ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পরজীবী ( শেষ পর্ব ) ।। অভিষেক ঘোষ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
২০১৫ : উপসংহার
সূর্যকান্ত ভীষণরকম উত্তেজিত হয়ে সাত-সকালে বাবার ঘরের সামনে এসে থমকে যায়, একপ্রকার বাধ্য হয়েই । কারণ অন্যান্য দিন সকাল সাতটার সময়ে কৃষ্ণকান্ত বাইরের ইজি চেয়ারটায় বসে থাকেন । আজ ইজি চেয়ারটা ফাঁকা পড়ে আছে । শুধু তাই নয়, পুরোনো আমলের কারুকার্যখচিত দরজাটা পর্যন্ত ভিতর থেকে বন্ধ । আজ আবার দশমী । তার মানে কি… ? হ্যাঁ.. একমাত্র সেটাই হতে পারে । গোপন কুঠুরিতে নেমেছে বাবা । কিন্তু এখন ! এই সকালবেলা ? চিন্তিত মুখে একবার কোমরে হাত দিয়ে এদিক-ওদিক দেখে নেয় সূর্যকান্ত । নাহ্ কেউ এখনও ওঠেনি । সীমা বাথরুমে, সে দেখেই এসেছে । মা এখন বেলা করেই ওঠে ঘুম থেকে । বাকি সকলেই ঘুমকাতুরে । চন্দ্রকান্ত তো মাল টেনে রাত সাড়ে বারোটায় ফিরেছে, এখন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে । জ্যেঠামশাইয়ের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অন্য দিকে । মাঝখানে চৌকো চত্বরটার চারপাশে সারি দিয়ে তাদের ঘরগুলো । কিন্তু এই পুরোনো নকশাটা গত দশ বছরে একটু একটু করে বদলেছে । সে আর কৃষ্ণকান্ত - দু'জনে মিলেই বাড়িটায় কিছু পরিবর্তন করেছে ধীরে ধীরে, অবশ্যই তখন বাবা অনেকটা সুস্থ ছিলো । ফলে সদরের পাশে সেকেলে দারোয়ানের ঘরটার একদিকের দেওয়াল ভেঙে তার পাশের ঘরটার সাথে জুড়ে দিয়ে, বাড়ির ভিতরের দিকে সলিড দেওয়াল রাখা হয়েছে । সেই সঙ্গে ওই ঘরটার পৃথক স্নান-পায়খানার ঘর, মাঝে একটা দরজা রেখে, তার পাশের ঘরে করে দেওয়া হয়েছে এখন । ওই ঘর থেকে বাড়ির বাইরে সরাসরি যাওয়ার মতো দরজা করে দেওয়া হয়েছে । নবকান্ত ঘোষ এই বাড়িতে সস্ত্রীক এলে, ওই ঘরেই থাকেন । তাঁর একমাত্র মেয়ের সেই কবেই বিয়ে-থা হয়ে গিয়েছে, সে বরের সাথে বোম্বেতে থাকে । ওদেরও আবার একটাই মেয়ে রয়েছে । বুড়ো-বুড়ি দু'জনেই নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ, থাকার জন্য ওই নতুন স্মার্ট ব্যাবস্থাটা তাদের পছন্দই হয়েছে । ওদিকে ঠিক উলটো দিকে ড্রেনের পাশ দিয়ে খিড়কির পথে ভিতরের পুকুরে যাওয়ার রাস্তা দিয়ে যাতে দুম্ করে বাইরের কেউ বাড়িতে ঢুকতে না পারে, তাই ওইপথে একটা কোল্যাপসিবল্ গেট্ বসানো হয়েছে । নিতাই গত পনেরো বছর হলো, রাতে কৃষ্ণকান্তর পাশের ঘরে শোয় । ফলে সূর্য এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত । মাঝেমাঝে নিতাই ছুটি নিলে, কুমোর পাড়ায় নিজের বাড়িতে থেকে গেলে, সূর্যকান্ত বাবার ঘরের সোফায় শুয়ে পড়ে । সীমা এই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে, ও নিশ্চই বিশ্বাস করে, কৃষ্ণকান্তর স্বাস্থ্যর কথা ভেবেই তার এই সিদ্ধান্ত । আর সীমা বুদ্ধিমতী মেয়ে, ও বোঝে স্বাস্থ্যই সম্পদ - মানে এভাবেই বাবা তাদের হাতের মুঠোয় থাকবে । সীমা অবশ্য আসল কথাটাই জানে না । ওই ঘরে যে এতো বছর ধরে একটা টাইম্ বোম্ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, সেটা যাতে কাকপক্ষীতেও জানতে না পারে, তার জন্য নিতাইকে কম তোয়াজ করতে হয় ! ব্যাটা খুব চতুর । অথচ এমন ভাব করে যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে পারে না ।
সূর্যকান্ত সাত-পাঁচ ভেবে নিতাইয়ের ঘরের বন্ধ দরজার কড়া নাড়ে । চোখ কচলাতে কচলাতে নিতাই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে । আজব গান্ডু ! একটা হনুমান টুপি পরে আছে । পরনে সূর্যকান্তর বাতিল একটা পাতলুন, বছর চারেক আগে দিয়ে দিয়েছিলো, সেটা এখনও পরছে !
"কী হয়েছে মেজদা ?"
"বালটা ! দরজা খুলতে এতো দেরি হয় কেন ?"
"তা কী করবো ? গত রাতে সেই দুটো-আড়াইটে অব্দি আটচালা মুনে বসে ছিলুম ।"
"তোকে কি আটচালা মুনতে পয়সা দিই বাঁড়াটা ?"
"আজ্ঞে না । কিন্তু মাঠাকরুন বললে, আমি কি না বলতে পারি ?"
"মাঠাকরুন ? মানে আমার মা ? মা তোকে রাতে আটচালায় বসতে বলেছিলো ? কেন ?"
