্ত দেয়। এ পর্যন্ত বেশ চলছিল। সমস্যা হলো গরিবের ঘোড়া রোগ হওয়ায় ! অশোক প্রেমে পড়ে গেল ! তাও আবার একতরফা ! ও-তরফের প্রণয়িনীটি মধ্যবয়স্কা বিবাহিতা একজন মহিলা। অবশ্য প্রণয়িনী সে অর্থে বলা যাবে না – কারণ সে তো বিন্দুবিসর্গও জানে না এসবের। যাইহোক, অশোক চার কিমি পথ অতিক্রম করে বড় কালভার্টের পাশে যেখানে বাঁক নিয়ে স্টেশনের পথ ধরে, সেই বাঁকের বাঁদিকের দোতলা বাড়িতে এই প্রণয়িনী দেবীর অধিষ্ঠান। দোতলার সুদৃশ্য ব্যালকনিতে তার হরবখত দেখা মেলে। উল্টোদিকে বিশাল এক কৃষ্ণচূড়া গাছ।
কোনও এক চৈত্রের সহনীয় মধ্যাহ্নে ফেরি করে ফিরছিল অশোক। মহিলাটি তখন কাঁচা হলুদ রঙের একটি তাঁত শাড়ি পরে ব্যালকনিতে শোভিতা। সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটি লালে লাল। অশোক কোনও কালেই রোমান্টিক ছিল না – কিন্তু মদনদেবের পঞ্চশর তাকে বিদ্ধ করলো মুহূর্তেই। অপরপক্ষ কি ভাবছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনা ছিল না অশোকের – শুধু একতরফা প্রেমে হাবুডুবু খেতে লাগল অশোক। তার ধ্যান জ্ঞান সাধনা হয়ে উঠল কালভার্টের পাশের ৫১ নম্বর বাড়ির ব্যালকনির অপরূপাটি।
এভাবে বেশ কয়েকটি চৈত্র এলো, গেলো ... । কৃষ্ণচূড়া নিয়ম করেই আগুন জালালো আকাশ জুড়ে – আর সেই আগুনে পুড়ে ঝামা হলো অশোকের দেহ-মন। অশোক এখন ভীষণভাবেই জানে তার প্রণয়িনীর কোন কোন রঙের শাড়ি আছে। সে আরও জানে কোন রঙের শাড়িতে সে সবচেয়ে আকর্ষণীয়া হয়ে ওঠে অশোককে আরও পোড়াবার জন্য। অশোকের দিবাস্বপ্ন নির্লজ্জ-রঙিন হয়ে ওঠে দোতলার ওই বাসিন্দার অনিন্দ্যসুন্দর দেহকান্তিকে ভেবে।
এভাবে চলতে চলতে ক্রমশ: হকারদের কয়েকজন ব্যাপারটা জানতে পারে। তাদের কারও বা উস্কানিতে, কারও বা কপট সমবেদনায় ক্রমশঃ পাকা প্রেমিক হয়ে ওঠে অশোক। দিনে একবার অন্ততঃ তার এই প্রণয়ী তথা কামনাময়ীকে না দেখলে অশোকের দিন ভালো যায় না।
এহেন অশোককে সেই দেবী যখন একদিন ইশারায় ডাকলো, তখন অশোকের সারা শরীর জুড়ে কম্পন, সারা বুক জুড়ে লক্ষ সাগরের ঢেউ ভাঙছে ! দুরুদুরু বুকে অশোক গিয়ে দাঁড়াতেই স্বপ্নসুন্দরী একরাশ পুরোনো শাড়ি-জামা-কাপড় এনে দেখালো যার মধ্যে রয়েছে অশোকের অতি পরিচিত সেই হলদে রঙের তাঁত শাড়িটা ! অশোক তো এই মরে, সেই মরে ! তার বুকে ঢেঁকি পাড় দেয় প্রায় দ্বিগুন বেগে। সে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারে না তার স্বপ্নসুন্দরীর দিকে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে আশাতীত দাম দিয়ে ফেলে তার স্বপ্নসুন্দরীকে। তারপর পুরোনো জামা-কাপড়গুলো নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যেন সে নেমে আসে হাওয়ায় ভর করে।
***** ***** ***** *****
পরদিন সকালে পথচারীরা দেখতে পায় ৫১ নম্বর বাড়ির উল্টোদিকে অজস্র ফুলে ফুলে ছাওয়া কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে হলদে রঙের কি যেন একটা পড়ে আছে ! কয়েকজনের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দেখতে পায় হলদে রংয়ের একখানা তাঁত শাড়ি জড়িয়ে কে যেন শুয়ে আছে গাছের নিচে ! বেশ কিছু কৃষ্ণচূড়া ফুল ঝরে পড়ে হলদে শাড়ির উপর তৈরি করেছে বিচিত্র এক নকশা। কিন্তু কে এই মহিলাটি ! কেনই বা সে এই গাছতলায় একাকী শুয়ে আছে!
কিছুক্ষণ ধরে ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি, টানাটানির পর সবাই টের পায় কোনও মহিলা নয়, একজন পুরুষমানুষই শাড়িটা জড়িয়ে শুয়ে আছে ! আরও খানিকক্ষণ পর সবাই জানতে পারে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে যে শুয়ে রয়েছে সে আর কেউ নয় – অশোক হকার ! নানারকম হাসি-ঠাট্টা, টিপ্পনীর পর আবিষ্কৃত হয় – অশোক হকার মৃত এবং তার মুখে ফুটে রয়েছে মধুর একটি সব পেয়েছির হাসি। ক্রমশই ঠাট্টা-মস্করার বাতাবরণ সরে গিয়ে পরিবেশটা ভারী হয়ে ওঠে।
একসময় ব্যালকনির স্বপ্নসুন্দরীও মজা দেখতে আসে এবং সবকিছু শুনে দেখে নিয়ে বলে – আহা রে ! আমার এই প্রিয় হলদে তাঁত শাড়ীটা গায়ে জড়িয়েই মরল বেচারীটা ! ইস ! গতকালই বেচারী আমার পুরোনো শাড়ি জামা কাপড়ের বদলে একগাদা টাকা দিয়েছে যা ভাবা যায় না। বেঁচে থাকলে আবার ক'টা শাড়ি কাপড় দিয়ে একগাদা টাকা পেতাম আমি এবং আমার লাভ হতো বেশ ! স্বপ্নসুন্দরী তার লাভ-লোকসানের হিসাব কষতে থাকে। কিন্তু বুকের মধ্যে তার জন্য একগাদা "লাভ" নিয়ে যে মানুষটি ঘুমিয়ে আছে চিরতরে তার লাভের কথা জানতে পারে না স্বপ্নসুন্দরী। শুধু চৈত্রের বাতাসটা এলোমেলোভাবে বয়ে যেতে থাকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে !
=======================
স্বরচিত মৌলিক অপ্রকাশিত গল্প।
প্রেরক: গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, ডাকসূচক - 741103
WhatsApp/ফোন: 8653395807