Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। ক্রুদ্ধ-কবির ব্রাত্য-কাব্য ।। শংকর ব্রহ্ম

 



ক্রুদ্ধ-কবির ব্রাত্য-কাব্য 
শংকর ব্রহ্ম
 

             গাল দু'টি ভিতরে ঢোকা। উঁচু খাড়া নাক। গালের চোয়ালদুটি ভাঙা। মুখটা দেখতে অনেকটা তোবড়ানো ঘটির মতো। মাথাটা কাতলা মাছের মতো বড় সরু ঘাড়ের উপর বসানো। চশমার পুরু কাচের আড়ালে বড় বড় চোখ দুটি টুনি লাইটের মতো জ্বলছে।
            ইনি হচ্ছেন সেই কবি যিনি কিছুদিন আগে প্রকাশ করেছেন 'ধূর্তের ধারাপাত'। তারও কয়েক বছর আগে তার দ্বিতীয় কবিতার বই 'পন্ডিতের পন্ডশ্রম' প্রকাশিত হয়ে বোদ্ধা পাঠকের মনে বেশ আলােড়ন তুলেছিল।
একেবারে তাঁর প্রথম দিকের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। 'বিভ্রান্তের বৈভব', যা পড়ে পাঠকরা প্রথমবার হতচকিত হয়ে পড়েছিল।
         কী আপসোসের কথা, এমন একটা শ্যাওলা ধরা স্যাতস্যাতে অন্ধ কুঠরির মধ্যে এমন একজন কবি বাস করেন ! আজকের দিনে এমন হওয়া কি সত্যিই উচিৎ। যখন দেখা যাচ্ছে তার সময়কার সব স্মার্ট কবি-লেখকরা, আগাম টাকা পেয়ে, গ্রান্ট পেয়ে, পুরস্কার পেয়ে, নতুন গদীর নরমে শরীর ডুবিয়ে আরামে দিন কাটাচ্ছেন। আর সুখকাব্য নির্যাস বমন করছেন। বিভিন্ন কবিতা উৎসেবে দেশ বিদেশ ঘুরে আসছেন প্লেনে।
 
সরু প্যাকাঠির মতোে লম্বা পা ফেলে তিনি বকের মতাে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ছাদে মাথা তার ঠেকে যাবার উপক্রম। এতটা নীচু ছাদ। এ জন্য তিনি মাথা নিচু করে, পিঠটা কুজো করে নিলেন খানিকটা।
আমাকে দেখে বললেন, কি চাই আপনার?
- আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি।
- আমি কি সিনেমা আর্টিষ্ট বা কোন রাজনৈতিক নেতা নই যে আমার সাক্ষাৎকার দিতে হবে -
- না তা নয়। আপনি একজন কবি, তাই আপনার কাছে আপনার লেখা সম্পর্কে কিছু জানতে এসেছি।
- আমি কাউকে সাক্ষাৎকার দিই না।
- কেন?
- আমার ইচ্ছে। আপনার আর কিছু বলার আছে?
কথাটা শুনে আমি তার মুখের দিকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলাম। তিনি তখন জানলা থেকে সরে গিয়ে আমার মুখের উপর জানলাটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন। 
আমি তখন শেষকুটো আকড়ে ধরার মতো বললাম, ঠিক আছে সাক্ষাৎকার দিতে হবে না।
আমি আপনার কবিতার বই 'ধূর্তের ধারাপাত' প্রসঙ্গে কিছু জানতে চাই। 
আমার এই কথা শুনে, কি মনে হলো তার, ক্যাচম্যাচ আওয়াজ করে আধভাঙা দরজার খিলটা খুলে দিয়ে, বললেন, ভিতরে আসুন।

             বহুল প্রচারিত বাণিজ্যিক একটি পত্রিকা একসময় তার প্রথম প্রকাশিত বই  'বিভ্রান্তের বৈভব'-এর সমালোচনা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন,সমসাময়িক কবিদের মধ্য তিনিই কবিতা সাম্রাজ্যের মুকুটহীন সম্রাট।