"ওই একজনের আসার কথা ছিলো... কে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবো না কিন্তু.. মহিলা, এইটুকু জানি ! মাঠাকরুন লাঠি হাতে বিকেলে ওনার ঘর থেকে এসেছিলেন আমার সাথে কথা বলতে ! ভাবতে পারো ? কত্তদিন পর ! ঠাকুর মনে হয় মুখ তুলে চাইলেন ! জয় মা.."
"মা এসেছিলো তোর ঘরে ? বলিস কীরে উদগাণ্ডু ! সেটা এতক্ষণে বললি ? সঙ্গে কে ছিলো ? একা তো আসতে পারবে না ।"
"সকাল সকাল এতো মুখ খারাপ করে না মেজদা । বউদিদি জানতে পারলে তুমিই ঝামেলায় পড়বে । মাঠাকরুন একা আসতে যাবেন কেন ? টমবাবু ছিলেন সাথে ।"
"ওফ্ ওই বেজন্মাটা !"
"আবার মুখ খারাপ করছো ! তা এখন কী হয়েছে বলো ?"
"বলছি । তার আগে বল্, সেই মহিলা এসেছিলো রাতে? যার জন্য তোর ঘুম কাঁচি হলো..."
"নাহ্ আসে নি ।"
"আসে নি ?"
"নাহ্ । আমি শোর ।"
"শোর না রে শুয়ার । ওটা সিওর ।"
"ওই হলো । মাঝ রাতে টমবাবু এসে বললো, 'তুমি শুতে যাও নিতাই দা । আমি আছি ।'... আমার বাপু তখন খুব ঘুম পেয়েছিলো । রাত জেগে ঠান্ডায় বসে থেকে সর্দি ধরে গেছে । তাই এই টুপিটা বের কর্লুম ।"
"বেশ করেছো ।" - সূর্যকান্ত কথাটা বলে, একবার তলিয়ে ভেবে নিলো । রজত নিতাইকে শুতে পাঠিয়ে, কার আশায় রাত জেগে বসে থাকবে ? কে আসবে রাতের অন্ধকারে ! মাধবী নাকি ? কিন্তু মুখে কিছুই না বলে সূর্যকান্ত নিতাইকে ডেকে নিলো কৃষ্ণকান্তর ঘরের সামনে ।
বন্ধ দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে সূর্যকান্ত বললো, "ভিতর থেকে এখনও বন্ধ । কেন ?"
"ঘুমোচ্ছেন হয়তো । বুড়ো মানুষ ।"
"তোমার মাথা আর আমার মুন্ডু । এতো বেলা অব্দি বাবা কোনোদিন ঘুমোয় ? সেই পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটায় উঠে পড়ে বাথরুম - ঘর, ঘর আর বাথরুম - এই করে ! তারপর ইজি চেয়ারে বসে থাকে । তুই জানিস না ? ন্যাকা ?"
"তা ডাকলেই হয় ।"
"তুই ডাক্ ।"
"বা রে ! তুমি আগে এসেছো । তুমি ডাকো । ছেলে ডাকলে কি আর বাপ দরজা না খুলে থাকতে পারে ?" - বলে দাঁত বার করে বিচ্ছিরিভাবে হাসতে লাগলো নিতাই ।
অতএব সূর্যকান্ত দরজায় কড়া নাড়লো । প্রায় দু-মিনিট কোনো সাড়া-শব্দ নেই ! কী-হোল দিয়ে কেউ ভিতর থেকে দেখছে, বোঝা গেলো । তারপর কৃষ্ণকান্ত দরজাটা খুলে দিলো । অন্ধকার ঘর । নিতাই সূর্যকান্তকে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে, দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলো । বিস্মিত সূর্যকান্তর চোখটা অন্ধকারে একটু সয়ে যেতে সে দেখতে পেলো, বাবার ঘরের সোফাটায় বসে হরলিক্স আর বিস্কুট খাচ্ছে প্রেত-প্রতিম রাধাকান্ত । কৃষ্ণকান্ত মিত্তির তাঁর স্বভাব মতোই হাতে ধরে রাখা বড়ো কাপটার গা চাটছেন, তাঁর হাতটা যেন ঈষৎ কাঁপছে । রাধাকান্তর সাথে চোখাচোখি হতেই সে কেমন সংকুচিতভাবে চোখটা সরিয়ে নিলো, চোখে-মুখে চলে এলো একটা বিচলিতভাব । সূর্যকান্ত যে এসময়, এভাবে এসে পড়বে, ওরা নিশ্চই কল্পনাও করে নি । কিন্তু এতো সকালে ওদের হরলিক্স বা, চা কে করে দেবে ? নিতাই ? সূর্যকান্ত ঘুরে নিতাইয়ের দিকে তাকালেন । হনুমান টুপি পরে দাঁত বের করে তার দিকেই তাকিয়ে সে হাসছে ! "মিথ্যুক, বিশ্বাসঘাতক !" - চাপা গলায় বললো সূর্যকান্ত ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
পার্থ স্নানের বিরাট ঘাটটায় বসেছিলো । একটু আগেই চন্দ্রকান্ত আর মিত্তিরদের এক জ্ঞাতি ভাই একটা টুলে উঠে প্রতিমার হাত থেকে সমস্ত অস্ত্রগুলো খুলে নিয়ে, পাতলা টিনের তৈরি মূল্যহীন নকল অস্ত্র রেখে দিয়েছে । এবার ওই নকল অস্ত্র-সহ ঠাকুর ভাসান হবে । মূল অস্ত্রগুলো চলে যাবে সিন্দুকে । পার্থর কাছ থেকে হ্যান্ডিক্যাম চেয়ে নিয়ে বুবুন সেসবের ভিডিও তুলে দিয়েছে । বেচারা বাবার দামী ক্যামেরায় হাত দিতে পারে না । তনু তার নিজস্ব মোবাইলও ভরসা করে ভাইয়ের হাতে দেয় না । অগত্যা বুবুনের পার্থই সহায় । একটু পরেই হয়তো সিঁদুর খেলা শুরু হবে । দালানে এখন মহিলাদেরই ভিড় । রজত কখন গিয়ে পালপাড়া-কুমোরপাড়া থেকে লোকজন জড়ো করে এনেছে, প্রতিমা ভাসানের সময় ওদেরও লাগবে । বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে বাজে বোধহয়, পার্থ মোবাইলে দেখলো ৪:১২ । ঘাটটা চমৎকার বাঁধানো । গত রাতেও এই ঘাটে বসে কয়েকজন মদ্যপান করছিলো, চন্দ্রকান্তও ছিলো । এখন ঘাটে রজতের ডেকে আনা জনাদশেক লোক বসে আছে । মিত্তিরবাড়ির বাবুরা মনে হয় না, কায়িক শ্রম দিতে প্রস্তুত, হয়তো দড়ি ছুঁয়ে থাকবে । ঠাকুর তুলবে তো এই লোকগুলোই । পুকুরের জলটা বেশিরভাগটাই সবুজ হয়ে আছে, প্রায় সবদিকেই সবুজ গাছপালা । ছাতিমগাছ, শিউলিগাছ, বকুল ফুলের গাছ একদিকে, অন্যদিকে খেঁজুর গাছ, কলাগাছ, নারকেল গাছ । ছাতিমের ডাল ঝুঁকে রয়েছে জলের উপর, হাওয়ার ধাক্কায় নিঃশব্দে দুটো-চারটে পাতা ঝরে পড়ছে ডাল থেকে । জলে শুনেছে ভালোই মাছ আছে । পুকুরটা লিজ্ দেওয়া হয় প্রতি বছর, এটাও শুনেছে । ঘাটের তিন ধাপ সিঁড়ি পুরোপুরি দৃশ্যমান, বাকিটা ঘোলাটে জলের তলায়, সিঁড়ির কিছু জায়গায় শ্যাওলা হয়ে সবজেটে লাগছে । একজনই কাপড় ধুচ্ছে থুবথুব্ করে, কোনো বাড়ির কাজের বউ হবে । যতীন রায়ের বাড়ির একটা অংশের প্রতিচ্ছায়া এসে পড়েছে জলে, বাতাসে জল ভাঙলে ছবিটা কাঁপছে । একটা বাচ্চা ছেলে পুকুরের সেই ওপার থেকে খোলার টুকরো ছুঁড়ে ব্যাঙবাজি চালিয়ে যাচ্ছে । শান্ত পরিবেশ । ঠিক এসময়েই যতীনবাবুদের ঠাকুরটা বেরোয়, এদিকের মাঠে ঘুরে যাবে নিয়মমাফিক । বিসর্জনের বাজনা বাজছে । রজত ওদিকে মিত্তিরদের আটচালা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে, পার্থ তার দিকে চেয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই অতর্কিতে একটা ঘটনা ঘটে যায় । সূর্যকান্ত প্রায় ছুটে এসে, পিছন থেকে একটা জোরে ধাক্কা দেয় রজতের পিঠে । ছেলেটা ছিটকে পিচের রাস্তায় পড়ে যায় । উঠে দাঁড়াতে দেখা যায়, হাতের তেলো আর কনুইতে ছড়ে গিয়েছে । ছাতিম গাছের কাছের ঢিবিটায় রজত উঠে দাঁড়িয়ে জামা-প্যান্টের ধুলো ঝাড়তেই যাচ্ছিলো বোধহয়, সূর্যকান্ত ফের এগিয়ে গিয়ে তার কলার চেপে ধরে গাছের মোটা গুঁড়িতে ঠেসে ধরে । রজত কিন্তু বেশ নির্বিকার । যেন এসবে অভ্যাস আছে তার । ততক্ষণে পালপাড়া-কুমোরপাড়ার লোকজনেরা সব ছুটে গিয়েছে সেখানে । পার্থ দেখতে পেলো, শ্রীকান্তও দৌড়ে আসছে ।
"বল মাধবীকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস ? বল্... বেজন্মা কোথাকার.. মেরে তোর হাড় গুঁড়ো করবো । ভেবেছিলি, মাধবীকে আমার মায়ের ঘরে লুকিয়ে রাখবি আর আমি টের পাবো না ? বল্ সোগো । না বললে… তোদের দুটোকেই আমি মেরে পুঁতে দেবো ।"
সূর্যকান্তর মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে – সেকী বলছে, তার নিজেরও হয়তো হুঁশ নেই । শ্রীকান্ত এসময় অস্থিরভাবে দু'জনের মাঝখানে এসে দাঁড়ায় । সূর্যকান্ত কটমট্ করে তার দিকে তাকায় । তারপর ছেলেকে বাঁ-হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে, ফের রজতের জামার কলার চেপে ধরে । সহসা ক্রুর মুখে বলে ওঠে, "তার আগে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে । অনেকদিন তক্কে তক্কে ছিলাম বাঁড়া, আজকে তোর বাপের মুখোমুখি দাঁড়াবি চল্ !"
এবার রজতের অভিব্যক্তিতে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন দেখা যায় । সূর্যকান্তর ওই কথায় উপস্থিত সকলের মধ্যেই একটা ফিসফাস্ শুরু হয় । এ ওর মুখের দিকে তাকায় । বিস্ময় জমতে থাকে সকলের মুখে । শ্রীকান্ত পুরো হাঁ করে তার বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছে ! ওদিকে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে যতীনবাবুদের ঠাকুর পুকুরের পাশ ঘুরে পাকা রাস্তা দিয়ে এদিকেই আসছে । মাঠে এনে ঠাকুর ঘোরানো হবে, তারপর বিসর্জন হবে । এদিকে এই উত্তেজনা । জনতা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে । সূর্যকান্ত বিহবল রজতের কলার ধরে টেনে নিয়ে চলেছে আটচালার মধ্যে দিয়ে ভিতরবাড়িতে । ঢাকিরাও অবাক চোখে দেখছে । ততক্ষণে পার্থ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, সে যাবে ওদের সাথে । এরা যা শুরু করেছে, এরপর রজতকে মারধোর করতে পারে !
