বিসর্জন
সমর আচার্য্য
বৃদ্ধ বরুণবাবু বড় রাশভারী মানুষ। সরকারী অফিসে চাকরি করতেন। প্রায় ছয় ফুট লম্বা দেহ এখন বয়সের ভারে আনত হয়ে পড়লেও মনে অসীম শক্তি এবং আনন্দ। স্ত্রী কমলাদেবী খুব শান্ত স্বভাবের। তার হাতেই সংসারের ভার সঁপে দিয়ে বরুণবাবু বন্ধুবান্ধব আর খেলা ধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।
একটি পুত্র সন্তান। যেদিন সে জন্মেছিল খুব আনন্দ পেয়েছিলেন বরুণবাবু, মনে মনে খুশি হলেও উপরে তা কাউকে বুঝতে দেননি। ছেলে বড় হতে লাগে, তার যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেন, কিন্তু ছেলের সামনে তা প্রকাশ করেন না।
দেখতে দেখতে ছেলে কিশোর হয়ে উঠল । পড়াশুনায় খুব ভালো না সে। তার জন্য বরুণবাবুর বড় রাগ। সারাদিন ছেলেকে বলেন, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না, একটা অকম্মার ঢেঁকি।
জীবনটা যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায় একমাত্র ছেলে গদাই এর। মা ভালোবাসলেও বাবা'র এই সদা সর্বক্ষণের নিরুৎসাহমূলক কথা বড় কষ্ট দেয় গদাইকে। তার রেজাল্ট খারাপই হতো। এক দিকে সেই কষ্ট অন্যদিকে বাবার সবসময়ের বকুনি আর অবহেলা গদাইকে আস্তে আস্তে খারাপ রাস্তায় নিয়ে গেল। বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে নেশা করতে শুরু করলো।
মা কমলাদেবী ব্যাপারটা বুঝেও অতি আদর আর স্নেহের বশে তাকে তেমন শাসন করতে পারতেন না l
কথাটা বরুণবাবুর কানেও যায়। তিনি আরো রেগে যান ছেলের উপর, স্ত্রী কমলাদেবীকে বলেন, এমন ছেলে থাকার চাইতে মরে যাওয়া ই ভালো। আমার মান সম্মান আর কিছু রাখলো না।
মনে বড় কষ্ট বরুণবাবুর। আর কমলা দেবী তো সারাদিন ছেলের পক্ষ নিয়ে স্বামীকে বলে, তুমি যদি ওকে একটু ভালোবাসার কথা বলো, যদি একটু পাশে ডেকে বসাও, তাহলে হয়তো ও ঠিক হয়ে যায়। স্ত্রীর কথায় রেগে গিয়ে বলেন, আগে যদি জানতাম এমন ছেলে জন্মাবে তাহলে------l
আজ দশ বৎসর হয়ে গেল। বিজয়া দশমীর দিন পাড়ার প্রতিমার সঙ্গে ভাসানে গিয়েছিল গদাই। পরিমানটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিলো হয়তো। মায়ের ভাসানের তালে অন্য বন্ধুরা লক্ষ্য করেনি, যে গদাই এর জামা মায়ের আসনের সঙ্গে আটকে সেও মায়ের সঙ্গে ডুবে গিয়েছে। যখন সবাই দেখতে পেল, ততক্ষণে গদাই ও চলে গিয়েছে না ফেরার দেশে।
খবরটা বাড়িতে পৌঁছালে স্বামী স্ত্রী দুজনেই কেমন নীরব হয়ে গিয়েছিলেন। কতক্ষণ যে তারা কথা বলতে পারেননি, সেকথা এখন আর মনে নেই।
সময় বয়ে চলে সময়ের তালে। আর পাঁচটা পুত্রহারা সন্তানের বাবা মার মত তারাও বেঁচে থাকে।
এবারের পূজা ও শেষ হয়ে গেল। আজ বিজয়া দশমী। মায়ের বিসর্জনের দিন। সকাল থেকেই মা কমলাদেবী মাঝে মধ্যেই কেঁদে কেঁদে উঠছেন। বরুণ বাবু কেমন থ মেরে বসে আছে। স্ত্রীর কান্না শুনে গুটিগুটি তার কাছে গিয়ে বললেন, এমন করে কান্না করো না আর। যা হওয়ার তাতো হয়েই গিয়েছে। বিসর্জন তো সবারই হয়, তাই না? এই দেখ না, জগতের যিনি মা তার ও তো আজ বিসর্জন। তোমার ছেলে তো মায়ের সঙ্গেই গিয়েছে। কথা গুলো বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন বরুণবাবু। কমলা দেবী স্বামীর চাপা স্বভাবের কথা জানতেন, কিন্তু আজ তার অন্য রূপ দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলেন না। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তুমি চুপ করো, এই দেখ আমি আর কাঁদছি না, লক্ষীটি আমার তুমি চুপ করো।
বাইরে তখন মা দুর্গার বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজ, ডিজের উচ্চস্বরে কর্কশ দানবীয় শব্দ আর অগণিত ভক্তের, আসছে বছর আবার হবে চিৎকারে আকাশ বাতাস মুখরিত না বিষাক্ত হয়ে উঠেছে তা বোধগম্য হলো না তাদের কাছে।
শুধু পুত্র হারা বৃদ্ধ বৃদ্ধার একে অপরে জড়িয়ে ধরে বুক ফাটা কান্না ঘরের চার দেওয়ালে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাসটা বড্ড ভারি করে তুললো।
--------------------------------
যোগাযোগ --৯৭৭৫৭৭২২৫৫