            সে সব অনেকদিন আগেকার কথা। পরে বোধহয় সে'সব কথা তারা বেমালুম ভুলে গেছেন কিংবা হজম করে ফেলেছেন।
একদা তার কয়েক বছরের প্রেমিকা, পরে তার বিবাহিত স্ত্রী, তাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে। তারপর থেকে বন্ধুরাও কেউ আর খুব একটা আসে না তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
সে বড় একা, নিঃসঙ্গ বড়। কবিতাই একমাত্র সঙ্গী তার এখন।
          ঘরটি একটি চৌকো কুঠরি। আসল এটি একটি গ্যারেজ। কোন এস সহৃদয় ধনী ব্যক্তি দয়া পরবশ হয়ে তাকে থাকতে দিয়েছেন। তবে কবি কারও কৃপা প্রার্থী নন। তার মতে, সে ধনী ব্যক্তি তাকে তার কবি প্রতিভার প্রতি স্বীকৃতি স্বরূপ এ ঘরটি দান করেছেন। এ'ছাড়া বর্তমানে আর কোন উপায় নেই বলেই, তিনি সেচ্ছায় এই ঘরে আছেন, তা না হলে কবেই অন্যত্র সরে পড়তেন। ছাদ এতাে নীচু যে প্রত্যেকের মাথা ঠুকে যাবে এখানে, এ'কথা ভাবলে, তার বউ ওরফে প্রেমিকা পালানাের ব্যাপারটা মোটেও আশ্চর্য মনে হয় না আমার কাছে।
           আমাকে ভিতরে আসতে বলে, সেই স্যাতস্যাতে গ্যারেজ ঘরটিতে গিয়ে ঢুকলেন তিনি। জরাজীর্ণ সােফায় ধুপ করে বসে পড়লেন। ভঙ্গিটা এমন যে, এই অবস্থার মধ্যেই ভাল মানুষের মতো তাকে বাস করতে হচ্ছে অন্য আর কোন উপায় নেই বলে। আমায় তিনি বললেন, আমার কাছে আপনার কী দরকার ? যা জানার  'বিভ্রান্তের বৈভব'- সম্পর্কে তাড়াতাড়ি বলুন। আমার এখন অনেক কাজ আছে।
     চর্মসার ঐ পাঁজর ভেদ করে, কী ভীষণ গুরুগন্তীর কন্ঠ বেরিয়ে এলো, যা শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। তিনি আরও বলেন, আমি কে তা জানার জন্য, আপনার কোনো কৌতূহলের কারণ থাকতে পারে না , বলতে বলতে তিনি চশমাটা চোখ থেকে খুলে নিয়ে, হাতে ধরে তার ময়লা পাঞ্জাবি দিয়ে ঘষে ঘষে পরিস্কার করতে লাগলেন। তারপর বললেন, সে যাই হোক .... সৌজন্যের খাতিরে আমি জানাই, আমার নাম বাৎসায়ন মিত্র। নামটা শুনে আপনার মনে কি কোন কৌতূহল হচ্ছে?