ওরা আটচালা পেরিয়ে, মিত্তিরবাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে, ভিতরের উঠোনে এসে পড়ে । সূর্যকান্ত রজতকে টেনে নিয়ে চলেছে কৃষ্ণকান্তের ঘরের দিকে । রজতও যেন কেমন হয়ে গেছে, কোনো প্রতিরোধ করছে না । কৃষ্ণকান্তর ওই ঘরটায় এখনও ঢোকে নি পার্থ, এবার মনে হচ্ছে ঢুকতে হবে । এমন সময় কোথা থেকে যেন সেই বোরখা-পরা মহিলা ছুটে আসে । মাধবী ! মাধবী মাথার উপর থেকে হ্যাঁচকা টানে বোরখাটার উপরের অংশ সরিয়ে ফেলে, তার হাতে-পায়ে যেন কোনো নিষ্ঠুর প্রত্যাঘাতের সংকল্প । সূর্যকান্ত এক হাতে রজতকে ধরে রেখেই, অন্য হাতের তর্জনী তুলে নিজের ঠোঁটের উপর রাখে । সে যেন মাধবীকে ইশারা করছে, একদম চুপ থাকতে । কোনো বয়স্কা মহিলাকে এরকমভাবে কোনো মধ্যবয়স্ক পুরুষ চুপ থাকতে বলছে... পার্থর এসব দেখে অসহ্য লাগে । কিন্তু এরপর সক্কলকে চমকে দিয়ে মাধবী যে প্রতিক্রিয়াটা দিলো, তাতে পার্থ পুরো স্তম্ভিত হয়ে গেলো । সূর্যকান্তর সামনে এসে মুখটা হাঁ করে একটা প্রচণ্ড, টানা চিৎকার করে ওঠলো সে । যেন বহুদিনের একটা প্রবল ঘূর্ণিঝড় থমকে ছিলো তার বুকের মধ্যে, আজ মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এলো গলা দিয়ে... "আঁ আঁ আঁ আঁ আঁ.." । কানে তালা-ধরানো মুহূর্ত । পার্থ ঘটনাটায় এতটাই হতভম্ব হয়ে পড়ে যে, কিছুক্ষণের জন্য যেন তার হৃদস্পন্দন থমকে যায় !
সূর্যকান্তও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো বলে মনে হয় না । তার হাতের মুঠো আলগা হয়ে যায় । রজত তার মুঠো থেকে ছাড়া পেয়েই, মাধবীকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে । মাধবী তার বুকের ঝড়টাকে বাইরে বের করে দিয়ে, তখন যেন এক্কেবারে খালি হয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে । রজতের বুকে মাথা গুঁজে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো । তার তখন কোনো দিকে খেয়াল নেই । সূর্যকান্ত অসহায় বোধ করছে বোঝা যাচ্ছিলো, কিন্তু মুখের অভিব্যক্তিতে সেটা যাতে না বোঝা যায়, তার জন্য প্রবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । গোটা উঠোন জুড়ে অসংখ্য লোক । দালানে একটু আগেই সিঁদুর খেলা শুরু হয়েছে । চন্দনা দেবী, অনুশ্রী দেবী, এমনকি তনুশ্রীর গালেও সিঁদুরের দাগ । পার্থ এগুলো সবই মিস্ করে গেলো ! যাহ্ কী আর করা যাবে ! ওদিকের থামটা ধরে এসে দাঁড়ালেন কে ? মাধুরী দেবী ? অনেকজন পাড়া-প্রতিবেশী ওদিকটায় ভিড় করেছেন । দুর্গাপুজোর এইসব আচার প্রতিবছর দেখা যায় । আসছে বছর আবার হবে । কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কোনো পরিবার বা, প্রতিষ্ঠানের কায়েমি আধিপত্য টাল খেতে দেখলে, সম্মান ধুলোয় লুটোতে দেখলে, সকলেরই বড়ো লোভ হয় তার স্বাদ চেটেপুটে নেওয়ার । সুন্দরপুরের গ্রামবাসীরাও তার ব্যতিক্রম নয় । তবে তাঁদের পিছনে মাধুরীদেবীর মুখটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না... উনিও কি সিঁদুর খেলেছেন ?
এদিকে সকলের বিহ্বলতার মাঝেই আরেকটি ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে । কৃষ্ণকান্ত মিত্রের ঘরের বন্ধ দরজাটা কখন খুলে গিয়েছে । তাঁর ঘরের নিচে লুকোনো কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে রাধাকান্ত, বাবার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সে । দীর্ঘ এতগুলো বছর পাতালবাসের পর সামনে এতগুলো লোক দেখে রাধাকান্ত হতভম্ব ! তার মুখ দেখে মনে হয়, সে কিছু বলতে চায় । কিন্তু বলতে পারছে না ! এতো চিৎকার-চেঁচামেচি কিন্তু তার বেরিয়ে আসার কারণ নয়, এরকম এ বাড়িতে প্রায়ই ঘটে থাকে । পার্থর জানার কথা নয় । কিন্তু রজত, শ্রীকান্ত বা, নিতাইরা জানে । রেগে গেলে সূর্যকান্ত ভয়ানক দুর্মুখ, এটা সবাই জানে । কিন্তু ওই পর্যন্তই । কারো গায়ে হাত তোলার সাহস সে বড়ো একটা দেখাতে পারে নি । কিন্তু ওই দরজায় যে এসে দাঁড়িয়েছে, উঠোন ভর্তি মানুষগুলো যাকে দেখে আলোড়িত, বিস্মিত, নির্বাক, সেই ইঁটচাপা ঘাসের মতো সাদাটে হাত-পা ওলা লোকটা একসময়ে অনায়াসে মানুষের গায়ে হাত তুলতো । নিতাই হয়তো সেসব ঘটনা মনে করতে পারবে । সূর্যকান্ত ও । এসময়েই কোথা থেকে বেরিয়ে এসে রাধাকান্তর দিকে এগিয়ে যায় চন্দ্রকান্ত, "দাদা !" - চন্দ্রকান্ত যেন ভূত দেখার মতো চমকে গেছে । অনুশ্রী দেবী স্বামীর হাত ধরেন, "কী বলছোটা কী ?"