         কুন্ডলী পাকানাে মুর্তির মতো, তিনি আমার দিকে তাকালেন। পুরাে কাঁচ ভেদ করে সে দৃষ্টি যেন আমাকে সম্মোহিত করে ফেলল।
যেন কোনো জ্যোতির্বিদ চেয়ে আছেন দুরবীনে কোনও রহস্য উন্মোচনের জন্য। 
        হঠাৎ তিনি উৎকট ভাবে হেসে উঠলেন। মাঝ পথে হাসি থামিয়ে তিনি আবার বললেন, আমি ভাবছি একজন যথার্থ সুন্দরী যুবতীর কাছে নামটা আমার কেমন শোনাবে, নামটা কতাে পুরুষালী, কতােটা যৌন আবেদন আছে এতে? কথাটা বলে তিনি যেন খুব তৃপ্তি পেলেন।
          কথাটা বলেই হঠাৎ তিনি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, আমার অনেক সময় নষ্ট করে দিচ্ছেন আপনি। সহসা জরাজীর্ণ সােফা থেকে উঠে দাঁড়ানােয় সেটা যেন প্রতিবাদে ক্যাচ ক্যাচ করে উঠল। তিনি আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আমার নাম শোনেন নি কখনও ?
আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। আমি বলতে যাচ্ছিলাম, সমালােচকরা বলেন, আপনি - কথাটা শেষ করতে পারলাম না।
'সমালােচক' কথাটা কানে যেতেই তিনি যেন ক্রোধে ঝলসে উঠলেন, 'সমালোচক বলে একটু থামলেন তিনি, পরে তার মাথাটা বিড়ালের মতাে আমার দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, যান বেরিয়ে যান এখান থেকে। তার চোখ কুঁচকে গেল। মুখটা পাথরের মতোেন কঠিন হয়ে উঠল।
সমালােচক, নিজেদের কিছু করার মুরোেদ নেই। নপুংসক। খাসি সব। ওরা সকালের দুধ মেশানো চা-তে এক টুকরো রুটির মতো, লেখা ডােবাতে থাকে, যতক্ষণ না সেটা তাদের ফোকলা মাড়ির পক্ষে যথেষ্ট নরম হয়ে পড়ে এবং যে মানুষটা শতবর্ষ আগে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের জন্য ক্রীতদাসের মতো পরিশ্রম করে গেলেন, যখন তার অস্থি মজ্জা অনেক আগেই মিশে গেছে মাটিতে আমাদের চারপাশের ধুলােয়, তখন তার ডি.এন.এ. টেস্ট করে চেঁচাতে থাকে শতবার্ষিকীর জন্য।
 - যান বেরিয়ে যান। তিনি ক্ষু্ব্ধ স্বরে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন আমাকে।
শিরদাঁড়ায় হূল ফুটছিল আমার তাঁর কথা শুনে। সহ্য করলাম। তাকিয়ে রইলাম সেই মাথাটার দিকে, যে মাথা দিয়ে বেরিয়েছে 'বিভ্রান্তের বৈভব' কিংবা'ধূর্তের ধারাপাত' অথবা 'পণ্ডিতের পন্ডশ্রম'। ওই সেই মাথা যা থেকে এমন সব চিন্তা ভাবনার ফুলকি বেরিয়েছে। ভাবলাম এই মাথা থেকেই বেরিয়ে ছিল এমন সব ভাবনা, যা আগে কেউ কখনও তেমনভাবে ভাবেননি,  প্রকাশ করেন নি কবিতায়।
সত্যিই আমি তাঁর সময় নষ্ট করছি, ভাবলাম মনে মনে, সে যা বলছে, তাতে আমার আঁতে ঘা লাগলেও, তাঁর কিছু করার নেই। সে যা বলছে তা তো ভুল নয় মোটেও।
বললাম, এক্ষুণি আমি চলে যাব। একটা কথা শুধু জানতে চাই। আপনি জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছেন কিভাবে ? মানে আমি বলতে চাইছি, আপনার কাজ এবং জীবন যাপনের জন্য অর্থ সংগ্রহ এই দুই-এর মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখছেন কিভাবে আপনি ? মাফ করবেন, আমি জানি আপনার বই বিক্রি হয় না মােটেও। আপনি কোন রাজনৈতিক দলের নন। কোন গোষ্ঠীর নন। কানাে পত্রিকার সম্পাদক সম্প্রতি আপনার কবিতার প্রতি কোনো আগ্রহ দেখান না। লোক চক্ষুর সামনে আপনাকে তুলে ধরার জন্য কোনও ইনলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা কোনও প্রকাশক এগিয়ে আসেন না। নিজেই নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করেন। পুরুস্কার যারা দেন তারা বোধহয় আপনার নামও শােনেন নি তবু আপনি লিখে চলেছেন আপন খেয়ালে। কিন্তু কেন ?