"এ যে দাদা ! এ... এটা.. কী করে সম্ভব ?"
চন্দ্রকান্ত উত্তরটা সূর্যকান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজতে চায় । সে জানে, মেজদা অনেক কিছুই তার থেকে গোপন করে । জমিজমার হিসেব বা, টাকাপয়সা ছাড়াও আরো অনেক কিছু । এমনকি বাবার ঘরেও তাকে যেতে বারণ করেছে সূর্যকান্ত । সে বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে গেছে বলে নাকি, বাবা তার মুখ দেখবেন না বলেছেন ! কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের টানে তাকে এবার পুজোয় এসে থাকতেই হয়েছে । তারই পয়সায় মদ খায় ওরা... কিন্তু ওরাই তার প্রাণের বন্ধু.. একসাথে বড়ো হয়েছে । ওরা তার সব দুঃখগুলো জানে । কিন্তু তার নিজের বাড়িতে, বাবার ঘরে লুকিয়ে ছিলো তার বড়দা ? রাধাকান্ত মিত্র ! সে জানে, রাধাকান্ত মৃত । একটা ক্লোজড্ চ্যাপ্টার । কবে, কীভাবে এসব ঘটেছে, সে কিছুই জানে না । জানার কোনো ইচ্ছেও নেই তার । কিন্তু এটা জানে, কোনো গর্হিত ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে তার দাদার সাথে । জীবনে ওসব পিছনে ফেলেই এগিয়ে গিয়েছে সে । কিন্তু এ কী হলো ? অনুশ্রীর হাত ধরে সম্মোহিতের মতো, যেন কোনো অজানা কৌতূহলে চন্দ্রকান্ত বড়দার পিছন দিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে পড়ে । বাবাকে বাইরে দেখা যাচ্ছে না কেন ? নিতাই-বা কোথায় ? সেইসব প্রশ্নের উত্তর বাবার ঘরে ঢুকেই পেয়ে যায় সে, মানুষটা বুক চেপে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে শুয়ে আছে বিছানায়, নিতাইয়ের কোলে মাথা । নিতাই ম্লান মুখে বলে ওঠে, "ছোড়দা, ডাক্তারকে ফোন দাও গো... দেরি হয়ে যাচ্ছে.. বড়দা তো কথা শুনলো না.. বেরিয়ে গেলো.. আমি কতদিক্ দেখবো.. আমারও তো বয়স হচ্ছে ! ফোনটা করো গো..." - নিতাইয়ের চোখে জল চলে আসে । সে মনে মনে একমাত্র কৃষ্ণকান্তর প্রতি বিশ্বস্ত, আর কারো প্রতি নয় । সূর্যকান্ত ভাবতো, সে টাকা দিলেই নিতাই তার কেনা গোলাম হয়ে যাবে । থুঃ ! ওই টাকা কার ? সূর্যকান্তর নিজের কোন্ রোজগারটা আছে ? সবই তো বাবার টাকা, তাতেই এতো ফুটানি ! নিতাই তাই রাতের অন্ধকারে মাধুরী দেবীর কথা মতো তাঁর ঘরে মাধবীকে রেখে এসেছে, তার আগে নিশ্চিত হয়েছে মেজদা শুয়ে পড়েছে... । তারপর রজতকে তার চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে বলে এসেছে, তার মা রয়েছে কর্তামায়ের শোওয়ার ঘরে । কৃষ্ণকান্ত ছেলেকে আশ্রয় দিতে বৌয়ের থেকে আলাদা রয়েছে... এই এতো বছর । কিছু লুকোলে, কিছু ক্ষতিও স্বীকার করতে হয় । তার ফলে তাঁর এরকম বেহাল অবস্থা আজ । যন্ত্রণায় ছটফট্ করছেন, কিন্তু দেখার কেউ নেই ।
ওদিকে তখন সূর্যকান্ত পুরোনো ফর্মে ফিরেছে । রজত আর মাধবীর দিকে তাকিয়ে অসভ্যের মতো হাসছে আর আঙুল তুলে রাধাকান্তকে দেখিয়ে বলছে, "দ্যাখ দ্যাখ... চিনতে পারিস ? হে হে... হো হো.." রজত পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় রাধাকান্তর দিকে । সে তো বাবাকে চেনে না ! এই তাহলে তার বাবা । তার মা এসে জাপটে ধরে ওই রোগাটে ভঙ্গুর মানুষটাকে । ডাক ছেড়ে বলে ওঠে, "আমায় চিনতে পারছো না ? আ... আমি মাধবী !" রাধাকান্তর নীরক্ত মুখে যেন প্রাণের সাড়া জাগে । সূর্যকান্ত বিহ্বলভাবে লক্ষ্য করে, রাধাকান্ত এতদিনে তাকে একটিবারও চিনতে না পারলেও, মাধবীকে সে ঠিক চিনেছে ! ভিতরে ভিতরে কেমন কেঁপে যায় সে ! 'পাগল, ছাগল' ভাবতো যাকে, সে কী বুকের মধ্যে অভিমান আর রাগ পুষে রেখেছিলো এতদিন ? ওদের দু'জনের জীবনের যাবতীয় দুর্যোগের পিছনে যে সূর্যকান্তর হাত অনেকখানি, সেটা কি দাদা জেনে গিয়েছে ? কীভাবে ? কতটা ? কে বললো ? নিতাই ? শুয়োরের বাচ্চা ! ওকে বিশ্বাস করে ঠকে গিয়েছে সূর্যকান্ত ! নেমকহারাম । মায়ের কানেও অনেক কথাই তার নামে তুলে দিয়ে এসেছে নিতাই, এটা সে আজই শেষ দুপুরে মায়ের ঘরে মাধবীর বিরুদ্ধে দরবার করতে গিয়ে জেনেছে । বাড়ির কাজের লোকগুলো যে একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে এরকম শত্রুতা শুরু করবে, কে জানতো ?
কিন্তু এসময় সূর্যকান্তর দুশ্চিন্তার জাল ছিঁড়ে ভেসে আসে একটা চিৎকার । বাবার ঘর থেকে... অনুশ্রীর গলা । তারপর সকলের দৃষ্টি সেই ঘরের দিকে ঘুরে যায় । চন্দ্রকান্ত কানে ফোন চেপে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে । অনুশ্রী তার পিছন পিছন বেরিয়ে এসে সূর্যকান্তকে বলে, "মেজদা... বাবা.. হার্ট অ্যাটাক মনে হয় ।"
সূর্যকান্ত এবার একটা জোর ধাক্কা খায় । সে ছুটে যায় বাবার ঘরের ভিতরে । সঙ্গে এপাশ থেকে তনু, শ্রীকান্ত, নবকান্তবাবু, রজত, মাধবী; ওপাশ থেকে মাধুরী দেবী আসেন । তিনি চন্দনা দেবী আর জ্যেঠাইমার হাত ধরে ওই ঘরে প্রবেশ করেন । বাকিরা বাইরে, যেন অপেক্ষা শুরু হয় একটা । এমন সময় নবকান্তবাবু বেরিয়ে এসে ঘোষণা করেন, "এখন একটু স্টেবল । ডাক্তারবাবু আসছেন । তোমরা চিন্তা কোরো না । ঠিক হয়ে যাবে । ওদিকে ঠাকুর ভাসান দিতে হবে । দেরি হয়ে যাচ্ছে । বলি... সব দায় কি একা আমার ? এসো সব... সন্ধ্যে নামলো বলে, প্রতিমা তুলতে হবে.. ।"
তাঁর এই কথায় উপস্থিত জনতার মধ্যে একটা সাড়া জাগে । অনেকেই "চলো... চলো.." রব তুলে একে একে দালানের দিকে রওনা দেয় । এখানে পরিস্থিতি সামলেছে বুঝে পার্থও সকলের পিছু নেয় । সন্ধ্যা নামলো বলে । তারা সদর দিয়ে বেরোলো, আর ডাক্তার এসে ঢুকলেন, বয়স্ক লোক, লোকাল ডাক্তার হবে । যাক্ আর চিন্তা নেই । পার্থ বেরিয়ে যেতে যেতেও এক ঝলক ভিতরে তাকিয়ে দেখলো, রজত ঝুঁকে দাড়িয়ে আছে । তার সামনে কৃষ্ণকান্তের ঘরের সামনের সিঁড়ির ধাপে বসে শান্ত রাধাকান্ত আর অস্থির মাধবী । তনু একটা ওষুধের শিশি থেকে কিছু নিয়ে, তুলো দিয়ে রজতের হাতের ক্ষতস্থান মুছে দিচ্ছে ।
*** *** *** *** *** *** *** *** *** *** *** ***
সন্ধ্যার বুকে বিসর্জনের ঢাক বাজছে । পার্থ একবার ক্যামেরায় নাইট ভিশন অন করে আর একবার নর্ম্যালি চেষ্টা করে ছবি তুলতে গিয়ে বুঝলো, এভাবে ভাসানের ভালো ছবি তোলা দুষ্কর । আলো এত পড়ে এসেছে ! পুকুরের গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা লাইট পোস্টের আলো অতো উজ্জ্বল নয় । তখন সে মোবাইলে ফ্ল্যাশ অন করে, তিন পাক্ ঠাকুর ঘোরানোর সময় চটপট কয়েকটা ছবি তুললো, এবার দেখা যাক্ কী ওঠে । উপস্থিত কয়েকজনের সাথে প্রতিমার পা ছুঁয়ে প্রণাম সেরে নিলো সে । একটা ঠান্ডা হাওয়া বইছে । রজত আর তনুর সাথে শ্রীকান্তও এসে প্রণাম সারলো । রজত একবার তার দিকে চেয়ে ম্লান হাসলো । প্রতিমার দড়ি আলগা হলো, জলের উপর সিঁড়ির শেষ ধাপে ঝুঁকে পড়লো কাঠামোটা । তারপর জল স্পর্শ করলো । মা দুর্গার হাতের খাঁড়াটা দেখা গেলো রজত খুলে নিয়ে তনুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে । শ্রীকান্ত হাঁটু অব্দি জলে নেমে একটা টিনের গদা তুলে এনে ধরিয়ে দিলো বুবুনের হাতে, বুবুন সেটা নিয়ে তার দিদির আঙুল চেপে ধরলো । শীত শীত লাগছে পার্থর, একটা পাতলা সবুজ পাঞ্জাবি পড়ে আছে সে, গতবার ভাইফোঁটায় পেয়েছিলো । মা-কে একটা ফোন করতে হবে, ফিরতে রাত হবে সেটা জানাতে ।
পার্থর স্টেশনে রওনা দেবার মুহূর্তে তনুর সাথে চন্দ্রকান্ত ঘাটে এলো । সঙ্গে বাইক, সে পার্থকে প্রস্তাব দিলো, "চলো ভাই, তোমাকে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসি ।"
"আরে ! কোনো দরকার ছিলো না কিন্তু । আমি একটা অটো-ফটো ঠিক পেয়ে যেতাম ।"
রজত এই সময় তার কাঁধে হাত দিয়ে একটু পাশে ডেকে নেয়, বলে, "মা-কে একটু আপনার সাথে পাঠাবো ? মায়ের আগামীকাল হসপিটালে মর্নিং ডিউটি আছে । বজবজ লাইনের নুঙ্গি-তে একটা বাড়িতে মা ভাড়া থাকে, হসপিটালের কাজ তো, দেরি করা যায় না । ছুটি নিয়ে এসেছিলো । একাই যাতায়াত করে । কিন্তু আজ এতো কান্ডর পরে একা ছাড়তে ভয় করছে ।"