তিনি আমার কথা শুনলেন ধৈর্য ধরে, স্থির দৃষ্টিতে আমার চোখে চোখ রেখে। তারপর চোখ থেকে তার চশমাটা খুলে ফেললেন। গায়ে পরে থাকা নােংরা পাঞ্জাবিটা দিয়ে পুরাে কাচদুটি ঘষে ঘষে মুছলেন।
খানিকক্ষণ। মাথা নীচু করে চশমার কাচ মুছছিলেন, সেভাবে থেকেই বললেন, ঠিক কথা। 
- কেন লিখি ? সত্যি কথা বলতে তার উত্তর আমি নিজেও জানি না। কেন লিখি? লিখে কি লাভ ? সত্যিই তাে - বলে একটু থামলেন তিনি। চশমাটা চোখে পরে বললন, না লিখে যখন আর কোন উপায় থাকে না, তখনই লিখি আমি। না লিখলে, হয়তো এতদিনে আমি পাগল হয়ে যেতাম। তাই আমার ভিতর থেকে কেউ যেন আমাকে দিয়ে এসব লিখিয়ে নেয়। আমি ঠিক জানি না। লেখা আমার কাছে বাঁচবার জন্য। বেচবার জন্য নয়। কিছুদিন ইচ্ছে করেই কিছু লিখিনি। নিজেকে মনে হয়েছিল, একটা লাশ হয়ে যেন বেঁচে আছি, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম ভিতরে ভিতরে।  অসহায় লাগত খুব, অস্থিরতা ঘুণ-পােকার মতাে কুরে কুরে মগজ খেত।
অনেক সময় এ'কথা একা একা ভাবতে ভাবতে মনে হয়েছে, কবিতা লেখা এক রকম মােহ। কিংবা তীব্র কোন আরকের নেশা যা একবার ধরলে আর ছাড়া যায় না। হেরােয়িনের নেশার মতাে।
আমি টের পেয়েছি, একটা লেখা শেষ করার পর, নিজেকে খুব বিধ্বস্ত লাগে। হ্যাঁ, হ্যাঙ্গওভারের মতো। তখন আমি একটু ড্রিঙ্ক করি।
আমি খুব মদ টেনে নিয়ে লিখি এমন কথা কেউ কেউ আমার সম্পর্কে ভাবে। তবে সে ভাববার কোন সত্যতা নেই। বোতলের দরকার হয় আমার লেখার পরে।
চোখের সামনে তখন সরষে ফুলের মতো হলুদ হলুদ বিন্দু ভাসতে থাকে। মাথার ভিতরটা দপদপ করে। বুকের ভিতরের সবকিছু যেন চুরমার হয়ে ভাঙে পড়তে চায়। ঠিক সেই সময় তাকে সামাল দেওয়ার জন্য দরকার হয় বোতলের। কবিরা কেবল মদে চুর হয়ে কবিতা লেখে। সাধারণ লোকের এ ধারনা ঠিক নয়। 
কেউ কেউ অবশ্য মদ খেয়ে সভা-সমিতিতে গিয়ে বাহাদুরী দেখাবার চেষ্টা করে, তার মধ্যে আমি নেই।
- এই সময়ের কবিতা লেখা কেমন হচ্ছে?
- শতকরা নব্বুইভাগ লেখা পড়ে তাে মনেই হয় না যে তারা পূর্বসূরীদের লেখা মন দিয়ে পড়ে। 
লেখাপড়ার জন্য কমপক্ষ ঘন্টা আট দশ ব্যয় করি আমি , এটা নির্ভর করে আমার দমের ওপর। বাকি যা পড়ে রইল, তার কিছুটা সময় নিদ্রাদেবীর জন্য আর কিছুটা সময় প্রকৃতিদেবীর জন্য তোলা থাকে আমার। তারপর আছে বাইরে গিয়ে অপরূপ রমণীয় রূপকথার পরীদের দেখে চোখের শুশ্রুষার জন্য, তাছাড়া ঘরে শারীরিক ক্রিয়াদি গ্রহণ-বর্জন, প্রাতরাশ-প্রাতঃকৃত্য, সাজগোজ ইত্যাদি । 
কিন্তু একটা কথা ভুললে চলবে না, কিছুটা সময় নিজের জন্য রাখতেই হবে, নিজের মনকে নিয়ে একটু খেলা করবার জন্য।
বেঁচে থাকার জন্য কিছু রোজগার করা প্রয়োজন। তার জন্য দু-একটি ছাত্র পড়াই আমি। কিছু অনুবাদের কাজ করি বেনামে। 
কিন্তু যা'ই করি, এসব সত্ত্বেও আমার চেতনার মধ্যে প্রতিটি শব্দকে থাকা চাই তার যথা স্থানে। কঠিন হোক, সহজ হোক,দৃঢ় হোক, আলগা হােক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু দারােগা যেন আবার বিচারকের চেয়ারে গিয়ে না বসেন, সেটা লক্ষ্য রাখতে হয় আমাকে। কবি যেন আবার কোন অবান্তর ব্যাপারে জড়িয়ে না পড়েন, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে তার। যাক এসব ব্যাপার স্যাপার, বলে তিনি থামলেন হঠাৎ।
আমি বললাম, বিগত সরকারের গ্র্যান্ট আপনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেন?
তিনি এবার ধমকে উঠলেন আমাকে, যারা আমার কোনাে লেখার খবরই রাখেন না, পড়েন নি আমার কোন লেখা, তারা আমায় গ্রান্ট দেবেন কেন, এতে যদি তাদের কোন স্বার্থ না থাকে। আমি কি তাহলে, আমার মেধা বিকিয়ে দেবো তাদের স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য, আপনি কি বলেন? তার চেয়ে না খেয়ে থাকলে বাজারে আলু, পটল বেচবাে। আমার মেধা আমি বেচবাে না কখনোই কারও কাছে । না কোনও প্রতিষ্টান, না কোনও সরকার। 
- সেজন্যই আমি এসেছি আপনার কাছে। আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বিভ্রান্তের বৈভব' যখন বের হয়, তখন তার সমালােচনা প্রসঙ্গে আমি লিখেছিলাম, স্বার্থের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা আপনার কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় । তারপর আপনি আরও দূটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, সেগুলাের গুরুত্বও কম নয়। পড়লে মগজে আলোড়ন তােলে। তিনি আমার কথা শুনে নীরবে হাসলেন, যেন আত্ম-তৃপ্তির হাসি। আমার কথা শুনে বললেন, আপনাকে ধরে নিয়ে এ পর্যন্ত খুব বেশি হলে আমার পাঠক সংখ্যা ঊনত্রিশজন মাত্র, যারা আমার বই ভালো করে পড়েছেন, বুঝেছেন। আরাও বললেন, আমার আসল নাম বৃন্দাবন মেটে। আদি-বাস ছিল নানুরে, বীরভূমে। বর্তমানে আমি এখানে কলকাতা শহরে থাকি।
এখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে, যখন প্রথম কবিতা লিখত শুরু করি, তখনকার আমার এক সাহিত্য যশঃপ্রার্থী বন্ধুকে তা দেখালাম। সে বলল, লেখাগুলি মন্দ হয়নি। তবে বৃন্দাবন মেটে নামে কেউ কবিতা ছাপবে না। যতােই ভাল হােক লেখাগুলো। আর অনুগ্রহ করে ছাপলেও, কেউ তা পড়ে দেখবে না ভুলেও এই নামের জন্য। সে-ই আামার নাম পালটে করে দিল 'বাংসায়ন মিত্র। তারপর থেকে ঐ নামেই আজ অবধি লিখে আসছি। তাতে আর কি লাভ হল? কেউ কি এখনও পডে আমার কবিতাগুলি ?
যে বন্ধু নামটা আমার বদলাতে বলেছিল, সেই বন্ধুর নামটা বলতে পারছি না সৌজন্য বশতঃ। কারণ সে এখন একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক। প্রখ্যাত এক বাণিজ্যিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সে এখন।
নামটা আমার সে পাল্টালে কি হবে? লেখা তাে তার মতাে আর পাল্টাতে পারলাম না আমি। 'জনমােহিনী' লেখা লিখতে পারলাম কই তার মতাে। রুচিতে বাধল আমার, জনরুচির কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে । আমি তাে আর সকলের মতাে নই। আমি আমার মতাে। নিজের মেধা বেচবো কি বেচেবাে না, সেটাই হল আসল কথা। আমি জনপ্রিয় কবি হতে চাই না। বিক্রীত কবি নই আমি বটে । আমার লেখা নিয়ে কোনদিন 'পপুলার সংস্করণ' বের হবে না। বহু বিকৃত কবি-লেখক বাজারে পাবেন, যাদের লেখা নিয়ে সম্পাদকরা পত্রিকা ভরান। 
এবার যান দয়া করে। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। অনেক সময় নষ্ট হল অযথা আপনার সাথে বকবক করে। বলেই তিনি উঠে দাঁড়লেন সোফা থেকে।
 আমিও আর কথা না বাড়িয়ে মানে মানে বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে।
===================
 চিত্রঋন- ইন্টারনেট।  

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. অভিনন্দন ❤️ শুভেচ্ছা ❤️

    ReplyDelete