তনু পাশে এসে ওদের কথা শুনছিলো, সে তার বাবাকে গিয়ে কী বললো । তারপর ফিরে এসে বললো, "আমি আর বাবা অটো ডেকে আনছি । তোমরা দাঁড়াও ।"
"তোমার বাবা কেমন আছেন রজত ?" - পার্থ রজতকে জিজ্ঞেস করে ।
ম্লান হেসে রজত বলে, "ওই আর কি ! কী বলি বলো তো ! মানুষটা যে বেঁচে আছে, ওই পাতালঘরে এতগুলো বছর, এতো শাস্তি পাচ্ছে, তাই তো জানতাম না ! আমি তাহলে ঠিকই তো দেখেছিলাম । সেই রাতে… কলতলায়.. ওটা বাবাই ছিলো । মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক !..."
"রজত জানিনা আমার বলা উচিত হচ্ছে কিনা, তবুও তোমাকে একটা প্রশ্ন না করে পারছি না । তোমার সাথে এত অবিচার, সবাই এত অত্যাচার করে, তুমি কোনো প্রতিবাদ করো না কেন ?"
"মনে করুন আপনার সামনে দুটো পথ আছে - একটা সঠিক আর একটা সহজ । আপনি কোন্ পথটা নেবেন পার্থদা ? সদানন্দ মিত্তির মনে করতেন, আমার মায়ের উপর রাধাকান্ত মানে আমার বাবা কোনো অত্যাচার করেছিলো । তাই মায়ের প্রতি ওঁর একটা করুণা ছিলো । মা সেটাকে বরাবর ব্যবহার করেছে । সত্যটা কাউকে জানায় নি । কেন ? নিজের স্বার্থে, সার্ভাইভ করতে । বাবা যে বেঁচে, সে আশা মার মনে বহুদিন টিকে ছিলো । কিন্তু মায়ের ধারণা ছিলো, বাবা পাগল হয়ে গিয়েছিলো । গত পাঁচ-সাত বছর মা সব আশা ছেড়েই দিয়েছিলো । বাবা পাশে থাকলে হয়তো সত্যিটা সামনে আনতে দুজনে মিলেই লড়াই করতো । সত্যটা সঠিক, কিন্তু কারো জন্যই সহজ নয় । সদাকাকা যদি জানতেন, একপ্রকার ভাই-বোন হয়েও একটা অবৈধ সম্পর্ক ছিলো আমার বাবা-মায়ের এবং তারই ফলাফল এই আমি, তাহলে সেই সত্যিটা আমার বা, আমার মা, কারো জন্যই ভালো হতো না । বাবা তখন কোথায় ? জেলে না হসপিটালে নাকি ওই পাতালঘরে ! কে জানতো ! সত্যিটা সামনে এলে, আমিও কিন্তু এই মিত্তির বাড়িতে জায়গা পেতাম না । বুঝলেন ? ভুলে যাবেন না, আমরা পরজীবীর জাত । আমাদের কোনোদিনই কোনো অওকাৎ নেই । মানে বিষয়টা হলো, বাড়ির সকলের মধ্যে একটা অপরাধবোধ আছে, আর আমরা মানে আমি আর মা সেটাকে বছরের পর বছর কাছে লাগাচ্ছি । কেন জানেন ? সার্ভাইভ করতে, জীবনটা এভাবেই সহজে চলছে, এটাতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি । মা শুনেছি খুব ডাকাবুকো ছিলো । কিন্তু বাবা আর মাকে টেনে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণবাবুর লোকেরা যা অত্যাচার করেছিলো ! সেরে উঠলেও প্রতিবাদের অভ্যাসটা মা বোধহয় ওই ঘটনার পর হারিয়ে ফেলেছিলো । আর আমি জন্ম থেকে ওটাতেই অভ্যস্ত, অসুবিধা হয় না । মুখ নিচু করে চলি, ব্যাস । বলুক না, কত বলবে । জানবেন, বোবার শত্রু নেই । কিন্তু ওরা আমাদের নিয়ে, আমাদের ইতিহাস নিয়ে নিশ্চিত নয় । নিশ্চিত হলে, এ-বাড়ির সম্পত্তিতে আমার ন্যায্য দাবী জন্মায় । সেটা হলে কিন্তু অনেক গোলমাল হবে, তখন আমরা কেউই নিরাপদ নয় ।"
একটানা কথাগুলো বলে থামলো পার্থ । তাকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো । জ্যেঠামশাই আর তাঁর স্ত্রী একটা টিফিন ক্যারিয়ারে করে কীসব খাবার এনে মাধবীর সাথে ঘাটে এসে দাঁড়ালেন । মাধবীর পিঠে মাঝারিমাপের স্কুল-ব্যাগ, তার মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও শরীরের নড়াচড়ায় তার ছাপ সেভাবে পড়ে নি । এই সময় অটো এসে হাজির হলো । পার্থ ঝুঁকে নবকান্তবাবু আর তাঁর স্ত্রীকে প্রণাম করলো । শ্রীকান্ত এসে হ্যান্ডশেক করে বললো, "ফোনে কথা হবে ।"
"কৃষ্ণকান্তবাবু ভালো আছেন এখন ?"
"দাদাইকে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে, সুগার ফল্ করেছিলো । হার্টেরও প্রবলেম আছে । কাল সকাল সকাল হসপিটালে নিয়ে গিয়ে টেস্টফেস্ট করিয়ে আনবো ।"
নবকান্ত বাবু এগিয়ে এসে বললেন, “চিন্তার কোনো কারণ নেই... বুঝলে পার্থ.. বিপদ কেটে গেছে । উল্টে একজনকে ফিরে পেলাম আমরা, যাকে কিনা হারিয়েছি বলেই ধরে নিয়েছিলাম ! নিয়তি বুঝলে... আর চিন্তা নেই । এবার আমি দেখছি । আর গোপাল তো আছেনই । তুমি রাসযাত্রার সময় এসো... বুঝলে.. বেশ মেলাটেলা বসে, যতীনদের শ্যামসুন্দরকে সাজিয়ে ওদের দালানে বসানো হয় । প্রায় ষাট বছর হতে চললো, আমাদের বাইরের রেষারেষি শেষ হয়েছে, কিন্তু ভিতরেরটা সহজে শেষ হওয়ার নয় ।” – বিষণ্ন মুখে কথাটা বলে তিনি আবার আগের কথার খেই ধরে বললেন, “এখন ওদের কেষ্টযাত্রায় আমরা না গেলে, হয় না । এসো বুঝলে... রাসে এসো । এখন সাবধানে যাও.. অনেকটা পথ ।”
সন্ধ্যার অন্ধকারে পার্থ আর মাধবী অটোতে চেপে বসে । একটা দুর্বোধ্য আর জটিল ইতিহাস মাটি খুঁড়ে উপরে উঠে এসেছিলো, এবার সেসব পিছনে ফেলে রেখে বিদায় নেওয়ার পালা । পার্থ হাত নেড়ে সবাইকে বিদায় জানায় । রজত পার্থকে হাত নেড়ে, মাধবীর চোখে চোখ রাখে । কিছু বলে না । মাধবীই বলে ওঠে, "আমি গিয়ে ফোন্ দেবো... তুই সাবধানে থাকিস্ । আমি তিন দিনের মধ্যে ফিরে আসবো... তুই তোর বাবাকে দেখিস্.. রজত ।" গলাটা যেন শেষদিকে একটু কেঁপে গেলো, হাহাকারের ছোঁয়া লাগলো তাতে ।
সুন্দরপুর পিছনে ফেলে, ওদের অটো বেরিয়ে গেলো স্টেশনের
পথে । আধ ঘন্টা পরে দেখা গেলো, পার্থ আর মাধবী মুখোমুখি জানালায় বসে, দুজনেই আনমনা,
জানালার বাইরে অন্ধকারে চলমান শূন্যতার দিকে চেয়ে উভয়েই কী যেন ভেবে চলেছে । মাধবী
কী ভাবছিলো, তার মাথার মধ্যে ঠিক কী চলছিলো, তা বোঝা পার্থর পক্ষে প্রায় অসম্ভব । পার্থরা
জানে না, মানুষ কখন পরজীবীতে বদলে যায় । কখন ও কীভাবে তারা আত্মপ্রকাশ করে । কীভাবে
তারা শরীর ও মন, স্মৃতি ও বিস্মরণের জটিল জীবনব্যাপী প্রক্রিয়ার মধ্যে আত্মগোপন ক’রে,
নিজেদের প্রয়োজন মতো প্রাণরস আহরণ করে নেয় । পার্থদের মতো স্বভাব-ভীরু, সুযোগ-সন্ধানী,
সদা-পলায়নপর অথচ সংস্কৃতিবানদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এমন রোগের লক্ষণ ও কারণ । যাদের
আপাত-দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হয়, তারাও কেমনভাবে শোষণ-পটু সামন্ত-জীবনে ঢুকে
পড়ে নিঃসাড়ে বিপর্যয় ডেকে আনে, তা পার্থদের জানার কথা নয় । এই যে নারী, এখনও বোরখা-পরে
ঠিক উলটোদিকে জানালার ধারে তার মুখোমুখি বসে আছে, তার অতীত-ইতিহাস ও বেহাল-বর্তমান
– দুইই জানালার বাইরের ওই দ্রুত অপসৃয়মান তাৎপর্যহীন অন্ধকারের মতো । ওই নিরালোক চলনের
অন্তরালে কী কী হারিয়ে গেলো আর কীভাবে, এর অনুসন্ধান বা, সমাধান করা পার্থর পক্ষে অসম্ভব
। ওই অন্ধকার মাধবীর বোরখার মতোই তাৎপর্যহীন বটে, কিন্তু চরম তাৎপর্যপূর্ণ সত্য লুকিয়ে
আছে ওরই আড়ালে । সেই অসুখ, সেই রোগ-জর্জর, বিকট ভয়াবহতায় প্রবেশ ও সত্যানুসন্ধানের
কথা কল্পনাও করতে পারে না পার্থরা । তাই মাধবীর মুখোমুখি বসে থেকেও, মনের মধ্যে ঘুরপাক
খেতে থাকা হাজারো প্রশ্নকে মনেই দমিয়ে রেখে ছদ্ম-উদাসীনতায় নিমগ্ন হয়ে থাকে সে ।
…………………. সমাপ্ত ……………………
💖💕❤️💙💝
উত্তরমুছুনSesh korlam. Sundor Aviggotaa.
উত্তরমুছুন